এক_ফালি_রোদ ৪১তম_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
৪১তম_পর্ব

রাইসার সামনের মানুষটি আর কেউ নয় সেই ডাক্তার সে রাইসার অপারেশন করেছিলো। রাইসা মুচকি হেসে বলে,
– স্বাভাবিক। বছর দুয়েক আগে, আমি এখানে এডমিট হয়েছিলাম। আপনি আমার অপারেশন করেছিলেন।
– হ্যা, রাইসা। আসলে বয়সের সাথে সাথে স্মৃতি গুলো ঝাপসা হয়ে গেছে৷ তোমার কি অবস্থা বলো?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
– বিয়ে টিয়ে
– জ্বী এক বছর হতে চললো।
– যাক আলহামদুলিল্লাহ, আসলে তোমার বাবা খুব চিন্তায় ছিলেন। তুমি কখনো মা হতে পারবে না ব্যাপারটি তিনি মানতে পারেন না। আমি বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি লাভ হয় নি। আলহামদুলিল্লাহ, এখন তুমি ভালো আছো।

ডাক্তারের কথা শুনে ফ্যালফ্যালিয়ে থাকিয়ে আছে রাইসা। তার মস্তিস্ককোষ গুলো যেনো কয়েক সেকেন্ডের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। অবিশ্বাসের হাসি হেসে রাইসা বলে,
– আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি কারোর সাথে হয়তো আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন।
– বুড়ো হয়েছি কিন্তু আমার রোগীর কেস আমি ভুলি না। তোমার কেসটা খুব অদ্ভুত ছিলো। তাই আমার মনে আছে। বিশ্বাস অবিশ্বাস তোমার ব্যাপার।

রাইসার দুনিয়াটা ঘুরছে। মনে হচ্ছে সে একটি মিথ্যে বানোয়াট দুনিয়াতে থাকতো। এতোবড় সত্যটা তার পরিবার তার কাছে লুকিয়ে গেলো। শুধু সে নয়, আবরার ও এই সত্য থেকে অজানা। সত্যি কি অজানা! রাইসার পা কাঁপছে। দাঁড়িয়ে থাকাটা কষ্টকর লাগছে৷ গলাটা শুকিয়ে আসছে, মাথাটা ভনভন করছে। তার বাসায় যেতে হবে। তার বাবা মা তাকে সত্যটা জানাতে পারবে। একমাত্র তার বাবা-মাই তাকে সত্যের সাথে পরিচিত করতে পারবে।

বিকেলের সোনালী রোদ আছড়ে পড়ছে প্রাপ্তির গায়ে। আজকে এক পশলা বৃষ্টির পর এখন রোদ উঠেছে। আকাশে রংধনুর একটি রেখা যাচ্ছে। শীতল ঠান্ডা বাতাস কানের শো শো করে আওয়াজ করছে৷ এক কাপ কফি হলে মন্দ হতো না। কিন্তু ছাঁদ থেকে নামতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আর পেটটা আজকাল বেশ ভার লাগে। নবাগত মানুষটি জানান দিচ্ছে সে আসছে। লাথি মারলে বেশ ব্যাথা অনুভূত হয়। তাই মনের ইচ্ছেটুকু মনেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছে প্রাপ্তি। প্রাপ্তির ঢেউ খেলানো চুলগুলো উড়ছে। পেটটুকু হাত দিয়ে আকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে শীতল বাতাসকে আলিঙ্গন করছে সে। বাচ্চাটাকে প্রচুর আগলে রাখার চেষ্টা করে সে। এই বাচ্চাটি তার একমাত্র আপন, একান্ত নিজের। হঠাৎ ক্যামেরার শ্যাটারের শব্দ কানে বাজলো। চমকে পিছনে তাকালো প্রাপ্তি৷ অয়ন ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিলো সে। প্রাপ্তি আবার আগের ন্যায় দৃষ্টি বাহিরের দিকে দিলো। অয়ন ধীরে ধীরে তার কাছে এলো। টেবিলে রাখা গরম কফির কাপটা নিয়ে এগিয়ে দিলো প্রাপ্তির দিকে। প্রাপ্তি অবাক হলো, কারণ কখন অয়ন তার পেছনে এসে দাঁড়ালো, কখন কফির মগ টেবিলে রাখলো সে টের পায় নি। সে মুগ্ধ হয়ে তার বাচ্চার সাথে প্রকৃতি উপভোগ করছিলো। প্রাপ্তি কফির মগটা হাতে নিলো। মগে চুমুক দিতে দিতে বললো,
– ধন্যবাদ
– কেমন হয়েছে?
– ভালো
– সত্যি ভালো নাকি এমনেই মন রাখার জন্য বললে?
– না সত্যি ভালো হয়েছে।
– যাক আমার বাবুর আম্মুর ভালো লেগেছে মানে কফিটা বানানো শিখে গিয়েছি।
-………

প্রাপ্তি নিশ্চুপ। তার এই নিস্তব্ধতা গ্রাস করছে অয়নকে। একটা সময় প্রাপ্তির কাছ থেকে শূন্যতা অনুভূত হতো না। কিন্তু এই ছয়টা মাস যেনো শূন্যতাই পেয়েছে সে প্রাপ্তির কাছে। প্রাপ্তির দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সে। কতোদিন তাকে বুকে নেয় না। কতোদিন তার হাতটি ধরে না। এই যন্ত্রণাটি তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। অবশ্য সে একটিবারো প্রাপ্তিকে দোষ দেয় না। এটা তার প্রাপ্য ছিলো। কত ছলনা, প্রতারণা করেছে এই বাচ্চা মেয়েটার সাথে। তার মেয়েটা বেঁচে থেকেও জীবন্ত নয়। সারাক্ষণ চুপ করে ঘরের কোনায় পরে থাকে নয়, রঙ তুলিতে মিশে থাকে। মাঝে মাঝে পেটটি জড়িয়ে ধরে কাঁদে। হরমোনাল চেঞ্জ হচ্ছে, মাঝে মাঝে সে কান্নায় ফেটে পড়ে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ব্যাপারে আনন্দ খুজে নেয়৷ কিন্তু অয়ন তার কারণ কিংবা অংশ নয়। নীরবতা ভেঙ্গে অয়ন বলে,
– দুপুরের ঔষধ খেয়েছো?
– ফুলি দিয়েছিলো
– এখন সিড়ি না বাইলে হয় না।
– ওই রুমে দম বন্ধ লাগে৷
– আমাকে তো বলতে পারতে?
– ইচ্ছে হলো না।
– আমি মানুষ প্রাপ্তি। আমিও মানুষ। এভাবে জড় বস্তুর মতো আমার সাথে আর কতদিন আচারণ করবে?
-.. ……….
– আমি ভুল করেছি, না অন্যায় করেছি৷ কিন্তু আমি এখন আমার ভুলটা শুধরাতে চাই। আমি প্রতিটা ক্ষণ, প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি।
– কিন্তু আমি তো বলি নি।

এবার নিজেকে আটকাতে পারলো না অয়ন। প্রাপ্তির বাহু টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। প্রাপ্তি টাল সামলাতে না পেরে অয়নের বুক আকড়ে ধরলো। অয়নের এরুপ আচারণ অকল্পনীয়। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– তুমি কি সত্যি বুঝো না? আমি ভালোবাসি তোমায়, সত্যি বুঝো না তুমি। আরে মানুষ তো আমি। তুমি তো জানতে আমি রাইসাকে ভালোবাসতাম। তখনের পরিস্থিতি আমার প্রতিকূলে ছিলো। সব মিলে ঘেটে ছিলোম। কখন তোমাতে মত্ত হয়েছি বুঝতে পারি নি। আমি মানছি আমি অন্যায় করেছি৷ কিন্তু তোমার উদাসীনতা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আমি আর পারছি না, প্রাপ্তি। আর সত্যি পারছি না।
– কাঁচ ভাঙ্গলে সেটা জোড়া লাগানো যায়। কিন্তু ক্ষতটা রয়ে যায়। কোথাও চোট পেলে সেখানের ক্ষত ভরে যায়। তবে সূক্ষ্ণ দাগ রয়েই যায় অয়ন। আর এটা তো আমার মন। যাকে প্রতারণা, ছলনা, কপটতা দিয়ে আপনি বিষিয়ে দিয়েছেন। এই ভালোবাসা নামক পাটাতনে আমি পিষ্ট। রাগ অভিমান আমার তীক্ষ্ণ ভালোবাসাটাতে অমসৃণ এবং ভোঁতা করে দিয়েছে। আমার ভয় হয়। ভালোবাসতে ভয় হয়। আমি তো একটা পরিবার চেয়েছিলাম। এটা কি আমার দোষ ছিলো অয়ন? একান্ত নিজস্ব, আপন একটি পরিবার। একটু ভালোবাসা, একটু স্নেহ। আমি কি মানুষটা এতোটাই পাপী৷ সে আমাকে এটুকু সুখ দেওয়া যেতো না? আমি কাঁদতাম, আপনার উদাসীনতা মেনে নিতাম। ভাবতাম আপনি চেষ্টা তো করছেন। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আপনি চেষ্টা করেন নি। আপনি আমাকে ঘুমের নগরীতে রেখেছিলেন। আমি যে এখন জেগে গেছি। এখন আমার ভালোবাসার চাঁদরে গা ভাসাতে যে বড্ড ভয় করে।

প্রাপ্তির কথায় অয়ন তার বাহু ছেড়ে দিলো। প্রাপ্তি চোখ ছলছল করছে। সে ছলছল নয়নে অয়নের চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অয়নের চোখের কোন ভেজা। নীরবে কাঁদছে তারা। ভালোবাসা দুজনের মাঝেই জীবন্ত। কিন্তু সেটাকে মুক্ত করতে পারছে না। যেদিন মুক্ত হবে হয়তো সেদিন অয়ন, প্রাপ্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে_____________

রাত আটটা,
প্রায় দু ঘন্টা জ্যামে আটকে ছিলো আবরার। সেই ছয়টায় বেড়িয়েছিলো অফিস থেকে। এই হুটহাট বৃষ্টি বিরক্ত করে ফেলছে আবরারকে। প্রায় ভিজেই গিয়েছে সে। গরম পানি দিয়ে গোসল না করলে ঠান্ডা লেগে যাবে। বাসায় ঢুকতেই ফুলি বললো,
– ভাইজান চা খাইবেন?
– হু দে তো, কড়া এক কাপ দিবি। মাথা টা ব্যাথা করছে। এই বৃষ্টির পানি। জ্বর বাধিয়ে দিবে।
– আচ্ছা আপনি ঘরে যান। আমি দিয়ে যাবো নে।
– তোর ভাবি কোথায় রে?
– ভাবি তো বাড়ি নেই। সেই সকালে বের হইছিলো। এখনো বাসায় আসেন নি। আম্মায় ফোন দিছিলো। কইছে তার বাপের বাড়ি আছে। আজকে আইবেন না।
– তুই তো দেখি বিবিসি। এতো কিছু জানতে চাইছি?
– চাইতেন ঠিক ই। আমি এক বারেই কইলাম।
– বকবক থামা। চা দে

ফুলি মুখ ভেসকি দিয়ে রান্নাঘরে গেলো। আবরারের কপালে চিন্তার ভাঁজ। এই এক বছরে এমনটা এই প্রথম করলো রাইসা। তাকে একবার জানালো ও না। হঠাৎ কি এমন হলো। আবরার রুমে গিয়ে ব্যাগটা রাখলো। ফোন টা পলিথিন থেকে বের করে ফোন লাগালো রাইসার নাম্বারে। কিন্তু অপরপাশ থেকে শুনলো,
” কাঙ্ক্ষিত নম্বরে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব নয়। দয়া করে কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন।”

আবরারের কলিজায় কামড় লাগলো। মনটা অস্বস্তিতে ভরে গেলো। খারাপ কিছুর আভাস পাচ্ছে সে। তখনই তার ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে “আব্বা” নামটি ভেসে উঠলো। আব্বা বলে সে ইসমাইল সাহেবকেই সম্বোধন করে৷ উদ্বিগ্ন হয়ে সে ফোনটি রিসিভ করে। ফোন রিসিভ করতেই………….

চলবে

[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here