দ্বিতীয়_বসন্ত,পর্ব-৬
লেখনীতে: নুরুন্নাহার_তিথি
রিথী নিজের হাতের শিরার উপর ভাঙা কাচ দিয়ে টান দেয়। রক্ত ফিনকি দিয়ে চুইয়ে পরতে থাকে। এমনিতে রিথী রক্ত বা কাঁটা-ছেঁড়া দেখলে ভয় পায় তাই বেশি গভীর করে হাত কাটতে পারলো না। রিথীর এই কাজের কারন,
রিথীকে কিছুক্ষণ আগে রুদ্ধর রুমে রেখে গেলে রিথী একা থাকতে চায়। কিন্তু চাইলেই কি আর একাকি নিরিবিলি থাকতে পারে! না, পারেনা। তেমনি মিনিট পাঁচেকের মাথায় সানভি ও সারিকা রিথীর কাছে আসে। সানভি হিংস্রতার সাথে রিথীর গলা টিপে ধরে আর বলতে থাকে,
–হাউ ডেয়ার ইউ! হাউ ডেয়ার ইউ টু ম্যারি রুদ্ধ? ইউ চিপ গার্ল! নিজের রূপ দিয়ে ফাঁসিয়ে নিলে রুদ্ধকে। তুমি কি ভুলে গেছ যে তুমি বিধবা! বিধবা হয়েও নিজের থেকে ছোট একটা ছেলেকে বিয়ে করলে। ইউ ব্লাডি হেল।
সারিকা রিথীকে কাশতে দেখে সানভিকে জোর করে ছাড়িয়ে আনে। সানভি সারিকার হাত ছুটিয়ে বারবার যেতে চাইছে রিথীর উপর আক্রমণ করতে। আর রিথী গলায় হাত রেখে কাশতে থাকে। আর একটু হলে হয়তো দম বন্ধ হয়ে যেতো ওর। সারিকা রিথীকে বলে,
–কি ভালোবাসা তোমার! প্রথম হাসবেন্ডের কথা কি মনে পড়লো না? হ্যান্ডসাম কিউট ছেলে দেখলেই গলায় ঝুলে পরতে মন চায় নাকি! সে নাকি আবার নিজের প্রথম স্বামীকে ভালোবাসে! সুন্দর ছেলে দেখলে মন সামলাতে পারেনা। হাউ ফানি!
এই কথা গুলোই যথেষ্ট ছিলো রিথীকে স্তব্ধ করে দিতে। রিথী কাশি থামিয়ে বাকশূন্য চোখে ওদের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। সারিকা সানভিকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। আর রিথী ওই ভাবেই তাকিয়ে আছে। তার মাথায় সানভি ও সারিকার বলা কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। কয়েক মিনিট পার হবার পর রিথী হুট করে হিংস্র হয়ে উঠে। রিসোর্টের এই রুমে যা যা আছে সব ভাঙা শুরু করে। দরজা লাগিয়ে সবকিছু তছনছ করতে থাকে আর মুখ দিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে,
“আমি কাউকে ফাঁসাই নি। আমি নিদ্রকে ভালোবাসি।”
দরজার বাহিরে সকলে ভীর জমাতে থাকে। কারন একটু আগে রিহা তার বোনের কাছে এসে দেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ আর ভিতর থেকে ভাঙচুরের শব্দ আসছে। রিহা তখন ঘাবরে যায়। রিহা জানে তার বোন কতটা ডেস্পারেট! মাঝে মাঝে রাগ কন্ট্রোল করতে রিথীকে মেডিসিন নিতে হতো। রিথীর “বাইপোলার ডিজঅর্ডার” আছে। তবে সেটা সে খনে খনে কন্ট্রোল করতে পারে আবার হুট করে সামান্য বিষয় নিয়েও রেগে যায়।
রিথীর নিদ্রর সাথে দেখা হবার আগে এই রোগ ছিল। এরপর প্রপার মেডিকেশন ও নিদ্রর সাথে চলাফেরা করতে করতে ওর এই লক্ষন আর দেখা যায়নি। রিথী এর আগে অতিরিক্ত রেগে যেতো। কেউ ওর সাথে সামান্য মিসবিহেভ করলেও প্রচন্ড রেগে যেতো আর হাতের কাছে যা পেতো তাই ভাঙতে থাকতো। রিহার এখনো মনে আছে,
রিহা যখন ছয় বছরের তখন রিহা ক্লাস ওয়ানে পড়তো তখন রিহা রিথীর একটা বইয়ে ভুলে পানি ফেলে দিয়েছিল আর রিথী সেটা দেখে রেগে রিহাকে দুই গালে স্বজোরে দুইটা থাপ্পর মারে আর নিজে গিয়ে রিহার সব বইয়ে পানি ঢেলে ভিজিয়ে আসে আর একটা কাচের কাপ টেবিল থেকে ফেলে দেয়।
তখনি রিথীর বাবা-মায়ের মনে হয় রিথীকে সাইকোলজিস্ট দেখানো দরকার। সাইকোলজিস্ট তখন একটা মেডিসিন দেয়। কারন বাইপোলার ডিজঅর্ডাররে রোগী অনেকসময় আত্নহত্যাতে যেতে পারে কারন মানসিক ভাবে সো,সন্তুষ্ট না।
রিহা তার বাবার কাছে দৌড়ে গিয়ে এটা বললে মিস্টার বাশার চটজলদি সেখানে যায়। বাকিরাও সাথে আসে। দরজা ধাক্কানোতে খুলছে না। ভিতর থেকে কিছুক্ষণ পর শব্দ আসা বন্ধ হয়ে যায়। রুদ্ধ দরজা খোলার জন্য রিসোর্ট ম্যানেজারকে ডাকে তবে রিথী তো ছিটকিনি দিয়ে লক করেছে তাই লাভ হয়না। রুদ্ধ সহ আরো দুই জন দরজা ভাঙার চেস্টা করছে। শেষমেশ সক্ষম হলেও ভিতরে গিয়ে দেখে রিথী বিছানায় শুয়ে আছে আর বাম হাত থেকে টুপটুপ করে রক্ত ফ্লোরে পরছে। ফ্লোরে খানিকটা জায়গায় রক্তের লঘু এখন গড়ানোর অপেক্ষা। রুদ্ধ জলদি করে রিথীর হাতটাকে উঁচু করে ধরো। যাতে রক্ত কম ঝরে।
★হাত কোথাও কেটে গেলে সেটা হৃদপিন্ড লেভেল থেকে উঁচু করে রাখলে রক্ত ঝরে কম। ★
এরপর কি করবে ভেবে পাচ্ছে না তখন মিস্টার বাশারের এক বন্ধু ডাক্তার, সে এসে ঠিক করে মেডিসিন দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয় আর বলে,
–বাশার, রিথী কি এর আগে কখনো সুইসাইড এটেম্পট করেছিলো?
–হ্যাঁ, নিদ্র মারা যাবার তিন দিন পর একসাথে সাতটা স্লিপিং পিল খেয়েছিল। তখন আমরা ওর উপর নজর রাখতাম। তাই সময়ের মধ্যে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আবার কাউন্সিল করানো শুরু করি ওর।
মিস্টার বাশারের কথায় তার বন্ধু বলে,
–আবার চিকিৎসা মানে?
মিস্টার বাশার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
–ওর বাইপোলার ডিজঅর্ডার আছে সামান্য। নিদ্রর সাথে দেখা হবার আগে এটা আমরা জানতে পারি তারপর মেডিসিন নিতো। রাগ অতিরিক্ত ওর। তাই সাইকোলজিস্ট দেখাই।
মিস্টার বাশারের বন্ধু বলে,
–রাগ সবার আছে তবে অতিরিক্ত হলে সেটা মানসিক অবসাদের কারন হয়। যাইহোক, ওর মেডিসিন গুলো কি এনেছিস?
মিস্টার বাশার মাথা নাড়ায় মানে সে আনেনি। তা দেখে তার বন্ধু রুদ্ধকে বলে,
–রুদ্ধ, বাশারের থেকে মেডিসিনের নাম জেনে তারপর মেডিসিনটা এনে ওকে খাইয়ে দাও। আমি রিথীকে লো ডোজের ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছি। আমার কাছে এটাই ছিল। তিন ঘন্টার মতো ঘুমাবে রিথী। এখন তো রাত ১০.৩০ টার বেশি বাজে। রাত ১.৩০ বা ২ টায় ওর ঘুম ভাঙবে তখন রিহাকে দিয়ে রিথীকে মেডিসিন খাইয়ে দিবে। তুমি কিন্তু ওর সামনে আসবো না কালকে সকালের আগে।
রুদ্ধ সায় দিয়ে মিস্টার বাশারের কাছ থেকে মেডিসিনের নাম নিয়ে সেটা কিনে আনে।
________________________________________________
রাত ২টায় রিথী ঘুম থেকে সজাগ হয়। তারপর উঠে বসতে নিলে বাম হাত দিয়ে বিছানায় ঠেকা দিলে হঠাৎ অসহনীয় ব্যাথা অনুভূত হয়। তখন বাম হাতটাকে সামনে এনে দেখে সেখানে ব্যান্ডেজ করা আর টান লাগায় রক্ত উঠেছে খানিকটা।
রিথীর পাশেই রিহা ঘুমিয়ে ছিলো। রিথীর আচানক উঁহু শব্দে রিহা ধরফরিয়ে উঠে যায় তারপর হন্তদন্ত হয়ে বলে,
–কি হয়েছে আপু? দেখি দেখি!
রিহা রিথীর হাতটাকে নিজের কাছে নিয়ে রক্ত দেখে ঘাবড়ে যায়। এমনিতে রিথীর হাত থেকে রক্ত পড়ার দৃশ্য দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়েছিল। রিহা বিছানা থেকে জলদি করে উঠে কাউকে ডাকবে বলে কিন্তু রিথী ওর হাত ধরে আটকিয়ে বলে,
–কাউকে ডাকিস না। এটা কিছু না।
রিহা শান্ত হতে পারে না। ক্লাস ফাইভে পড়া মেয়ে আর কতুটুকু বুঝে! রিহার মনে পড়ে মেডিসিনটার কথা তাই সে মেডিসিনটা নিয়ে রিথীকে বলে,
–এটা খাও। তোমাকে খেতে বলেছে এটা ডাক্তার।
রিথী ভ্রুকুটি করে বলে,
–কিসের এটা?
রিহা ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–রাগ কমানোর। তোমাকে যে এর আগে খেতে হতো সেটা। এটা খেয়ে রাগ কমাও। রাগ কম রাখবা বুঝেছো? তোমার রাগ আমি খুব ভয় পাই। আমার মতো বাচ্চার প্রতি কি একটুও মায়া হয়না তোমার?
রিথী হেসো ফেলে তারপর রিহার হাত থেকে মেডিসিনটা নিয়ে খায় আর বলে,
–কিছু রাগ দমানো যায় না। ওসময় পরিস্থিতি এমন থাকে যে আমরা অন্য কিছু ভাবতে পারিনা। তখন যেটা করলে মন শান্ত হবে সেটাই করে ফেলি।
রিহা তার বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–আমাদের কথা একটু ভাবো আপু। আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। তুমি এমন করলে আমার কষ্ট হয়। তখন রক্ত দেখে আমি ভয়ে কান্না করছিলাম জানো!
রিথী নিজের বোনকে আগলে নেয় আদরের সাথে। এদিকে দরজার ফাঁকা দিয়ে এক জোরা তৃষ্ণার্ত চোখ তার বসন্তরাণীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণার্ত চোখের অধিকারীকে যে এখন আড়ালেই থাকতে হবে নাহলে তার বসন্তরাণী যদি আবার নিজের ক্ষতি করে বসে!
চলবে ইনশাআল্লাহ,