রংধনুর_রঙ_কালো,২৭,২৮
Sidratul Muntaz
২৭
সোফিয়া টুয়ার্ডকে সামনে দাঁড় করিয়ে পনেরোশোবার স্কিপিং করাচ্ছে। এটা তার পানিশমেন্ট। যদি তার পা কোনোভাবে স্কিপিং করার সময় দড়িতে বেজে যায় তাহলে যতবার বাজবে ততবার পায়ে স্টিকের বারি খেতে হবে। সোফিয়া হাতে স্টিক নিয়ে অপেক্ষা করছে। তার নজর টুয়ার্ডের পায়ের দিকে। হাতের স্টিকটি সোফিয়া ধীরে ধীরে নাড়াচ্ছে। টুয়ার্ড ক্লান্ত এবং ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,” ম্যাম, শাস্তি কি কিছুটা কমানো যায় না? আমি তো মরে যাবো।”
সোফিয়া চোখ পাকিয়ে তাকালো। টুয়ার্ড আতঙ্কে আরও জোরে স্কিপিং শুরু করলো। এরই মাঝে সে কমপক্ষে দশ বার স্টিকের বাড়ি খেয়েছে পায়ে। আর বারি খাওয়ার ইচ্ছে নেই। পা ব্যথায় টনটন করছে। সোফিয়ার মাথা আজকে খুবই গরম। সে কপট মেজাজ নিয়ে বসে রয়েছে চেয়ারে। টুয়ার্ড জিজ্ঞেস করলো,” ম্যাম আমি কি জানতে পারি আমাকে এমন শাস্তি দেওয়ার কারণটা কি?”
সোফিয়ার জ্বলন্ত দৃষ্টি পড়লো টুয়ার্ডের উপর। এতো বড় অপরাধ করেও গাঁধা আবার জিজ্ঞেস করছে তাকে শাস্তি দেওয়ার কারণ কি? সোফিয়া চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,” বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমি তোমাকে বার-বার নিষেধ করেছিলাম। আমি যে সকালে স্কিপিং করি, সন্ধ্যায় ড্রিংক করি এসব যাতে কোনোভাবে ইলহানের কানে না যায়। তবুও তুমি এতোবড় ভুল কিভাবে করলে?”
” মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে ম্যাম। তাছাড়া এগুলো তো আপনার প্রতিদিনের অভ্যাস। আমি তো ভেবেছি স্যার এসব নরমালি জানেন।”
” তবুও আমি যখন নিষেধ করেছি, তোমার অবশ্যই বোঝা উচিৎ ছিল যে এর পেছনে কোনো কারণ আছে।”
” সেটা আমি পরে বুঝতে পেরেছি ম্যাম। স্যার আপনাকে প্রেগন্যান্ট জানেন। পরে তো আমি ব্যাপারটা ম্যানেজও করে ফেলেছি। ”
” কিছুই ম্যানেজ করতে পারোনি তুমি। ইলহান ঠিকই আমাকে সন্দেহ করেছে। এই জন্য যদি আমাদের বিয়েতে কোনো প্রবলেম হয় তাহলে আমি তোমাকে ছাড়বো না টুয়ার্ড! আই উইল কিল ইউ!”
” ম্যাম, স্যরি ম্যাম!”
” শাট আপ। তুমি আজ পর্যন্ত আমার কোনো অর্ডার ঠিকমতো শেষ করতে পারোনি। তুমি একটা গুড ফর নাথিং! বেংলাডেশে যখন তোমাকে পাঠিয়েছিলাম অরিনকে মার্ডার করার জন্য তখনও তুমি অনেক গোল-মাল করেছো। বার-বার ধরা খেয়েছো ব্যারিস্টার অন্বয়ের কাছে। তিনি তো আরেকটু হলেই আমাদের ধরে ফেলতেন। ভাগ্যিস আমি বুদ্ধি করে সবকিছু ইলহানের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম। তাই তিনি ইলহানকে সন্দেহ করেছেন। নয়তো এতোদিনে সবকিছু অন্যরকম হয়ে যেতো। ইলহান সব জেনে ফেলতো। সেদিন কফিশপে অন্বয়ের সাথে দেখা হওয়ার পর সে একটু ভয় দেখাতেই তুমি আমার ব্যাপারে সবকিছু বলে দিলে। তোমার এই গাঁধার মতো বুদ্ধির জন্য আমি সবসময় বিপদে পড়তে যাই। আজকে তোমাকে এই পানিশমেন্ট দিচ্ছি যাতে আর কখনও গাঁধামী করার আগে এই কথা মনে পড়ে। বুঝেছো ইডিয়েট!”
সোফিয়া তার কথা শেষ করে দম ফেলার আগেই শুনতে পেল ইলহানের কণ্ঠ, ” সোফিয়া!”
সোফিয়া তাকিয়ে দেখলো ইলহান ঠিক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি প্রশ্নবিদ্ধ। সোফিয়ার কপালের একপাশ থেকে ঘামের বিন্দু গড়িয়ে পড়লো। ইলহান নক না করেই বাড়ির ভেতরে কিভাবে চলে এসেছে? তারপর হঠাৎ সোফিয়ার মনে পড়লো, সে তার বাড়ির মেইন গেইটের চাবি সবসময় বাগানের ফ্লাওয়ার প্ল্যান্টের নিচে রাখে। এটা ইলহান জানে। সোফিয়া ঢোক গিলতে লাগলো অনবরত। ইলহান ধীরপায়ে হেঁটে এলো সোফিয়ার কাছে। তার দুইচোখে বিস্ময়ের ভার। টুয়ার্ড এতোক্ষণে লাফানো থামিয়ে দিয়েছে। হাঁপিয়ে উঠা অবস্থায় বললো,” ম্যাম আমি কি চলে যাবো?”
সোফিয়া ইশারায় বললো চলে যেতে। টুয়ার্ড চলে গেল। আর ইলহান দাঁড়িয়ে রইল সোফিয়ার মুখোমুখি, অনেকগুলো কৌতুহল নিয়ে। সোফিয়ার ভয় শেষ হয় না। ইলহান কি তার সব কথা শুনে ফেলেছে? মনে হচ্ছে শুনেনি। কারণ যদি সে আসলেই শুনতো তাহলে এতোক্ষণ সোফিয়া এইখানে সুরক্ষিতভাবে বসে থাকতে পারতো না। সোফিয়া দাঁড়িয়ে বললো,” হঠাৎ এই সময় এলে? বসো!”
ইলহান আরাম করে সোফায় বসলো। পায়ের উপর পা তুলে দিল। সোফিয়া আরও নিশ্চিন্ত হলো এখন। ইলহানের বসার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে কিছুই শোনেনি। ধেন্দা একটা! সোফিয়ার হৃদয়ে স্বস্তির বর্ষণ বয়ে গেল। এই কয়েক মুহুর্তেই কত তটস্থ হয়ে পড়েছিল সে। ইলহান অতিরিক্ত শান্ত কণ্ঠে বললো, ” পানি আছে সোফিয়া?”
” অবশ্যই আছে। থাকবে না কেনো? এখনি আনছি দাঁড়াও।”
সোফিয়া রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে গাঁয়ের ঘাম মুছে নিল। পানি এনে দেওয়ার পর ইলহান বললো,” আমাকে না৷ পানিটা তুমি নিজে খাও। কারণ তোমার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে৷ গলাও নিশ্চয়ই শুকনো! আগে পানি খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নাও। ”
সোফিয়ার গলা এতোক্ষণ শুকনো ছিল না। কিন্তু এই কথায় শুকিয়ে গেল। মাত্রাতিরিক্ত আতঙ্কে কণ্ঠও থেমে গেল। ইলহান তড়াক করে দাঁড়িয়ে সোফিয়ার চোয়াল চেপে ধরে বললো, ” বাচ্চা নিয়ে এতোবড় মিথ্যে! আমাকে আবার ধোঁকা দিতে যাচ্ছিলে তুমি! অরিনকে খুন করার জন্য টুয়ার্ডকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলে! তুমি এতো শয়তান সোফিয়া? ”
অন্যহাত দিয়ে থাবা মেরে সোফিয়ার ডানহাত চেপে ধরলো ইলহান। আরও হিংস্র হয়ে বললো,” চাইলে এখনি তোমাকে মেরে ফেলতে পারি। তারপর সেই খুনের দায় টুয়ার্ডের উপর চাপিয়ে দেওয়াও আমার জন্য কোনো ব্যাপার না। কেইসটা এমন হতে পারে, অতিরিক্ত শারীরিক অত্যাচার টলরেট করতে না পেরে রাগে,ক্ষোভে তোমারই পারসোনাল এসিসট্যান্ট তোমাকে খুন করেছে! ব্যস, দু’জনেরই শাস্তি হয়ে গেল!”
সোফিয়া মুখ খোলার জন্য কাতরাচ্ছে। সে কিছু বলতে চায়। ইলহান বললো,” নো মোর ওয়ার্ডস। আমি তোমার কাছে আর কিছু শুনতে চাই না। অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে আমার। আগে সেই ক্ষতিগুলো পূরণ করতে হবে। জীবনের আসল হিসাব চোকাতে হবে। তারপর তোমাকে আমি দেখে নিবো।”
ইলহান ধাক্কা মেরে সোফিয়াকে ছাড়লো। মিনি টেবিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে প্রায় সবকিছু নিয়ে ফ্লোরে উল্টে পড়লো সোফিয়া। কাঁচের গ্লাস ভেঙে তার হাত দিয়ে ঢুকে গেল। হাতের রক্ত, চোখের অশ্রু সব একসাথে বইছে তার। ইলহান চলে যাচ্ছে ক্ষীপ্রগতিতে। সোফিয়া তীব্র ক্রোধ নিয়ে বললো,” একটা ফালতু, কুচকুচে কালো মেয়ের জন্য তুমি আমাকে…”
সোফিয়া বাক্য সম্পূর্ণ করার আগেই ইলহান প্রচন্ড শব্দে গর্জে উঠলো,” স্টপ শ্যামিং হার! শী ইজ মাই ব্ল্যাক ডায়মন্ড। এন্ড ইউ আর আ বিচ!”
অপমানে রুষ্ট সোফিয়া তেজী গলায় বলতে লাগলো,” অরিনকে তুমি কোনোদিন পাবে না ইলহান। সে আর কখনও তোমার কাছে আসবে না। আর যদি আসে, তাহলে ওই মুহুর্তেই আমি ওকে শেষ করে দিবো! আমি বেঁচে থাকতে তুমি অন্যকারো কখনও হতে পারবে না। ”
সোফিয়ার শেষ কথাগুলো ইলহান আদৌ ভালো করে শুনলো কি-না বোঝা গেল না। সে দরজা খুলে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। ইলহানের আগেই বোঝা উচিৎ ছিল, সোফিয়ার মতো মেয়ে কখনও তার বাচ্চার মা হতে পারে না। যে অরিনকে মেরে ফেলার মতো নিকৃষ্ট পরিকল্পনা করতে পারে তার কাছে নিষ্পাপ বাচ্চা নিয়ে মিথ্যে বলা তো কোনো ব্যাপারই না! ইলহানের ভীষণ আফসোস হচ্ছে। একটা মিথ্যে ঘটনার জন্য কতবড় ভুল হয়ে যাচ্ছিল তার জীবনে। সে অরিনকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিল। ভাগ্যিস ডিভোর্সের আগেই সে সব জানতে পেরেছে! নয়তো সারাজীবন সীমাহীন আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে থাকতে হতো। ইলহানের মনের মধ্যে এখনও আশা আছে অরিনকে ফিরে পাওয়ার। যে করেই হোক সে অরিনকে আবার তার জীবনে ফিরিয়ে আনবে। আনবেই!
চলবে
#রংধনুর_রঙ_কালো
২৮.
রাত আটটায় অরিন অন্বয়ের দরজায় এসে খুব জোরে করাঘাত করতে লাগলো। অন্বয় মাত্র গোসল করে বের হয়েছে। তার একটা বদভ্যাস হলো সে রাতের বেলা গোসল করে। দরজা খুলতেই বিচলিত অরিন এক নিঃশ্বাসে বললো,” অম্বয়সাহেব, ইলহান একটু আগে আমাকে ফোন করে বলেছে ডিভোর্সের আগে ও আমার সাথে একবার দেখা করতে চায়৷ ওর নাকি খুব জরুরী কথা বলার আছে। ওর কথা বলার ধরণ শুনেই আমি বুঝে গেছি যে ও আসলে কি বলতে চায়। ও মনে হয় সোফিয়ার প্রেগ্ন্যাসি নিয়ে মিথ্যে বলার ব্যাপারটা জেনে গেছে। কারণ এয়ারপোর্ট থেকেই ও এই বিষয়ে সন্দেহ করছিল। আমি তখনই বুঝেছি যে ও হয়তো সব জেনে যাবে। এখন আমি ওর কাছে গেলে ও নিশ্চয়ই আবার আগের মতো শুরু করবে,ক্ষমা চাইবে, আমাকে আটকে রাখতে চাইবে আর ডিভোর্স তো জীবনেও দিবে না। আমার কি করা উচিৎ অন্বয়সাহেব? আমি কি যাবো?”
অন্বয় এতোকিছু শুনে নিরব হয়ে গেল। কতক্ষণ চেয়ে থেকে হাসার ভঙ্গি করে বললো,” এটা একান্তই আপনার সিদ্ধান্ত মিসেস অরিন। আমি এখানে কি বলতে পারি? আপনার যদি ইচ্ছে করে যেতে তাহলে আপনি অবশ্যই যাবেন!”
” কিন্তু যাওয়াটা কি ঠিক হবে? ওকে ক্ষমা করা কি ঠিক?”
” এটাও আপনি জানেন। আপনার হাসব্যান্ড, আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এখন আপনার যদি ইচ্ছে করে ক্ষমা করতে তাহলে করবেন?”
” ওর অপরাধটা কি আসলেই ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য?”
” এটা বড় কথা না। বড় কথা হচ্ছে আপনার মন কি চায়?”
অরিন বিরবির করে বললো,
“না,না, আমি তো ওকে ক্ষমা করতে চাই না।”
অন্বয় মনে মনে হাসলো এবং বললো,” আপনি অবশ্যই তাকে ক্ষমা করতে চান মিসেস অরিন৷ এজন্যই এতো কনফিউজড হয়ে পড়েছেন। আপনি ইলহান মাহদীর উপর এখনও ততটাই দূর্বল। যতটা প্রথমে ছিলেন। তাই তো তার একটা ফোন আপনার সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে।”
অরিন নিচে তাকিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো বললো,” আমি বুঝতে পারছি না কি করবো? আমার ওর সাথে দেখা করতে ভয় লাগছে।”
ভয়ের কারণটাও অন্বয় জানে। ইলহানের আকুতি শুনে দূর্বল হওয়ার ভয়৷ তাকে ফিরিয়ে দিতে না পারার ভয়। অরিন নিজেও মনে মনে জানে, ইলহান কখনও ঠিক হবে না। তবুও তার প্রতি দূর্বল হওয়ার এতো কিসের ভয়? অরিন বললো,” অন্বয়সাহেব, আপনিও আমার সাথে চলুন।”
” এটা কিভাবে হয়? আপনি আমাকে আবারও মার খাওয়াতে চান?”
অরিন জীভ কেটে বললো,” আই এম স্যরি। কিন্তু আমার মনে হয় ও এখন আপনাকে আর কিছু করবে না।”
” তবুও আপনাদের হাসব্যান্ড-ওয়াইফের পারসোনাল ব্যাপারে আমি ঢুকতে চাই না।”
” ঠিকাছে, তাহলে আমি একাই যাচ্ছি।”
অরিন যেভাবে এসেছিল সেভাবেই দৌড়ে চলে গেল। অন্বয়ের উত্তরের জন্য অপেক্ষাও করলো না। অরিনকে দেখে মনে হলো, সে শুধু এই দিনটার জন্যই অপেক্ষাতে ছিল। অন্বয় জানে না কি হতে চলেছে। কিন্তু তার হৃদয়ের যন্ত্রণা ক্রমশ এমনভাবে বাড়ছে যেমন অক্সিজেনের উপস্থিতিতে জ্বলন্ত আগুনের উত্তাপ দাউ দাউ করে বাড়ে।
অরিন ফিরে এলো রাত এগারোটায়। অন্বয় তখনও জাগ্রত অবস্থায় অরিনের অপেক্ষা করছে। সে ভেবেছিল অরিন আসবে না। হয়তো কিছু জানাবেও না। ইলহানের সাথে চলে যাবে। এরপরদিন হয়তো ফোন করে বলবে, ” সব ক্যান্সেল অন্বয়সাহেব। আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিচ্ছি না। আমাদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে। আপনাকে বাসায় দাওয়াত রইল৷ এসে আমাদের নতুন করে সাজানো সংসার দেখে যাবেন।”
সেরকম কিছুই হলো না। অরিন ফিরে এসে কাঁদতে কাঁদতে বললো,” আমি পারিনি অন্বয়সাহেব। তাকে আমি ক্ষমা করতে পারিনি। সে খুব কাঁদছিল জানেন। ওইভাবে কাঁদতে আমি তাকে কখনও দেখিনি।”
কথা বলতে বলতে অরিন হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। দুইহাতে মাথা চেপে ধরলো। অন্বয় জিজ্ঞেস করলো,” তাহলে এখন আপনি কেনো কাঁদছেন? তাকে ক্ষমা করতে পারেননি বলে? নাকি তাকে আগে কখনও কাঁদতে দেখেননি বলে?”
” জানি না। আমি জানি না আমি কেনো কাঁদছি। শুধু জানি, সে যখন আমাকে হাত ধরে বললো আবার নতুন করে সব শুরু করবে, আমাকে আর কখনও কষ্ট দিবে না, সে ভালো হয়ে যাবে, সে তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত! তখন আমি ভেতর থেকে একটুও তাগিদ অনুভব করিনি তার সাথে যাওয়ার। আমার মন একবারও সায় দেয়নি তাকে ক্ষমা করতে। আমার শুধু কি মনে হচ্ছিল জানেন? যতক্ষণ আমি তাকে ক্ষমা না করবো ততক্ষণ সে ক্ষমা চাইতে থাকবে। আর ক্ষমা পেয়ে যাওয়ার পর আবারও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধগুলো করবে। এক কথায় আমি তাকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না অন্বয়সাহেব। কিন্তু আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে।”
” বিশ্বাস করতে পারছেন না এজন্যই কি কষ্ট হচ্ছে?”
” হয়তো।”
” আপনি কি তাকে বিশ্বাস করতে চান?”
” নিশ্চয়ই চাই।”
” বিশ্বাস করতে পারলেই কি ক্ষমা করতে পারবেন?”
অরিন এবার কান্নায় বিরতি দিয়ে ভ্রু কুচকালো। কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললো,” তা জানি না। আমি নিজেকেই নিজে বুঝতে পারছি না এখন। আমি জানি না আমার কেমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ। ”
অন্বয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” জীবনের এমন কিছু সিদ্ধান্তগুলো খুব ভেবে-চিন্তে নিতে হয়। নাহলে একটা সময় গিয়ে খুব আফসোস করতে হবে। ”
” আমি কি করবো অন্বয়সাহেব?”
” আমি বলবো না। আপনি নিজেই খুঁজে বের করুন। ইলহান মাহদীকে ক্ষমা করতে আপনার বিবেকে বাঁধছে। তাকে ফিরিয়ে দিতে আপনার মনে বাঁধছে। আবেগ আর বিবেকের এই লড়াইয়ে কার জোর বেশি দেখা যাক!”
অরিন কিছু বললো না। চুপচাপ কাঁদতে লাগলো। অন্বয় জিজ্ঞেস করলো,” ইলহান মাহদী আপনাকে এভাবেই ছেড়ে দিলেন? আপনি তাকে কিছু বলে আসেননি? মানে কোনো সিদ্ধান্ত? ”
” আমি তাকে বলেছি আমার সময় প্রয়োজন। আমি তাকে ভেবে বলবো, তাকে সুযোগ দেওয়া যায় কি যায় না? যদি আমার উত্তর ‘না’ হয় তাহলে ডিভোর্স পেপার ওর বাসায় চলে যাবে। ও ডিভোর্স দিক আর না দিক আমাকে কখনও আর পাবে না। কিন্তু যদি উত্তর ‘ হ্যা’ হয় তাহলে সবার আগে তাকে বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। নিজের অপরাধ সবার কাছে স্বীকার করবে। আমার কাছে যেভাবে ও ক্ষমা চেয়েছে সবার কাছে একইভাবে ক্ষমা চাইবে। তখন যদি সবাই ওকে ক্ষমা করতে রাজি হয়, আমিও ওকে ক্ষমা করবো। নয়তো কোনোদিন না।”
অন্বয় মনে মনে অদ্ভুত শান্তি পেল। মিসেস অরিন নিঃসন্দেহে বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতী৷ কিন্তু একটা ছোট্ট সমস্যা হলো, স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসার পরিমাণ অনেক বেশি। এইভাবে কাউকে ভালোবাসতে নেই৷ কক্ষনো ভালোবাসতে নেই।
অন্বয় সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগেই অরিনের রুমের দরজায় এসে কড়া নাড়লো। অরিন প্রায় সাথে সাথেই দরজাটা খুললো। তার চোখ-মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, সারারাত ঘুমায়নি। মেয়েটা কঠিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। অন্বয় ভেতরে আসার অনুমতি চাইলো। অরিন দরজা থেকে সরে বিছানায় বসলো। অন্বয় ঘরে ঢুকে বললো,” কি অবস্থা? কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন?”
অরিন শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। জবাব দিল না প্রশ্নের। যেনো শুনতেই পায়নি। অন্বয় বললো,” আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। মাথায় একটা পরিকল্পনা ঘুরছে। আমার মনে হয় এর মাধ্যমে আপনার সকল কনফিউশান দূর হয়ে যাবে। আপনি নির্দ্বিধায় সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।”
অরিন চকিতে চোখ তুলে তাকালো। কিছুটা আবেগকম্পিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,” কেমন পরিকল্পনা? ”
” আপনি ইলহান মাহদীকে শেষ একটা সুযোগ দিবেন। ”
অরিন কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই অন্বয় তাকে থামিয়ে বললো,” আগে শুনুন, আপনি যদি তাকে শেষ একটা সুযোগ না দেন তাহলে সারাজীবন আফসোস হতে পারে। আপনার আবেগাক্রান্ত মন সারাক্ষণ আপনাকে জ্বালাবে এই বলে যে, শেষমেষ ইলহান হয়তো শুধরে যেতো। নতুন করে আপনাদের সুখের জীবন শুরু হতে পারতো। শুধু একটা শেষ সুযোগের অভাবে তা হয়নি। ডিভোর্সের পর এই চিন্তা আপনার মনে আসতেই পারে। তখন সেটা হবে খুব যন্ত্রণার। তাই আমি বলছি, শেষ একটা সুযোগ দিন তাকে। যেনো এই নিয়ে কখনও আফসোস করতে না হয়। নিজের কাছে সন্তুষ্ট থাকবেন যে আপনি তো শেষ সুযোগ দিয়েছিলেন কিন্তু ইলহান শুধরায়নি।”
” আর যদি শেষ সুযোগ দেওয়ার পর আবারও প্রতারিত হই? সেই আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা আমার আর নেই!”
” সেটার সলিউশন আমি বের করেছি। এখন আপনি আমার প্রস্তাবে রাজি হলেই হলো।”
অন্বয়ের প্রস্তাব একদমই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। অরিন রাজি হতে বাধ্য ছিল। কারণ এছাড়া অন্যকোনো পথ সে খুঁজে পাচ্ছিল না। অরিন ইলহানকে ফোন করে জানিয়ে দিল, সে ইলহানকে শেষ সুযোগ দিবে। কিন্তু এটাই তার শেষ সুযোগ। সত্যি, সত্যি শেষ সুযোগ!
চলবে