আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️সিজন_২,পর্ব_১৫,১৬
সাহেদা_আক্তার
পর্ব_১৫
এখন হঠাৎ অন্য কোথাও যাওয়ার প্ল্যান হইলো কোন সময়? ধুর বাবা, ভাল্লাগে না। আমি বেশ বিরক্ত হইয়া আচার খাওয়ায় মন দিলাম।
.
.
.
.
আহা, কি আরাম! আমরা মেয়েরা দাঁড়াই হাওয়া খাইতেসি আর পোলারা জিনিস পত্র নামাইতেসে। এক সপ্তাহ অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে কক্সবাজার ট্যুর দিতে আসলাম ডিপার্টমেন্ট থেকে। বাপরে কি এক জার্নি হইলো! বাসে বইসা থাকতে থাকতে হাত ঠ্যাং ব্যাথা হই গেসে। প্রায় বারো ঘন্টা মেবি, রাত নয়টা থেকে ভার্সিটি মাঠ থেকে বাস ছাড়সে। আমি হিসাব করমু ভাবতেসিলাম সেই সময় সাহেদা ডাক দিল। সাগরের কাছেই একটা হোটেলে রুম ভাড়া নিসে সবার জন্য। মেয়েদের দুইটা ফ্ল্যাট আর ছেলেদের একটা৷ সবাই সেখানে রওনা দিসে। আমিও নিজের ব্যাগ কান্দে (কাঁধে) নিয়া ওদের পেছন পেছন হোটেলের ভেতরে গেলাম। আমরা এক বাস পোলাপাইন। তার সাথে স্যার ম্যাম আর আমার কটু গাজর জামাইটা। ওরে যে কি সুন্দর লাগে সব সময়! গল্পের নায়কের মতো। একটা ল্যামন কালারের শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরসে। চুলগুলা কেটে একটু ছোট করসে মনে হইতেসে। টিচার হওয়ার পর থেকে ওর গুল্লু মার্কা চশমাটা আর পরতে দেখলাম না। ঐটাতে তো লেদা বাইচ্চা লাগতো। খুব দেখতে শখ হইতেসে। কিন্তু দেখার সৌভাগ্য হইবো কি না কি জানি৷ খালি বিয়াটা হইতে দাও, ঐ চশমা পরাই বসায়ই রাখমু সামনে।
আমরা সাড়ে আটটায় পৌঁছাইলাম। আমাদের নয়টায় নাস্তার সময় দেওয়া হইলো। এর মাঝে সবাই ফ্রেশ হয়ে হোটেলের নিচে চইলা আসলাম। সেখানে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সবাই সেখান থেকে নাস্তা কইরা নিলাম। তারপর বের হইলাম সাগরের উদ্দেশ্যে। বিশাল জলরাশি দেইখা মনটাও পানির মতো টলমল করতে লাগল৷ ইস, এত্ত সুন্দর! যতদূর চোখ যায় কেবল পানি। উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরে ফেনা তৈরি করতেসে। পানিতে দাঁড়াইলে ঢেউ ভাঙার পর বালুগুলা সুরসুর কইরা সইরা পড়ে পায়ের তলা থেকে। তখন আমার কাতুকুতু লাগে। আমি আমার এই মনের ভাব সাহেদারে প্রকাশ করতেই সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাইলো যেন আমিই একমাত্র ভিনগ্রহের বাসিন্দা যে এমন হাস্যকর কথা কইতে পারি। তারপর আর কি? সবাইরে পানির পাগলে কামড়াইলো। সবাই তো পারতেসে না পানিতে ভাইসা যাইতে। আমরা দুইটাও কতক্ষণ ইচ্ছামতো পানিতে চরলাম। পানিতে ভিজা বিড়াল হইয়া, বালিতে গড়াগড়ি খাইয়া, একমণ ওজন হইসে এক একটার। দুপুরে সবাই ভালোমতো গোসল কইরা নিল হোটেলে আইসা। এটা কক্সবাজারের সমুদ্রতীরের বালি। বালির যে ভার! ধুইলেও যাইতে চায় না। পানি ঢালতে ঢালতে নড়েও না। কয়েকমণ পানি ঢাইলা একের পর এক গোসল কইরা নিল তাড়াতাড়ি। তিনটায় সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে নিল।
আমাদের প্ল্যান ছিল রাতের খাবারটা বীচে খাওয়া হবে। তাই সারা বিকাল মাল পত্র টানাটানি আর দৌঁড়াদৌঁড়িতেই সবার কাটল। বাঁবুর্চি ঠিক করা হইসে আগে থেকে। তারা কই যেন রান্না করতেসে। সেখানে নাকি বাতাস কম। আমরা সবাই সাগরের কাছে বালির উপর বসছি গোল হয়ে। এদিকটা কিছুটা নিরিবিলি। সাগরটাও খানিকটা শান্ত তবে বাতাস আছে মোটামুটি। ইচ্ছে ছিল আগুন ধরাবে কিন্তু যে বাতাস আগুন ধোপে টিকবো না। তাই আর চেষ্টাও করে নাই। চাঁদটা উঠসে বলে রক্ষা। আমি সাগরের দিকে তাকাইলাম। কি সুন্দর চাঁদের আলোয় চিকচিক করতেসে সাগরটা! মনে হয় যেন ডায়মন্ড জ্বলতেসে পানিতে। স্যার ম্যাডাম সবাই নিজেদের মতো। আমার গাজর জামাইটারে খুঁজলাম। কই যে গেল! আসার পর দেখিই না যেন। ওর চেহারাটা না দেখলে শান্তি লাগে না। সাহেদা আমার পাশেই ছিল। আমারে এদিকে ওদিকে তাকাইতে দেখে কইলো, আকাশ ভাইয়াকে খুঁজিস?
– হঠাৎ ভাইয়া ডাকলি?
– ভাইকে ভাইয়া ডাকবো না তো কি শালা ডাকবো?
– আরে ধুর, স্যার না ডেকে ভাইয়া ডাকছিস সেজন্য জিগাইলাম।
– একটা ডাকলেই হলো। আয়ানকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করব তোর গাজরের কথা?
– বাব্বা, কি বালুবাসা! থাক লাগবে না।
– ওকে।
আমি একটু পরে কানে ফিসফিস করে জিগাইলাম, সাহেদা তুই জানিস কোথায়? ও না জানার ভান কইরা কইলো, কি? আমি একটু বিরক্তিভাব করে কইলাম, আরে গাজর আর কি। সাহেদা একটু উদাস উদাস ভাব কইরা কইলো, গাজর রান্না করতেসে যে ওখানে। গিয়া খা। আমি মুখটা ভেঙাইলাম।
একটু পরে দেখলাম আয়ান আর আকাশ আইসা বসলো ছেলেদের মাঝে। কই ছিল কে জানে। হঠাৎ কথায় কথায় কটা মেয়ে বায়না ধইরা কইলো, আকাশ স্যার, আপনি নাকি রান্না জানেন। আমাদের খাওয়ালেন না যে।
– আচ্ছা একদিন খাওয়াবো।
– আজকেই খাওয়ান না স্যার, সবাই খাবো।
আমি চিল্লাই উঠলাম, না………। সবাই আমার দিকে বেকুবের মতো তাকাইলো। আমি ভেটকি দিলাম। সেদিন গাজরের হালুয়া খাইয়া আমি যে বয়রা হইসি! এখনো ভাবলে চক্কর আসে। আজকে একটু আরাম কইরা খাইতে চাই। কিন্তু জনসম্মুখে জামাইর বদনাম করাটা ঠিক না। আমি কইলাম, না মানে, আমরা এখানে সবাই মজা করবো আর স্যার রান্না করবে। ব্যাপারটা কেমন না? সাহেদা কইল, তা ঠিক, তার থেকে বরং সবাই মিলে কিছু খেলি।
– কি খেলবি?
– ট্রুথ ডেয়ার?
সবাই সায় জানাইলো। ওরা কোথায় থেকে একটা বোতল জোগাড় করল। তারপর কোথা থেকে একটা ছোট টুল আইনা রাখল সবার মাঝে। বোতল ঘোরানোর দায়িত্ব দিল সৌরভরে। সে তো মহা খুশি। আর যাই হোক খেলা লাগবে না। না হইলে ট্রুথ ডেয়ারের ফান্দে কোন চিপকায় পড়ে ঠিক নাই।
বোতল ঘুরালো। প্রথমেই ফাইরুজ আর আকিব। ফাইরুজ আকিবকে জিগাইলো, ট্রুথ না ডেয়ার? ও উত্তর দিলো, ট্রুথ।
– এ পর্যন্ত কয়বার ছ্যাঁকা খাইলি?
আকিব কাঁদো কাঁদো হইয়া কইলো, আর কিসু পাইলি না জিজ্ঞেস করবার? কালকেও একটার কাছে ছ্যাকা খাইসি। এই নিয়ে সাত বার খেয়ে সপ্তাহ পূরণ করসি। ফাইরুজ হাসতেসে আকিবের কথা শুইনা। সৌরভ আবার ঘুরাইলো। এভাবে চারবারের সময় আমি পড়লাম। আমার বিপরীতে ফাত্তাহ, ক্লাসের দুষ্ট পোলা। আমারে জিগাইলো কি নিবো। আমার ডেয়ারের ঝামেলায় কাম নাই। কি না কি করতে দেয়। তাই ট্রুথ নিলাম। সবার সামনে জিগাই বসল, তুমি কাউকে পছন্দ করো? আমি চমকাই গাজরের দিকে তাকাইলাম। চাঁদের আলোয় ওর চেহারা দেখতেসি না ভালো। কিন্তু সেও যে আমার দিকে তাকাই আছে। ভাবতে লজ্জায় আস্তে আস্তে কইলাম, গাজরকে। আমার উত্তরে সবাই হাইসা উঠল৷ ওরা জানেই আমার গাজর অনেক প্রিয় তাই আর আমারে আলাদা কিসু কয় নাই৷ কিন্তু সাহেদা পাগলি লগে বসি মুখ চাইপা হাসতেসে। আমি একটা গুঁতা দিলাম ওরে।
এভাবে খেলা চলতেসিলো। এবার সাহেদার পালা। তার সরাসরি আমার গাজর বসছিল। সাহেদা জিজ্ঞেস করল, কোনটা নিবেন স্যার? ট্রুথ না ডেয়ার? আমি বুঝি না সাহেদা একবার ভাইয়া আর একবার স্যার কয় ক্যান। ভাবসিলাম ট্রুথ নিবো। তাইলে পেট থেকে বাইর করতাম কাউরে ভালো টালো বাসে কি না। সে আমার প্ল্যানরে কাঁচ কলা দেখাই ডেয়ার নিলো। অর্থ ভালো গান গায়, তাই গিটার আনসিলো। সাহেদা ওর থেকে গিটারটা নিয়া গাজররে দিয়া কইলো, ছোঁয়ার সাথে আপনাকে সরি দীপান্বিতা গানটা গাইতে হবে। আমি চমকাই উইঠা মনে মনে কইলাম, আমারে টানস ক্যান বেডি? আমার ভাবনার মাঝেই আকাশ গিটার বাজানো শুরু করল। তার মানে তারঁ আপত্তি নাই। কি আর করা! গলাটা ঝারি দিয়া শুরু করলাম। আমি গানের উসিলায় (মাধ্যমে) গাজরটার দিকে তাকাই রইলাম।
♪সময় যখন মরু ঝড়ে, এ মন হারায় কেমন করে,
আমি তখন যোজন দূরে একাকি সঙ্গী মৌনতা।
আকাশ যখন আধার ভীষণ, এক ফোঁটা জল চেয়েছে মন,
অবহেলায় অপমানে পেয়েছে রিক্ত শূণ্যতা।♪
ওর সময় আসতেই ও গান শুরু করল। আহা! কি কন্ঠ! আমি হা কইরা শুনতেসি। কি যে ভালো লাগতেসে। আমি গানের মাঝে হারাই গেলাম।
♪সমান্তরাল পথের বাঁকে, তোমার পথের দিশা থাকে,
সে দিশা খোঁজে তোমাকে দীপান্বিতা…
গাছের সবুজ পাতার ফাঁকে, তোমার ছোঁয়া মিশে থাকে,
সে ছোঁয়া খোঁজে তোমাকে দীপান্বিতা……
তুমি নীলাকাশ আপন করেছো, হঠাৎ কোন কালে কে জানে!
স্বপ্ন সীমানা ছুয়ে দিয়েছ, কোন সে জাদুতে কে জানে!
আমি ছিলাম তোমার পাশে, তোমার আকাশ ভালোবেসে,
সে বিশালে খুজেছি এটুকু ঠাঁই, তাও মেলেনি তা।
হঠাৎ যখন ছুটির খেলা, মেঘে মেঘে অনেক বেলা।
তখন সে ক্রান্তিকালে, ধুম্রজালে খুঁজছ যে বৃথা।
অশান্ত মন বোঝাই কাকে, হারিয়ে চাইছি তোমাকে,
হাতছানি দিয়ে যে ডাকে স্মৃতির পাতা…
নদীর শেষে আকাশ নীলে, স্বপ্নগুলো মেলে দিলে,
তারা বলে সবাই মিলে দীপান্বিতা……
শোননা রূপসী, তুমি যে শ্রেয়সী,
কী ভাষণ উদাসী প্রেয়সী, না না না…
জীবনের গলিতে এ গানের কলিতে,
চাইছি বলিতে ভালোবাসি।
চোখের জলের আড়ালে খেলা শুধু দেখেছিলে,
যন্ত্রণার আগুন নীলে, পুড়েছি যে বোঝোনি তা।
অভিমানে চুপটি করে এসেছি তাই দূরে সরে,
বোঝাতে চেয়েও পারিনি, তাই বোঝাতে লুকানো কথা।
ইট পাথরের শহরে, গাড়ি বাড়ির বহরে,
খুঁজেছে এ মন ভীষণ করে দীপান্বিতা…
জীবন যখন থমকে দাঁড়ায়, স্বপ্নগুলো দৃষ্টি ছাড়ায়,
তৃষ্ণা বুকের বৃষ্টি হারায় দীপান্বিতা……
কল্পনারই আকাশ জুড়ে, নানা রঙে লোকের ভীড়ে,
দুচোখ বুজেও স্বপ্ননীড়ে দীপান্বিতা…
তুমি আমার চোখের ভাষা, তুমি আমার সুখের নেশা,
তুমি আমার ভালোবাসা দীপান্বিতা……♪
আকাশ গান শেষ হইতেই হঠাৎ কইল, আমি দেখি খাবার কতদূর। বইলাই উইঠা চইলা গেল। সবাই আবার খেলায় মন দিল। সাহেদা আমার কানে ফিসফিস কইরা কইলো, যাহ, আজকে তোরে একদিনের জন্য আকাশের দীপান্বিতা বানাই দিলাম। আমি হাসলাম। কিন্তু কেন যেন মনে হইল আমার গাজরটার মন খারাপ ছিল।
নয়টার দিকে খাওয়ার জায়গায় ডাক দিল। সবাইকে ওয়ান টাইম প্লেটে খাবার বাইড়া দেওয়া হইলো। বালিতে বড় দুইটা পাটি বিছাই বসছে সবাই। আমি সাহেদার লগে আইসা বসলাম। খাবার নেওয়ার সময় কেমনে কেমনে জানি পড়তে লাগসিলাম। নিজে পড়সি না পিছন থেকে কেউ ধাক্কা দিল তা ঠাউর করতে পারলাম না। কোথা থেকে গাজরটা সামনে আইসা পড়ল তাই তার বুকের উপর গিয়া ধাক্কা খাইলাম। নইলে পড়তাম খাবার সহ বালিতে। আকাশ জিজ্ঞেস করল, তুমি ঠিক আছো? আমি মাথা নাড়লাম। এখন খাইতেসি আর মন কইতেসে, গাজরের কাছে যাওয়ায় যে ঘ্রাণটা নাকে লাগসে আমি তো ফিদা ছোঁয়া। মনরে ধমক দিয়া কইলাম, চুপ, খালি পোলা দেখস, ঐ যে লালুমিয়া দেখ, লালুমিয়া। সালাদের প্লেটে উঁকি দিয়া তোরে দেখতেসে। ঐটা দেখ। বেদ্দপ বেডি।
মাত্র দশটা বাজে। কারো হোটেলে যাওয়ার মুড নাই।সবাই ইচ্ছামতো আড্ডা দিতেসে। হঠাৎ সাহেদার শরীর খারাপ লাগল। ও আমারে বলল, ছোঁয়া, আমার সাথে হোটেল যাবি? আমার মনে হচ্ছে জ্বর আসছে।
– আচ্ছা চল।
আমি পিছন ফিইরা দেখলাম মাইয়া গুলা আয়ান আর আকাশরে ঘিইরা ধইরা গল্প করতেসে। আমি মনে মনে কইলাম, বেত্তমিজ মাইয়াগুলা। আমগো জামাইগুলার দিকে খালি নজর দেয়। আমি সাহেদার দিকে খেয়াল রাখতে রাখতে হাঁটতে লাগলাম। ওর বেশিই খারাপ লাগতেসে মনে হইল। কপালে হাত দিয়া দেখলাম বেশ গরম। সাহেদা হঠাৎ চারদিকে তাকাইয়া কইল, ছোঁয়া, কোথায় যাচ্ছিস? এটা তো হোটেলের রাস্তা না।
চলবে…
#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️
#সাহেদা_আক্তার
#সিজন_২
#পর্ব_১৬
সাহেদা হঠাৎ চারদিকে তাকাইয়া কইল, ছোঁয়া, কোথায় যাচ্ছিস? এটা তো হোটেলের রাস্তা না। আমি চারদিকে তাকাইলাম। ঠিকই তো। এটা তো হোটেলের রাস্তা না কিন্তু আমি চিনি রাস্তাটা। অথচ কক্সবাজার এ প্রথম আসলাম! আমি ওরে নিয়া হাঁটতে হাঁটতে কইলাম, সাহেদা আমি চিনি রাস্তাটা। চল।
আমরা একটা বাংলোর সামনে দাঁড়াইলাম। কার কে জানে। বুঝতে পারতেসি না। গেটের কাছে যাইতেই দারোয়ান সালাম দিলো। আটকাইলো না। আমি ঢুকলাম ভেতরে। সাহেদা কইলো, আমারে কই নিয়া যাস? ভূতের বাড়ি আনছিস নাকি!? এত বড়ো কেন? আমি চিন্তায় থাকার পরও ওর কথায় হাইসা ফেললাম। তারপর আগাইলাম। আমি সব চিনি। এই রাস্তা, বাংলো। ভেতরে আসতেই হঠাৎ একটা মেয়েকে চোখে পড়লো। রান্নাঘরে কাজ করতেসে। শব্দ শুইনা ফিরতেই দেখলাম মুন। আমাদের দেখে দৌঁড়ে আসল।
– ছোঁয়া এসেছিস?
– তুমি এখানে?
– এটা তো আমাদের বাংলো। তোর তো মনে নেই।
ও আমাদের বসতে বইলা কইলো, কাল পর্ষীর কাছে শুনলাম তুই নাকি কক্সবাজার ট্যুরে আসবি৷ তাই ভাবলাম আমরাও আসি একটু। যদি দেখা হয়ে যায়! আমি চিন্তা করতেসি আমার ট্যুরের কথা পর্ষী জানল কেমনে? ওরে তো বলি নাই।
– বোস, আমি খাবার দেই।
– না, আমরা খেয়ে এসেছি। সাহেদার খারাপ লাগছিল তাই হোটেলে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে হঠাৎ খেয়াল হলো ভুল রাস্তায় চলে এসেছি। চেনা লাগল তাই…
– চেনা তো লাগবেই কত এসে……
মুন অর্ধেক বইলা থেমে গেল। সবাই এত রহস্য করে ক্যান কে জানে। ও কথার টপিক ঘুরাইয়া কইল, কি হয়েছে ওর? আমি কইলাম, জ্বর আসছে মনে হয়। সাহেদা মাথায় হাত দিয়া বলল, গত কদিন শরীরে জ্বর জ্বর ভাব ছিল। আজকে সাগরের পানিতে ভেজায় হয়তো জ্বর চলে আসছে।
– আমার সাথে উপরে এসো। শুয়ে থাকবে।
মুন আমাদের দোতলায় নিতে নিতে বলল, পর্ষীটা একটু আগে ঘুমিয়েছে। তোর কাছে যাওয়ার জন্য কত কান্নাকাটি করছিল। আক…… মানে ওর আব্বু এসে শান্ত করল। তারপর ঘুমাতে গেল। আমি একটু অবাক হইয়া কইলাম, ওর আব্বু আসছে? মুন বলল, হুম। আমি কইলাম, এতদিন দেখিনি যে? ওর আব্বুর কথা তো জানিই না। কি নাম? কি করেন? মুন রুমের দরজা খুইলা বলল, বলা যাবে না। পর্ষীর বারণ। বলেই আমাদের রেখে নিচে চইলা গেল। যেন পলাইলো। সাহেদা গিয়া বিছানায় শুইয়া পড়ল। আমি ওর গায়ে চাদর টাইনা কইলাম, পর্ষী বাচ্চাটারে দেখতে কত সহজ সরল মনে হয়! কাছে থাকলে বোঝা যায় কত দুষ্ট। আচ্ছা ওর বাবার নাম লুকালো কেন? নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে। সাহেদা ঘুমানোর চেষ্টা কইরা কইল, তা তো আছে। সময় হলে জানতে পারবি।
– তুই জানিস নাকি?
– ছোঁয়া ঘুমাতে দে। মাথাটা ব্যাথা করছে, চোখও জ্বলছে। সৌরভকে ফোন দিয়ে বলে দিস আমরা কোথায়।
আমি ফোন দিয়া কইলাম সাহেদার শরীর খারাপ লাগতেসিলো তাই কাছেই এক রিলেটিভের বাসায় আসছি। আজকে হয়ত এখানে থাকতে হবে। সৌরভ কইলো স্যার গো জানাইবো। আমি ফোনটা কেটে রুমের দিকে তাকাইলাম। কেন যেন চেনা সবকিছু। রুমের সাথে একটা বারান্দা। সেখান থেকে সাগরের গর্জন আসতেসে। আমি গিয়া দরজা খুলতেই বাতাসগুলা হুমড়ি খাইয়া পড়ল রুমে। আমি দাঁড়াইলাম আরাম কইরা। এত সুন্দর জায়গা! চাঁদটারে যে অনেক কাছে লাগতেসে এখান থেকে। এখন যদি গাজরটা থাকতো! আমি সরমে মুখ ঢাকলাম।
হোটেলে ঢুকতেই সবাই ঘিইরা ধরল। কোথায় ছিলাম, কি হইসে, এখন কেমন আছে, এসব। আমরা কইলাম সবই ঠিক আছে। সাহেদার এখন জ্বর নাই। সে আরামেই ঘুমাইসে। আমিই ওভারলোড হইয়া ঘুমাইতে পারি নাই। কাল রাতে এখানে খাইবার পরও মুন জোর কইরা আমারে খাওয়াইলো পরে। পেটটা দেখলে হয়ত কেউ জিগাইতো কয় মাস। আরেকটুর জন্য পেট ফুইটা খাবার বাইর হয় নাই। এত কিছু খাইবার পর যদি আমারে লালুমিয়া দেওয়া হয় কোন চিপায় তারে ঢুকাইতাম!? লালুরে না খাইতে পারার দুঃখে ইচ্ছে করতেসিলো সাগরে ডুব দিয়া আসি। এরপর আবার সকালে দেখি ঐ পিচ্চি শাঁকচুন্নিটা আমারে কোলবালিশ বানাইয়া ঘুমাই আছে। কখন আসছে কে জানে। নড়তেই জাইগা গিয়া এত জোরে জাপটে ধরল! আল্লাহ! আসার সময় কইলো, ফেরত গেলে নাকি আবার ট্যুর দিবে আমার বাসায়। কয়েক কেজি লালু কিইন্না রাখতে তার জন্য। ইহ্! আমারই কুলায় না আবার তার জন্য রাখতাম।
ফ্রেশ হইয়া নিলাম ভালোমতো। দুপুরে খাওয়া শেষে গেলাম একটু টুকটাক কিনতে। কালকে তো ঘোরাই হয় নাই আড্ডার জন্য। অনেক শামুক ঝিনুকের দোকান। এসব কেনার থেকে সাগর পাড়ে কুড়াই নিতে ভাল্লাগে। আমরা দুইটা বড়ো শামুক কিনে রাইখা আইলাম দোকানে উপর দিয়ে নাম লেখার জন্য। আমি আকাশ নামটা লিখতে কইসিলাম। আরেকটুর জন্য গাজর নামটা চইলা আসছিল মুখে। আমরা ঘুরলাম দোকানে দোকানে। কেনাকাটা কইরা সাড়ে আটটায় চইলা আসলাম হোটেলে। রাতের খাওয়া সাইরা নয়টায় রওনা দিলাম। বাসে সবাই ঘুমে কাদা। সৌভাগ্যবশত আমাদের পাশের সিটে আয়ান আর আকাশ বসছে। আমি সাহেদার কোলে মাথা রাইখা বাসের সিটে শুইয়া ওর দিকে তাকাই আছি। যখন বাইরের আলো পড়তো কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওরে দেখতাম তারপর আবার অন্ধকার। ওরে দেখলে মনটা চঞ্চল হয় ঠিকই কিন্তু এক অজানা শান্তি লাগে! এর মাঝেই ঘুম।
.
.
.
.
বনভোজনের আনন্দ শেষ হইতে না হইতেই সেমিস্টার শুরু। কি যে প্যারা! দশদিন মাঝে পাইসি কেবল। আমি গাজর খাইতে খাইতে পড়তেসি এর মধ্যে পর্ষী আইসা হাজির। দরজায় ঢুকতেই কইলাম, খবরদার, কালকে আমার এক্সাম। বিরক্ত করবা না। আমার পরীক্ষা খারাপ হবে। সে গাজরের দিকে তাকাইতেই আমি গাজরগুলা নিজের পেছনে লুকাইয়া কইলাম, খবরদার, লালুর দিকে নজর দিবা না। আমার পরীক্ষা খারাপ হবে। আমার কথা শুইনা মুখ ভেঙচাইয়া চইলা গেল। আমি আবার পড়ায় মন দিলাম। এক ঘন্টা মন দিয়ে পড়ার পর দেখলাম লালু শেষ। আমি বই নিয়ে পড়তে পড়তে হাঁইটা ফ্রিজের কাছে গেলাম। ফ্রিজ খুইলা লালু নিয়া আবার ফিরলাম টেবিলে। বাটি থেকে একটা লালু নিয়া কামড় দিতেই কইলাম, তিতা লাগে ক্যান! বই থেকে বাটির দিকে তাকাইতেই আমার সারা মুখ কুচকাই চিৎকার মারতে মন চাইল। লালুর বদলে করলা রাক্ষস আমার পেটে পড়সে। আমি তাড়াতাড়ি ওগুলারে ফ্রিজে রাইখা লালু খুঁজতে লাগলাম। পর্ষী এখনো ঠ্যাঙ ঢুলাইতেসে সোফায় বইসা। আমারে গাজর খুঁজতে দেইখা কইল, গাজরের হালুয়া তুমি কি এটা খুঁজছো? আমি তাকাইয়া দেখি তার হাতে গাজরের অর্ধেক। আমি গিয়া দেখলাম আমার সব লালুরে সে একলা সাবাড় করে ফেলসে! কাল আব্বু মাত্র দুইকেজি আনসিলো।
– আমার সব লালু মিয়া খেয়ে ফেললি?
– কটাই বা ছিল? মোট পাঁচটা।
– কাল দুই কেজি এনেছিল।
– তো? পাঁচটা আর কতটুকু? বাকিগুলা তো তুমিই সাবাড় করেছো।
এ মেয়ের সাথে তর্ক করা মানেই নিজের পায়ে নিজে দা, কুড়াল, বটি, ছুটি সব মারা। আমি রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াইতে কইল, এটা লাগবে? অর্ধেইক্কা গাজর আমার দিকে বাড়াই রাখসে। আমি কইলাম, থাক। তারপর রুমে গিয়া পড়ায় মন দিলাম। এর কথা ভাবলে আমার পরীক্ষার বারোটা বাজি তেরোটার কাছে যাইবো গা।
পনেরো দিন পরীক্ষা চলল এক টানা। এরমধ্যে পর্ষী প্রত্যেকদিন আইসা সোফায় ঠ্যাং ঢুলাইতো, গল্প করতো আর আমার লালু সাবাড় করত। তার মধ্যে আরো একটা দুঃসংবাদ পাইলাম। আমার গাজরের মেয়াদ শেষ। দুই মাসের সময় শেষ। তারে আর ভার্সিটি দেখমু না। তার ক্লাস মিস করার কষ্টে কান্দন আইলো। তবে বাসার পাশে থাকায় শোক করা লাগে নাই। কুক করলেই দেখতে পামু। তাই টেনশন নাই। আজকে পরীক্ষা শেষ কইরা আম্মুর সাথে দেখা করতে গেলাম। অনেকক্ষণ থেকে বইসা আছি। সেই একটা থেইকা। সাহেদারে বিদায় দিয়াই হাসপাতালে চলে আসছি। আমার মতো শুকনা কিউট মেয়েটা যদি এত মানুষের মাঝে থাকে তো জেরির মতো চিলে চ্যাপ্টা হই যামু। আজকেই এত রোগী হইতে হইল? রিসেপশনিস্টের সাথে কথা বইলা জানতে পারলাম রোগীর চাপে কারোরই বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ হইতেসে না। আম্মাটাও একবার এসে আমার সাথে দেখা করতে পারতেসে না। আমি বইসা বইসা ঠ্যাং ঢুলাইতেসি আর চুইংগাম চাবাইতেসি। ভাবতেসি লালু মিয়া থাকলে বেস্ট হইতো। চাবাইতে চাবাইতে আশপাশটা উপভোগ করা যাইতো।
হঠাৎ একজনকে দেইখা টম এন্ড জেরির মতো আমার মনে ঘন্টি বাজতে লাগল! আমার গাজর! এখানে! সে হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে যাইতেসে। গায়ে সাদা এপ্রোন, গলায় স্ট্যাথোস্কোপ। তার নতুন নতুন রূপে আমি উগান্ডায় যাইয়া পড়ার অবস্থা! আমার গাজর ডাক্তার! আমার সেই লেভেলের ডিংকা চিকা নাচ দিতে মন চাইতেসে। কিন্তু হাসপাতালে এমন নাচ দিলে সমস্যা। সবাই আমার দিকে ভেটকাই তাকাই থাকবো। আমি লজ্জায় দুই হাত দিয়া মুখ ঢাইকা ফেললাম। এত আনন্দ কই রাখি? কিন্তু চোখ ঢাকার ফল সরূপ সে আমার অজান্তেই হাওয়া হই গেল। যাহ! এদিক ওদিক তাকাই তার কোনো হদিস করতে পারলাম না। ধুর, এটা ঠিক হইলো? আমার পেয়ারের গাজরটা। নাহ, আমারে খুঁইজ্যা বাইর করতে হবে। এখন মনে হয় না আর কিছু করা যাইবো। আম্মার সাথেও দেখা করার উপায় নাই। বাসায় গিয়া লালু মিয়া খাইতে খাইতে ভাবা লাগবে কি করা যায়।
সেই একঘন্টা বিছানার সাথে ল্যাপ্টা মেরে শুয়ে আছি। কিচ্ছু মাথায় আসতেসে না। দুইকে পেটে ঢুকাই তিন নাম্বার লালু মিয়ারে কইলাম, বুদ্ধি দে। না হইলে আজকে তোর ঘাড় মটকামু। হু হা হা হা……। লালু মিয়া আমার দিকে নির্বাক হই তাকাই রইল। এক কামড়ে ওর অর্ধেকটা পেটে চালান দিয়া কইলাম, হুম…… হুম……… ঠিক বলছিস লালু মিয়া। তোকে আমার ফার্স্টে খাওয়া উচিত ছিল। তাহলে বুদ্ধিটা আরো আগে বাইর হইতো।
.
.
.
.
পরদিন সাহেদারে সকাল সকাল ডাইকা নিয়া হাসপাতালে চলে আসলাম। ও কইল, তোর কি হইসে যে সকাল সকাল হাসপাতালে আসছিস? অসুস্থ? ডাক্তার দেখাবি নাকি? আমি এদিক ওদিক তাকাই কইলাম, হুম।
– ডাক্তার দেখাইলে মাস্ক পরছিস কেন?
– হুম।
– এই তুই চগর বগর না করে বলবি কি হইসে?
– গোয়েন্দাগিরি করতে আসছি।
– কার উপর?
– গাজরের উপর।
– স্যার এখানে!? জানলি কেমনে?
– কালকে দেখসি। কি যে কিউট লাগতেসিলো!
– তোর তো সব সময় কিউট লাগে। কিন্তু মাস্ক পরছিস কেন?
– যেন না চিনে।
– আমাকে দেখলে তো চিনে ফেলবে।
– তোকে ছাড়া একলা গোয়েন্দাগিরি করতে মজা নাই।
– এজন্য আমাকে তলব করেছিস এই সাঝ সকালে? একটু পরে ভাইবা দিতে যাইতে হবে। আর তুই এখানে নিয়া আসলি! পড়াশোনা নাই?
– টুক কইরা খোঁজ নিয়া চইলা যামু।
আমি মাস্কের আড়ালে বত্রিশটা দাঁত দেখাইলাম। সাহেদা আমারে নিয়া হতাশ হই রোগীদের বসার জায়গায় বসে পড়ল। আমি সবাইরে ভালো কইরা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। আজকে আর মিস করা যাবে না। লজ্জা পাইলেও না।
চলবে…