এক_ফালি_রোদ
৪০তম_পর্ব
বসারঘরে বসে রয়েছে, সিকদার পরিবার। শেফালী বেগমের মুখে আধার নেমে এসেছে। মহীমা বেগম মুখ শক্ত করে বসে রয়েছে। নাসির সাহেব মাথা নিচু করে রয়েছেন। টি টেবিলের উপর একটি রিপোর্ট। তার সামনে আবরার এবং রাইসা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আবরার তার মিথ্যে রিপোর্টটি পরিবারের সামনে রেখেছে। এতোবড় ধাক্কাটি সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি সবাই জানানোর ইচ্ছে তার ছিলো না। কিন্তু না জানানোর উপায় ও দেয় নি শেফালী বেগম। কিছুদিন পূর্বে হঠাৎ করেই বেশ বাগবিতণ্ডায় জড়ান তিনি আবরারের সাথে। তার কারণ তার ছোট ছেলের বউ মা হতে চলেছে।
কিছুদিন পূর্বে,
প্রাপ্তির শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছে না। কক্সবাজার থেকে আসার পর থেকেই কেমন যেনো উদাসীনতার জাল তাকে ঘিরে ফেলেছে। অয়নের সাথে একই ছাদের নিচে, একই বিছানাতে থাকা সত্ত্বেও তাদের মাঝে ক্রোশ ক্রোশ মাইলের দূরত্ব হয়ে গেছে। অয়ন তার দিকে চেষ্টা করলেও প্রাপ্তির অভিমানের গভীরত্ব সে ভেদ করতে পারছে না। প্রাপ্তি ভেবেছিলো অয়ন ব্রাজিলে চলে যাবে। তাদের মাঝের এই টানাপোড়েন সম্পর্কটা শারীরিক দূরত্বের প্রভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। অয়ন ব্রাজিলে যায় নি। বরং সে প্রতিনিয়ত তাদের মরীচা পড়া সম্পর্ককে নতুনত্বের প্রলেপ দেওয়াতে উঠে পড়ে লেগেছে। কিছুদিন আগে হলে হয়তো এগুলো ভালোলাগতো। কিন্তু এখন সব মেকি মনে হয়। হৃদয়ের ক্ষতটা এতটাই গভীর যে এখন সেখানে পচন ধরেছে। সামান্য মলমে এই পচন সারার নয়। প্রাপ্তি অন্য কোনো মেয়ের মতো রাগ করে, কষ্ট পেয়ে বাপের বাড়ি যেতে পারবে না। কারণ তার বাবা-মা নেই। আর ইসমাইল সাহেবের বাড়িতে সে যাবে না। তাই সিকদার মঞ্জিলেই সে পড়ে রইলো। শরীর খারাপটা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বমি হয়, মাথা ব্যাথা করে, মাথা ঘোরায়, খাবার দেখলেই অরুচি হয়। কিন্তু প্রাপ্তি এই কথাগুলো কাউকে বলে না। চুপ করে সহ্য করে নেয়। জীর্ণশীর্ণ শরীরটাতে হাড় ব্যাতীত আর কিছু নেই। সেদিন সকালে যখন বাথরুমে বমি করছিলো তখন অয়নের কাছে সে ধরা পড়ে যায়। অয়ন এক মূহুর্ত দেরি না করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। বিভিন্ন টেস্টের পর জানা যায়, প্রাপ্তি এখন একা নয়। তার গর্ভে ধীরে ধীরে অয়ন এবং তার মিলিত অংশ বেড়ে উঠছে। তার প্রেগ্ন্যাসির দেড় মাস চলছে। দিনটি একটি সাধারণ রবিবার ছিলো। কিন্তু অয়নের জন্য সেই রবিবারটা সেপ্টেম্বরের শ্রেষ্ঠ রবিবার ছিলো। ছুটে গিয়ে সে প্রাপ্তিকে জড়িয়ে ধরে। চুমুতে, আদরে তাকে ভরিয়ে দেয়। তারপির পাগলের মতো তার কোমড় আকড়ে তার পেটে মুখ গুজে কাঁদতে থাকে। প্রাপ্তির ওকান্না পাচ্ছিলো খুব। কিন্তু মনের মাঝে এতো অনুভূতির বিচরণ হচ্ছিলো যে সে কোনো অনুভূতির প্রকাশ করতে পারছিলো না। নতুন কেউ আসছে এটা যেমন আনন্দের ছিলো তেমনি তাদের সম্পর্কটা ভাঙ্গনের দিকে এই সময় এই নবজাতকের আগমণটা ঠিক সুখময় নাকি কষ্টকর এটা সে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তাশের ঘরে আর যাই হোক পরিবার থাকতে পারে না। ভালোবাসার প্রদীপটুকু যেখানে নিভে গেছে সেখানে আশার এক ফালি রোদের উদয় কেনো! প্রাপ্তি অনুভূতির টানাপোড়েনে জর্জরিত। সুখ, দুঃখ, অভিমান, ভয় তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। বাসায় এই খবর আসতেই খুশিতে আটখানা হয়ে যায় সিকদার মঞ্জিল। সব থেকে বেশি খুশি হয়েছিলেন মহীমা বেগম। কিন্তু শেফালী বেগমের কপালে চিন্তার ভাজ ফুটে উঠে। একদিকে ছোট ছেলের বউ মা হতে চলেছে। বংশের নতুন প্রজন্মের সূচনা হতে যাচ্ছে। অথচ তার বড় ছেলে এবং তার বউ এর এই ব্যাপারে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। একেই আবরারের বয়স ত্রিশোর্ধ্ব। রাইসার বয়স ও পঁচিশ পেরিয়ে গেছে। এখন বাচ্চা নিবে না তো কখন নিবে। এই নিয়েই তিনি আবরার এবং রাইসার সাথে কথা বলেন। এক কথা দুকথায় বেশ ঝামেলা বাধে। শেফালী বেগম এক পর্যায়ে হিনহিনে কন্ঠে বলে উঠেন,
– রাইসার কোনো সমস্যা থাকলে সেটার চিকিৎসা তো রয়েছেই৷ আর যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা করা হবে তত ভালো। ওর বয়স বাড়লে সমস্যাও বাড়বে।
– যদি বাচ্চা না হয় তাহলে এডোপ্ট করে নিবো। এতে এতো কথা বাড়ার কি রয়েছে? আমাদের স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার আমাদের স্বামী স্ত্রীর ভেতরেই থাকতে দাও।
– আমরা তো তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে আসছি না আবরার। তোমাদের বিয়ের কম দিন কিন্তু হয় নি। তোমাদের সম্পর্ক কেমন তা আমাদের চোখ এড়ায় নি। আমি তোমাদের ভালোর জন্য বলছি৷ আর রাইসার যদি কোনো সমস্যা থাকে….
– সমস্যা কেনো শুধু রাইসার ই হবে মা? আমার সমস্যা থাকতে পারে না? আমি পুরুষ বলে সাত খুন মাফ নাকি? আমার ও তো সমস্যা হতে পারে
– ছেলেদের সমস্যা হয় নাকি! কি আবল তাবল বকছিস?
– মা তুমি তো আমার মা, এতো নিচু মানসিকতা কেনো পুষে রেখেছো গো। পুরুষ হয়ে জন্মেছি তাই আমার মাথায় কি শিং গজিয়েছে? তাকি আমি বিশ্বজয় করে ফেলেছি যে আমার কোনো সমস্যা হতেই পারে না। বাচ্চা হচ্ছে না সেটাও রাইসার দোষ তাই না? কিন্তু সত্যি কি জানো? সমস্যাটা ওর নয়, আমার। আমি বাবা হবার ক্ষমতা নেই।
আবরারের কথায় স্তব্ধ হয়ে যান শেফালী বেগম। তার চোখে মুখে অবিশ্বাসের ঝলক স্পষ্ট। নিজের ছেলের স্পর্ধা দেখে তিনি বেশি স্তব্ধ। এতোবড় অপবাদ সে কি করে নিজের কাধে নিচ্ছে! মানুষ শুনলে কি বলবে! ভদ্র সমাজে থাকে তারা, কিন্তু ভদ্র সমাজের কালো দিকটা খুব নিষ্ঠুর। আবরার সমাজের কাছে একটি বিদ্রুপের পাত্র হয়ে যাবে। অগ্নিকন্ঠে বলতে লাগলেন,
– পাগল হয়ে গেছিস? কি উলটো পালটা কথা বলছিস? বউয়ের ক্ষুদ লুকাতে এতো বড় অপবাদ কি করে মাথায় নিয়ে নিলি?
– আমি কারোর অপবাদ নিচ্ছি না। সত্যিটা মানতে শেখো।
বলেই নিজের ঘরে চলে যায় আবরার। রাইসা তাকে হাজারোবার বাধা দেবার চেষ্টা করে, বোঝানোর চেষ্টা করে,
– আবরার তারা কষ্ট পাবে, এতো বড়ো ধাক্কা তারা সহ্য করতে পারবেন না। পাগলামী করো না।
– কিন্তু সত্যিটা তাদের জানা উচিত, তাদের এটা মেনে নিতে হবে সে আমাদের কখন বেবি হবে না! শুধু তাদের নয় তোমাকেও এটাই মেনে নিতে হবে। কম চিকিৎসা কিন্তু করাই নি। বাট রেজাল্ট জিরো। তাই সত্যিটা তাদের জানা উচিত।
আবরারের কথা শোনার অর আর কথা বাড়াতে পারে না রাইসা। আবরারের সিদ্ধান্ত অটল। সে যখন একবার ভেবেছে সে রিপোর্টের ব্যাপারে সবাইকে জানাবে তার মানে সে জানাবেই।
বর্তমান,
পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে আবরার বলে,
– আমি বাবা হতে পারবো না। এটা সত্য। তোমরা এটা ভাবছো আমি বিদ্রুপের পাত্র হয়ে যাবো, আমি কিভাবে সমাজে মুখ দেখাবো। এটা একবার ভেবেছো? রাইসার উপর যখন মা অপবাদ দিচ্ছিলো ওর কেমন লাগছিলো? আজ যদি আমার জায়গায় রাইসার সমস্যাটা থাকতো তাহলে তোমাদের কোনো সমস্যা হতো না। ওরে সারাদিন উলটো পাল্টা কথা বলতে তারপর তালাকের কথা তুলতে। আমার দ্বিতীয় বিয়ের কথাও ভাবতে। এটাই তোমাদের সমস্যা। আজ আমার এই সত্যটা জেনেও রাইসা আমার পাশে আছে। এটাকে তোমরা বলবে ওর কর্তব্য। কিন্তু ঘটনাটা উলটো হলে বলতে বউয়ের আঁচল ধরা। এটাই তোমাদের সমস্যা। যাক গে, সত্যটা মানতে শিখো। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটা বাচ্চা এডোপ্ট করবো। তোমাদের আপত্তি থাকলে জানাতে পারো।
বলেই নিজ ঘরে চলে আসলো আবরার। রাইসা তার পিছু পিছু রুমে এলো। আবরার বারান্দায় যেতে ধরলে রাইসা হাতটা টেনে ধরে। ধীর কন্ঠে বলে,
– ধন্যবাদ।
– হঠাৎ?
– এমনি। আমরা কি সত্যি বাচ্চা এডোপ্ট করবো?
– হুম, আমি বেশ কিছু জায়গায় বলেছি। সময় লাগবে। বাকিটুকু উপরওয়ালা জানেন।
রাইসা তার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। আবরারের বুকে মুখ গুজে নিবিড়ভাবে লেপ্টে থাকে সে। আবরার ও তাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে। সে জানে রাইসা কাঁদছে। নিঃশব্দে অশ্রু ঝড়াচ্ছে। আবরার কিছু বললো না। জেনেও না জানার ভান করে দাঁড়িয়ে রইলো, হয়তো এটাই তাদের সম্পর্কের বোঝাপড়া__________________
দিন কাটতে লাগলো। একদিন, সপ্তাহ, মাস করতে করতে পাঁচমাস কেটে গেলো। অয়ন তার চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না প্রাপ্তির যত্নে। প্রাপ্তির থিসিসের কাজ চলছে। কিন্তু তার ঘর থেকে বের হওয়া বারণ। অয়ন হেডস্যার মঈনুদ্দিন সাহেবের সাথে কথা বলে নিয়েছে। প্রাপ্তির সাথে কোনো সমস্যা না হয় সেই খেয়াল অয়নের সর্বক্ষণ। প্রাপ্তির পেটটা বোঝা যাচ্ছে তবে জীর্নকায়া হবার জন্য বেশি একটা বাড়ে নি। প্রাপ্তির কান্নাঘরে যাওয়াটাও বারণ করে দিয়েছে অয়ন। মোটামুটি প্রাপ্তিকে তুলোর চাদরে জড়িয়ে রাখতে পারলে হয়তো সে শান্তি পেতো। প্রাপ্তি তার কোনো কিছুতে বাধা দেয় না। করছে করুক, সমস্যা কি! কিন্তু সম্পর্কটা এখনো একই জায়গায় এসে আটকে আছে। প্রাপ্তির মনে সে আগের জায়গাটা এখনো পাওয়া হয় নি অয়নের।
হাসপাতালের বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাইসা। কলিগের বাচ্চাটা অসুস্থ তাই তার এখানে আসা। হাসপাতালের করিডোরে তার সাথে একজনের ধাক্কা লাগে। সাথে সাথেই রাইসা বলে,
– সরি। আসলে আমি খেয়াল করি নি, সরি
– ইটস ওকে। আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।
রাইসার সামনের মানুষটি আর কেউ নয় সেই ডাক্তার সে রাইসার অপারেশন করেছিলো। রাইসা মুচকি হেসে বলে,
– স্বাভাবিক। বছর দুয়েক আগে, আমি এখানে এডমিট হয়েছিলাম। আপনি আমার অপারেশন করেছিলেন।
– হ্যা, রাইসা। আসলে বয়সের সাথে সাথে স্মৃতি গুলো ঝাপসা হয়ে গেছে৷ তোমার কি অবস্থা বলো?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
– বিয়ে টিয়ে
– জ্বী এক বছর হতে চললো।
– যাক আলহামদুলিল্লাহ, আসলে তোমার বাবা খুব চিন্তায় ছিলেন। তুমি কখনো মা হতে পারবে না ব্যাপারটি তিনি মানতে পারেন না। আমি বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি লাভ হয় নি। আলহামদুলিল্লাহ, এখন তুমি ভালো আছো।
ডাক্তারের কথা শুনে…………
চলবে
[আজ দুইটি পর্ব দেওয়া হবে না। শরীরটা এখনো ভালো হয় নি। তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আগ থেকে। পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি