অপরিচিতা_ভালোবাসা,পর্ব-৩
ফাবিহা_নওশীন
বর্ণা ফোন নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা।ওর বুকের ভিতরে রক্তক্ষরণ চলছে।নিজেকে সামলাতে পারছেনা।চিতকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে।
বর্ণা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে।যেনো ওর ফ্যাকাসে কালো মুখটা কেউ দেখতে না পায়।
রাফি একটু পর পর বর্ণাকে দেখছে।খাবারের অর্ডার দিয়ে রাফি ইনিয়ে বিনিয়ে রুপাকে জিজ্ঞেস করলো,
—-আপনারা কিছুদিন যাবত কুমিল্লা এসেছেন মানেটা বুঝলাম না।
রুপা হাসিমুখে বললো,
—একি আপনি দেখছি কিছুই জানেন না।
আমরা ঢাকায় থাকতাম আব্বুর চাকরির সুবাদে।এখানে আমাদের যাওয়া আসা হয়না।আর বর্ণা তো এই প্রথম বার এখানে এসেছে।তাই ওকে সাবধান করলাম।
রুপার কথা শুনে রাফির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।ওর মনের ভিতরে একটা আশার বাতি জ্বলে উঠে।
রাফি রুপাকে বললো,
—আপনার বোন ওখানে একা বসে আছে খারাপ দেখায়।এখানে আসতে বলুন।
—ও আসবে না।ও অনেক লাজুক মেয়ে।আপনাকে লজ্জা পাচ্ছে।
—লজ্জা পাচ্ছে না ইচ্ছে করে এভয়েড করছে।(মনে মনে)
রাফি ভাবছে যেভাবেই হোক বর্ণার সাথে কথা বলতে হবে।
বর্ণা উঠে রুপার কানেকানে বললো,
—-ওয়াশরুমে যাচ্ছে।
বর্ণা ওয়াশরুমের দিকে গেলো।রাফি সুযোগ খোজছে বর্ণার কাছে যাওয়ার।
বর্ণা ওয়াশরুমে গিয়ে কান্না করছে।চোখে মুখে বারবার পানি দিচ্ছে।
রাফি রুপাকে বললো,
—আমি একটু অর্ডার চেক করে আসি।
—জ্বি।
রুপা টিস্যু বের করে ফোনের স্কিনে দেখে মুখের মেকাপ মুছছে।
রাফি ওয়াশরুমের পাশে একজনের সাথে কথা বলছে আর আড়চোখে দরজার দিকে চেয়ে আছে।
বর্ণা রুমাল দিয়ে ভেজা মুখটা মুছতে মুছতে বের হচ্ছে।দরজার সামনে দাড়িয়ে চোখ গেলো রাফির দিকে।বর্ণার রাফিকে দেখে কেমন ভয় হতে শুরু করলো।বর্ণা ফোন বের করে কানে নিয়ে রাফিকে শুনিয়ে মিথ্যা ড্রামা করার চেষ্টা করছে।
—হ্যা আর বলোনা আমি তো চেষ্টা করেছিলাম বের হওয়ার কিন্তু আপু আটকে দিয়েছে।আমি তোমার সাথে দেখা করতে পারবোনা।প্লিজ রাগ করো না।
—আমি বের হতে পারবোনা।আপু আমাকে যেতে দেবে না।অন্য সময় মিট করবো।প্লিজ জান রাগ করোনা।প্লিজ বলেছি তো অন্য সময় ম্যানেজ করে বের হবো।দরকার হলে মিথ্যা কিছু একটা বলে বের হয়ে তোমার সাথে মিট করবো।
—-লাভিউ।উম্মাহ।বায়।
বর্ণার এই টাইপ কথা শুনে রাফির কান গরম হয়ে গেলো।
বয়ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে এসেছে।আমার বর্ণালী আর যাইহোক এমন নয়।ওর কথার ধরণ এমন নয়।
বর্ণা রাফিকে না দেখার ভান করে চলে গেলো নিজের জায়গায়। তারপর টেবিলে রাখা খাবারগুলো নিজের মতো করে খেতে লাগলো।রাফি বর্ণাকে দেখছে কেমন ভাবলেশহীন।এই সেই বর্ণালী হলে আর যাই হোক এত নরমাল কিছুতেই থাকতে পারতোনা।কিছুটা হলেও অস্বস্থিতে পড়তো।
রাফি, রুপা,বর্ণা রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।এরমধ্যে রুপার ফোন বেজে উঠলো।রুপার ফ্রেন্ড ফোন করেছে রুপা একটু সাইডে গেলো কেননা এখানে অনেক শব্দ হচ্ছে।রাফি আড়চোখে রর্ণার দিকে তাকালো বর্ণা কেমন উসখুস করছে।রাফি বর্ণাকে জিজ্ঞেস করলো,
—আপনি কি আমাকে চিনেন?
বর্ণা চমকে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
—হ্যা চিনবো না কেন?আপনি আপুর হবু বর,কিছুদিন পর আপনাদের বিয়ে।আপনি আমার হবু দুলাভাই।
বলেই হিহি করে হেসে দিলো।
রাফির নিজেকে বেকুব মনে হচ্ছে।কি প্রশ্ন করা উচিৎ ছিলো আর কি প্রশ্ন করলো।
তারপর আমতা আমতা করে বললো,
—না মানে,,আমাকে কি আগে চিনতেন?
বর্ণা কিছু ভাবার ভংগীতে বললো,
—উম,,হ্যা।আপনি আপুকে দেখতে আসার আগে থেকেই চিনি।
রাফি উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
—কতদিন আগে?
—দেখতে আসার সপ্তাহ খানিক আগে।আপনার ছবি দেখিয়েছে আমাদের সবাইকে।
রাফি নিরাশ হয়ে বললো, ওহহহ।
।
।
রুপা আর বর্ণা রিকশা করে যাচ্ছে।বর্ণার চোখে পানি টলমল করছে।
“রাফি তুমি হয়তো এখনো আমায় খোজার চেষ্টা করছো,প্লিজ আমাকে খোজার চেষ্টা করোনা।তুমি আমাকে সন্দেহ করছো,,বারবার আমার উপর নজর রাখছো।এমন করলে তো আমি ধরা পড়ে যাবো।কত আর অভিনয় করতে পারবো।আমি প্রতিনিয়ত অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যেতে পারি প্লিজ আমাকে খোজো না।আমি আর পারছিনা।”
রাফি শুয়ে শুয়ে বর্ণালীর কথা ভাবছে।ভাবছে কি সুন্দর সময় কাটিয়েছে দুজনে।সবকিছু স্বপ্নের মতো ছিলো।কিন্তু হটাৎ করেই দুঃস্বপ্ন হয়ে গেলো।রাফির বোন রাফসা এসে রাফির পাশে বসে বললো,
—কিরে কেমন হলো ডেট?
রাফি আনমনে বললো,ভালো।
রাফির ইচ্ছে হলো রুপার ফ্যামিলি সম্পর্কে জানতে।রাফি উঠে বসে বললো,
—আমি তো রুপার আর রুপার ফ্যামিলি সম্পর্কে কিছুই জানি না।আমাকে কেউ কিছু জানালো না।
—তুই ই তো জানতে চাস নি।ফ্যামিলির অনেক প্যাচ আছে তাই প্রথমে আমি রাজি ছিলাম না কিন্তু মায়ের জন্য রাজি হয়েছি।
রাফি প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
—যেমন?
—রফিক সাহেব রুপার নিজের বাবা নয়।রুপার বাবা মারা গেছে।রুপার মা রুপাকে নিয়ে রফিক সাহেবকে বিয়ে করেন।রফিক সাহেবের স্ত্রী মারা যায় বর্ণাকে রেখে।মানে হলো রুপা আর বর্ণা আপন বোন নয়।বুঝলি?
রাফি বিস্ময় নিয়ে বললো, কিহ?তাই নাকি?
—হুম।আর তাসিন ওনাদের দুজনের ছেলে।
তিন ভাইবোন তিন দিকের।
রাফির মাথায় প্যাচ লেগে গেছে।
.
.
রাফি রূপাদের ড্রয়িংরুমে বসে আছে।বর্ণা মাথায় ওড়না দিয়ে নাস্তার ট্রে এনে সেন্টার টেবিলে রাখে।
এনগেজমেন্ট এর জন্য হোটেল বুক করা,গেস্ট লিষ্ট ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে এসেছে।যেহেতু রাফির বাবা অসুস্থ আর দুলাভাই বাহিরে থাকে তাই রাফির সবকিছু নিজেকেই সামলাতে হচ্ছে।
রাফি কথার মাঝে আড়চোখে বর্ণাকে দেখছে।ও নিজেকে বুঝিয়েছে এটা ওর অপরিচিতা নয় তবুও বর্ণাকে দেখে কেমন একটা অদ্ভুত ফিলিং হয়,সবকিছু এলোমেলো লাগে।
বর্ণা কাপে চা ঢেলে রাফির দিকে এগিয়ে দেয়।রাফি কাপ নিয়ে বললো,
—-থ্যাংক ইউ।
বর্ণা বাবাকে কাপ দিতেই তিনি রাফিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—বর্ণার জন্য একটা ছেলে দেখো।রুপার বিয়ের পর পর ই বর্ণার বিয়েটা দিতে চাই।তুমি তো এখন আমার ছেলে হয়ে গেছো তাই তোমাকে বললাম।
রাফি একবার বর্ণার দিকে তাকালো।বর্ণার চোখে পানি জমেছে।যা রাফির চোখ এড়ায়নি।রাফি রফিক সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—জ্বী অবশ্যই।আমার অনেক কলিগ আছে আনমেরিড,,অনেক চেনাজানা ছেলেও আছে আমি চেষ্টা করবো তাদের মধ্যে একজন বেষ্টকে বর্ণার জন্য সিলেক্ট করতে।
তার আগে আমার বর্ণার পছন্দ জানতে হবে।
রফিক বললো,
—-ওর আর কি পছন্দ তুমি ভালো একজন দেখো তাতেই হবে।ও আপত্তি করবেনা।তুমি খারাপ কাউকে আনবে না সে ভরসা আমার আছে তোমার উপর।
—-জ্বী।
~~~~
রাফি বর্ণার সাথে কথা বলছে।
—একটা সত্যি কথা বলবেন?
বর্ণার বুক কেপে উঠলো।বর্ণা কাপা কাপা গলায় বললো,
—-জ্বী।
—আপনি কি সত্যিই এর আগে আমাকে চিনতেন না?আমার আপনাকে পরিচিত মনে হয়।আসলে আমি বর্ণালী নামে একজনকে চিনতাম।তাকে আমি কখনো দেখি নি।
—কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনিনা।আমি সে নই,,হয়তো অন্য কেউ হবে।
রাফি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—হয়তো।
যাইহোক আপনি বিয়ের কথা শুনে এমন কেন করলেন?
বর্ণা অবাক হয়ে বললো,
—-মানে?
—মানে চোখে পানি চলে এলো?কেন?আপনি কি কাউকে পছন্দ করেন?
বর্ণা এখন কি বলবে বুঝতে পারছেনা।যদি হ্যা বলে তবে বাড়ির কাউকে যদি রাফি বলে দেয়,,আর সেদিন তো রেস্টুরেন্টে তেমন ভান করেছিলো।কিন্তু এখন কোনটা বলা বেশি কার্যকর ডোন্ট নো।তাই বর্ণা মাথা নিচু করে বললো,
—-সেটা আমার পার্সোনাল ম্যাটার।
রাফি মুচকি হেসে বললো,
—কিন্তু বিষয়টি এখন আর পার্সোনাল নেই।কেননা আপনার বাবা আমাকে ছেলে খোজতে দিয়েছে এখন যদি আপনার কাউকে পছন্দ থাকে তাহলে শুধু শুধু…
—খোজতে হবে না।আপনার এই ম্যাটার নিয়ে ভাবতে হবে না।বাদ দিন।বাবা এমনি কথার কথা বলেছে।আমার এখনো গ্রাজুয়েট কমপ্লিট হয়নি।
বর্ণা কথা শেষ করে কিছু না বলেই জায়গা প্রস্থান করলো।
রাফি বর্ণার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো।
চলবে….