নীলচন্দ্র,পর্বঃ০২

নীলচন্দ্র,পর্বঃ০২
জাহান আরা

শুভঃ আমার আইডল অসহায় মেয়েদের সহায়,দরদী নেতা,নারীজাতির ভরসার মানুষ ইমরান হাশমি।

শুভর কথা শুনে আমার হাত থেকে পানির গ্লাস পড়ে গেলো,ভাবীর হাত থেকে চামচ পড়ে গেলো,ভাইয়ার গলায় খাবার আটকে গেলো…..

আমি বুঝতে পারলাম এবার আমার বিপদ ঘনিয়ে আসছে।

বাবাঃ ইমরান হাশমি,সে কে??

শুভঃ তুমি কিছু জানো না দাদুভাই,ইমরান হাশমি কে চিনতে পারলে না সে তো অসহায় মেয়েদের অনেক সাহায্য করে থাকে,চাচ্চু কে জিজ্ঞেস করো,আমাকে তো চাচ্চুই বললো তার কথা,এরকম একজন ভালো মানুষ অথচ তোমরা নাকি তাকে চিনই না,এই দুনিয়ায় ভালো মানুষের মূল্য নাই দাদুভাই।

বড় ভাইয়াঃ শুভ তোমাকে এই কথা কি তোমার ছোট চাচ্চু বলেছে??

শুভঃ হ্যাঁ বলেছে তো,কেনো,ভালো মানুষের কথা বলেছে আমাকে,আমি যেনো তার মতো হই।

ভাবীঃ শুভ তুমি এখান থেকে যাও।

শুভ চেয়ার ছেড়ে উঠার আগেই আমি উল্কার বেগে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম।

বাবাঃ কি হয়েছে তোমাদের কিছুই তো বুঝলাম না আমি।

ভাবীঃ কিছু না বাবা,ওসব আপনি বুঝবেন না।

কিছুক্ষণ পরে ভাইয়া ভাবী এসে আমার রুমের দরজা নক করতে লাগলো।

ভাবীঃ নীল দরজা খোলো,আজকে তোমার খবর আছে।

আমিঃ ভাবী আজকের মতো দরজা খোলা যাবে না,যা বলার আগামীকাল বলিও।গুড নাইট ভাইয়া-ভাবী।

ভাইয়াঃ তোর খবর আছে দেখিস তুই বদমাশ।






বাবা মাথায় খুব ব্যথা পেয়েছে,সারারাত বাবা ঘুমাতে পারে নি ব্যথায়,মাথার পিছন দিক ফুলে গেছে।
আমার খুব কান্না পেতে লাগলো,কিভাবে এরা পারলো এরকম করে আমার বাবাকে মারতে!!!
একটুও কি হাত কাঁপে নি ওদের??

নাকি টাকাপয়সা বেশী হলে মানুষের মনুষ্যত্ব থাকে না।

সারারাত বাবার পাশে বসে রইলাম।

বাবার জ্বর এসে গেলো রাতে,জ্বরের ঘোরে বাবা নানা প্রলাপ বকতে লাগলো,শ্বাসকষ্ট ও শুরু হলো।
এরইমধ্যে বড় চাচী এসে কয়েকবার ঝাড়ি দিয়ে গেলো বাবার জন্য নাকি ওনাদের ঘুমাতে সমস্যা হয়।

আমার প্রতিবাদ করার কিছু রইলো না কারন আমরা তো ওদের বাড়িতে থাকি,মা না থাকলে মনে হয় এরকমই হয় প্রতিটি পরিবারের।
আমার মা সেই ছোটবেলায় মারা গেছে।বাবা আর বিয়ে করে নি আমাকে ছোটবেলা থেকে হোস্টেল রেখে লেখাপড়া করিয়েছে তাই।
বড় চাচা বাবাকে আর আলাদা থাকতে দেয় নি কিন্তু চাচী বিষয়টা মেনে নিতে পারে নি তাই বড় চাচার মৃত্যুর পর আর চাচীর সহ্য হয় না বাবাকে। যদিও বাবা তার সংসার চালিয়েছে,ইদানিং চাচীর চিন্তা নতুন কেনা জমিটা কিভাবে হাতিয়ে নেওয়া যায়।

সকালে বাবার জ্বর আরো বেড়ে যায়,বাবার সব টাকাপয়সা চাচীর কাছে।

আমিঃ চাচী আমাকে কিছু টাকা দাও বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে

চাচীঃ এমনভাবে হুকুম করছিস যেনো কতো টাকা জমা দিয়েছিস!!

আমিঃ আমি না দিলেও আমার বাবা দিয়েছে।

চাচীঃ ওসব তোর বাবার খাওয়া বাবদ গেছে,২ দিনের মেয়ে এখন আসছে আমার কাছে হিসেব চাইতে।

চাচী কিছুতেই টাকা দিতে রাজী হলো না।
জ্বর নিয়ে বাবাকে বাড়িতেই রাখতে হবে এটা আমার সহ্য হয় না।
তাই জোর করেই চাচীর আলমারি খুলতে নিই,চাচী আমার গালে ২টা থাপ্পড় লাগায়।

চাচীঃ পারলে নিজে কামাই করা টাকা দিয়ে বাপের চিকিৎসা কর,রূপ তো আর আল্লাহ কম দেয় নি,যেমন নাম চন্দ্র তেমন চন্দ্রের মতো রূপ,তোর তো কাস্টমারের অভাব হবে না চন্দ্র,যা বের হ বাড়ি থেকে,পাড়ায় যা এতো দরকার হলে টাকার।

বাবা অনেক আগে থেকেই হার্টের পেশেন্ট ছিলো। চাচীর এসব অকথ্য ভাষা আর নিতে পারলো না শোকে বাবা স্ট্রোক করলেন সেখানেই।

আমি বাবার চটপট মরে যাওয়া দেখলাম হতভম্ব হয়ে। জীবনের শেষ আশ্রয়স্থল আমার চোখের সামনেই বিলীন হয়ে গেলো।

আমি পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, দেখতে দেখতে অনেক মানুষ জমে গেলো,কেউ বাবাকে গোসল করাতে নিয়ে যায় কেউ যায় কবর খুঁড়তে।
একসময় বাবাকে কবর দেওয়া হয়ে যায় কিন্তু আমি কিছুই দেখছি না এসব,আমার অনুভূতি আমি অনুভব করতে পারছি না মনে হয়।

আমার নামের পাশে এতিমের ট্যাগ লাগিয়ে বাবাও আমাকে রেখে চলে গেলো।








সকালে ঘুম থেকে দেরি কিরে উঠলাম,ভাইয়া অফিসে ভাবী হাসপাতালে যাওয়ার পর রুম থেকে বের হলাম।

ডাইনিং রুমে যেতেই দেখি শুভ বসে আছে।

আমিঃ কিরে তোর স্কুল কোথায়??

শুভঃ আছে তো স্কুলের আগের জায়গায়,স্কুলের কি পা গজিয়েছে নাকি যে স্কুলে তার জায়গা ছেড়ে চলে যাবে বোকার মতো প্রশ্ন করো কেনো চাচ্চু??
তাও তোমার কনফিউশান থাকলে গিয়ে দেখে আসো স্কুল তার আগের জায়গায় আছে কিনা।

আমিঃ বাবা তুই থাম,আমার অন্যায় হয়েছে তোকে প্রশ্ন করে।
তুই কাল রাতে কেনো বললি আমি তোকে ইমরান হাশমির কথা বলেছি??

শুভঃ তো বলবো না,এরকম একজন ভালো মানুষের কথা সবাইকে বলা দরকার,ভালোর প্রচার করতে শুভ কখনো পিছ পা হয় না চাচ্চু।
খারাপ মানুষ হলে অবশ্য তার কথা মাথায় রাখতাম না।

আমিঃ তো স্কুলে যাবি কখন?

শুভঃ আমি তো তোমার জন্য অপেক্ষা করতেছি

আমিঃ কেনো আমার জন্য অপেক্ষা করস??

শুভঃ কেনো তোমার মনে নেই,আজকে যে আমাকে বাবাকে নিয়ে যেতে বলেছে,বাবার বদল তুমি যাবে,জানই তো চাচা বাবার সমান।

আমিঃ তুই এই বয়সে এতো অকালপক্ব হলি কিভাবে শুভ?

শুভঃ কথা না বাড়িয়ে চলো,আমার ক্লাস মিস হয়ে যাবে,ক্লাস মিস হলে পরের দিনের পড়া জানবো না।

কি আর করার কোনো রকম নাশতা করে বের হয়ে গেলাম শুভকে নিয়ে স্কুলের দিকে।

শুভর স্কুলে যেতেই শুভ আমাকে ওর ম্যাডামের ডেস্কে নিয়ে গেলো।

আমিঃ হ্যালো মিস

মিসঃ হ্যালো

আমিঃ আমি শুভর চাচ্চু,আপনি নাকি ওর বাবাকে ডেকে পঠিয়েছেন,ভাইয়া অফিসের কাজে একটু ব্যস্ত তাই আমাকেই আসতে হলো।

মিসঃ আপনি শুভর চাচ্চু তাহলে,শুভ কার সাথে মিশে,কি করে তার খেয়াল কি রাখেন আপনারা???

শুভঃ মিস আমি চাচ্চু ছাড়া আর কারো সাথে মিশি না।

আমিঃ চুপ ফাজিল

মিসঃ গতকাল আমি আমার ভিটামিন ঔষধ খেয়ে আসতে ভুলে গেছি,ক্লাসে এসে আমি আমার হাউজমেইড কে কল দিয়ে বললাম যে আমার জন্য ভিটামিন ঔষধ টা পাঠিয়ে দিতে ড্রাইভার কে দিয়ে।
শুভ উঠে দাঁড়িয়ে বললো মিস আমি একটা প্রাকৃতিক উপায় জানি ভিটামিন নেয়ার।
আমি যথেষ্ট ইন্টারেস্ট নিয়ে ওর কাছে জানতে চাইলাম কি উপায়,কিন্তু ও যা করলো ক্লাসে,তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
এখন থেকেই যদি এসব করে,তাহলে আর বড় হলে কি করবে???

শুভঃ মিস আমার কোনো দোষ নেই আমাকে আমার চাচ্চু বলেছে এটা,চুমুতে ভিটামিন আছে।

মিস অগ্নিদৃষ্টি হেনে আমার দিকে তাকালো,আমি শিওর যে আগের যুগের সাধুরা এরকম দৃষ্টি দিয়ে মানুষকে ভস্ম করে দিতো।

আমিঃ মিস সরি,আমি ওকে অবশ্যই শাসন করে দিবো,আর ভবিষ্যতে যেনো এই কাজের পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই বিষয়ে অবশ্যই খেয়াল রাখবো।

মিসঃ ঠিক আছে এখন যেতে পারেন।

আমিঃ যা তুই ক্লাসে,চাচ্চু বাসায় যাই।

শুভ বাহিরে বের হয়ে এসে বললো,চাচ্চু আমি আজ ক্লাস করবো না,আজকে একটু তোমার সাথে ঘোরাঘুরি করবো,দেখছো না আমি আজকে ইউনিফর্ম পরে আসি নি।

আমি ভালো করে খেয়াল করে দেখি সত্যি ও ইউনিফর্ম পরে আসে নি।

আমিঃ চল আজকে আমার খুশী সেলিব্রেট করি চাচা ভাতিজা মিলে।তোর চাচীকে তোর দাদুভাই মেনে নিয়েছে

শুভঃ চলো চাচ্চু,আমাকে আইসক্রিম,চকোলেট খাওয়াও।

আমি আর শুভ একটা কনফেকশনারি থেকে চকোলেট আইসক্রিম নিয়ে একটা পার্কে ঢুকে বসলাম।

শুভ আর আমি আইসক্রিম খাচ্ছি,পাশ দিয়ে ১ টা কাপল কথা বলতে বলতে যাচ্ছে,ছেলেটা বলছে,লিটনের ফ্ল্যাটে আবার কবে যাবা??
মেয়েটাঃ যাও ফাজিল।

শুভঃ চাচ্চু লিটনের ফ্ল্যাট কোথায়???

শুভর প্রশ্ন শুনে আমার মেরুদণ্ডর উপর দিয়ে একটা হালকা শীতল স্রোত বয়ে গেলো।
এই ছেলে আশেপাশের কে কি বলছে সব কথা খেয়াল দিয়ে শুনে এখানে থাকা মোটেও নিরাপদ নয় আমার।

শুভঃ কি হলো চাচ্চু,বলো না কেনো,লিটনের ফ্ল্যাট কোথায়,কি আছে লিটনের ফ্ল্যাটে??

আশেপাশের মানুষ এবার কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে নিজেকে এবার চিড়িয়াখানার প্রাণী মনে হচ্ছিলো,সবাই দেখছে তাকিয়ে।

আমিঃ লিটন হচ্ছে একজন বড় শিল্পপতি,ওনার ফ্ল্যাট অনেক দামী,তাই সবাই ওখানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে কিন্তু সবার কপালে থাকে না।

আমার কথা শুনে সবাই হাহা করে হেসে উঠলো। আমি আর এক মুহুর্ত শুভকে নিয়ে এখানে থাকা নিরাপদ মনে করলাম না।

আমিঃ চল এখান থেকে উঠে আয় আমরা বাসায় যাবো।

শুভঃ না আমি চকোলেট শেষ করে নেই আগে তারপর যাবো,বসো তুমি।

আমিঃ চল আমরা অন্যপাশে গিয়ে বসি।

শুভঃ আচ্ছা চলো।

শুভকে নিয়ে অন্যপাশে গিয়ে বসল এখানে সব ছেলে,কোনো মেয়ে নাই,এই জায়গাটা শুভকে নিয়ে বসার উপযুক্ত ভেবে বসলাম।

শুভঃ চাচ্চু,লিটন সাহেব কি আমার বাবা আর তোমার চাইতে ও বেশী বড়লোক???
উনি কি তোমার,বাবার,দাদুভাইয়ের চাইতে বড় শিল্পপতি??

আমিঃ হ্যাঁ রে বাপ,অনেক বড় শিল্পপতি উনি,এবার তুই চুপ কর তো।

শুভঃ না আমি চুপ করবো না,তুমি বলো,লিটনের ফ্ল্যাট কিনে নিবা কিনা, আমার দাদুভাইয়ের চাইতে বড় শিল্পপতি কেউ হতে পারে না আমি মানি না।
তুমি লিটনের ফ্ল্যাট আমার নামে কিনে দিবা আমি নাম পাল্টে দিবো “চৌধুরী ফ্ল্যাট “।

এই প্রসঙ্গ চাপা দেয়া দরকার এখনই,জরুরি ভিত্তিতে তাই বললাম,” ঠিক আছে কিনে দিবো যা তোর নামে লিটনের ফ্ল্যাট”

পাশে থাকা একটা ছেলে আমার আর শুভর কথা শুনে হেসে উঠলো।

শুভঃ চাচ্চু উনি কেনো হাসছে??

ছেলেটাঃ বাবা তুমি এখনই লিটনের ফ্ল্যাট কিনতে চাও,ভবিষ্যতে কি জনি সিন্স হতে চাইবা??

আমিঃ শুভ চল আমরা বাসায় যাই চাচ্চুর অফিসে যাওয়া লাগবে একবার।

শুভঃ আগে আমাকে বলো যে জনি সিন্স কার নাম?

আমিঃ চল গাড়িতে গিয়ে বলছি।

শুভ গাড়িতে বসেই জিজ্ঞেস করছে,বলো এবার জনি সিন্স কে??

আমিঃ তুই আর একটা কথা বলবি তো আমি তোরে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে যাবো,চুপ একদম।

শুভ মুখ কালো করে বসে রইলো।
আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আর কখনো শুভকে নিয়ে কোথাও বের হবো না,আমার জনমের শিক্ষা হয়ে গেছে।






বাবাকে কবর দেয়ার পর সবাই চলে গেলো,আমার আর যাওয়ার জায়গা নেই কোথাও,আমি কোথায় যাবো এখন??
এখানে আমার বাবার ঠিকানা হয় নি আমি এখানে এক মুহূর্ত ও থাকবো না।

ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম,এই গ্রামকে বিদায় সারাজীবনের জন্য।






ইমতিয়াজ সাহেব চন্দ্রদের বাড়িতে কল দেয়,চন্দ্রর চাচী ফোন ধরে।

ইমতিয়াজ সাহেবঃ আমি কি হাবিব সাহেবের সাথে কথা বলতে পারি??

চাচীঃ হাবিব ভাই আজকে সকালে মারা গেছে,কি দরকার আমাকে বলুন।

ইমতিয়াজ সাহেবঃ ইন্না-লিল্লাহ………রাজীউন।কিভাবে মারা গেছে উনি,কি হয়েছে ওনার??

চাচীঃ আপনি কে,আপনি কেনো কল দিছেন??

ইমতিয়াজ সাহেবঃ আমি ওনার মেয়ে চন্দ্রর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্য কল দিছি,আমার ছেলে ওনার মেয়েকে খুব পছন্দ করেছে,আমি ইমতিয়াজ চৌধুরী,আশা করি নাম শুনেই চিনতে পেরেছেন।

চাচীঃ কি বলেন,আপনাকে চিনবে না এরকম কেউ আছে নাকি,বাব্বা আমাদের চন্দ্রর কি সৌভাগ্য, হতভাগী এই সৌভাগ্য পায়ে ঠেলে কি করলো এটা??

ইমতিয়াজ সাহেবঃ কি করেছে??
ওর বাবার কি হয়েছে??

চাচীঃ চন্দ্র এক ছেলের সাথে বাসা থেকে পালিয়ে গেছে এই শোকে ওর বাবা স্ট্রোক করে মারা গেছে।আপনি এই মেয়ের রূপ দেখে ভাবছেন ভালো,যতোটা দেখতে মনে হয় ততোটা ভালো না।

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here