এক_ফালি_রোদ
৪৩তম_পর্ব
– তুমি আমাকে কখনোই বুঝলে না রাইসা, যদি বুঝতে তাহলে আমার এবং অয়নের মাঝে কনফিউজ হতে না। যে মানুষটাকে না দেখে ভালোবেসেছিলে সেই মানুষটাই কি তোমার সাথে দেখা করেছে কিনা এটা তুমি বোঝো নি। তোমাকে আমি ঠকাই নি, ভালোবেসেছি, আগলে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু আমার এই কাজগুলোই আমাকে তোমার চোখে নামিয়ে দিয়েছে। যাক গে, তোমার দোয়া যেনো আল্লাহ পূরণ করে। এই কামনাই করি
বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো আবরার। রাইসা তখন ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। আবরারের বলে যাওয়া শেষ উক্তিটি শোনার পর কলিজায় কামড় পড়েছে। আবরারের বিষাদভরা, অসহায় মুখটা রাইসার চোখে ভাসছে। আবরারের কন্ঠে বেদনা চুয়ে চুয়ে পড়ছিলো। রাইসার কথাগুলো তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করেছে, সেই সহজ কথাটা বুঝতে রাইসার বেশি একটা কষ্ট হলো না। কিন্তু লোকটা তাকে মিথ্যে বাদে কিছুই দেয় নি। মিথ্যের বোনা স্বপ্ন যখন ভেঙ্গে যায় তখন মানুষ স্বপ বুনতেই ভুলে যায়। রাইসা হাটু আকড়ে মাথা গুজে সশব্দে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগে। তবে আবরারের কিছু উক্তির মর্মার্থ সে বুঝে উঠতে পারে নি। কিন্তু মস্তিষ্কের নিউরণগুলোকে একটি বিশাল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার কাজ দিয়ে গিয়ে। প্রশ্নটি হলো “যদি বুঝতে তাহলে আমার এবং অয়নের মাঝে কনফিউজ হতে না। যে মানুষটাকে না দেখে ভালোবেসেছিলে সেই মানুষটাই কি তোমার সাথে দেখা করেছে কিনা এটা তুমি বোঝো নি”- এই উক্তিটির মানে কি!
আকাশ ডাকছে, ঠান্ডা বাতাস বইছে। হয়তো বৃষ্টির প্রকোপ আবার শুরু হবে। ফুটপাত দিয়ে হাটছে আবরার। চোখ গুলো ভিজে আসছে। এজন্য নয় রাইসা তাকে ভুল বুঝেছে, বরং এইজন্য রাইসা তার মুখটি অবধি দেখতে চায় না। কতটা জড়তাবিহীন ভাবে সে কথাটা বললো। রাইসা এবং তার সম্পর্কটা স্বাভাবিক হতে হতেও সব এলোমেলো হয়ে গেলো। আর এখন যে গিট লেগেছে সেটাকে ছাড়ানোর ক্ষমতা তার নেই। রাইসার কথাগুলো তার কানে বিষের মতো লাগছিলো। হয়তো আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালে রাইসার সামনেই ভেঙ্গে পড়তো। আবরার ইসমাইল সাহেবের বাসা থেকে বের হবার সময় বাইকটাও রেখে এসেছে। পরাজিত সৈনিকের ন্যায় মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসেছে। পা জোড়া তার চলতে চাচ্ছে না। হঠাৎ ঝুপ করে বৃষ্টি নামলো। আবরার মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকালো। মলিন হাসি ঠোঁটের কোনাতে ফুটলো। প্রকৃতিও তার সাথে বিদ্রুপ করছে। আজ সে হেরে গেছে। ভালোবাসার জুয়ায় সব হারিয়েছে_________
বাসায় ঢুকতেই শেফালী বেগম আবরারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে উঠে,
– এ কি অবস্থা তোর? বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয় আছিস তো? কোথায় গিয়েছিলি শুনি?
-………….
– তোর চোখ লাল হয়ে আছে কেনো? কথা বলছিস না করা কেনো? আবরার বাবা কি হয়েছে?
– ভালো লাগছে না, মা পরে কথা বলি?
আবরার উত্তরের অপেক্ষা করলো না। নিজের রুমে চলে গেলো। আবরারের করুণ মুখখানা দেখে শেফালী বেগম চিন্তায় পড়ে গেলেন। তার ছেলেকে এতোটা হতাশায় নিমজ্জিত থাকতে কখনো দেখে নি সে। তার চোখগুলো বেদনার টুইটুম্বর ছিলো। শেফালী বেগম আবরারের এলোমেলো পায়ের চলের যাবার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
রাত তিনটা,
অয়ন ঘুমে বিভর। সারাদিনের খাটুনির পর রাতের ঘুমটা খুব জরুরি হয়ে যায়৷ এদিকে প্রাপ্তির ঘুম আসছে না। পেটে তীব্র ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে, ব্যাথার উৎস কি হতে পারে এটা জানা নেই তার। এপাশ ওপাশ করলেও ব্যাথাটা কমছে না। চুল ঘেমে গেছে তার। ঠোঁট চেপে ব্যাথা সহ্য করার চেষ্টায় লিপ্ত সে। কিছু কাজ হচ্ছে না। অয়নকে ডাকবে কি না বুঝে উঠতে পারছে না। লোকটা ঘুমিয়েছে একটু আগে। ঘন্টাখানেক আগে তার পায়ের তলায় তেল মালিশ করে দিচ্ছিলো। আজকাল হাটতে গেলে বেশ ব্যাথা লাগে পায়ে৷ পেট বড় না হলেও জীর্ণকায় শরীরটা ভর নিতে পারে না। ওর কাঁচা ঘুমটা ভাঙ্গতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এই ব্যাথা সহ্য করাটা খুব কঠিন হয়ে উঠছে। একটা পর্যায়ে গেঞ্জি টেনে ধরলো অয়নের। গোঙ্গানি ক্রমশ বাড়ছে প্রাপ্তির। ব্যাথায় কথা বলার ক্ষমতা টুকু নেই তার। প্রাপ্তির গোঙ্গানির আওয়াজে অয়নের ঘুম পাতলা হয়ে গেলো। চোখ খুলে দেখলো প্রাপ্তি ক্রমশ ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। তড়াক করে উঠে বসলো অয়ন। কন্ঠে তার উৎকন্ঠা, প্রাপ্তির হাত খানা ধরে বললো,
– কষ্ট হচ্ছে তোমার?
– ব্যা…থা, ব্যা…থা
– এক মিনিট সময় দাও। আমি তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। চোখ বুঝো না। কিচ্ছু হবে না। এক মিনিট সময় দাও।
বলেই তড়িৎ গতিতে গেঞ্জিটা গায়ে জড়ালো অয়ন। উবার কল করলো। উবার আসতে তিন মিনিট সময় নিলো। প্রাপ্তিকে কোলে তুলে নিলো সে। দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। কাউকে জানিয়ে সময় নষ্ট করার সময় তার ছিলো না। ফুলি তখন পানি খেতে উঠেছে মাত্র। ফুলিকে গেট খুলতে বললো খালি। তারপর হাসপাতালে রওনা দিলো সে। প্রতিটা মিনিট তার জরুরি। প্রাপ্তি তার শার্ট আকড়ে মুখ খিচে বসে রইলো। অয়নের হাতের মুঠোতে তার হাত। অয়ন তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো তার বলতে লাগলো,
– একটু খানি, আর একটুখানি। এখন ই পৌছে যাচ্ছি। একটু সহ্য করো সোনা। এই তো এসে পড়েছি।
অয়নের বুক কাঁপছে, এতো তাড়াতাড়ি ব্যাথা উঠবে এটা যেনো অকল্পনীয়। মাত্র তো ছয় মাস শেষ হলো। সে শুধু একটাই দোয়া করছে,
” প্রাপ্তি এবং বাবু যেনো সুস্থ থাকে”
ভোর ছয়টা,
হাসপাতালের করিডোরে পায়চারী করছে অয়ন। বুকটা ধুকপুক করছে, সেই কখন অপারেশন থিয়েটরে নেওয়া হয়েছে প্রাপ্তিকে এখনো কোনো খবর পাওয়া যায় নি। মাঝে দুবার নার্স বেরিয়েছে। কিন্তু তাতেও কোনো খবর পাওয়া যায় নি। আবরার এবং শেফালী বেগম ফুলির কথা শুনে হাসপাতালে চলে এসেছেন। প্রেগন্যান্সির ছয়মাসেই ডেলিভারি ব্যাপারটা ঝুকিময়। বাচ্চা এখনো পরিণত হয়ে উঠে নি। অথচ এখনই তাকে দুনিয়ায় আনার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। ডাক্তার ইতি সাহা অবশ্য অয়নকে হোপ না রাখার কথাই বলেছে, বলেছে,
– আমরা আপনার ওয়াইফ কে সেফ রাখার চেষ্টা করবো। বাকিটুকু ঈশ্বর জানেন। প্রার্থনা করুন।
অয়ন নামায পড়ে অনেক কান্নাকাটি করেছে। তার যে দুজনকেই চাই। কারণ এই বাচ্চাটার জন্য প্রাপ্তি এখন তার কাছে রয়েছে। তাদের ভগ্ন সম্পর্কের সেতু এই বাচ্চা। সেই সেতুটাই যদি না থাকে সে কিভাবে এগোবে প্রাপ্তির কাছে। শেফালী বেগম তাকে শান্তনা দিচ্ছেন। কিন্তু অয়নের দুশ্চিন্তা কমছে। তখনই ডাক্তার ইতি অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হোন। তার মুখের হাবভাব বোঝাযাচ্ছে না। না খুশির ঝলক, না দুঃখের রেশ। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– কংগ্রেচুলেশন, মেয়ে হয়েছে। তবে মেয়েটা খুব ছোট। প্রিম্যাচ্যুর বেবি, আইসিউ তে রাখতে হবে। আমার জীবনে এটা রেয়ার কেস। আপনার ওয়াইফ এবং বাচ্চার সে অবস্থা ছিলো তাতে সারভাইভাল রেট খুব কম ছিলো। ফরচুনেটলি ও.টি তে কোনো এক্সিডেন্ট হয় নি। এটা তাদের উইল পাওয়ারের জন্যই সম্ভব হয়েছে। দুজনের উইল পাওয়ার অনেক।
– আমার ওয়াইফ?
– সি ইজ ওকে, এখন বাবুটার জন্য প্রার্থনা করুন। কারণ তার ওর্গানগুলো উইক, প্রিম্যাচ্যুর। আমরা আর্টিফিশিয়ালি তাকে সাইভাইব করার ওয়ে তো করে দিবো। কিন্তু বাচ্চাটিকে নিজেই লড়তে হবে।
– কোনো উপায় নেই?
– দেখুন সাধারণত সাত মাসের বাবু হলে ওভারকাম করতে পারে। কিন্তু ছয়মাসের বাচ্চা, কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা তাকে আইসিউ তে শিফট করে দিয়েছি। দেখতে হলে ইউ হ্যাভ টু গো দেয়ার।
ডাক্তার ইতি চলে গেলেন। অয়ন কাঁদছে। তার মেয়ে হয়েছে, এটা খুশিটা তার চোখে মুখে স্পষ্ট কিন্তু ভয় হচ্ছে এই খুশি যাতে ক্ষণস্থায়ী না হয়। তখন ও.টি থেকে প্রাপ্তিকে বের করা হয়। কেবিনে শিফট করা হবে তাকে। অয়ন প্রাপ্তির স্ট্রেচারের কাছে যায়। মুখখানা শুকিয়ে গেছে। কতটা কষ্ট না করেছে মেয়েটা। প্রাপ্তিকে কেবিনে নিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে বাসায় যেতে বলে অয়ন। সবাই ক্লান্ত, কারোর ঘুম হয় নি। শেফালী বেগম এবং আবরার ছোট মেয়েটিকে দেখতে যায়। একদম অয়নের ছোট ভার্সন। উজ্জ্বল শ্যামলা মুখখানা, চোখ অবধি ফুটে নি। হাত পা এতোটা ছোটো সে একটা মাংসপিন্ডের ন্যায় মনে হচ্ছে। অক্সিজেনের নল তার নাকে লাগানো। শেফালী বেগমের চোখ ভিজে যায়। অয়ন সেদিকে গেলো না। সে প্রাপ্তির কেবিনে বসলো। অপেক্ষা প্রাপ্তির জ্ঞান ফেরার। ফোন বাজছে সেদিকে খেয়াল নেই তার। সে প্রাপ্তির হাতটা ধরে বসে রইলো। ফোন বাজছে, বিশ্রী এক রিংটোন। অয়নের বিরক্ত লাগছে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলো……
চলবে
[পরবর্তী পর্ব আজ তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি