এক_ফালি_রোদ
৪৪তম_পর্ব
অয়ন প্রাপ্তির কেবিনে বসলো। অপেক্ষা প্রাপ্তির জ্ঞান ফেরার। ফোন বাজছে সেদিকে খেয়াল নেই তার। সে প্রাপ্তির হাতটা ধরে বসে রইলো। ফোন বাজছে, বিশ্রী এক রিংটোন। অয়নের বিরক্ত লাগছে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলো রাইসা নামটি স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে। অয়ন ফোন রিসিভ করলো। রাইসা ভনিতা ছাড়াই বললো,
– তোমার সাথে দেখা করবো! কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই। সময় হবে আজ?
– আমি হাসপাতালে
অয়নের কথাটা শোনা মাত্রই রাইসার বুক কেঁপে উঠলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
– কি হয়েছে?
– কাল রাতে প্রাপ্তির পেইন উঠেছিলো। কিছুক্ষণ আগে অপারেশন হলো। জানো আমার মেয়ে হয়েছে।
– আলহামদুলিল্লাহ, প্রাপ্তি ভালো আছে?
– হ্যা, ও ক্লান্ত।
– বাবু?
– আইসিউ তে আছে, প্রিম্যাচ্যুর তো। সময় লাগবে নাকি! বাঁচবে কি না তার ঠিম নেই। প্রাপ্তি এখনো জানে না!
– এভাবে বলতে হয় না। কোন হসপিটালে আছে?
– ইবনে সিনা তে
– আমি এগারোটার দিকে আসবো৷
– আচ্ছা, তোমার প্রশ্নের উত্তরগুলো আমি তখন দিয়ে দিবো।
– লাগবে না, পরে জেনে নিবো।
– আমি ফোন কেটে দিচ্ছি। কথা বলতে আর ভালো লাগছে না।
বলে ফোনটা রেখে দিলো অয়ন। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো প্রাপ্তির দিকে। প্রাপ্তির হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলো সে। নিজেকে শক্ত করে নিলো সে। প্রাপ্তিকে সামলাতে হবে, এখন ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। প্রাপ্তির কপালে ছোট একটি চুমু একে দিলো সে। প্রাপ্তিকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে। তার জাগতে সময় লাগবে। অয়ন সেই সুযোগে একটু আইসিউ এর কাছে গেলো। তার এবং প্রাপ্তির মেয়েটিকে একটা কাচের বাক্সে রাখা হয়েছে। এই প্রথম সে দেখলো তার বাচ্চাটিকে। সুখের অনুভূতি এতোটা বেদনাদায়ক হতে পারে এটা এই প্রথম জানলো অয়ন। তার চোখ থেকে পানি পড়ছে। সে ভেবেছিলো সে কাঁদবে না। কিন্তু সেটা হলো না। সে কাঁদছে। বাচ্চাটার চোখ মুখ বুজে আছে। তার পেটটা শুধু কিছুক্ষণ পর পর নড়ছে। এতোটাই ছোট যে হাতে নিলে ফাঁকা নিয়ে পড়ে যেতে পারে। নল দিয়ে তাকে খাবার দেওয়া হচ্ছে। অয়নের আনন্দ হচ্ছে সাথে কষ্ট হচ্ছে। তার বাচ্চাটিকে সে চাইলেও ধরতে পারছে না। কাঁচের দেয়ালের হাত দিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু তাতে লাভ হলো না। কাঁচের ভেতর থেকে বাচ্চাটিকে দেখা তো যায় ধরা যায় না________
রাইসা সিকদার মঞ্জিলে এসেছে। এতোবড় বিপদের সময় বাড়ির বউ বাপের বাড়ি থাকবে ব্যাপারটা সমাজের কাছে নিন্দনীয়। রাইসার আসার কারণটি যদিও প্রাপ্তি। প্রাপ্তির উপর দিয়ে কি যাচ্ছে সেটা অনুমান করাটা এতোটাও কঠিন নয়। রাইসা যখন জানতে পেরেছিলো সে মা হতে পারবে না, তখন তার উপরেও ঝড় বয়ে গিয়েছিলো। তখন বারবার প্রশ্ন হয়েছিলো সেই কেনো? এই সুখ টা কেনো আল্লাহ তার থেকে কেড়ে নিয়েছিলো। তার প্রাপ্তি তো এই বাচ্চাটাকে ছয় মাস নিজের গর্ভে রেখেছিল, অথচ এই বাচ্চাটিকে সে ছুতেও পারছে না। রাইসা প্রাপ্তিকে সামলাতেই এ বাড়িতে এসেছে। শুধু একটা ব্যাপারটিকে তাকে ভাবাচ্ছে। সেটা হলো আবরারের সম্মুখীন তাকে হতে হবে। আবরারের সাথেই একই ঘরে তাকে থাকতে হবে। তার প্রশ্নের উত্তরগুলো না পাওয়া অবধি সে আবরারের মুখোমুখি হতে চায় না। কিন্তু এ বাড়িতে এটা সম্ভব নয়। স্বামী-স্ত্রীর ঝামেলা বাসার সবাইকে ঘটা করে জানানোর মতো মেয়ে সে নয়। তাই চিন্তার জ্বলাঞ্জলি দিয়ে নিজের রুমে গেলো সে। রুমে প্রবেশ করে দেখলো আবরার নেই। রাইসা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ঘরটা বেশ অগোছালো। চাঁদর এলোমেলো, সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশে ফ্লোর ভরে রয়েছে। কাপড়গুলো এলোমেলো করে মেঝেতে গড়াচ্ছে। ভেজা গামছা খাটের বেশ খানিকটা অংশ ভিজিয়ে দিয়েছে। রাইসা ঘরটা গুছালো। এর মাঝেই ফুলি এসে বললো,
– ভাবী অয়ন ভাই আর প্রাপ্তি ভাবীর জন্য খাবার পাঠাতে হইবো। কি তরকারী কাটবো?
– লাউ আর কুমড়ো বের কর। আমি আসছি।
– জ্বী
– এই শোন?
– তোর ভাইজান খেয়ে বেরিয়েছে?
– না, উনি কইলেন রাস্তায় খায়ে নিবেন। হাসপাতাল থেকে আইসেই ব্যাগ গুছায়ে বের হয়ে গেলেন।
– ব্যাগ গুছায়ে মানে?
– উনি চট্টগ্রাম গেছেন। কবে আইবেন কন নি।
– ওহ, আচ্ছা তুই যা।
ফুলি চলে গেলো। রাইসা বিছানায় বসে পড়লো। ঘরটাকে একবার চোখ বুলালো সে। কি নিশ্চুপ ঘরটা, আবরারের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে না। আবরারের হুংকার নেই। কতটা শান্ত, এটাই তো চেয়েছিলো রাইসা। তবুও তার কোথাও একটা ফাঁকা লাগছে। মনটা কাঁদতে চাচ্ছে। কিন্তু চোখের পানি যেনো শুকিয়ে এসেছে।
সময় যেতে থাকে, চিকিৎসার উন্নতির জন্য এবং উপরওয়ালার কৃপায় বাচ্চাটিকে একমাস চব্বিশ দিনের মাথায় আইসিউ থেকে বের করা হয়। যখন প্রথম প্রাপ্তির কোলে শিশুটিকে দেওয়া হয়। সে কান্নায় ফেটে পড়ে। তার ঠোঁটের কোনায় হাসি থাকে আবার চোখের কোনায় নোনাজল। অয়ন মূহুর্তটিকে ক্যামেরাবন্দি করে। অয়নের তোলা সবথেকে সুন্দর ছবি এটা। আজ বাচ্চাটিকে দিয়ে অয়ন এবং প্রাপ্তি বাড়ি ফিরবে। রাইসা সব আয়োজন করে রেখেছে। প্রাপ্তি এবং অয়নের ঘরটা পরিস্কার করে দিয়েছে। প্রাপ্তি যখন বাচ্চাটিকে বাসায় প্রবেশ করে তখন সিকদার মঞ্জিলের যেনো সুখীর জোয়ার বয়ে যাচ্ছিলো। মহীমা বেগমের বার্ধক্য আজ সফল, সে নতুন প্রজন্মকে দেখছে। প্রাপ্তিকে একটি সোনার চেইন পড়িয়ে দেন শেফালী বেগম। প্রাপ্তিকে যেনো তিনি মেনে নিয়েছেন। নাসির সাহেব পাড়ায় মিষ্টির বহর বিলিয়েছেন। নাতনীর আগমন হয়েছে বলে কথা। অয়ন প্রাপ্তি এবং তাদের নবাগত শিশুকে নিয়ে রুমে নিয়ে গেলো। কি করবে না করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বাবুর জন্য দোলনা কিনেছে, খেলনা কিনেছে। সে একবার তাদের বিছানায় বসায়। আবার বাবুকে দোলনায় শোয়াতে যায়। আবার বাবুর জন্য খেলনা সাজায়। পাগলের ন্যায় আচারণ করতে লাগে। আজ সে খুশিতে আত্নহারা হয়ে গিয়েছে। প্রাপ্তি অপলক দৃষ্টিতে তাকে দেখে যাচ্ছে। এই এক মাস চব্বিশটা দিন লোকটা নিশাচর প্রাণীর ন্যায় দিন কাটিয়েছে। পাগলের মতো ডাক্তারের পেছন পেছন ছুটেছে। প্রাপ্তির মনের জোর হয়ে তার পাশে থেকেছে। কেঁদেছে কিন্তু আড়ালে। বাচ্চাটির জন্য কত টাকা খরচ হয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। অথচ লোকটা একটি বার ও বিরক্তি প্রকাশ করে নি। ধার করেছে, দেনা করেছে। কিন্তু জোগাড় করেছে। প্রাপ্তির নিজেকে খুব অকেজো মনে হচ্ছিলো। সে অয়নের কোনো সাহায্যে আসতে পারছিলো না। প্রাপ্তি কেবিনে থাকতো কারণ তার দুধের প্রয়োজন হতো। এই একমাস চব্বিশটা দিন সে হাসপাতালেই পড়ে থাকতো। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছিলো। প্রাপ্তিও আশা ছেড়ে দিয়েছিলো। শুধু অয়ন আশা ছাড়ে নি। সে বাচ্চাটিকে বাঁচানোর সব চেষ্টা করেছে। তাই হয়তো আজ বাচ্চাটি তাদের কাছে ফিরে এসেছে। অয়ন যখন পাগলামি করছিলো প্রাপ্তি তার হাতটি টেনে ধরে, ধীর কন্ঠে বলে,
– একটু বসবেন?
– হু বলো
প্রাপ্তির পাশে বসে অয়ন উত্তর দেয়। প্রাপ্তি অয়নের হাতটা ধরে। ধীর কন্ঠে বলে,
– আমি আমাদের নিয়ে কথা বলতে চাই। আমাদের ভগ্ন সম্পর্কটা নিয়ে।
– প্রাপ্তি, আমাকে ক্ষমা করা যায় না? আমাদের ছোট্ট মেয়েটার কথা ভেবে কি আমাকে একটা সুযোগ দেওয়া যায় না?
– আমি আমাদের মেয়ের জন্য এই সম্পর্কটাকে বয়ে নিতে চাই না।
– প্রাপ্তি প্লিজ, একটা সুযোগ দাও আমাকে!
– বললাম তো, আমি আমাদের মেয়ের জন্য এই কাজটা করবো না। আমি আমাদের সম্পর্কটাকে আমাদের জন্য আরেকবার সুযোগ দিতে চাই। আমার জন্য একবার সুযোগ দিতে চাই। আমি একটা পরিবার চাই অয়ন। আপনি ছাড়া সেটা সম্ভব নয়।
অয়ন এক মূহুর্ত দেয় না করে প্রাপ্তিকে জড়িয়ে ধরলো। এতোদিন সে নীরবে কেঁদেছে। আজ সশব্দে কাঁদছে। তার অশ্রুতে প্রাপ্তির কাঁধ ভিজে গেছে কিন্তু প্রাপ্তি তাকে বাঁধা দেয় নি। কারণ এই কান্নাটি সুখের, বেদনার নয়__________
আজ দুমাস হতে চললো, আবরার এখনো বাড়ি ফিরে নি। এই দুইটা মাস রাইসার সাথে তার কথা হয় নি। রাইসা তাকে অবশ্য ফোন করেছিলো৷ কিন্তু ফোনটা বন্ধ ছিলো। রাইসা অনেকবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু আবরারের সাথে তার কথা হয় নি। এই দুইমাসের ব্যাবধানে সে এটুকু বুঝে গেছে সে আবরারকে কতোটা ভালোবাসে। আবরারের অনুপস্থিতি তাকে প্রতিটাক্ষণ জানান দিয়েছে মানুষটা তার জীবনে কতোটা জরুরি। কতোটা মূল্যবান। কিন্তু এই কথাগুলো শোনার জন্য লোকটি তার কাছে নেই। রাইসা আলমারি থেকে আবরারের একটি শার্ট বের করে সেটিকে বুকে আকড়ে বসেছিলো তখন ই ফুলি এসে দরজায় কড়া নাড়ে।
– ভাবী, ভাইজান আইছেন……………
চলবে
[আগামীকাল যেহেতু শবে কদরের রাত। তাই পরবর্তী পর্ব আগামীকাল দুপুরে ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি