জীবন সায়াহ্নে,পর্ব_১

জীবন সায়াহ্নে,পর্ব_১
মারজানা হোসেন রোজী

-আর বলিস না! আমার শাশুড়ি এই বুড়ি বয়সে বিয়ে করতে চাচ্ছেন! এই বয়সে প্রেমে পড়েছেন উনি! সমাজে মান ইজ্জত আমাদের আর কিছুই থাকবে না। কামাল তো লজ্জায় আমার সামনেই মুখ দেখাতে পারছে না এমন অবস্থা । এই ঘটনা ঘটলে বুঝতে পারিস যে কামালের স্ট্যাটাসটা কোথায় নামবে! তার উপর আমাদের ছেলেমেয়েরাও বড় হয়েছে! ওদেরকেও বাইরে মুখ দেখাতে হয়, তাই না! আমি বুঝি না এই বয়সে ওনার মাথায় বিয়ে করার শখ জেগেছে কেন ! বলল, বিপাশা!

বিপাশার বান্ধবী তমার বাসাতে ওরা কয়েক বান্ধবী মিলে একটা কিটি পার্টির আয়োজন করেছে। এরকম প্রতিমাসেই কারো না কারো বাসায় এ ধরনের পার্টির আয়োজন করে । গত মাসে বিপাশার বাসাতেই প্রোগ্রাম ছিল।

– আচ্ছা, ব্যাপার কি খুলে বল দেখি, বিপাশা ! তোর শাশুড়ির বয়স কত হবে?

– ষাট পয়ষট্টি মেই বি!

– ও মাই গড! এই বয়সে উনি বিয়ে করতে যাচ্ছেন? তোর শ্বশুর মারা গিয়েছিলেন কত বছর আগে?

– অনেক বছর । কামাল সম্ভবত এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছে যে বছর, সেই বছরে।

– সে তো তাহলে অনেক বছর আগের কথা। যেহেতু উনি তখন বিয়ে করেননি এখন বিয়ে করার পাঁয়তারা করছেন কেন?

– কী জানি! মানুষের চরিত্র চেঞ্জ হতে তো আর সময় লাগে না! তাছাড়া ওনার চরিত্রে আগে থেকেই সমস্যা আছে। তোদের তো বলাই হয়নি! আমার শাশুড়ি তো যুদ্ধের সময়ে অনেকদিন সেনাক্যাম্পে ছিল।

– কি বলিস!

– হুম। মাসের পর মাস ক্যাম্পের উনাদের মনোরঞ্জন করে তারপরে ফিরেছে বাড়িতে।

– বলিস কিরে! তোর শাশুড়ি তো তাইলে বীরাঙ্গনা!

– বীরাঙ্গণা না ছাই! ইচ্ছে করেই নাকি গিয়েছিল! নষ্টা মহিলা! আমার মা তো ওই মহিলাকে দেখলেও পাঁচবার অজু করে!

– আচ্ছা, আরেকটা ব্যাপার বলতো! ওই বুড়ি মহিলাকে এই বয়সে কে বিয়ে করবে? দেশে কি পাত্রীর অভাব পড়েছে?

– ওনার মতো আরেক বুড়ো! এখন তো একদম লটর পটর প্রেম চলছে বুড়োটার সাথে! আমি বাসায় থাকি না এই সুযোগে আমার বাসাটাকে সরাইখানা বানিয়ে ফেলেছে! যখন যা মন চায় রান্না করে নিয়ে ওই বুড়োটাকে খাওয়ায়। সুযোগ পেলে বুড়োটাকে বাসায়ও আনে। আরো কী করে না করে খবর আছে! এবার বুঝেছিস আমি বাইরে থাকলে ওনার কত সুবিধা। বাসার চাল, ডাল, তেল, নুন কোনো কিছুর হিসেব তো আর আমি নেই না।

– তুই সহ্য করছিস কি করে এসব?

– আর বলিস না!

– কামাল ভাই কিছু বলে না তার মাকে?

– কী বলবে? ও কোনো কালে কোনো কিছু বলতে পারে ওর মাকে!

– না বিয়ের বিষয়ে উনি কি বলেন? উনি কি সত্যিই উনার মাকে বিয়ে দিবেন?

– উনি বিয়ে দেওয়া বা না দেওয়ার কে? যার লাইফ সে ডিসিশন নিয়েছে।

– কিন্তু তাই বলে এমন একটা ব্যাপারে উনি উনার মাকে কিছুই বলবে না! এক কাজ কর তুই তোর দেবরের সাথে যোগাযোগ কর!

– দেবরকে জানিয়েছি। তার মা বিয়ে করলে তার কি! ওদের কী কোন সমাজ নামাজ আছে? নিজেই তো একটা বেহায়া নির্লজ্জ! সাদা চামড়ার মেয়ে বিয়ে করে ইতালিতে থেকে গেল! দেশে তার মা কি আকাম করছে না কুকাম করছে এগুলো নিয়ে মাথাব্যাথা কই তার! সব জঞ্জাল জুটেছে আমার ঘাড়ে। বাদ দে তো! খুব টেনশনে আছি।

– টেনশনেতো থাকবিই। তোর শাশুড়ির বিয়ে হয়ে গেলে তোর সংসারের অবস্থাতো ছন্নছাড়া হয়ে যাবে। পাখির মত উড়ে উড়ে ফুরুত ফুরুত এখানে সেখানে যেতে পারবি না। এখন তো সারাদিন যেখানেই থাকিস, যখনই বাসায় পৌছাস রেডিমেড খাবার টেবিলে এসে হাজির। তোর প্লেটটা পর্যন্ত ধুয়ে ভাত খেতে হয় না।

– কি যে বলিস না, তমা! আজকাল টাকা থাকলে এসব নিয়ে ভাবনা করতে হয়। কথায় আছে না ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না। বিপাশার বরের টাকা আছে। চাইলে ডজনখানেক বুয়া রাখতে পারবে।
শুধু শুধু অযথা টেনশন করিস না তো, বিপাশা। তোর শাশুড়ি যেতে চাইলে যেতে দে। আমি তো মনে করি বরং সংসার থেকে একটা আপদ কমবে। ঘরের মধ্যে একটা বুড়ো পালা মানে একটা অযথা ঝামেলা। এখন তোর শাশুড়ির বল শক্তি আছে তোদেরকে রান্নাবান্না করে খাওয়াচ্ছে। কদিন পরে বিছানায় পড়লে তোকেই টানতে হবে ওনাকে। উনার একমাত্র ছেলের বউ তুই। আরেকটা তো বিদেশে থাকে। সে তো কোনদিন আসবেনা। তাই বলছি যেতে দে! এমন রেডিমেড খাবার টাকা হলে অনেক পাওয়া যাবে।

– দেখি কি করি! যেতে চাইলে তো আর আটকানো যাবে না! কিন্তু লোকের সামনে যে বদনাম হবে সেটাই ভাবছি! আচ্ছা যা, বাদ দে! এসব কথা ভাবলেই এখন মাথা ব্যথা করে। আমার শাশুড়ি এমন একটা বিশ্রী মহিলা। ছিঃ এরকম বেহায়া, নির্লজ্জ মহিলা আমি জীবনেও দেখিনি। কথাগুলি খুব বিরক্তির সাথে বলল, বিপাশা।

– পাশ থেকে ইলোরা বলে উঠল, তোর শাশুড়িকে কিন্তু আমার কাছে তেমন খারাপ মনে হয়নি। কত সুন্দর সেদিন আমাদের সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলল! আমার শাশুড়ি হলে তো মুখ গোমড়া করেই বসে থাকত। আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব বাসায় এসেছে দেখলে উনার মুখের দিকেই তাকানো যায় না।

– শোন, ইলোরা! অন্যের শাশুড়িকে ভালোই মনে হয়! এই যেমন তোর শাশুড়িকেও কিন্তু আমার কাছে ভালোই লাগে, ঠিক তেমনই! মুখ গোমরা করে থাকাই ভালো। হেসে হেসে মানুষের সাথে রসের আলাপ করার চাইতে এটাই বরং বেটার। একটু হেসে কথা বলেছে অমনি তোর উনাকে খুব ভালো মনে হলো। মহিলা এক নম্বরের লুচ্চা। মহিলার এই বুড়ো বয়সেও বিয়ে করার ভীমরতিতে পেয়েছে। তাহলে বোঝ কত ভালো। অন্ততপক্ষে তোদের শাশুড়ি নিশ্চয়ই এই বুড়ো বয়সে নতুন করে সংসার পাতার চিন্তা করছে না।

– দেখলাম সংসারের সব কাজকর্ম একার হাতেই দেখাশোনা করে! তোর তো কোনো কিছু বলতে গেলে দেখতেই হয় না। কত সুন্দর নিশ্চিন্তে শাশুড়ির কাছে সংসার, ছেলেমেয়ে ফেলে রেখে তুই নিজের লাইফটাকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছিস। জব করছিস, যখন যেখানে মন চায় চলে যাচ্ছিস! ঘন্টার পর ঘন্টা পার্লারে কাটাচ্ছিস, তার উপর তোর শাশুড়ি তোর এসব নিয়ে কোনো প্রতিবাদও করছে না।

– প্রতিবাদ করবেই বা কেন? সে এমন স্বাধীনতা কোথায় পাবে? পুরো সংসারটা তার হাতে ফেলে রেখে আসি। সেও যখন যা খুশি তাই করতে পারছে। কেউ তো আর খাবার-দাবারেরও হিসাব নিচ্ছে না, কোথায় যাচ্ছে কি করছে তাও দেখছে না। আমি যত বাইরে বাইরে থাকছি ততই তো উনার সুবিধা।

মতিহার বানু সকাল থেকে কয়েকবার ফোন দিচ্ছেন ছেলেকে। ব্যস্ততার কারণে একবারও রিসিভ করার সময় হয়নি কামালের। হাতের কাজ বাজ সবকিছু শেষ করে সন্ধ্যার কিছু আগে মতিহার বানু আবার ফোন দিলেন কামালকে। এবার একবার ফোন বাজতেই রিসিভ করল কামাল।

– হ্যাঁ, মা! কি বলবে বলো!

– কিরে বাবা ফোন দিয়ে বিরক্ত করলাম মনে হয়!

– কি যে বল মা! কি বলবে দ্রুত বলো! আমার মিটিং আছে এখনই।

– হ্যা রে বাবা! আমাকে না ক্লিনিকে নিয়ে যাবার কথা আজ তোর! সাতটা বাজতে আর কিন্তু বেশি দেরী নেই। আজও কি এপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল করতে হবে, বল তো! এর আগেও দুটো দিন মিস করলি। সুগার লেভেল খুব বেড়েছে । এত নিয়মের মধ্যে চলি তারপরেও কেন যে এত বাড়ছে!

– ওহো! আজ তো আবার তোমার সিরিয়াল ছিল! ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা, বিপাশা ফেরেনি! ওকে নিয়ে যাও।

– একটা দীর্ঘশ্বাস গোপণ করে মতিহার বানু বলল, নাহ!

– তাইলে এক কাজ করি ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে পাঠিয়ে দেই। ওর সাথে চলে যেও।

– তুই যেতে পারবি না, তাইতো!

– বললামই তো, খুব ব্যস্ত!

– হুম। আচ্ছা। কাজ কর তুই। ডাক্তারের কাছে যাব না আজ আর। খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে না এখন আমার! পরে যাব না হয়।

– সমস্যা বেশি না? তাইলে ডাক্তারের জন্য পাগল হয়েছ কেনো!

আচ্ছা রাখছি। আর মা, রাতে কী রান্না করেছ?

– শুটকি ভুণা, মাসকলাইয়ের ডাল আর কুমড়ো বড়ি দিয়ে বেগুনের ঝোল।

– একটু গরুর বট রান্না করতে পারবা? খুব খেতে মন চাচ্ছে!

– বটতো ফ্রিজে আছে কিন্তু পরিস্কার করা না! কোরবানির দিন রাখছিলাম কোনোরকম পরিস্কার করে। আচ্ছা দেখছি!

– নিরব আর নিশুতি ফিরছে বাসায়?

– নিশুতি এসেছে! নিরব আসেনি।

– নিশুতির কালকে এক্সাম আছে। একটু পড়তে বলো। ওর মা কখন আসে কে জানে! আজ আবার পার্টি না কি যেন আছে ওর ফ্রেন্ডের বাসাতে। আর মা, নিরবকে একটা ফোন দাও তো! দু’দিন বাদে যার সেমিষ্টার ফাইনাল সে যদি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘোরে তাইলে কেমনে কি হবে! তুমি একটু খেয়াল রাখবা না এইসব!

– আচ্ছা দেখছি। বলে মতিহার বানু চোখ মুছতে মুছতে ফোন রেখে দিলেন।

মায়ের সাথে কথা বলতে কত ব্যস্ততা। কিন্তু সাংসারিক আলাপ আলোচনায় আর মিটিংয়ে বিঘ্ন ঘটলো না কামাল সাহেবের।
বউয়ের পার্টি কোথায়, ছেলে মেয়ের এক্সামের ডেট সবই মনে আছে অথচ এই তিন তিনটা ডেট মিস হয়ে গেলো তাও মাকে নিয়ে একটু ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা মনে থাকে না তার।

বউ ফোন দিয়ে যে খাবার রান্নার অর্ডার করেছে সেটাই রেঁধেছেন মতিহার বানু। বউয়ের অনুমতি ছাড়া একটা কিছু শখ করেও রান্না করলে বউয়ের হাজার কথা শুনতে হয়। এখন আবার গরুর বট নামিয়ে ভেজাল। ছেলের পছন্দ বলে এটা সে প্রতি কুরবানির ঈদেই সাথে সাথে পরিস্কার করে পুটলি করে রেখে দেয় কিছুটা। এবার ঈদের দিন একগাদা মেহমান থাকায় সময় হয়নি।
কিন্তু ঝামেলা হলো অনেকদিন ফ্রিজে থাকায় এখন পরিস্কারই হচ্ছে না একদম। কোনোরকম কেটেকুটে সাফ করতে করতেও রাত নয়টা বেজে গেল। কোমরের অবস্থা বেগতিক খারাপ। এতক্ষণ বসা থাকাতে দাঁড়াতেই পারছে না একদম। কোনোভাবে এটা সেটা ধরে উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়াতে গিয়ে তার মনে হলো শরীর কাঁপছে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখে তার ইনসুলিনের টাইম পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। দ্রুত হাত ধুয়ে হেলতে হেলতে রুমে যেয়ে ইনসুলিন নিলো। চোখ দিয়ে মনের অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়ছে। হাত পা থরথর করে কাঁপছে। ছেলে দশটার মধ্যে চলে আসে তাই শরীর খারাপকে পাত্তা না দিয়ে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।

টেবিলে খাবার দিয়ে মতিহার বানু ছেলে আর ছেলে বউয়ের অপেক্ষায় বসে আছে।

– মা, বট খেতে চাইলাম। এটা কি রান্না করেছো? একদম গলে গেছে আর পোড়া গন্ধও বেরুচ্ছে। প্রেশারকুকারে দিয়েছিলে, না?

– হ্যা রে বাপ! নইলে এত তাড়াতাড়ি রান্না হয় কি করে! আর চুলায় বসানোর পরে ঘরে যেয়ে বসতেই চোখটা লেগে আসছিল কখন যেনো । তাই একটু পোড়া ধরেছিল নিচ থেকে।

– সেই সন্ধ্যায় বললাম তাও এত তাড়াতাড়ি বলছ !

– পরিস্কার করতেই কি কম সময় লাগল!

– মায়ের কথার আর কোনো জবাব না দিয়ে সে খেতে খেতেই বলল, বিপাশা তোমাদের আড্ডা কেমন জমল?

– এই তো!

– নিরব আর নিশুতি দুজনের পড়াশোনার খোঁজখবর রাখছ তো! একটু রেখো।

– মা তো আছেই । অফিসে নানান ঝামেলা পোহাতে হয়। এতদিক কি করে দেখি বলো। নিশুতির টিচার আছে। সেতো দেখছেই। আর নিরব এখন বড় হয়েছে। নিজেই বোঝে নিজের ভালোমন্দ। কথাগুলি বলতে বলতে প্লেট টেবিলে রেখেই বেসিনে হাত ধুয়ে রুমে চলে গেল বিপাশা । এর কিছুক্ষণ পরে কামালও চলে গেল বিপাশার পিছুপিছু। মা খেলো কি না খেলো সেই হুশ নেই।

রাতে ছেলেমেয়েরা খায়না। ওরাও যে যার রুমে।মতিহার বানুর শরীর আজ একদম চলছে না। টেবিল ভর্তি থালাবাসন কীভাবে পরিস্কার করবে সেটাই বুঝতে পারছে না।

আজকাল পার্মানেন্ট থাকার জন্য মানুষই পাওয়া যায় না। কোনোরকম একটা মেয়েকে যাও পেয়েছিল নিরবের যন্ত্রণায় তাকে ছেড়ে দিয়েছেন মতিহার বানু নিজেই। নাতীটার কিছু সমস্যা আছে। তাছাড়া বয়সটাই এখন এমন। এজন্যই ভরসা না পেয়ে মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়েছেন। মান ইজ্জত যাওয়ার চাইতে কষ্ট করবেন তাও ভালো।

মতিহার বানু খুব নাক ডাকে সেজন্য তার রুমে মেয়েটা শুতে চাইত না। আর নিশুতি ওর রুমে কাউকে এলাউ করে না তাই বাধ্য হয়েই মেয়েটা ড্রয়িংরুমে ঘুমাত। মেয়েটারও হয়তো কিছু ঝামেলা ছিল। মতিহার বানু একদিন রাতে পানি নিতে বের হয়ে দেখে নিরব আর কাজের মেয়েটা অন্ধকারে ফিসফিস করছে। সে ব্যাপারটা বুঝেও না বোঝার ভাণ করে আস্তে গলা খাঁকারি দিতেই নিরব চোরের মত পা টিপে টিপে তার রুমে চলে গেলো। মতিহার বানু চাননা এই বয়সে ঘরের সবার সামনে নিরবকে লজ্জা দিতে! এতে তার ভয় ভেঙে যাবে এসব ব্যাপারে।
তাই পরেরদিন মেয়েটাকে পুরো মাসের বেতন দিয়ে বিদেয় করে দেয়। যদিও এসব বিষয় নিয়ে মতিহার বানুর ছেলে আর ছেলে বউয়ের মাথা ব্যথা নেই। ছেলে মেয়ে পূর্ণ স্বাধীনতায় ঘোরাফেরা করে। মতিহার বানু এখনো আছেন বলে কিছুটা রক্ষা! নইলে কি যে হতো!

বউ ছেলে কারোরই মতিহারের সাথে কথা বলার সময় হয় না। এই খাবার টেবিলেই যা দেখা হয়। তাও নিজেরা কথা বলায় খুব ব্যস্ত থাকে। মায়ের কথা কখন শুনবে?
অথচ এখন রুমে গেলে দেখবে দু’জনই দু’দিক ফিরে ফোনে ব্যস্ত।

মতিহার বানুর শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। পিত্তথলিতে পাথর ধরা পড়েছে।
এইবার ছেলেকে সাথে নিয়ে ডাক্তার তাকে যেতে বলেছে। সারাবছর তো একাই যায়। কিন্তু এবার অপারেশনের ব্যাপার! তার উপর ডায়াবেটিস অনেক বেশি। তাই ডাক্তার তার ছেলের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে চায় । কিন্তু মতিহার বানুর ছেলে কামালের সময় কোথায়? এত ব্যস্ত মানুষ! সবদিকে খেয়াল থাকলেও মায়ের কথা মনে রাখার সময় নাই! মায়ের কাছে ফাই ফরমায়েশ দেয়া ছাড়া এমনি মায়ের কোনো খোঁজখবর শেষ কবে নিয়েছে কামাল সেটা মনে করাই দায়!

ছোট ছেলে জামাল ফ্রান্সে থাকে। পড়াশোনার জন্য সেই যে গেল এখন তো চাকরি বাকরি বিয়ে শাদী সবই সেখানে। দেশে দু’দিনের মেহমান হওয়া ছাড়া আর স্থায়ীভাবে ফিরবে এমন কোনো লক্ষণ নেই। তার উপর বিদেশি বউ। সে না বোঝে এদেশের রীতি রেওয়াজ, না বোঝে ভাষা! তাই এই কামালই তার একমাত্র ভরসা! কিন্তু ভরসা যে কি ভরসা তা তো টেরই পাচ্ছে!
মতিহার বানু সব কাজ শেষ করে নিজের রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করেছেন মাত্র! মনের অজান্তেই চোখ দুটি ভিজে উঠল তার! পেটটা চিনচিন করে ব্যথা করছে। আজ আর ঘুমোতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না! ব্যাথাটা বাড়তেই থাকছে। পেট ব্যথায় পাগলের মত অবস্থা হয়। অনেক শক্ত মানুষ মতিহার বানু। অন্য কেউ হলে চিৎকার চেঁচামেচি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলত!
মতিহার বানু চোখ মুছতে মুছতে ভাবছেন এই জীবনে কি শুধু দিতেই এসেছেন! কিছুই কি পাবার নেই তার! জীবন আর কয়দিনের?

পেট চেপে ধরে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। দু’চোখে ভাসছে সেই পঞ্চাশ বছর আগের স্মৃতি।

মতিহার বানু তিন ভাইয়ের আদরের ছোট বোন। বাবার অঢেল সম্পদ। বাবা নেই। বড় ভাইই তাদের বাবার স্থানে। বড় তিন ভাইয়ের চোখের তারা সে! আশেপাশের মেয়েরা দশ পেরুতেই শশুরবাড়ি যাচ্ছে! লেখাপড়া করারও সুযোগ নেই। সেখানে মতিহারকে বাড়িতে শিক্ষক রেখে পড়াশুনা করানো হচ্ছে! স্কুল দূরে বলে নিয়মিত যাওয়া হয় না। তবে পরীক্ষা দেয় সময়মত। রেজাল্টও ভালো। আশেপাশের কয় গ্রামের মধ্যে সেই একমাত্র মেয়ে তাদের ক্লাশে। বোনের শখ মেট্রিক পাশ করার! ভাইয়েরা কি বোনের শখ অপূর্ণ রাখবে! মতিহারের মা ছেলেদের সারাক্ষণ বকাবকি করেন। দেশের অবস্থা ভালো না। সুন্দরী মেয়ে! ওদিকে বয়সও কম হলো না! পনেরো ছুঁই ছুঁই! পাশের বাড়ির মহিলারা পান খেতে এসে আড়ালে আবডালে কত কথা কয়! আইবুড়ো মেয়ে বিয়ে দিবে কীভাবে! আরও কত কী! মতিহারের মায়ের মেজাজ তখন বিগড়ে যায় ছেলেদের উপর!

মতিহারের মেজ ভাই হারুন। মতিহারের থেকে বয়সে বছর পাঁচেকের বড় হবে হয়ত। হারুনের বন্ধু বান্ধব একটু বেশি। গঞ্জে বড় কাপড়ের ব্যবসা তার! বিয়েশাদী করেনি এখনো । কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই আড্ডা দেয়া তার স্বভাব । মাঝে মাঝে বন্ধুদেরকে বাড়িতেও নিয়ে আসে নেমন্তন্ন খেতে!

পাশের গ্রামের সৈয়দ বাড়ির ছোট ছেলে নুরুন্নবী আর গঞ্জের আরেক ব্যবসায়ী আলিমের সাথে তার গলায় গলায় ভাব। প্রায়ই আসে আলিম আর নুরুন্নবী তাদের বাড়িতে। এ নিয়ে মতিহারের বড় ভাই তার মা আর ভাইয়ের সাথে বকাঝকাও করে! ঘরে সোমত্ত বোন থাকতে পুরুষ ছেলেদের এমন আনাগোনা গ্রামের বাড়িতে কেউ ভালো চোখে দেখে না। মতিহার ক্লাশ নাইনে পড়ে। এই তো আর দু’ক্লাশ শেষ হলেই বোনের বিয়ে দিবে! মতিহারের বড় ভাবিও অনেক আদর করে ননদকে!
একদিন নুরুন্নবী মতিহারের মেজ ভাইয়ের হাত চেপে ধরে। সে মতিহারকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটা মেজ ভাইয়ের মনে ধরল। নুরুন্নবী ভালো ছেলে। মতিহারের মেজ ভাই কথাটা ঘরের সবাইকে জানালে নুরুন্নবীকেও সবার পছন্দ হয়। বাপের ছোট ছেলে। খুবই ভদ্র! সবচাইতে বড় কথা ছেলে জানাশোনার মধ্যে। তাছাড়া সৈয়দ বংশের খুব নাম ডাক। কিন্তু মতিহারের বড় ভাই সবাইকে সাফ জানিয়ে দিলেন ম্যাট্রিক পাশের আগে বোন বিয়ে দিবেন না।

ওই কথাই রইল। মতিহারকে নুরুন্নবীর পরিবারের সবারও খুব পছন্দ। এমন শিক্ষিতা, সুন্দরী, বুদ্ধিমতি মেয়ে দশ গ্রামের মধ্যে আরেকজন আছে কিনা সন্দেহ!
মতিহারদের পরিবারের সাথে নুরুন্নবীর পরিবারে আসা যাওয়া আর ঘনিষ্ঠতা খুব বেড়ে গেল। কোনো অনুষ্ঠান হলেই দু’বাড়ির মানুষ একত্রিত হয়। নুরুন্নবীর আর মতিহারের মধ্যেও খুব ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হলো।
দেখতে দেখতে মতিহার টেনে উঠে যায়।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here