দ্বিতীয়_বসন্ত,পর্ব-৭
লেখনীতে: নুরুন্নাহার_তিথি
সকাল হলে সবাই ব্রেকফাস্ট করতে গার্ডেনে জড়ো হয়। রিথী রিহাকে নিয়ে যায়। সবাই ব্রেকফাস্ট করছে। সানভি নাইফ দিয়ে রিথীর দিকে তিক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আপেল কেটে খাচ্ছে। আপেল কাটার কোনো ছিঁড়ি নেই। সানভির আপেল কাটা দেখে মনে হচ্ছে যেনো সে কাউকে কেটে টুকরো টুকরো করছে। মালিহা সানভির চাহনি লক্ষ্য করে হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
রুদ্ধ এখনো রিথীর সামনে যায়নি। রিথীর থেকে আড়ালে ব্রেকফাস্ট করছে আর রিথীকে দেখছে। হাসি নেই রিথীর মুখে। হাসি ছাড়া রিথীকে বেমানান লাগে রুদ্ধর। রুদ্ধর বসন্তরাণী সবসময় হাসবে, ফুলের মতো নিজের হৃদয়ের সুবাস ছড়িয়ে রুদ্ধর পৃথিবী বসন্তের সাঁজে সজ্জিত করবে।
দুই বছর আগেই রুদ্ধর রিথীকে ভালোলাগে। রুদ্ধ আর্মি বয়েস স্কুল কলেজে পড়াশোনা করেছে তাই মেয়েদের সাথে তার কথা বলা, উঠা বসা ছিলো না বিধায় রিথীর আগে আর কাউকে ভালো লাগেনি। যখন রিথীর বিয়ের কথা শুনলো তখন তার খারাপ লেগেছিল। আর বয়সে তিনমাসের বড় তাই হয়তো তার ভাগ্যে নেই এটাই নিয়তি ভেবে নিয়েছিল রুদ্ধ। কিন্তু সে কি জানতো নিয়তি আসলে কি চায়!
ঠিকই রুদ্ধ রিথীকে পেলো তবে এক নিস্তব্ধ রঙহীন বেশে। রুদ্ধ এলো রিথীর জীবনকে দ্বিতীয় বার বসন্তের রঙে রাঙাতে।
ঘরির কাঁটায় পূর্ণমিলনীর বিদায় সম্ভাষণ নিকটস্থ। রুদ্ধ এখন পর্যন্ত রিথীর সামনে আসেনি। সবাই বিদায় নিচ্ছে তখন মিস্টার রাশেদ তার বন্ধু মিস্টার বাশারের কাছে আসে আর হাত মিলিয়ে বলে,
–বন্ধু, তোমার মেয়েকে আমি শিগ্রই পুত্রবধূর দর্জা দিয়ে নিয়ে যাবো। এই বিয়েটা একসেডেন্টলি হয়েছে তাই আমি আত্নীয় স্বজনকে জানিয়ে তাদের নিয়ে পুত্রবধূ বরণে আসবো।
মিস্টার রাশেদ এবার রিথীর মাথায় হাত রাখে তারপর রিহারো। চলে যায় মিস্টার রাশেদ। রুদ্ধ দূর থেকে দেখেছে সব। রিথী সৌজন্য হাসি দিয়েছিল সেটাও দেখেছে কিন্তু রুদ্ধ চাইছিল হাসিটা মন থেকে হাসুক। কিন্তু তা কি এতো জলদি সম্ভব!
_______অসীম অম্বরতলে নিমজ্জিত অরুণ তার আলোয় রক্তিম বর্ণে রাঙিত। উবার প্রাইভেটকারের গ্লাস সামান্য নামিয়ে এই দৃশ্য অবলোকন করছে রিথী।
মিস্টার বাশার উবার ঠিক করেছেন বাড়ি ফিরার জন্য। রিথীর পাশে রিহা বসে বসে ফোনে গেমস খেলছে। “টেমপল রান” গেমস খেলছে। মিস্টার বাশার ফ্রন্টে বসেছে। কিছুক্ষণ পর রক্তিম অরুণ অস্তিমিত হয়ে কৃষ্ণ রঙে রাঙায় অম্বরতল।
বাসায় ফিরে রিথী কারো সাথে কোনো কথা না বলে নিজের রুমে চলে যায়। রিথীর মা, চাচি ও বোন ডাকলেও পেছোন মুড়ে চায় না। তারা সকলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রিথী নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে কান্না করছে। তার নিজের জীবন নিজেই বুঝতে পারছে না। কি হচ্ছে? কেনো হচ্ছে? এসব ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিছু সময় এভাবেই নিজের দুঃখের সমুদ্র বাইয়ে ফোনের স্ক্রিন খুলে। লক স্ক্রিনে নিদ্রর হাস্যউজ্জ্বল ছবি। রিথী চোখ মুছে লক স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে। কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর রিথীর ফোনের লক স্ক্রিনে একটা মেসেজ নোটিফিকেশন আসে। রিথি ফোন আনলক করে মেসেজ ওপেন করে। সেখানে লেখা,
“বসন্তরাণীর চোখে কি আজ শ্রাবণধারা নেমেছে?
তবে তাকে বলে দিও,,
তার এই শ্রাবণের বন্যায় আমি ভেসে যেতে চাই!”
_____তিথি🍂
রিথী হতভম্ব চোখে ফোনের মেসেজে শায়েরীটির দিকে তাকিয়ে আছে। কে পাঠাতে পারে সেটাই ভাবছে। কিন্তু কোন ক্রমেই ভেবে পেলো না। দরজার করাঘাতে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে রিথী। ফ্লোর থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসে। তারপর জামা পাল্টিয়ে রুমের বাহিরে যায়। রিথীর মা মিসেস রোজী এতোক্ষন দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েকে বের হতে দেখে সে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
–মা রে, তোর কপালে বিয়েটা এভাবেই লিখা ছিল। তাই হয়েছে। নাহলে বল, বেড়াতে গিয়ে এমন দুর্ঘটনা কেনই বা ঘটবে! মেনে নে মা। জীবন তো আর থেমে থাকবে না। বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে মেনে নে। জানি নিদ্রকে ভুলা কষ্টকর কিন্তু..
রিথীর মা আর কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না। রিথী আবার হাইপার হয়ে বলে,
–নো নো নো! নিদ্রকে আমি ভুলতে চাই না। তাই ওকে ভুলার কথা বলবে না আম্মু। সে কোনো পরপুরুষ না আমার জন্য। সে স্বামী আমার।
রিথীকে হাইপার হতে দেখে মিসেস রোজী কিছু বলবে তার আগেই রিথীর কাকি মিসেস তানজিনা বলে,
–তোমাকে ভুলতে হবে না নিদ্রকে। তুমি শুধু রুদ্ধকে মেনে নেও। কারন যা হয়েছে তা আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে। নিদ্রকে স্মৃতির ডায়েরিতে রেখে রুদ্ধকে নিয়ে এগিয়ে যাও। জানি অনেক কষ্ট হবে তবে পারবে কারন নিদ্র তো আর চাইলেও ফিরে আসবে না। তাই না!
রিথী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। মিসেস রোজী রিথীকে নিয়ে যায় ডাইনিং রুমে। রিথীর পছন্দের নুডুলস রান্না করেছে। রিথীকে সে বাটিতে নুডুলস দেয়। রিথী না করে না। খেয়ে নেয়। এরপর এশারের আজান হবার কিছুক্ষণ পর মাগরিবের নামাজ কাজা ও সাথে এশার নামাজ পড়ে বিছানায় বসলে কয়েক মিনিট পর মিসেস রোজী হাতে দুধের গ্লাস নিয়ে আসে।
রিথী মাকে দুধের গ্লাস আনতে দেখে মুখ কালো করে ফেলে। অবশ্য মুখ কালো করেও লাভ নেই কারন প্রতিদিন খেতে হয়। মিসেস রোজী মেয়েকে এক গ্লাস দুধ খাইয়ে দুইটা মেডিসিন দেয়। একটা রাগ কমানোর ও আরেকটা লো ডোজের স্লিপিং পিল।
রিথী ঘুমিয়ে পড়ে জলদি। রাত সবে ৯টা। কালকে ভার্সিটির ক্লাস আছে সকাল ১০টায়
সকালে,,
ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে এক মগ কফি বানিয়ে বই ও ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে যায়। স্নিগ্ধ সকাল, সূর্যের সদ্য পরিস্ফুটিত আলো। হালকা কুয়াশা আছে কারন বসন্ত কালেও শীত থাকে হালকা।
যখন সকাল ৬টা বাজে তখন ফোনে আরেকটা মেসেজ আসে। সেখানে লিখা,
“সূর্যের প্রথম পরিস্ফুটিত আলোর মতো,
উজ্জল হোক তোমার দিন বসন্তরাণী!”
_____তিথি🍂
রিথী বুঝতে পারছে না, কে তাকে মেসেজ দুটো পাঠাচ্ছে! রিথী এবার মেসেজ যেই নাম্বার থেকে এসেছে সেটাতে কল করে কিন্তু নাম্বার বন্ধ বলছে। রিথী বিরক্তি নিয়ে ফোন অফ করে রাখে। তারপর ক্লাসের পড়াতে মন দেয়।
সকাল ৮টায় বাড়ি থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রওনা হয়। দেড় ঘন্টা লাগবে যেতে। এদিকে, রুদ্ধর আজকে প্রথম ক্লাস সকাল ১১.২০ এ। তাই সেও জাবিতে যাবে তার বসন্তরাণীকে দেখতে একপলক।
হ্যাঁ, ছন্দ গুলো রুদ্ধই পাঠাচ্ছে রিথীকে। রুদ্ধ সকাল ৯.৪৫ এর পর জাবি ক্যাম্পাসে বিজ্ঞান অনুষদে পৌঁছায়। রুদ্ধর অস্থির চোখ জোড়া রিথীকে খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। ১০টা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। এখনি রিথীকে খুঁজে না পেলে আজকে আর দেখা হবে না।
ঠিক তখনি রুদ্ধর পেছোন থেকে এক ছেলে “রিথী” বলে চিল্লিয়ে উঠে। রুদ্ধ পেছোনে তাকায় তারপর ছেলের ডাকার দিক অনুসরন করে ডান দিকে তাকিয়ে দেখে এক টিয়া রঙের থ্রিপিস পড়িহিত স্নিগ্ধ রমণীর।
রিথী তখন ক্লাসের দিকে যাচ্ছিলো। বন্ধু সৌরভের ডাকে তাকায় তারপর দাঁড়ায়। রিথী রুদ্ধকে দেখেনি। আর দেখলেও চিনবে না কারন রুদ্ধ মাস্ক পড়ে আছে আর একদিনে তো আর চিনে ফেলবে না পুরোপুরি! রুদ্ধ তার বসন্তরাণীকে অপলক দেখে। আজ মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে। রিথীর বন্ধু-বান্ধুবীদের সাথে থাকলেই হয়তো হাসি-খুশি থাকে!
রিথীকে ডাক দেয়া ছেলেটা রিথীর কাছে দৌড়ে গেলে রিথী ছেলেটার কাঁধে জোরে একটা থাপ্পড় মেরে বলে,
–ঝালমুড়ি আনতে বলেছিল জান্নাত তোকে। আর পনেরো মিনিটের বেশি লেট তুই সৌরভ!
রিথী হাতের ঘরির দিকে তাকিয়ে বলে শেষের কথাটা। রুদ্ধ ছেলেটার সাথে সাথে সেও এগিয়ে গিয়েছিল। ছেলেটা কাঁধ ডলতে ডলতে বলে,
–তো কই আমাদের জানু? ওর ঝালমুড়ি আনতে আমাকে গেটের বাইরে যাইতে হইছে।
রিথীর পাশ থেকে রিয়া বলে,
–এই বান্দর পোলা, তুই এতো লেট তাই তো জানু(জান্নাত) আদি ভাইয়ের সাথে কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। তুই সবসময় লেট লতিফ।
সৌরভ চোখ ছোট ছোট করে বলে,
–চুপ থাক শাঁকচুন্নি! তুই আনতে পারলি না গিয়া? আমারে তোমরা মাগনা কামলা পাইছো তাই তো কিছু আনতে এই সৌরভরে মনে পড়ে। এখন ধর এই ঝালমুড়ি। খা বেশি করে খা!
রিয়া মুখ ভেঙচি কেটে ঝালমুড়ির প্যাকেট দুইটা নেয় আর আরেকটা নেয়না। রিথী ওদের ঝগড়া দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে। রুদ্ধর যেনো এই হাসিতে হৃদয় শান্ত হয়ে যায়। রুদ্ধ খুশি মনে চলে যায়।
______সারাদিনের ক্লাস শেষে রুদ্ধ ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ফিরে। আজকে ওর টানা চারটা ক্লাস ছিলো। ক্লান্ত শরীরে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় গা হেলিয়ে দিলে রুদ্ধর মা মিসেস ইফা ছেলের জন্য এক গ্লাস ম্যাংগু জুস নিয়ে আসে। তারপর ছেলের মাথায় হাত রাখলে রুদ্ধ চোখ খুলে মায়ের দিকে তাকায়। মিসেস ইফা বলে,..
চলবে ইনশাআল্লাহ,