ছায়া,২য়_পর্ব
Misk_Al_Maruf
সুমি হিমেলকে বলেছিল সে যখন লায়লা বেগমের চিৎকার শুনে তার রুমের দিকে দৌড়ে যায় তখন সে একটি ছায়াকে তার রুমের দরজা থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে যেতে দেখেছিল। তাহলে কি এসবের সাথে কামাল কিংবা জামালের কোন সংশ্লিষ্টতা আছে? এতসব ভাবনার মাঝে হঠাৎই মোবাইলে কলের শব্দে ওর হুঁশ ফেরে। আনমনে মোবাইলটি পকেট থেকে বের করতেই দেখতে পায় সিয়ামের কল।
সিয়ামের সাথে হিমেলের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা একেবারে শিশু কালের। দুইজনই একই স্কুলে পড়ালেখা করতো তৎকালীন সময়ে। কিন্তু হিমেল পড়ালেখায় অমনোযোগী এবং কম মেধাবী হওয়াতে সে ম্যাট্রিক পাশটাও করতে পারেনি। অপরদিকে সিয়াম ছিল একজন তুখোড় মেধাবী ছাত্র। স্কুল জীবনে কোনো পরীক্ষায় প্রথম বৈকি দ্বিতীয় হয়েছে কিনা সন্দেহ! আর সেই মেধাকে কাজে লাগিয়েই আজ সে একজন পিবিআইয়ের সিনিয়র কর্মকর্তা।
কলটি রিসিভ করার আগে হিমেল ওর দুজন ভগ্নিপতিকে বলে উঠলো,
“ভাইজান আপনেরা বাসায় যান, আমি একটু পর আইতাছি!”
হিমেলের কথা শুনে ওর বড় বোনের স্বামী ফারুক কিছুটা নরম স্বরে বললো,
“এখন আবার কই যাস? এখন তোর উচিৎ বিশ্রামে থাকা। এমনিতেই একদিকে আম্মা খুন হইলো আবার খুন করলো তোর বউ নিজেই। আমি তোর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারতাছি। এখন ঘোরাঘুরি না কইরা বাসায় চল।”
“না ভাইজান, আমি ঠিক আছি। আপনেরা যান আমি একটু পর আসতাছি।”
হিমেলের কথায় তারা আর কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলো।
কলটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সিয়াম বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,
“দোস্ত! তোর আম্মু নাকি খুন হইছে? কি শুনতেছি এগুলা? আর সুমিতো এরকম মেয়েও না যে সামান্য ঝগড়াঝাটির কারণে আন্টিকে খুন করবে। তুই সবসময়ই সুমির কথা আমাকে বলিস তাহলে এমন ঘটনা কিভাবে ঘটলো?”
সিয়ামের কথা শুনে হিমেল আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না বরং হু হু করে ফোনের এপাশ থেকেই কেঁদে উঠলো। হিমেলের এমন আকস্মিক কান্নায় সিয়াম অবাক হলো না কারণ সে এখন খুব করেই ওর মনের অবস্থা আঁচ করতে পারছে। তাই সে শান্ত স্বরে বললো,
“সবকিছু আমাকে খুলে বল। এখন কান্না করার সময় না। আমার মনে হয় সুমি খুন করেনি।”
হিমেল নিজের আবেগকে যথেষ্ট প্রশমিত করে বললো,
“আমারও তাই মনে হয়। আমার সন্দেহ হয় আমার চাচাতো ভাই কামাল আর জামালের ওপর। মায়ের দাফনের পর ঐ দুইটার চালচলন আমার ভাল লাগতাছেনারে।”
অতঃপর এক এক করে সমস্ত ঘটনা হিমেল সিয়ামের নিকট খুলে বললো। হিমেলের সমস্ত কথা শুনে সিয়াম বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,
“আচ্ছা আমি কালকেই ছুটি নিয়ে তোর বাসায় আসতেছি। দেখি কি করা যায়। তুই এক কাজ কর, থানায় কিছু টাকা ঢেলে সুমিকে কোর্টে নেওয়ার দিনক্ষণ একটু পিছিয়ে দে। আর খবরদার এসব যেন কেউ জানতে না পারে, তাহলে কিন্তু তোরই ক্ষতি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে”
হিমেলের দুই বোন বিথী আর সাথী এখনও মায়ের শোকটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পারবেই বা কেমন করে, ঘরের মানুষের হাতে যদি আপনজন খুন হয় তবে এর কষ্টের মাত্রাটা একটু বেশিই থাকে বটে। হিমেল ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই বড় বোন বিথী দৌড়ে এসে হিমেলের হাত ধরে বলে ওঠে,
“তোর বউ আমার মা’কে খুন করছে। তুই আদালতে সাক্ষী দিবি যাতে ঐ ছেমড়ির ফাঁসি হয়। কি দিবি নাহ?”
বোনের কথার জবাবে হিমেল কিছু বলতে পারে না বরং চুপ করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। হিমেলের এমন নিশ্চুপ থাকা দেখে বিথী বেশ আক্রোশের সহিত ওর গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বলে,
“আমি জানতাম তুই এখন চুপই থাকবি। ঐ মাইয়ায় তোরে তাবিজ করছে, তুই আমার ভাই না, তানা হইলে আজ তুই চুপ থাকতে পারতি না।”
তবুও হিমেল কিছু বলে না। শ্যালকের প্রতি স্ত্রীর এমন ব্যবহার দেখে ফারুক কিছুটা দৌড়ে এসে হিমেলের থেকে বিথীকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“কি করছো এসব? সুমি যেহেতু খুন করছে তাই ওর ফাঁসিতো অবশ্যই হইবো। আর তুমি হিমেলের সাথে এমন করতেছো কেন? ওর মন এম্নেই এখন ভালো না।”
এসব কথা শুনে বিথী আর কথা বাড়ায় না বরং আক্রোশমাখা মুখেই প্রস্থান করে।
প্রায় দশবছর পর গ্রামে এসে ছনের ঘরের বদলে টিনের ঘর এবং ছোট ছোট বিল্ডিং দেখে বেশ অবাক হয় সিয়াম। পাশাপাশি রাস্তাগুলোও রূপান্তর হয়েছে মেঠোপথ থেকে ইটের রাস্তাতে। গ্রামে সেই আগের অপরূপ সৌন্দর্য্যটুকু না থাকলেও শহরের ব্যস্ত কোলাহলের তুলনায় সিয়াম বেশ সতেজতাই অনুভব করছে। স্টেশন থেকে কিছুটা দূরেই হিমেল কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সিয়াম। বহুদিন পর নিজের প্রিয় বন্ধুকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরতে ভুলে না হিমেল। জড়িয়ে ধরেই হিমেল হু হু করে কেঁদে দিয়ে বলে,
“দোস্ত, তুই আমার বউরে বাঁচা। আমি জানি সুমি আমার আম্মাকে বিষ দেয় নাই।”
“আচ্ছা তুই শান্ত হ। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করমু সুমিকে বাঁচানোর আর আসল খুনিকে বের করার। এখন বাসায় চল।”
সিয়াম হিমেল দের বাড়িতে আসাতে হিমেলের ছোট বোন সাথী বেশ খুশি হয়ে আপ্যায়ন করলেও বিথী এবং ফারুক যে খুশি হয়নি সেটা তাদের গা ছাড়া স্বভাব দেখেই অবলোকন করতে পারলো সিয়াম। তবুও অনেকটা জোরপূর্বক সিয়াম ফারুকের সাথে পরিচিত হয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করছিল। সেও ভদ্রতার খাতিরে আর চুপ থাকতে পারেনি।
বিকেলের দিকে সিয়াম কাউকে কিছু না জানিয়েই বাসা থেকে বের হয়ে হিমেলের চাচাতো ভাই জামালের বাড়িতে রওয়ানা দিলো। জামালের বাড়িতে উপস্থিত হওয়া মাত্রই উঠোনে এক যুবককে দেখে সিয়াম তার দিকে এগিয়েই বলে ওঠে,
“আচ্ছা ভাই জামাল দের বাড়ি কি এটা?”
যুবকটি সিয়ামকে কিছুটা পরোক্ষ করে বেশ সন্দেহ চক্ষু নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“জামালেরে আপনের কি দরকার? আর আপনে কেডা কোত্থেকে আইছেন? চিনলাম নাতো আপনারে।”
“জ্বি আমি হিমেলের ছোটবেলার বন্ধু। হিমেলের মায়ের মৃত্যুর কথা শুনে ঢাকা থেকে দেখতে এসেছি। ওদের বাসায় এখন কথা বলার পরিস্থিতি নেই। বুঝতেই পারছেন গতকাল কিরকম একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল। আর এটা নাকি ওর চাচাতো ভাইয়ের বাসা। তাই একটু দেখা করতে আসলাম আরকি।”
যুবকটি মুচকি হেসে বললো,
“ওওও আইচ্ছা। আসেন ঘরে আসেন। আসলে বড় ভাই বাজারে গেছে আর আমার নাম হইলো কামাল। হিমেলের ছোট চাচাতো ভাই।”
এই বলেই দাত কেলিয়ে হাসি দিলো কামাল। ওর হাসি দেখে সিয়াম বুঝতে পারলো কামাল বেশ বোকা টাইপের একটি ছেলে। কিন্তু অনেক বোকা টাইপের লোকের মধ্যেও যে ভয়ংকর রূপ লুকিয়ে থাকে সেটা সিয়াম খুব ভালো করেই জানে।
বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর আচমকাই সিয়াম কামালের উদ্দেশ্যে বললো,
“আচ্ছা আপনাদের দুই ভাইয়ের সাথে নাকি হিমেলের জায়গা জমি নিয়ে ছোটোখাটো একটি ঝামেলা আছে। না মানে ঝামেলাতো থাকতেই পারে কিন্তু তবুওতো আপনাদের উচিৎ ছিল এই শোক মেয় মুহূর্তে ওদেরকে সান্ত্বনা দেওয়া তাই নাহ? একমাত্র আপনজন বলতে তো আপনারাই কেবল আছেন। হিমেল এই বিপদের মুহূর্তে আপনাদের এমন অবহেলা পেয়ে বেশ কষ্ট পেয়েছে। আমাকে বললো আপনাদের বোঝাতে যে সবকিছু ভুলে আপনারা দুই ভাই যেন ওদের পাশে থাকেন।”
সিয়ামের কথায় কামাল কিছুটা ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বললো,
“দেখেন আমরাতো ওগো সাথে মিশতেই চাই কিন্তু ওর ছোট ভগ্নিপতি হিমেইল্লারে ভুলভাল বুঝাইয়া আমাগো সাথে গ্যাঞ্জাম লাগায়। আমরা কইছিলাম আমার বাপে যেই জমি তোর বাপের থেকে কিনা নিছিলো সেইটার দলিল আমাগো দিয়া দে কিন্তু সাথীর জামাই সবুজ বলে যে ঐ জমি নাকি আমার বাপে কিনেই নায়। আমার বাপ চাচারা বাইচা থাকতে সবাই মিলেমিশে আাছিলো আর আমার বাপেও বিশ্বাস কইরা আমার চাচার কাছে দলিল রাখছিল। কিন্তু এখন ওরা সেই দলিল দিতাছে না।”
সিয়াম মনোযোগ সহকারে এতক্ষণ যাবৎ কামালের কথা শুনছিলো, আচমকাই ঘরের উপরের তাকের দিকে ওর চোখ যায়। একটি কাঁচের বোতলের ওপর বিষাক্ত চিহ্ন আঁকা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওটা বিষের বোতল বৈকি কিছু নয়। বেশ কৌতুহলী হয়ে সে কামালকে জিজ্ঞেস করে,
“আচ্ছা আপনাদের ঘরে কি ইঁদুরের উপদ্রব আছে নাকি?”
এই প্রশ্ন শুনে কিছুটা চমকে ওঠে কামাল। আগ্রহী স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“না না! কেন কি হইছে?”
“তাহলে বিষ দিয়ে কি করেন? ঐ যে তাকের উপর বিষের বোতল দেখা যাচ্ছে।”
এমন প্রশ্ন শুনে মুহূর্তেই থতমত খেয়ে যায় কামাল। কি বলবে তা যেন ভেবেই পাচ্ছে না। সিয়াম বেশ ভালো ভাবেই খেয়াল করছে কামালের ঐ শ্যামবর্ণের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের আস্তরণ জেগে উঠছে। সিয়াম বিষয়টা বুঝতে পেরে তৎক্ষনাৎ বলে ওঠে,
“আচ্ছা ভাই বিষের বোতল টা আমাকে একটু দেওয়া যাবে? আসলে হিমেলদের বাসাতে আসার পর থেকেই রাতে ইঁদুরের জ্বালায় ঘুমাতে পারিনি। আমার ব্যাগ টাও কেঁটে ফেলেছে কিছুটা। চিন্তা করছি আজ রাতেই ওদের সাথে একটা বন্দোবস্ত করেই ছাড়বো। এই মুহূর্তে বাজারে গিয়েও বিষ আনা সম্ভব না। বেশ দূরের পথ বুঝতেই তো পারছেন।”
কামাল কিছুটা ভাঙ্গা উচ্চারণে বলে উঠলো,
“আরে সমস্যা নাই বুঝতে পারছি। তয় বড় ভাই জানলে কিন্তু সমস্যা আছে। উনি শহর থিকা এই বিষ আনছিলো কি একটা কামে জানি। আপনে আবার বিষের ব্যাপারে বড় ভাইরে কিছু কইয়েন না কিন্তু আবার।”
“না না জানতে পারবে না। আপনি নিয়ে আসুন, কাল বিকেলে আবার দিয়ে যাবো সমস্যা নাই।”
ধীর পায়ে কামাল তাকের দিকে এগিয়ে গিয়েই কম্পমান হাত দিয়ে বিষের বোতলটি তাক থেকে নামায়। সিয়ামের হাতে বোতলটি দেওয়ার সময় কামালের হাত এতটাই কাঁপছিল যে বোধহয় সে ভয়ংকর কোনো এক জিনিস বহন করে নিয়ে এসেছে। সিয়াম আড়চোখে কামালের হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা আপনার হাত দুটো কাঁপছে কেন বলুনতো?”
কামাল কিছু বলার আগেই সিয়ামের চোখ যায় ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা ত্রিশোর্ধ এক যুবকের দিকে। তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো সে ঠিক সেই বিষের বোতলের দিকেই বেশ বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। সিয়ামের বুঝতে বাকি থাকেনা এটা হলো কামালের বড় ভাই জামাল। কিন্তু দুই ভাইয়ের এই বিষের বোতল নিয়ে কিসের এতো ভয়? তবে কি লায়লা বেগমকে বিষ দিয়ে মারার সাথে ওদের কোনো যোগসূত্র রয়েছে? হিমেলের সন্দেহ টাই কি তবে ঠিক? প্রশ্নটা থেকেই যায়…
.
[To be continued]