রংধনুর_রঙ_কালো,৩৫,৩৬
Sidratul Muntaz
৩৫
রাতটা না ঘুমিয়েই কাটলো অরিনের। সকালে ঘুম ভাঙার পর সুমনাকে ইলহানের খুন করার বিষয়ে আবার জিজ্ঞেস করলে সে কোনো উত্তর দেয় না। চোরা চোখে পালিয়ে যায়। আসলে এই ব্যাপারটা অরিনের কাছে গোপন রাখার কথা ছিল। অর্ণভও এই কথা জানে। কিন্তু অরিনকে জানায়নি। সুমনা ঘুমের ঘোরে বলে ফেলেছে। ঘুমন্ত অবস্থায় তার হুশ-জ্ঞান ঠিক থাকে না। অরিন বিস্তারিত সত্যি জানার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিল। সামনে যাকেই পাচ্ছে তাকেই জিজ্ঞেস করছে, ইলহান কেনো খুন করেছে? কাকে খুন করেছে? কিন্তু মানুষ অরিনের প্রশ্নের উত্তর দিতে নারাজ। যাকেই অরিন এই প্রশ্ন করছে সে-ই এড়িয়ে যাচ্ছে। অবশেষে দুইতলা থেকে একটা পিচ্চি মেয়ে এসে বলল,
” আন্টি, আপনাকে শ্যান আন্টি উপরে যেতে বলেছে।”
অরিন পিচ্চিটার কথামতো উপরে গেল। ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল শ্যানিন। তার চোখে চশমা, চুলে উপুড় করে হাত খোপায় বাধা। একটা ঢোলা টপ পড়ে আছে সে। অরিন নিজের পিঠ ভর্তি হাইলাইট করা চুল একপাশে এনে জিজ্ঞেস করল,” কেমন আছিস?”
শ্যানিন সরাসরি অরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,” তুই কেমন আছিস?”
অরিনের ভেতর থেকে একটা অভিমানী বাতাস আছড়ে পড়ল,” কাল আমাকে দেখে মুখের উপর দরজা আটকে দিয়েছিলি। আর এখন জিজ্ঞেস করছিস কেমন আছি?”
শ্যানিন একহাতে অরিনকে কাছে এনে বলল,” কিছু মনে করিস না। আমার আসলে তখন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। পরিবারের কি অবস্থা দেখছিসই তো। মন-মেজাজ কি ঠিক থাকার কথা? তুই আবার মনে করিস না যে তোর উপর রেগে আছি। আমরা কেউ তোর উপর রেগে নেই।”
” মা-ও আমার সাথে কথা বলেনি। সাদিকাকে পরিচয় করাতে নিয়েছিলাম। মা সাদিকাকে দেখেও কিচ্ছু বলল না জানিস? আমার খুব খারাপ লেগেছে।”
” মায়ের কথা আর বলিস না। মায়ের মাথা ঠিক নেই। আমার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করে জানিস? ইদানীং তো মা পাগলই হয়ে গেছে। আমিও পাগল হয়ে যাবো মনে হয়। বাবা তো চলে গিয়ে বেঁচে গেল। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। ভাইয়ার শেষ পরিণতি বাবাকে নিজচোখে দেখতে হবে না। বাবা এটা সহ্য করতে পারতো না রে! এজন্যই হয়তো মহান আল্লাহ বাবাকে আগে নিয়ে গেছেন।”
শ্যানিনের কণ্ঠে কান্নারচোট। অরিন শ্যানিনের মুখের কাছে ঝুঁকে প্রশ্ন করল,” এই শ্যানিন, বল না। ইলহান কি আসলেই খুন করেছে? এটা কি সত্যি?”
শ্যানিন ধীরে-ধীরে হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ল। অরিন আবার কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। এরপর হঠাৎ ব্যগ্র হয়ে বলল,” ওর কি ফাসি হবে?”
” খুন করলে তো ফাসি হওয়াই উচিৎ। ”
” কিন্তু ও কাকে খুন করেছে? কেনো খুন করেছে? ও কি খুন করতে পারে?”
শ্যানিন অরিনের কাঁধে হাত রেখে বলল,” সে অনেক ঘটনা। আরেকদিন বলবো।”
” না এখনি বল!”
অরিনের অধৈর্য্য কণ্ঠ।
” প্লিজ!”
শ্যানিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আচ্ছা, ভেতরে আয়।”
অরিনের কাছে ডিভোর্স পেপার পাওয়ার পর ইলহান বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল। শ্যানিন তখনও কানাডায়। ভাইয়া আর অরিনের বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা শুনেই সে ইমারজেন্সীতে বাংলাদেশে চলে আসে। কারণ ইলহানের অবস্থা তখন খুবই খারাপ। সে কারো সাথে কথা বলতো না, নিজেকে পুরো ঘরবন্দী করে ফেলেছিল। আর অদ্ভুত ব্যাপার, রাত হলেই সে কারো সাথে কথা বলতো। মোবাইলে না, আয়নায় তাকিয়ে কথা বলতো। হয়তো দিনের বেলাতেও বলতো। কিন্তু রাতে সবকিছু নীরব থাকায় তার কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যেতো। নুসাইবা অরিনের সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু অরিনের কোনো খোঁজ নেই। মেয়েটা পুরো লাপাত্তা। ইলহানের সাথে সে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আসেনি। ইলহানও অরিনের ব্যাপারে কিছু বলছে না। অরিনের মা-বাবাও মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে মরিয়া হয়ে যাচ্ছেন। তাদের সাথেও তখন অরিনের যোগাযোগ হয়নি। অবশেষে আমানত সাহেবের থেকে জানা গেল, অন্বয়-অরিন বিয়ে করে ফেলেছে। শুধু তাই না, অরিন এখন প্রেগন্যান্ট। সে অন্বয়ের বাচ্চার মা হবে। এইসব শুনে নুসাইবা ঘৃণায় আর রাগে শিউরে উঠলেন। শায়িখ সাহেব আমানত সাহেবের সাথে বন্ধুত্ব ছিন্ন করলেন। এতোবড় বিশ্বাসঘাতকতার জন্য অরিনকে তারা মন থেকে ঘৃণা করতে লাগলেন। অরিনের বাড়ি গিয়ে নুসাইবা ঝগড়া-বিবাদ শুরু করলেন। ওই মেয়েটার জন্যই আজকে তার ছেলেটার এই অবস্থা। কোন মা সহ্য করবে এই অনাচার? তারপর একদিন ইলহান নিজেই সবকিছু স্বীকার করল। সে অরিনের সাথে যত অন্যায় করেছে, মা-বাবা এবং বোনকে সব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিল। কিছুই গোপন রাখল না। তার স্বীকারোক্তিতে একফোঁটা মিথ্যে ছিল না। সবই সত্যি বলেছিল সে। নিজের অপরাধের জন্য বাবা-মায়ের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিল। ইলহানের পরিবার তাকে নির্দ্বিধায় ক্ষমা করে দিল। কারণ পরিস্থিতিটাই এতো করুণ ছিল যে তখন ওইসব ব্যাপার কিছুই মনে হচ্ছিল না। ইলহান যতটা কষ্ট পাচ্ছিল সেই তুলনায় তার পাপটাকেও ঠুনকো মনে হচ্ছিল। এর চেয়ে যদি অরিন ইলহানকে মেরে ফেলতো, তাও ভালো ছিল। এতোবড় শাস্তি সে ইলহানকে কিভাবে দিল? সবাই ইলহানকে ক্ষমা করল কিন্তু অরিন কেন ক্ষমা করতে পারল না? ইলহান তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিল। সে অরিনের কাছে ক্ষমা চাইতেও গিয়েছিল। কিন্তু অরিন ক্ষমা করেনি। উল্টো সেদিন অন্বয়কে দিয়ে ইলহানকে বীভৎসভাবে মার খাওয়িয়ে আহত করেছিল। রাস্তার মানুষ যদি সময়মতো তাকে হসপিটালে না নিতো, তাহলে আজকে ইলহান মা-বাবার কাছে ফিরে আসতে পারতো না। তার মৃত্যুর খবর তার মা-বাবা জানতেও পারতো না। অথচ এই কথা কেউ জানলো না সেদিন অরিন নিজেই ইলহানকে হসপিটালে নিয়েছিল। আর হসপিটাল কর্তৃপক্ষকে এই কথা গোপন রাখতে বলা হয়েছিল। অন্বয় যখন ইলহানের কাছে অরিনের সাইন করে দেওয়া ডিভোর্স পেপার নিয়ে এসেছিল তখন বলেছিল, সে আর অরিন বিয়ে করবে। তারা দুজনই দুজনকে ভালোবাসে। আর অরিনই চায় অন্বয়কে বিয়ে করতে। এই কথা জানার পর ইলহান আর অরিনকে বিরক্ত করেনি। জীবনে তো সে অনেক কষ্ট দিয়েছে অরিনকে। এখন যদি অরিন অন্যকারো কাছে সুখ খুঁজতে যায় তাহলে ইলহানের বাঁধা দেওয়ার অধিকার নেই। এতোদিন অন্বয়কে ইলহান সহ্য করতে পারতো না কারণ তার বিশ্বাস ছিল, অরিন কখনও অন্বয়কে ভালোবাসেনি। সবকিছুর পরেও অরিন শুধু ইলহানকেই ভালোবাসে। কিন্তু সেদিন যখন ইলহান ক্ষমা চাইতে গেল আর অরিন অন্বয়কে পাঠালো ইলহানকে মারার জন্য, তখন সত্যি ইলহানের পরিচিত পৃথিবীটা পাল্টে গেছিল। এর কিছুদিন পরেই অরিন ডিভোর্স পেপার পাঠাল ইলহানের কাছে। তখন ইলহান পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেল যে অরিন আর তাকে ভালোবাসে না। সে চিরজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে অরিনকে। অরিন- অন্বয়ের বিয়ের কথা শুনে ইলহানের জীবন অর্থহীন মনে হচ্ছিল। এরপর থেকেই তার অভিশপ্ত জীবনের সূচনা।
এ পর্যায়ে অরিন বলল,” তার মানে ইলহান সাদিকার আসল পরিচয় জানে না?”
শ্যানিন চোখের জল মুছে বলল,” উহুম।”
” তাহলে সে সাদিকাকে এতো আদর করছে কেনো? কালরাতে আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম সাদিকাকে ঘর থেকে নিয়ে গেছিল জানিস? আজকেও সকাল থেকে সাদিকা ওর কাছে। ও কেনো অন্বয়ের মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘুরছে? ”
” ইলহান ভাইয়ার কাছে সাদিকা তোর মেয়ে। এজন্যই হয়তো আদর করছে। তুই তো জানিস, ভাইয়ার মেয়ে বাচ্চার খুব শখ ছিল।”
অরিন ডানহাত মুখে ঠেকালো। সে ভাবতেই পারছে না তার বিরুদ্ধে এতোবড় মিথ্যে প্রচার করেছিল অন্বয়। কিন্তু অন্বয় এটা কেনো করল? এজন্যই তো সবাই তাকে এতো ঘৃণা করছে। তার বাবার মতো শ্বশুরও নিশ্চয়ই তার প্রতি এই ভুল ধারণা নিয়েই মারা গেছেন। ইশশ! শায়িখ সাহেবকে সত্যি কথাটা সে আর কোনোদিন জানাতে পারবে না।অরিনের খুব খারাপ লাগছে। এই পৃথিবীটা আসলে বিশ্বাসের অযোগ্য। কাউকে বিশ্বাস করে শান্তি নেই। সবাই বিশ্বাস ভাঙতে ওস্তাদ। অন্বয়ের প্রতি বিতৃষ্ণায় অরিনের বুক ভার হয়ে আসছিল। অরিন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” শ্যানিন, আমি কিন্তু অন্বয়সাহেবকে বিয়ে করিনি বিশ্বাস কর। সাদিকা অন্বয়ের মেয়ে না। ও তোর ভাইয়েরই মেয়ে।”
শ্যানিন বলল,” জানি আমি। কিন্তু এই কথা আমি মাত্র কয়েকদিন আগে জানতে পেরেছি। ভাইয়া আর মাকে এখনও জানানো হয়নি।”
” কেনো জানানো হয়নি? আমি এখনই জানাতে চাই।”
অরিন উঠতে নিচ্ছিল তখনি শ্যানিন ওর হাত চেপে ধরে বলল,
” প্লিজ অরিন, বোস। দোহাই লাগে ভাইয়াকে এইসব জানাবি না। আর তুইও ভাইয়ার সাথে কথা বলিস না প্লিজ। অনেক দেরি হয়ে গেছে এখন। ভাইয়ার হাতেও সময় নেই। কি দরকার পিছুটান তৈরী করার? এখন আফসোস ছাড়া তো আর কিছুই হবে না। ভাইয়া যদি এখন জানতে পারে, সাদিকা তারই মেয়ে আর তুইও বিয়ে করিসনি তাহলে কি তার মরতে ইচ্ছে করবে বল? তার তো আবার বাঁচতে ইচ্ছে করবে। আমি চাই না আমার ভাইয়ের নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জাগুক। কারণ এই এই ইচ্ছে পূরণ অসম্ভব। আর যে ইচ্ছে পূরণ করা অসম্ভব সেই ইচ্ছে জাগতে দেওয়াও উচিৎ না। ভাইয়া তো চাইলেও আর বাঁচতে পারবে না। তার মৃত্যুর মাত্র কিছু সময় বাকি! এই কিছুসময়ে আফসোসের বোঝা বাড়িয়ে তার মৃত্যুটাকে কঠিন করে তোলার কোনো মানে হয় না।”
শ্যানিন কথা বলতে বলতে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠল। অরিন শ্যানিনের মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরল। মনে মনে অরিনের ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে! ভয়ংকর! অনেকক্ষণ পর অরিন ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
” ইলহান কেনো খুন করেছিল?”
চলবে
– Sidratul Muntaz
#রংধনুর_রঙ_কালো
৩৬.
এ পর্যায়ে হু হু করে এক নিশ্বাসে কেঁদে উঠলো শ্যানিন। এতোক্ষণ তার কান্নাটা ছিল শব্দহীন। এখন প্রায় গর্জন করে কাঁদছে। ইলহান কাকে খুন করেছিল অরিন এই প্রশ্ন করা মাত্রই শুরু হয়েছে শ্যানিনের বাঁধভাঙা কান্নার জোয়ার। অরিন কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। শ্যানিনের দুই বাহু চেপে ধরে রাখল।
কানাডায় পড়াশুনা করার সময় শ্যানিনের এক কানাডিয়ানের সাথে রিলেশন হয়েছিল। ছেলেটার নাম ছিল ফ্লিন্ট। এ সম্পর্কে অরিন পাঁচবছর আগে জেনেছিল কিছুটা। শ্যানিন একবার ভিডিওকলে অরিনকে বলেছিল ফ্লিন্টের ব্যাপারে। অরিন ছবি দেখেছিল ফ্লিন্টের। হোস্টেলে থাকা অবস্থায় একটি মেয়ের সাথে শ্যানিনের অনেক ঝগড়া হয়। শ্যানিন এমনিতেই কিছুটা রগচটা আর বোকা স্বভাবের। অতি সহজেই রেগে যায় আর হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। হোস্টেল থেকে শ্যানিনকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। মেয়েটাই ষড়যন্ত্র করে শ্যানিনকে বের করার ব্যবস্থা করেছিল। সেদিন ফ্লিন্টের বাসায় যাওয়া ছাড়া শ্যানিনের আর কোনো উপায় ছিল না। কারণ কানাডায় শ্যানিনের পরিচিত বলতে একমাত্র ফ্লিন্ট। যে ভালোবাসার অধিকারে শ্যানিনের সবচেয়ে আপনজনও বটে। ফ্লিন্ট তার ফ্ল্যাটে একাই থাকতো। শ্যানিন যাওয়ার পর ওরা একই ফ্ল্যাটে কিন্তু আলাদা রুমে বসবাস শুরু করে। ফ্লিন্ট নিজেই রিকোয়েস্ট করেছিল যাতে শ্যানিন ওর সাথে থাকে। কিন্তু শ্যানিন চেয়েছিল আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকবে। ফ্লিন্ট সেটা হতে দেয়নি। ভালোবাসার দোহাইয়ে শ্যানিন ফ্লিন্টের সাথেই থাকতে শুরু করে যদিও ওদের রুম আলাদা ছিল। তাদের আশেপাশে অনেক কাপল ছিল, যারা লিভ টুগেদার করতো। একই রুমে, একই বিছানায় বিয়ের আগেই। কিন্তু অরিন এ ধরণের সংস্কারে অভ্যস্ত না। সে ফ্লিন্টকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, বিয়ের আগে কখনও তারা কাছাকাছি আসবে না৷ ফ্লিন্ট ছিল খ্রিস্টান আর শ্যানিন মুসলিম। ওদের বিয়ে কি আদৌ সম্ভব? তাদের মিলনে বিশাল ঝড় আসতে পারে জেনেও ফ্লিন্টকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি শ্যানিন। ছেলেটাকে ভালোবেসে বিশ্বাস করেছিল সে। কিন্তু সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ফ্লিন্ট প্রতিরাতে শ্যানিনকে গোগ্রাসে ভোগ করেছে। শ্যানিন এইসব বুঝতে পারল যখন সে এক্সিডেন্টলি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেল। এই অপরিকল্পিত প্রেগ্ন্যাসির নিউজ শ্যানিনের পুরো জগৎ এলোমেলো করে দিয়েছিল। সেদিন রাতেই বাড়ি ফিরে শ্যানিন জানতে পারলো, ফ্লিন্ট প্রতিরাতে শ্যানিনের খাবারে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিতো। তারপর শ্যানিন ঘুমানোর পর ফ্লিন্ট নিজের কাজ হাসিল করতো এবং সবকিছু ভিডিও করে রাখতো। শ্যানিন সেদিন অনেক কেঁদেছিল সে। ফ্লিন্ট শ্যানিনের কনসিভ করার কথা শুনে খুশি হয়নি বরং রেগে গিয়েছিল।হুমকি দিয়েছিল যদি শ্যানিন বাচ্চা নষ্ট না করে তাহলে ফ্লিন্ট তাদের সব ভিডিও ওয়েবসাইটে ওপেন করে দিবে। শ্যানিন হুমকিতে একদম ভয় পায়নি। সম্মান, ভালোবাসা, ভরসা, সব তো আগেই চলে গেছে। নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ কেড়ে নিয়ে খুনী সে কিছুতেই হয়নি। ফ্লিন্ট ভয়ে ছিল। এই বাচ্চা তার কুকর্মের ফল। যদি এই বাচ্চার দায়িত্ব নিতে হয়? সেই ভয়ে ফ্লিন্ট আবারও শ্যানিনের খাবারে ঔষধ মিশিয়ে বাচ্চা নষ্ট করে দেয়। পরদিন সকালেই শ্যানিনের মিসক্যারেজ হয়। তখন এমন একটা পরিস্থিতি ছিল যে শ্যানিন কাউকে কিছুই বলতে পারছিল না। সে ফ্লিন্টকে ছেড়েও যেতে পারছিল না আবার ফ্লিন্টের অত্যাচার সহ্য করে তার সঙ্গে থাকতেও পারছিল না। যদি শ্যানিন ফ্লিন্টের একটু অবাধ্য হতো তাহলেই ফ্লিন্ট হুমকি দিতো শ্যানিনের বাবা-মায়ের কাছে তাদের গোপন ভিডিও ফাঁস করে দিবে। ওইসব দেখলে তো বাবা নিশ্চিত মরে যাবে। শ্যানিনের একেকটা দিন ভয়ংকর দুঃসপ্নের মতো কাটছিল। ফ্লিন্টের চেয়ে নিকৃষ্ট আর ভয়ংকর মানুষ সে এই জগতে আর একটাও দেখেনি। ভালোবাসার মানুষের হঠাৎ এমন ভয়াবহ পরিবর্তনে শ্যানিনের জীবনটা নরক হয়ে গেছিল। ফ্লিন্ট শুধু শ্যানিনের সাথেই এতো নিষ্ঠুর ছিল তা কিন্তু না৷ সে বিদেশী সহজ-সরল আরও অনেক মেয়ের সাথে এ ধরণের গেইম খেলে। যাদের ব্লেকমেইল করা সম্ভব হয় না তাদেরকে মেরেও ফেলে। শ্যানিনের এইসব কাউকে না পারছিল বলতে আর না পারছিল সইতে। তারপর বাংলাদেশে ফিরে আসার একটা উপায় পেল। ইলহান অরিনের থেকে প্রাপ্ত ডিভোর্স পেপার নিয়ে যখন বাংলাদেশে ফিরে এলো তখন শ্যানিনকে কানাডা থেকে নিয়ে যেতে তার বড়ফুপু আর বড়ফুপুর হাসব্যান্ড এসেছিলেন। এদের সামনে ফ্লিন্ট আর শ্যানিনকে আটকে রাখতে পারেনি। শ্যানিন ভেবেছিল এইবার হয়তো সে বেঁচে যাবে। আর জীবনেও কানাডা ফিরে আসবে না। ফ্লিন্টের মুখ দেখবে না। বাড়ি ফিরে সবাইকে ফ্লিন্টের নৃশংসতার কাহিনি জানাতে নিয়েও পারেনি শ্যানিন। বাড়ির সবাই আগে থেকেই ইলহান-অরিনের ঝামেলা নিয়ে ডেস্পারেট। তাই নিজের ঝামেলার বোঝা নতুন করে পরিবারের উপর চাপিয়ে দিতে বিবেকে বাঁধছিল। দিনগুলো ভালো কাটছিল না শ্যানিনের। ভয়ংকর স্মৃতিগুলো মনে করে তার প্রতিরাতে গা শিউরে উঠতো। শারীরিক, মানসিক যত অত্যাচার সম্ভব সবই শ্যানিনের উপর করা হয়েছিল। আর শ্যানিন প্রতিবাদ করতে গেলেই অশালীন সেই ভিডিওগুলোর হুমকি দিয়ে থামিয়ে রাখা হয়েছিল তাকে। দিনগুলো খুব খারাপভাবে কাটছিল। কানাডায় থাকা অবস্থায় ফ্লিন্ট তাকে যত অত্যাচার করেছে বাংলাদেশে আসার পর সেই ভয়ংকর স্মৃতিগুলো তাকে মানসিকভাবে বিকারগস্ত করে ফেলছিল৷ তারপর একদিন হঠাৎ করেই ফ্লিন্ট বাংলাদেশে চলে এলো। শ্যানিনকে বলল দেখা করতে। কিন্তু শ্যানিন কিছুতেই যাবে না। তখন আবার সেই হুমকি। শ্যানিন এইবার সহ্য করতে না বাধ্য হলো নুসাইবাকে সবকিছু জানাতে। গভীর রাতে যখন বাবা ঘুমন্ত, পরিবেশ নীরব, তখন শ্যানিন মাকে নিজের রুমে ডেকে এনে সবকিছু জানাল। নুসাইবা এইসব শুনে রাগে-দুঃখে শ্যানিনকেই মারলেন। সে কেনো একটা অপরিচিত ছেলের সাথে ফ্ল্যাটে উঠতে গিয়েছিল? কেনো একটা খ্রিস্টান ছেলেকে ভালোবাসতে গেল সে? একদিকে নিজের ছেলের পাগলের মতো অবস্থা অন্যদিকে মেয়েটার এমন জঘন্য কাহিনি। সব মিলিয়ে নুসাইবা পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন। মা-মেয়ে কেউই সেদিন খেয়াল করেনি শ্যানিনের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ইলহান সবকিছু শুনেছিল। এর কয়েকদিন পরেই ফ্লিন্টের ভয়াবহ মৃত্যুর খবর পায় শ্যানিন। ফ্লিন্ট বাংলাদেশে এসে যেই হোটেলে উঠেছিল সেই হোটেলের ছাদের সুইমিং পুলে ফ্লিন্টের হাত-পা, আর মাথা সবকিছু আলাদাভাবে ভাসতে দেখা যায়। এইরকম নৃশংস খুন ইলহান কিভাবে করেছিল সেটা এখনও রহস্য। কিন্তু খুন করার পর সে নিজেই পুলিশের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। ঘটনা নিয়ে তদন্ত। ইলহানই খুনী সেটা প্রমাণিত হয়। যদিও শ্যানিনদের পক্ষের উকিল মানে আমানত সাহেব অনেক চেষ্টা করেছিলেন ইলহানকে যে কোনো মূল্যে বাঁচিয়ে দিতে। এজন্য অসদুপায়ও অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যেখানে ইলহান নিজেই ফ্লিন্টকে খুন করার লোমহর্ষক বর্ণনা স্বচ্ছ ও পুঙ্খানুপঙ্খভাবে পুলিশের কাছে স্বীকার করে ফেলেছে সেখানে আর কারোই তেমন কিছু করার থাকে না। এখন ইলহানের ফাঁসি মওকুফের একটাই উপায়। তাকে পাগল প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু মানসিকভাবে দূর্বল একজন মানুষ কখনও এতো ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে কাউকে সুনিপুণভাবে খুন করতে পারে না। তাই ইলহানকে মানসিকভাবে অসুস্থ প্রমাণ করতে চাওয়ার ব্যাপারটা নিতান্তই হাস্যকর।
শ্যানিনের রুম থেকে বেরিয়ে অরিন দোতলার ছাদে এসে দাঁড়ালো। এটুকু রাস্তা আসতেই তার প্রায় দশমিনিট লেগে গেল। পা চলছে না। সবকিছু কেমন যেনো লাগছে। এতো করুণ কাহিনী শোনার পর সে শ্যানিনকে একটা সান্ত্বনা বাক্য পর্যন্ত শোনাতে পারল না। তার নিজেরই এখন সবচেয়ে বেশি সান্ত্বনার প্রয়োজন! ছাদের এক কোণায় কারো কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অরিন এগিয়ে দেখল মিহরীমা আর সুমনা চেয়ারে বসে আছে। সুমনা কাঁদছে আর মিহরীমা দেখছে। অরিনের নিজেকে সামলাতে সময় লাগলো৷ বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর অরিন হঠাৎ ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল,” সুমনা কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
সুমনা জবাব দিল না। মিহরীমা বলল,” ভাইয়া সুমু আপুকে ধমক দিয়েছে।”
অরিন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করল,” ভাইয়া মানে? অর্ণভ ভাইয়া?”
মিহরীমা হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল। অরিন আবার জিজ্ঞেস করল,” কেনো?”
মিহরীমা মিনমিন করে বলল,” তোমার জন্যই তো..”
” আমার জন্য মানে?”
” তোমাকে ইলহান ভাইয়ার ফাঁসির ব্যাপারে সুমনা আপু বলেছিল তাই..”
সাথে সাথে সুমনা মিহরীমাকে চুপ করিয়ে দিল। তারপর ধরে নিচে নিয়ে গেল। অরিন দাঁড়িয়ে রইল একলা। তার শাড়ির আঁচল, চুলের গোছা, ক্লান্ত দুপুরের আবছা বাতাসে উড়তে লাগল। নিচে তাকাতেই অরিন দেখল ইলহান আর সাদিকাকে। দুজন একটা সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। সাদিকাকে দাঁড় করানো হয়েছে সাইকেলের উপর। সে সাইকেলের উপর দাঁড়িয়ে ইলহানের অগোছালো চুলগুলো ঠিক করে দিচ্ছে। দু’জনের মুখভর্তি হাসি। সাদিকা হাসছে খিলখিল করে। পেটে হাত দিয়ে। মেয়েটাকে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে কেনো? ইলহানের হাসিটা অন্যরকম। এখন তার হাসির ধরণেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। ওহ, অরিন তো ভুলেই গেছিল। ইলহানের বয়স এখন ত্রিশের কাছাকাছি। পাঁচবছর আগে সে পঁচিশ বছরের ছন্নছাড়া, বেপরোয়া, চরিত্রহীন এক নিকৃষ্ট যুবক ছিল। যেই যুবকের আচরণ ছিল টিনেজারদের মতো। আর এখন সে ফাঁসির আসামী। তবুও তার ব্যক্তিত্বের ধারে অরিনের বিক্ষিপ্ত মন কেটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছে। অরিন নিচে নেমে আসলো। যেই জায়গায় সাদিকা আর ইলহান দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেই জায়গায়। সাদিকা অরিনকে হঠাৎ দেখে সাইকেল থেকে নেমে দৌড়ে আসলো। অরিন সাথে সাথে মেয়েকে কোলে নিয়ে গালে একটা চুমু দিল। ইলহান একটিবারের জন্যও ফিরে দেখল না। সাদিকা দৌড়ে আসার সময় বলেছিল,” মাম্মাম এসেছে!” সুতরাং ইলহান জানে অরিন এসেছে। এজন্যই তাকাচ্ছে না। সাদিকা বলল,” জানো মাম্মাম, আমি আর ইলু পাহাড়ে বেড়াতে যাচ্ছি।”
” ইলু মানে?”
” মানে ইলহান। এতোবড় নাম আমার বলতে কষ্ট হয় না? তাই শুধু ইলু বলে ডাকি।”
” ছিঃ মা, বড়দের নাম ধরে ডাকতে হয় না। তুমি ইলু আঙ্কেল বলে ডাকতে পারো।”
” মাম্মাম তুমি কি আমাদের সাথে যাবে?”
অরিন হকচকিয়ে ইলহানের দিকে তাকালো। সাদিকা কোল থেকে নেমে দৌড়ে ইলহানের কাছে গিয়ে বলল,
” ইলু, ইলু, মাম্মামও যাবে প্লিজ।”
ইলহান সাদিকাকে কোলে নিয়ে সাইকেলের উপর রেখে বলল,” মাম্মাম যাবে না।”
এই প্রথম ইলহানের কণ্ঠস্বর শুনলো অরিন। এতো শীতল কেনো লাগছে? কেমন যেনো.. শুনলেই বুকে ধাক্কার মতো লাগে। সাদিকা মনখারাপ করে বলল,” কেনো যাবে না মাম্মাম?”
অরিন হঠাৎ বলে উঠলো,” আমিও যেতে চাই।”
ইলহান চমক লাগা দৃষ্টিতে অরিনের দিকে এমনভাবে তাকালো যে অরিন লজ্জা পেল কিছুটা। সাদিকা খুশিতে দুইহাতে তালি বাজিয়ে লাফাতে লাগল,” ইয়ে,ইয়ে, মাম্মাম যাবে, ইলু যাবে। আমরা সবাই মিলে যাবো।”
ইলহান একদৃষ্টে তাকিয়েই রইল অরিনের দিকে। দুচোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে। অরিন সেই দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সাইকেলের পেছনে উঠে বসলো। সাদিকা বলল,” আমি সামনে বসবো। আর ইলু মাঝখানে। মাম্মাম, তুমি পেছন থেকে ইলুকে ধরে রেখো। সামনে থেকে আমি ধরে রাখবো। নাহলে কিন্তু আমরা দু’জনেই পড়ে যাবো। জানো মাম্মাম, পাহাড়ের রাস্তা অনেক যিগয্যাগ(আঁকাবাঁকা)। ”
অরিন আড়চোখে ইলহানের দিকে তাকালো।
চলবে