এক_ফালি_রোদ
৩৯তম_পর্ব
প্রাপ্তি সমুদ্রের ধারে পানিতে পা ঢুবিয়ে ধারিয়ে আছে। গাঢ় লাল সূর্যটি সমুদ্রে মিলিয়ে যাচ্ছে। নীল সমুদ্র লালচে হয়ে আসছে। এই মনোরম দৃশ্যটি মন ভরে দেখছে সে। হঠাৎ কেউ চোখ চেপে ধরলে প্রাপ্তি নির্বিকার চিত্তে বলে,
– অয়ন।
– কিভাবে বুঝলে?
– আমি বুঝি
– প্রাপ্তি তোমাকে কিছু বলার আছে।
– আমি জানি, কি বলবেন
– তাই বুঝি?
– হুম, আপনি সামনের সপ্তাহে ব্রাজিল চলে যাচ্ছেন, তাই তো? আমি ফার্মহাউজে থাকতেই কথাটা জানি।
প্রাপ্তির দৃষ্টি এখনো ডুবন্ত সূর্যটিকে দেখছে। অয়ন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মিথ্যে অভিনয় ধরা পড়ে গেছে। তিনটি মাসের অভিনয় মেয়েটি ধরে ফেলেছে। তাও পাঁচদিন আগেই। অথচ একটিবার সে অয়নকে বুঝতে দেয় নি। এতোটা স্বাভাবিক ছিলো সে অয়ন তার অভিনয়ের কাছে হার মেনে নিয়েছে। সব কিছু জানার পর ও কতোটা ঠান্ডা ব্যাবহার করছে প্রাপ্তি। কোনো রাগ নেই, কোনো চিৎকার নেই৷ কিন্তু আজ যখন নিজ থেকে অয়ন এই অভিনয়ের ইতি টানতে চায় সেদিন ই কেনো এমনটা হলো। অয়ন আমতা আমতা করে বললো,
– তুমি যা ভাবছো
– আমি কিছু ভাবছি না, আমার ভাবনা গুলো সব হারিয়ে গেছে। আমি আর নতুন করে কিছু ভাবতে চাই না, আসলে পারবো না। আমি আমার নিয়তি মেনে নিয়েছি। সুখ আমার জন্য নয়৷ আমি আর সুখ খুজতেও চাই না। শুধু একটা প্রশ্ন কেনো? এতো অভিনয় কেনো? আপনি ই তো বলেছিলেন আপনি সুখী হতে চান আমার সাথে তাহলে কেনো?
প্রাপ্তির কন্ঠ কাঁপছে। অয়ন ভাবলো হয়তো মেয়েটি আবার কাঁদবে। কিন্তু এমনটি হলো না। প্রাপ্তি তা কষ্টের বহিঃপ্রকাশ করলো না। অয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেললো এরপর বললো,
– রাইসার শেষ দাবি ছিলো। বিয়ের আগেই আমার ব্রাজিলে যাবার কথা ছিলো। আমার ভিসার কাজ চলছিলো। কিন্তু রাইসাকে আমি ফিরাতে পারি নি। তাই
– তাই আমাকে ঠকানোর নাটকটা শুরু করলেন। তাই তো!
– প্রাপ্তি আমি জানি তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না। আমি তোমাকে বলবো না আমাকে ক্ষমা করো। তবে একটি বার আমার কথাটা শোনো। আমি তোমাকে সব খুলে বলবো আজ। আমার কথাটা শোনো প্রাপ্তি।
– আমি শুনছি, আমি খুব ভালো লিসেনার। আপনি বলুন। আমি আবারো শুনবো।
– তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না তাই তো? তবুও আমি আজ বলবো। প্রাপ্তি আমি সুখ খুজছিলাম ভুল জায়গায়, নিজের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত রেখে আমি আমার বাহিরের আঘাতে মলম দিতাম। আমি পালাতে চাইতাম হাজারোবার। রাইসার স্মৃতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে ব্রাজিল যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এর মাঝেই তোমাকে বিয়ে করার প্রেসার আসতে লাগলো। যখন দাদীজান ও বিয়েতে সম্মতি দিয়ে দিলেন আমার ভেতরে একপ্রকার রাগ, জেদ বাসা বাধতে লাগলো। আমার কাছে সবাই শত্রুর মতো লাগতে লাগলো। আমি ভেবেছিলাম বিয়ের আগেই আমি পালাতে পারবো। ব্রাজিল চলে গেলে কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। আমি আমার স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে পারবো। নতুন করে সুখ খুজতে পারবো। ক্ষতগুলো ভরে যাবে। কিন্তু আমার পরিকল্পনাটি সফল হবার আগেই রাইসা আমার কাছে আবদারটি করলো। রাইসাকে ফিরিয়ে দেবার সাধ্য আমার ছিলো না। তাই আমি বিয়েরে অমত করলাম না। বিয়ের আগে ভেবেছিলাম একটা বিয়েই তো এটা আর এমন কি, বিয়ের পর ই না হয় পালিয়ে যাবো। কিন্তু সেদিন পার্কে তোমার সামনে সত্যিটা বলার সাহস হলো না। তোমাকে দেখে মনে হতো তুমিও আমার মতোই একা একটা মানুষ, আমাদের আশেপাশে মানুষ তো আছে কিন্তু ভেতর থেকে আমরা একা। তাই ঠিক করলাম বিয়েটাতে নিজেকে মানিয়ে নিবো কারণ ব্রাজিল না যাবার আক্ষেপটা আমার হৃদয়কে বারবার আঘাত করতো। মনে হতো আমি নিজের সুখ থেকে দূর হয়ে গিয়েছে। বিয়ের রাতে ভেবেছিলাম সম্পর্কটা স্বাভাবিক রাখার নাটক করলে হয়তো আমি ধীরে ধীরে বিয়েটাতে, তোমাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবো। কিন্তু তা হলো না, বরং অপরাধবোধে ডুবতে লাগলাম। কিন্তু তোমার থেকে দূরেও নিজেকে রাখতে পারতাম না। তোমার প্রতি উদাসীন আচারণ করতাম। তাই কাজের অযুহাতে দূরে থাকতাম। ভাবতাম হয়তো মানসিক যন্ত্রণা কমবে। কিন্তু যখনই তোমাকে কাছে পেতাম আমি যেনো নেশাগ্রস্তের মতো তোমাতে ডুবতে চাইতাম। যারা মাদকাসক্ত থাকে তারা যেমন মাদক থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে না। আমিও পারতাম না। এই তিনমাসে তুমি আমার বাজে অভ্যেসে পরিণত হয়েছিলে। শুধু অভ্যেস নয় নেশা। তুমি আমার সেই নেশা যা আমার ভেতরের ক্ষতগুলো ঠান্ডা পরশ বুলিয়ে দিতো। আমি নিজের সাথে নিজেই ছলনা করেছি। চোখের সামনে থাকতেও আমি নিজের সুখকে পায়ে ঠেলেছি। সেদিন সকালে যখন তোমাকে খুজে পাচ্ছিলাম না আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলাম কেনো কাজে গেলে আমি পাগলের মতো বাসায় আসার তাড়া করতাম। কেনো তোমায় জড়িয়ে ধরলে আমি আমার সব ক্লান্তি ভুলে যেতাম। প্রাপ্তি অজান্তেই আমি তোমাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমি সত্যি ব্রাজিলে যাবার কথা চিন্তাও করি নি। তিন মাস আগে আমি তাদের বলেছিলাম আমার সময় লাগবে। তারা বলেছিলেন এই ভিসাটা তিন মাস পর্যন্ত থাকবে। সামনের সপ্তাহে না গেলে আমার ভিসা ক্যান্সেল হয়ে যাবে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার তাতে আফসোস নেই। আমি আমার স্বপ্ন গুলো তোমার সাথে পূরণ করতে চাই প্রাপ্তি। আর মিথ্যে অভিনয় নয় আমি এবার সত্যি সত্যি তোমাতে বাধা পড়তে চাই। আমাকে একটা সুযোগ দাও প্রাপ্তি। একটা সুযোগ
অয়ন প্রাপ্তির উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো। প্রাপ্তি নিশ্চুপ। সে একটা কথাও বলে নি, নিশ্চুপভাবে অয়নের কথাগুলো শুনেছে শুধু। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, তার দৃষ্টির সূর্যের শেষ লাল আভাটিকে দেখছে। আশেপাশে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আর মানুষের হাসির কলরব। শুধু তার দুজন চুপ। পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও তাদের মনের মাঝে ক্রোশের পথের দূরত্ব। অয়ন একরাশ আশায় প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অবশেষের সূর্যাস্তের সাথে সাথে প্রাপ্তির মুখে বুলি ফুটলো। যন্ত্রের মতো সে বললো,
– আমি যে আর কোনো সুযোগ দিতে চাচ্ছি না এই সম্পর্ককে। আমি মুক্তি চাই! এই মিথ্যে সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই।
– প্রাপ্তি! আমি তোমাকে আর কোনো মিথ্যে সম্পর্কে বাঁধবো না।
– কেনো? ভালোবাসেন আমায়?
-………
– উত্তর নেই। হাহাহা। আজও আপনার কাছে উত্তর নেই। আপনি শুধু রাইসা আপুকেই ভালোবাসেন। আপনার হৃদয়ে শুধু তার বিচরণ ই রয়েছে। শুধু শারীরিক চাহিদার জন্য আমাকে আপনার দরকার। আর কিছুই নয়।
প্রাপ্তি থামলো। তার কন্ঠ আবারো কাঁপছে৷ তার বুক চিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো৷ সে এবার বরফ শীতল কন্ঠে বললো,
– আমি আজ আপনাকে মুক্তি দিতে চাই৷ নিজেও মুক্ত হতে চাই। বাকিটা পথ আমি কোনো ছলনাতে কাটাতে চাই না। আমি একা থাকবো তাতেও আমার আক্ষেপ নেই। তবে এই মিথ্যের জালে থাকতে চাই না। আবারো মরীচিকার পেছনে ছোটার ইচ্ছে নেই আমার। আমি বাঁচতে চাই। আপনজন খোঁজার দুষ্কর কাজটি আমি আর করতে চাই না।
অয়ন হতাশাময় দৃষ্টিতে প্রাপ্তির যাবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার দম বন্ধ লাগছে, কষ্টে তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কিন্তু প্রাপ্তিকে আটকানোর সাহস হলো না। প্রাপ্তি চলে যাচ্ছে। সৈকতের ধার বেয়ে সে হেটে চলেছে। ধীরে ধীরে সে লোকালয়ে মিলিয়ে গেলো। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। আধারে ঢেকে গেছে সাগর। অয়নের জীবনের শেষ এক ফালি রোদটুকু মিলিয়ে গেছে। কিন্তু এবার সে হার মানব না। রাইসার মতো প্রাপ্তিকে নিজের থেকে হারিয়ে যেতে দিবে না। প্রাপ্তিকে হারালে সে আবারো হারিয়ে যাবে। অন্ধকারে নিজেকে বিলীন হতে দিবে না এবার অয়ন। সেও সুখী হতে চায়৷ আর তার সুখে প্রাপ্তিতে মিশে রয়েছে। অয়ন এবার নিজের ভালোবাসাকে হারাতে দিবে না______________
বসারঘরে বসে রয়েছে, সিকদার পরিবার। শেফালী বেগমের মুখে আধার নেমে এসেছে। মহীমা বেগম মুখ শক্ত করে বসে রয়েছে। নাসির সাহেব মাথা নিচু করে রয়েছেন। টি টেবিলের উপর একটি রিপোর্ট। তার সামনে আবরার এবং রাইসা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আবরার তার মিথ্যে রিপোর্টটি পরিবারের সামনে রেখেছে। এতোবড় ধাক্কাটি সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি সবাই জানানোর ইচ্ছে তার ছিলো না। কিন্তু না জানানোর উপায় ও দেয় নি শেফালী বেগম। কিছুদিন পূর্বে………
চলবে
[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি