রংধনুর_রঙ_কালো,৩৭,৩৮
Sidratul Muntaz
৩৭
পাহাড় দেখতে যাওয়ার আয়োজনে ভাটা পড়লো বৃষ্টির প্রকোপে। সাইকেল নিয়ে মাঝপথ অবধি যেতেই ক্ষীপ্রবেগে বাতাস ছুটল। হঠাৎ করেই আকাশ কাঁপিয়ে মেঘের তীব্র গর্জন আর মেঘ গলে ঝরো বৃষ্টি। সাদিকা ভয়ে ইলহানকে জাপটে ধরে রাখলো। সে মেঘের গর্জনে অনেক ভয় পায়। তার ছোট্ট হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল আতঙ্কে,ভয়ে। চোখমুখ কুচকে শুধু একটাই নাম জপ করছিল সে,” ইলু, ইলু, আমার ভয় লাগছে।”
ইলহান যত দ্রুত সম্ভব সাইকেল থামিয়ে একটা ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো সাদিকাকে নিয়ে। অরিনও তাদের পেছনে হেঁটে আসলো। সাদিকার দিকে চেয়ে বলল,” আমার মেয়েটা বজ্রপাতে খুব ভয় পায়।”
ইলহান এই কথা শুনে সাদিকাকে কয়েকবার ডাকলো। দাঁতে দাঁতে লেগে মেয়েটার প্রায় খিঁচুনি উঠে গেছে। অরিন মুখে দুইহাত চেপে কাঁদতে লাগল। ইলহান ভরসা দেওয়ার মতো অরিনের দিকে না তাকিয়েই বলল,” কিচ্ছু হবে না।”
ইলহান সাদিকার কানের কাছে মুখ নিয়ে কয়েকবার তার নাম ধরে ডাকল। তারপর তার দুই কানে আঙুল চেপে ধরল। তার ওর তুলোর মতো নরম শরীর বুকের মধ্যে এমনভাবে গুটিয়ে নিল যেনো সাদিকা একটুও ভয় না পায়।অন্য সময় হলে অরিন এই অবস্থায় অস্থির হয়ে উঠতো। বৃষ্টি হলেই সাদিকাকে নিয়ে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। নানা কলা-কৌশলে তাকে ভুলিয়ে রাখতে চায়। মেঘের গর্জন খুব বেশি হলে সাদিকার এভাবেই খিঁচুনি উঠে যায়। তাই অরিন বৃষ্টির দিনগুলোতে মেয়েকে নিয়ে সবসময় তটস্থ থাকে। কিন্তু আজকে তার তেমন তটস্থ লাগছে না। কারণ সাদিকা এমন একজনের কাছে আছে, যেখানে সে নিশ্চিত সুরক্ষিত। সাদিকা ঠিক একটা বিড়ালছানার মতো বাবার বুকে মুখ ঠেকিয়ে চোখ বুজে রইল। আস্তে আস্তে তার হাত-পায়ের কাঁপুনি কমে আসলো। ইলহান সাদিকার গায়ে এমনভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল যে আবেশে সাদিকা চোখ বুজে নিল। ইলহান পরম আদরে মেয়ের কপালে চুমু দিল। অরিনের অদ্ভুত তৃপ্তি অনুভব হচ্ছিল তখন। হোক না কিছু সময়, সাদিকা তার বাবার আদর তো পাচ্ছে। আর কয়দিন দেরি করলে হয়তো এই সৌভাগ্যটুকুও তার হতো না। অরিনের চোখের কোলে জল চলে এসেছে অদ্ভুত এক সম্মোহনে। একটা সময় সাদিকা ওইভাবেই ঘুমিয়ে গেল বাবার কোলে। ইলহান সাদিকাকে নিয়ে সোজামতো দাঁড়িয়ে রইল। যেনো একটা পুতুল কোলে নিয়ে রেখেছে। অরিনের মনে হলো এতো চমৎকার দৃশ্য এ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। থাকতে পারে না। হুমায়ূন আহমেদ হয়তো ঠিকই বলেছিলেন। এ পৃথিবীতে অজস্র খারাপ পুরুষ থাকতে পারে। কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই। অরিন স্থিরচিত্তে তাকিয়ে ছিল বাবা-মেয়ের দিকে। হঠাৎ আবারও বজ্রপাতের শব্দে অরিন বিকট আওয়াজে চেঁচিয়ে উঠলো। এইবার সাদিকা একটা টু শব্দও করল না। সে ঘুমিয়ে আছে। ইলহান শীতল গলায় বলল,” আস্তে, তুমিও দেখছি মেয়ের মতো শুরু করেছো।”
ইলহান কথাটা ঝোঁকের মাথায় বলে নিজেই মনে মনে আফসোস করল। অরিনের সাথে কথা না বলার, তাকে নিজের মুখ না দেখানোর শপথ করেছিল সে। তার প্রত্যেকটা শপথ আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছে।
অরিন খেয়াল করল ইলহান নিচের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেছে। সে অরিনের মুখের দিকে কেনো তাকাচ্ছে না? এতো আদব-কায়দা কবে থেকে শিখলো? অরিনও একইভাবে নিচের দিকে চেয়ে বলল,” হ্যাঁ শুরু করেছি। তাতে তোমার কি? মেয়ের মতো আমাকেও কি তুমি…”
উফফ, শিট,শিট! অরিন মনে মনে যেটা ভাবছিল মুখ দিয়ে সেটাই বলে ফেলল। এবার কি হবে? দুজনই একই সময় একইভাবে একে-অপরের দিকে তাকালো। অরিনের চোখে কিঞ্চিৎ লজ্জা আর ইলহানের চোখে বিস্ময়। এভাবেই কেটে গেল কয়েক মুহুর্ত কিংবা কয়েক হাজার বছরসম অনুভূতি। অরিনের মনে অচিরেই একটা গান খুব তাল মিলিয়ে বাজছে। বৃষ্টির দিনে বৃষ্টির সেই মায়াবী গান।
“আকাশে রিমঝিম বাদল জমেছে
তোমাকে পাবার মাদল বেজেছে,
কিছু তো শোনা যায় না
তোমাকে ছাড়া।
প্রকৃতি নতুন সাজে সেজেছে
তোমার আমার দেখা হয়েছে,
কিছু তো ভেবে পাই না
মন যে আর মানে না।
আমার মনের বনে কত
কথা ছিল বন্দি,
মেঘের আড়াল থেকে বৃষ্টি
হয়ে পড়বি।
রিমঝিম বৃষ্টি ঝরে যায়
তাকিয়ে দেখো না,
তুমি আমি বৃষ্টিতে ভিজে আজ
একাকার হয়ে আমরা…”
ইলহান শব্দ করে বলল,” স্টপ ইট অরিন। প্লিজ স্টপ ইট!”
ইলহান অরিনকে সামনে থেকে সরিয়ে সাদিকাকে নিয়ে সাইকেলে উঠে গেল। বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে। অরিন ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল। তার সারা শরীর অপমানে রি রি করছিল। এতোবড় ভুল, এতোবড় ভুল তার দ্বারা হয়ে গেল! কি করে? অরিন নিজের চুল নিজেই খামচে ধরল। নিজেকে ধিক্কার দিতে মন চাইল চিৎকার করে। ইলহান সাইকেলের বেল বাজাচ্ছিল। অরিন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে পাথরের মূর্তির মতো পেছনে গিয়ে বসল। এমন ভাবে বসলো যাতে ইলহানের গাঁয়ের সাথে তার গাঁয়ে একচুল পরিমাণ স্পর্শ না লাগে। কেউ কোনো শব্দ করল না। চুপচাপ বাড়ি ফিরে এলো।
সুমনা আর অর্ণভের মধ্যে বড়সড় ঝগড়া হয়েছে। একে-অপরের মধ্যে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। অরিন এসবের কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছে না। মিহরীমার কাছে সে শুনেছে তাদের ঝগড়াটার মূল ইস্যু নাকি অরিন। কিন্তু কেনো? অরিন কি এমন করেছে? তাছাড়া তাকে নিয়ে তারই ভাই আর ভাবীর মধ্যে ঝগড়া হবে আর সে কিছুই করবে না এটা তো হতে পারে না। অরিন অর্ণভের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে গেল৷
” ভাইয়া কি হচ্ছে এসব? তোমরা মরাবাড়িতে এসে এমন ঝগড়া শুরু করেছো কেনো?”
অর্ণভ নিরুত্তর। অরিন কাছে গিয়ে বলল,
” ভাইয়া প্লিজ, ঝামেলাটা তো আমাকে নিয়ে হয়েছে তাই না? তাহলে তুমি আমার সাথে ঝগড়া করো। সুমনার সাথে কেনো?”
অর্ণভ নিরসমুখে উত্তর দিল,” তোর সাথে কেনো ঝগড়া করবো? দোষ তো তোর নয়।”
” সুমনা কি দোষ করেছে শুনি? ইলহান ফাঁসির আসামী এইটা আমাকে বলে দিয়েছে এখানেই কি ওর দোষ? কেনো? আমার কি সত্যি জানার অধিকার নেই?”
” এই বিষয়টা তোর কাছে গোপন রাখা কতটা জরুরী ছিল সেটা তুই বুঝবি না।”
” কেনো গোপন করতে চেয়েছিলে? কিসের এতো জরুরী? প্লিজ বলো!”
” এখন নিশ্চয়ই ইলহানের জন্য তোর খুব দয়া হচ্ছে। ভালোবাসা উথলে উঠছে। তাই না?”
অরিন একটু অপ্রতিভ হয়ে বলল,” হ্যাঁ।খারাপ তো একটু লাগছেই। আমি তো মানুষ ভাইয়া। এতোটাও পাষাণ না যে এমন কঠিন সময়েও নিজেকে পাথর বানিয়ে রাখবো।”
” এইখানেই তো প্রবলেম। দ্যাট ইজ দ্যা মেইন ফ্যাক্ট!”
” মানে?”
” এখন কেনো তোর মায়া লাগছে? এতোদিন তো ওর নামও শুনতে চাসনি। ওকে নিয়ে কিছু বললেও তোর গাঁয়ে ফোসকা পড়তো। ছ্যাঁত করে উঠতি। ও মরে গেছে না বেঁচে আছে সেটা পর্যন্ত জানার আগ্রহ ছিল না তোর। তাহলে হঠাৎ করে এখন মায়া কেনো লাগছে? এটাকে কি বলে জানিস? করুণা। একটা ফাঁসির আসামীর জন্য মানুষের যতটুকু সমবেদনা আসে তোরও ঠিক ততটুকুই সমবেদনা এসেছে।”
” ভাইয়া, এসব তুমি কি বলছো? ”
” ঠিকই বলছি। তোকে যতবার আমি ফোন করে ইলহানের ব্যাপারে বোঝানোর চেষ্টা করেছি ততবার তুই ইলহানকে গালাগালি করেছিস। তুই কি জানিস? আমি তোকে ফোন করে স্পিকারে কথা বলতাম।তখন ফোনের অপর পাশ থেকে ইলহান বসে বসে সব শুনতো।”
অরিন অবাক হয়ে গেল,” হোয়াট? এসব তুমি কেনো করতে ভাইয়া?”
” ও ফোন করলে তুই নিশ্চয়ই কথা বলতি না। তাই ইলহান আমার কাছে আসতো। যেনো আমি কথা বললে ও তোর কণ্ঠ শুনতে পারে। কিন্তু তোর কণ্ঠ থেকে বেচারা ভালো কথা জীবনেও শুনতে পারেনি। শুনেছে শুধু গালাগালি।”
অরিন বিস্মিত চোখ মেলে স্থির চেয়ে রইল। অর্ণভ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,” ইলহান মৃত্যুর আগে এজন্যই তোর সাথে দেখা করতে চায়নি। তুই এতোবছরেও তাকে ক্ষমা করতে পারলি না। মৃত্যুর আগে তোর ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে করুণার বৃষ্টি ও সহ্য করতে পারবে না। এইযে এখন তুই কাঁদছিস। এটা তোর করুণার কান্না।”
অরিন হতবিহ্বল হয়ে কথাগুলো শুনছিল। আর একপা, দুইপা করে পিছিয়ে যাচ্ছিল। আসলেই কি সে ইলহানকে সারাজীবন শুধু ঘৃণা আর করুণাই করেছে? কোনোদিনও ভালোবাসেনি? সত্যিই কি ভালোবাসেনি? অরিন উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গেল ইলহানের ঘরের দিকে। কেনো যে গেল তা সে নিজেও জানতো না। ইলহান তখন সম্পূর্ণ একা সেই ঘরে। ব্যাগপত্র গুছাচ্ছে। সে কি জেলে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে? অরিনকে দেখে কৌতুহলী দৃষ্টিতে একবার তাকাল ইলহান। অরিন বলল,
” চলে যাচ্ছো?”
ইলহান খুব ধীরে উচ্চারণ করল,” হুম।”
অরিন ঢালা বর্ষণের মতো সিক্ত কণ্ঠে বলল,” আই এম স্যরি!”
ইলহান হকচকিয়ে গেল। কিছুটা স্তম্ভিত হলো। তারপর হাসার চেষ্টা করে বলল,” তুমি কেনো স্যরি বলছো আমাকে?”
অরিন দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো৷ অসহায়ের মতো বলল,
” জানিনা। কেনো স্যরি বলছি আমি?”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর ইলহান গলা পরিষ্কার করে বলল,” আমিও স্যরি।”
অরিন সরাসরি ইলহানের চোখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,” কেন?”
” তোমার দেওয়া ডিভোর্স পেপারে আজও সাইন করতে পারলাম না। তোমার শেষ চাওয়া অপূর্ণ রেখেই বিদায় নিতে হচ্ছে।”
অরিনের হু হু করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করল। খুব করে বলতে মন চাইল,” আমিও ইলহান। আমিও পারিনি তোমাকে ডিভোর্স দিতে। আমার হাতের আঙুলগুলো তখন খুব কাঁপছিল জানো? আমি অন্বয়সাহেবকে বললাম, সইটা আপনিই করে দিন। ইলহান না বুঝলেই হলো। তিনি আমার লেখা হুবুহু নকল করে সাইন করেছিলেন।”
অরিন মুখ ফুটে একটা শব্দও বলতে পারল না। কণ্ঠনালী দিয়ে যেনো রক্তক্ষরণ হচ্ছিল তার। ইলহান চলে যাচ্ছে। সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছে!
চলবে
– Sidratul Muntaz
#রংধনুর_রঙ_কালো
৩৮.
অরিনের খুব, খুব বলতে ইচ্ছে করল,” কেন সেদিন এমন করেছিলে ইলহান? যদি সেদিন তুমি সোফিয়াকে গ্রহণ না করতে তাহলে আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। তুমি, আমি আর সাদিকা মিলে আমাদের একটা স্বপ্নের পরিবার হতো। শুধু তোমার সেই গর্হিত কাজটির জন্য আমাদের জীবন দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে গেল। কেনো করেছিলে ইলহান তুমি এরকম? কেনো সবকিছু এভাবে শেষ করে দিলে?”
অরিন মনে মনে এইসব বলছিল আর কেঁদে ভাসাচ্ছিল। কান্নার দমক সামলাতে মুখে হাত দিয়ে হিঁচকি তুলছিল। ইলহান অপ্রস্তুত হলো। অরিনের কান্নার কারণ জানতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো না। অরিনের সাথে কথা বলতে সংকোচ কাজ করে তার। এইযে কাল সে চলে যাবে। এরপর হয়তো আর কখনও দেখা হবে না অরিনের সাথে। ছোট্ট পুতুলের মতো সুন্দর মেয়েটার সাথেও। ইলহানের কিন্তু বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই। সে তার ভাগ্য মেনে নিয়েছে। নিজেকে সে অনেক আগেই খুন করেছিল। এখন দেহটাকে মুক্তি দেওয়া বাকি। ইলহানের বাঁচতে ইচ্ছা করে না এই পৃথিবীতে। এতো গ্লানি, এতো হতাশা, এতো কষ্ট, অপরাধবোধের ক্লিষ্টতা নিয়ে সে বাঁচবে কেমন করে? অরিনের চোখে যখন সে নিজের জন্য ঘৃণা দেখতে পায় তখন বেঁচে থাকাটা আসলেই অর্থহীন মনে হয়। যখন সে প্রথম অন্বয়ের কাছে শুনেছিল যে অরিন তাকে ডিভোর্স দিতে চায় আর অন্বয়কে বিয়ে করতে চায় তখন খুব অবাক হয়েছিল। আসলে নিজের জীবনে অরিনের গুরুত্বটা সে টের পেয়েছে তখনি, যখন অরিন তাকে একটু একটু করে ছেড়ে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে সে বুঝতে পেরেছে শুধু আরেকবার অরিনকে পাওয়ার জন্য পৃথিবী বাজি রাখতেও তার আপত্তি নেই। কিন্তু সেই আরেকবার পাওয়ার সুযোগটাই অরিন তাকে দিল না। ক্ষমা করল না। সত্যিই কি ইলহানের কোনো সুযোগ পাওনা ছিল না? অরিন কি তাকে একটুও ভালোবাসেনি? যদি ভালোবাসতো তাহলে নিশ্চয়ই চাইতো আরেকবার তাদের ভাঙা সংসার জোড়া লাগাতে৷ অরিন কেনো সেটা চাইলো না? কেনো শেষ পর্যন্ত ইলহানকে একটা সুযোগ দিতে পারলো না সে? ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেওয়া কি খুব জরুরী ছিল? ইলহান একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। অরিনকে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল,” কেন অরিন? কেন সেদিন ক্ষমা করলে না আমায়? কেনো আসবে বলেও আসলে না আমার কাছে? কেনো স্বপ্ন দেখিয়ে আবার সেই স্বপ্ন ভেঙে দিলে? হ্যাঁ আমিও তোমার সাথে অন্যায় করেছিলাম। কিন্তু ক্ষমাও তো চেয়েছিলাম। একটিবার কি ক্ষমা করা যেতো না? এতো বেশি ঘৃণা করতে আমাকে তুমি? এতোটাই বুঝি ঘৃণিত ছিলাম আমি? অবশ্য ভালোই হয়েছে এতে। কিছু জিনিস না হারালে গুরুত্ব বোঝা যায় না৷ তুমি হারিয়ে গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছো। তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা কত কঠিন সেটা আমি এই পাঁচবছরের প্রত্যেক মুহুর্তে অনুভব করেছি। কি অদ্ভুত তাই না! তোমার ভালোবাসা আমাকে বদলাতে পারলো না। কিন্তু তোমার ঘৃণা ঠিকই বদলে দিল আমাকে। ভাগ্যিস তুমি আমায় ঘৃণা করেছিলে। নয়তো আমি বদলাতাম না। কোনোদিন বদলাতাম না।”
ইলহানের চোখের কোলে একফোঁটা স্বচ্ছ জল ভেসে উঠলো। অরিন স্পষ্ট দেখতে পেল সেই জলের ফোঁটা। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার কিছু একটা হলো। দুম করে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ইলহানকে। আর এক নিঃশ্বাসে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” জানি না আমার কি হয়েছে। কিন্তু তোমাকে যেতে দিতে ইচ্ছা করছে না। আমি চাই না তুমি চলে যাও। প্লিজ তুমি যেও না ইলহান। হায় আল্লাহ, তুমি যেও না!”
ইলহান এক মুহুর্তের জন্য ডুবে গেল পুরোপুরি। মনে হলো, এইতো সে পেয়ে গেছে সব। ঠিক এই মুহুর্তে যদি মৃত্যু হয় তাহলে থাকবে না কোনো আফসোস। জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মুহুর্ত বুকে নিয়ে প্রাণত্যাগ করার সৌভাগ্য কয়জনের হয়? কিন্তু আরেকটু দেরি হলেই হবে সর্বনাশ। মায়া জন্মাবে, জন্মাবে লোভ, বেঁচে থাকার আকাঙ্খা, দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু এখন তো ইলহানের মায়া কাটানোর সময়। ইলহান দুই হাতে সরানোর চেষ্টা করল অরিনকে। পারলো না। শরীরে একদম বল নেই তার। সকাল থেকেই সে খুব দূর্বল হয়ে আছে। একটু আগেই গাঁয়ে অনেক জ্বর এসেছে। অরিন টের পেয়ে যায়নি তো? বৃষ্টিতে ভিজে অবস্থা আরও খারাপ। ঠিক এই মুহুর্তে ইলহানের পুরো পৃথিবী চক্রাকারে ঘুরছে। নিজেকে এতো বলহীন মনে হচ্ছে যে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও নেই। পেট মুচড়িয়ে বমি চলে আসলো। রক্তবমি! এর আগেও অনেকবার রক্তবমি করেছে সে। কিন্তু কারো সামনে করেনি। কাউকে জানায়ওনি বিষয়টি। যে মানুষের আজ বাদে কাল ফাঁসি হতে চলেছে তার জীবনটা অতিশয় তুচ্ছ, শরীরের অসুস্থতাগুলোও ঠুনকো। এসব নিয়ে অন্যকে বিরক্ত করার কি দরকার? অরিন মুখে দুই হাত ঠেকিয়ে ইলহানের অবস্থা দেখছিল। তার ভেতরটা শ্বাস রুদ্ধকর অনুভূতিতে অসাড় হয়ে যাচ্ছে। ইলহান বমি করতে করতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল এবং মুর্ছা গেল।
আজ চল্লিশ দিন ধরে ইলহান কোমায়। হসপিটালের একটি নির্দিষ্ট বিছানা দখল করে তার অচেতন দেহ শুয়ে আছে দিনের পর দিন। বাহিরের জগতের প্রতি তার কোনো খেয়াল নেই। কত মানুষ ছটফট করছে,একটিবার তার কণ্ঠ শোনার জন্য, তার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছে আকুল হয়ে। তাকে দেখতে পরিচিত অপরিচিত অনেক মানুষ হসপিটালে এসে ভীড় জমিয়েছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছে ইলহানকে একনজর দেখতে। ফাঁসি হয়ে গেলে কেউ বোধহয় জানতেও পারতো না তার মৃত্যুর খবর। কিন্তু টানা চল্লিশদিন হসপিটালে ভর্তি থেকে সে প্রত্যেকটি মানুষকে নাজেহাল করে তুলেছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে তার গুরুত্বও কোনো অংশে কম নয়। এই কয়দিনে অরিনের একজন মানুষের সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। মানুষটির নাম অ্যাংকার। এতোদিন যার কোনো খোঁজ ছিল না। ইলহান-অরিনের বিয়ের আগে অ্যাংকার ছিল তাদের দু’জনেরই বেস্টফ্রেন্ড। ইলহান
অ্যাংকারের সাথে বাজি ধরেই অরিনকে বিয়ে করেছিল। তাদের মধ্যে শর্ত ছিল, যে হেরে যাবে সে আর কখনও অরিনের সামনে আসবে না। ইলহান জিতে গেছিল। অরিনকে বিয়ে করতে পেরেছিল। হেরে গেল অ্যাংকার। তাই শর্ত মোতাবেক সে আর কখনও অরিনের সামনে আসেনি। কিন্তু এইবার এসেছে। যে মানুষটির দুনিয়ার সঙ্গে কোনো যোগসুত্র নেই, ভয়ংকর রোগের সাথে যুদ্ধ করে যে কোমায় টিকে আছে তার সাথে করা শপথের আর মূল্যই বা কতটুকু। কিন্তু এইবার অ্যাংকারের সাথে কথা বলে অরিন যেটুকু জানতে পেরেছে তাতে মনে হলো তার চেনা পৃথিবীই যেনো পুরোপুরি বদলে গেছে। ইলহান অরিনকে ভালোবেসে বিয়ে করেনি, এটা ঠিক। কিন্তু বিয়ের পরেও হয়তো ভালোবাসতে পারেনি। কিংবা বেসেছিল কিন্তু বুঝেনি। তবে ডিভোর্সের পর ইলহান সত্যি উপলব্ধি করেছে সে শুধু অরিনকেই ভালোবাসে। এইযে, আজকে অরিনের ক্যারিয়ার এতো উঁচুতে৷ সে একজন সুপরিচিত মডেল। এই সবকিছুর পেছনে ইলহানের একটা ছোট্ট ভূমিকা আছে। অরিন সবসময় থেকেই খুব ফ্যাশন সচেতন ছিল। ফার্স্ট ক্লাস মেকাপ করতো সে। শুধু গায়ের রঙ নিয়ে মানুষের থেকে কপট বাক্য শুনতে শুনতে নিজের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল। কখনও সাহস হয়নি নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে স্বপ্ন দেখার। কিন্তু ইলহান অরিনের স্বপ্নের কথা জানতো। তাই মিসেস এলেক্সকে সে নিজেই অরিনের কাছে পাঠিয়েছিল। মিসেস এলেক্সের সেই ছোট্ট অনুষ্ঠানের জন্যই তো অরিনের এতো পরিচিতি। সেইদিক থেকে চিন্তা করলে ইলহানের ভূমিকাটাই এখানে মুখ্য। অ্যাংকার যখন অরিনকে এইসব বলছিল, অরিন থমথমে মুখে চুপচাপ বসে ছিল। তার এইসব কিচ্ছু শুনতে ভালো লাগছিল না। অ্যাংকারকে সে জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু ভেবেছিল। সেই বন্ধুটির হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ায় দুঃখও পেয়েছিল। আজ এতোবছর পর সেই বন্ধুটি এসে তাকে এমন কিছু সত্যি জানালো যেগুলো না জানলেই হয়তো ভালো ছিল। সোফিয়াও অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে ইলহানকে দেখতে। সে অনেক বার অরিনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অরিন সোফিয়াকে কথা বলার সুযোগ দেয়নি। এই মেয়েটির জন্যই ইলহান তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ইলহানকে মাফ করতে পারলেও সোফিয়াকে সে কোনোদিন মাফ করতে পারবে না। সোফিয়ার মতো অন্বয়ও অরিনের সাথে দেখা করার জন্য তাকে খুঁজছে। আজ অনেকদিন পর অন্বয় বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছে৷ এতোবছর ক্যারিয়ারের কাজে সে ছিল প্রচুর ব্যস্ত মানুষ। ইলহানের ফাঁসির খবর সে পেয়েছিল কিন্তু অরিনকে জানায়নি। তার ধারণা ইলহানের এমন একটা পরিণতির দরকার ছিল। কিন্তু এইখানে এসে, ইলহানের ভয়ংকর অবস্থা দেখে, আশেপাশের মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখে তার সত্যি খারাপ লাগছে। বেশি খারাপ লাগছে ছোট্ট মেয়ে সাদিকার জন্য। আরেকজনের জন্যও খারাপ লাগছে। অর্ণভের কাছে অন্বয় শুনেছে, সাদিকা অষ্টপ্রহর ইলহানের কেবিনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে চায়। সে চায় ইলহান চোখ খুলে সর্বপ্রথম তাকেই দেখুক। বাচ্চা মেয়েটি মনে করছে ইলহান ঘুমিয়ে আছে। একদিন তার ঘুম ভাঙবে। কিন্তু ঘুমটা ভাঙতে দেরি লাগছে। আরও কত দেরি লাগবে তা কেউ জানে না। বড়রা কেউ তাকে এ বিষয়ে বলছে না। সাদিকার ইদানীং খুব মনে পড়ছে তার আর ইলহানের প্রথম দেখার কথা। তখন সাদিকা মিহরীমার সাথে উঠানে ছোয়াছুয়ি খেলছিল। সুমনা হঠাৎ মিহরীমাকে ডাক দেওয়ায় সে ভেতরে চলে যায়৷ সাদিকাকে একটা চেয়ারে বসে থাকতে বলে। মিহরীমা চলে যাওয়ার পর সাদিকার একটু ভয় লাগছিল। সে মুখ গোমরা করে চেয়ারে বসে রইল। তখন একটি লম্বা কালো অবয়ব টর্চের আলো ফেলল সাদিকার মুখে। সাদিকা চোখে হাত দিয়ে হেসে ফেলল। তার ধারণা ওইটা অর্ণভ মামা। সে মাঝে মাঝে সাদিকার সাথে এমন দুষ্টুমি করে। অবয়বটি কাছে এসে সাদিকাকে কোলে তুলে নিল। কানে কানে বলল,
” একটা ম্যাজিক দেখবে?”
সাদিকা চোখ খুলে ইলহানকে দেখে একটু ভয় পেল। কিন্তু ম্যাজিকের কথা শুনে লোভ সামলাতে পারল না। দ্রুত ঘাড় নেড়ে বলল,” হু, ম্যাজিক দেখবো।”
ইলহান সাদিকাকে নিয়ে ঝিলপাড়ে চলে এলো। কাচের বাক্সে বন্দী জোনাকি পোকা সাদিকার সামনে মেলে ধরল। সাদিকা বলল,” ওয়াও, এগুলো খুব সুন্দর লাইট।”
ইলহান সাদিকাকে বলল,” বাক্সের মুখটা খুলে দাও। তারপর দেখতে পাবে আসল ম্যাজিক।”
সাদিকা মুখ খুলে দিতেই জোনাকিপোকারা উড়ে উড়ে পুরো ঝিলপাড় আলোকিত করে দিল। সাদিকা লাফিয়ে উঠে দুইহাতে তালি বাজাচ্ছিল। খিলখিল শব্দে হাসতে লাগল।। ইলহান মুগ্ধ চোখে দেখছিল সাদিকার উচ্ছ্বসিত চেহারা। মেয়েটা ঠিক তার স্বপ্নের মতই হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার নিজের জীবনটাই এখন দুঃস্বপ্ন। কি নিষ্ঠুর নিয়তি! এই মেয়েকে রেখে সে মরবে কেমন করে? সাদিকা হঠাৎ লাফালাফি থামিয়ে ইলহানের সামনে এসে দাঁড়ালো। ইলহানের রক্তলাল ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আচ্ছা তুমি কে?”
ইলহান হাসি হাসি মুখে বলল,” আমার নাম ইলহান।”
সাদিকা ইলহানের টোলে ছোট্ট আঙুল ডুবিয়ে বলল,
” ইলহান, তুমি অনেক সুন্দর।”
ইলহানের এতো ভালো লাগল। সাদিকার ছোট্ট হাত চেপে ধরে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল,” তাই? তাহলে এখন থেকে তুমি আমার বেস্টফ্রেন্ড হবে?”
” হ্যাঁ হবো। নিশ্চয়ই হবো। আজকে থেকে আমরা বেস্টফ্রেন্ড।”
কিন্তু তার বেস্টফ্রেন্ড হঠাৎ তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। বেস্টফ্রেন্ড কি রাগ করেছে? সাদিকার ভালো লাগে না কিছু। কবে ইলহান কথা বলবে? কবে চোখ মেলে তাকাবে? আহারে!
চলবে