এক_ফালি_রোদ
৩৭তম_পর্ব
অয়নের হাত ধরে আসতে আসতে ছাদে গেলো প্রাপ্তি। ছাদে গিয়ে যা দেখলো তাতে যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না প্রাপ্তি। ছাদটি ফুল এবং বেলুনে সাজানো। ছাদটি বেশ ছোট কিন্তু ছিমছাম। ছাদের রেলিংটা মাজা অবধি। কর্ণিশ বরাবর ফুলের টব সাজানো। রঙ বেরঙ্গের বেলুনের ঘনঘটায় আরোও মনোমুগ্ধকর লাগছে। ঠিক মাঝবরাবর একটি টেবিল সাদা কাপড়ে ঢেকে রয়েছে। ঠিক তার উপর একটি চকলেট কেক সাজানো, পাশে একটি ছুরি, আর কিছু গোলাপের পাঁপড়ি। প্রাপ্তি আরোও অবাক হলো, সে বাড়িটিতে কোনো মানুষের ছায়াও দেখে নি রাইসা। তবে এতো আয়োজন করলোটা কে! ভুত! প্রাপ্তি অবাক নয়নে অয়নের দিকে তাকালো। অয়ন তখন তার ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে বললো,
– এতো অবাক হবার কিছু নেই, ভুত আসে নি। সকালে এসে আমি এগুলো করেছিলাম। আর কেকটা ফ্রিজে রেখেছিলাম। আমরা আসার সময় আলম মামা, আমাদের কেয়ারটেকার যিনি তাকে বলেছিলাম কেকটা টেবিলে রেখে দিতে।
– আপনি না বললেন, ম্যাগাজিনের এডিটর ফোন করেছিলো।
– ওহ, তাই বলেছিলাম বুঝি। মনে নেই তাহলে!
– এতো সব করার কি সত্যি দরকার ছিলো?
অয়ন উত্তর দিলো না, শুধু প্রাপ্তির সামনে দাঁড়িয়ে তার কপালে ঠোঁটের উষ্ণ ছোয়া দিয়ে বললো,
– হ্যাপি বার্থডে
প্রাপ্তি ছলছল নয়নে অয়নের দিকে তাকালো। তার কেনো যেনো খুব কান্না পাচ্ছে। বাবা মারা যাবার পর এই প্রথম তার জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। ইসমাইল সাহেবের এই জন্মদিন পালন জিনিসটা বেশ অপছন্দ। তার নিজের মেয়ের কখনো জন্মদিন পালন করেন তিনি। সুতরাং আশ্রিতা মেয়ের জন্মদিন পালন করার প্রশ্ন উঠে না। প্রাপ্তির খুশি আজ বাধ মানছে না। তড়িৎ গতিতে সে অয়নকে জড়িয়ে ধরে। প্রাপ্তির এরুপ কাজে বেশ অবাক হয় অয়ন। প্রাপ্তির এভাবে অতর্কিতে তকে জড়িয়ে ধরবে এটা তার কল্পনাতে ছিলো না। নিজের বিস্ম্যের দুনিয়া থেকে বের হয়ে খেয়াল করলো প্রাপ্তি কাঁদছে। তার বুকে মুখ লুকিয়ে সে কাঁদছে। অয়ন বেশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। প্রাপ্তিকে একটু সুখের ঝলকানি দেখাতে আজকের এতো আয়োজন। এই আয়োজনে যদি প্রাপ্তির চোখে পানি এনে দেয় তবে সারাদিনের খাটুনি বৃথা। আলতো হাতে প্রাপ্তির মুখটা তুলে ধরলো অয়ন। ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– কাঁদছো কেনো? তুমি খুশি হও নি?
– আপনি জানতেন আমার জন্মদিন?
– জানতাম না, উড়ো কথায় একটু কান দিয়েছিলাম। তোমার ভালো না লাগলে বলতে পারো। আমি সব খুলে ফেলছি।
– খোলার প্রয়োজন নেই। আমি খুব খুশি হয়েছি। খুব। আজ আমার জীবনের সবথেকে আনন্দের দিন। বাবা-মাকে হারানোর পর এতোটা আনন্দ আমার জীবনে কখনোই আসে নি। ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ।
মানুষের এই অনুভূতি গুলো খুব জড়ানো। আনন্দ কিংবা দুঃখ কিংবা রাগ যেকোনো অনুভূতিতে এই সোডিয়াম ক্লোরাইড মিশ্রিত এই পানিটা গড়িয়ে পড়ে। প্রাপ্তি কাঁদছে, হাউমাউ করে কাঁদছে। তার ঠোঁটের কোনায় হাসির মিষ্টি আভা লেগে রয়েছে। কিন্তু চোখ অক্লান্তভাবে বন্যা গড়াচ্ছে। অয়ন আলতা হাতে জড়িয়ে ধরে রয়েছে প্রাপ্তিকে। কেকটা গলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু এখনো কাঁটা হয় নি। কারণ প্রাপ্তি কাঁদছে। অয়ন তাকে বাঁধা দিচ্ছে না। মেয়েটার কান্নামিশ্রিত মুখখানা যে তার খুব প্রিয়। সে প্রাপ্তিকে না ভালোবাসলেও তার এই রুপটাকে ভালোবাসে। মেয়েটি তাকে প্রতিনিয়ত অবাক করে, সে বিস্মিত হয়। মেয়েটির রুপে, মেয়েটির গুনে। তার সাথে সাথে গ্লানির পরিমাণটুকুও বাড়ছে। প্রতিনিয়ত গ্লানির চোরাবালিতে সে ডুবছে। সে একটা মেয়েকে ঠকাচ্ছে। কিন্তু এই ঠকানোটা ইচ্ছেকৃত নয়। সে মেয়েটাকে আশা দিতে চায় না, কিন্তু মেয়েটির আধারে ঢাকা মুখটি তার ভালো লাগে না। তাই কারণে অকারণে তাকে আশার আলো দেখায়। মন্দ লাগে না অবশ্য। মেয়েটির হাসিমুখটা দেখলে চিন্তার কালো মেঘগুলো সরে সরে যায়। আচ্ছা যদি কখনো ধরা পড়ে যায় প্রাপ্তির কাছে! মেয়েটির কাছ থেকে ক্ষমা ভিক্ষা চেতে পারবে তো?
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গে রাইসার। মাথাটা ঝিম ধরে রয়েছে তার। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো খেয়াল নেই। আস্তে আস্তে উঠে বসে সে। বিকেলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মস্তিস্কের কোষগুলো ভিডিও ক্যামেরার রিলের মতো মস্তিস্কের পর্দায় পূনরায় দেখায়। রাইসার অনুভূতি শুন্য লাগছে। নিজেকে একটি মোমের পুতুলের ন্যায় লাগছে। রাইসা উঠে অযু করে নামাযে দাঁড়ায়। বুকের মাঝে ভারী পাথর চেপে বসে রয়েছে। অশান্তি লাগছে তার, কিন্তু কান্না আসছে না। হাউমাউ করে কাঁদছে পারলে হয়তো এই পাথরটা নেমে যেতো৷ রাইসা নামায পড়ে কিছুক্ষণ নামাযের পাটিতে বসে রইলো সে। আবরারের সাথে কথা বলতে হবে কিন্তু কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারছে না রাইসা। মোনাজাতে শুধু একটা দোয়াই করলো রাইস,
” আমাকে সহ্য ক্ষমতা দাও, ধৈর্য্য দাও”
নামাযের পাটি গুছিয়ে বিছানা বসে রাইসা। সাইড টেবিলে এখনো রিপোর্টগুলো এলোমেলো হয়ে রয়েছে। রাইসা রিপোর্টগুলো গুছিয়ে রাখলো। তার নিজেকে সময় দিতে হবে। এতোবড় ধাক্কাটিকে সামলে নিতে তার কিছু সময় লাগবে। এখন অনুভূতিগুলো তার মাথায় জেকে বসেছে। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা অবধি করতে পারছে না। তার সময় প্রয়োজন। ঠিক এমন সময়ে আরবার রুমে প্রবেশ করে। রাইসা তাড়াতাড়ি আলমারীর দরজাটা লাগিয়ে দেয়। রাইসার দিকে কুন্ঠিত নজরে একবার তাকায় আবরার। সে বিচলিত। এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে তার মাঝে। আবরার তাকে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– তুমি ঠিক আছো?
– আমার কি হবে? আমি ঠিক আছি।
নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টায় লিপ্ত রাইসা। আবরার খাটে বসে। রাইসাকে পাশে বসবার জন্য ইশারা করে। রাইসা বিনা সংকোচে তার পাশে গিয়ে বসে। রাইসার ইচ্ছে হলো আবরারকে মুখের উপর কয়টা প্রশ্ন করবে। কিন্তু প্রশ্নগুলো গুছাতে পারছিলো না সে। কোথা থেকে শুরু করবে এই শুরুর পাতাটি যেনো হারিয়ে ফেলেছে। আবরার এবার নম্র গলায় বললো,
– রাইসা, আমার তোমাকে অনেককিছু বলার আছে। জানি অনেক আগে বলা উচিত ছিলো। কিন্তু বলার সাহসটা হয়ে উঠে নি। আজ বলতে ইচ্ছে করছে।
রাইসা চুপ করে রইলো। তার বুক টিপটিপ করছে। আবরারের মুখ থেকে কি একই কথাগুলো শুনবে যা সেই ফাইলের রিপোর্টে রয়েছে! ব্যাপারটা তাকে ভাবাচ্ছে। আবরারের মুখ থেকে শুনতেও কি একইরকম কষ্টকর লাগবে নাকি কষ্টের মাত্রাটা খানিকটা কমে যাবে! সেটা রাইসার জানা নেই। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। শাড়ির আচল দিয়ে ঘামটা মুছে নিলো রাইসা। তারপর বা হাতটা দিয়ে আচলটা শক্ত করে আকড়ে ধরে রইলো। আবরার তার ঘটনার সূচনা করলো। সূচনাটি এমন,
” দেড় বছর পূর্বে আমার একটি এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। এক্সিডেন্টে……….”
ঘন্টা খানিক পরে আবরার তার ঘটনার ইতি টানলো ঠিক এভাবে,
” রাইসা আমি বাবা হতে পারবো না”
রাইসা এখনো নির্বাক দর্শকের মতো বসে রয়েছে। তার মনে হচ্ছে সে দেখা সিনেমা দ্বিতীয়বার দেখছে। রাইসাকে মৌনতা অবলম্বন করতে দেখে আবরার তার হাতখানা নিজের মুঠোয় নিলো,
– আমাকে ক্ষমা করে দাও রাইসা, তোমাকে ঠকিয়েছি আমি। যখন বারবার বাচ্চা নিয়ে তুমি কথা বলতে তখন খুব অপরাধবোধ হতো আমার। গ্লানিতে চোখ নিচু হয়ে যেতো। আমি তোমাকে মাতৃত্বের সুখ দিতে পারবো না রাইসা। আমাকে ক্ষমা করে দেও।
রাইসা এখনো নির্বাক। সে মোমের পুতুলের ন্যায় বসে রয়েছে। আবরার তার উত্তরের প্রতীক্ষায় তার মুখপানে চেয়ে রয়েছে। ঘরে পিন পতন নিরবতা। শুধু ফ্যানের ঘ্যারঘ্যার শব্দটা শোনা যাচ্ছে___________________
অয়নের কাঁধে মাথা রেখে পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে রয়েছে প্রাপ্তি। তার দৃষ্টি পুকুরের অফুটন্ত পদ্মগুলোর দিকে। শেফালী বেগমের পদ্মফুল ভালোলাগে বিধায় এই পদ্মপুকুরটি বানিয়েছেন নাসির সাহেব। এই পুকুরে বিভিন্ন রঙ্গের পদ্মের কলি দেখা যাচ্ছে। প্রাপ্তি সেই পদ্মগুলোর দিকে চেয়ে রয়েছে। যদিও গ্রাম অঞ্চলে রাত খুব তাড়াতাড়ি হয়, কিন্তু পুকুরঘাটে লাগানো বড় এল.ই.ডি লাইটে সবকিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। প্রাপ্তি এবং অয়ন বিকেলের পর থেকে এখানেই বসে রয়েছে। কখন সন্ধ্যে হলো, রাত হলো তাদের খবর নেই। প্রাপ্তি এক মনে বসে রয়েছে দেখে অয়ন ও বসে রয়েছে। পা দোলাতে দোলাতে আনমনে প্রাপ্তি বললো,
– জানেন, এমন করে জন্মদিন পালন করার কথা আমি শুধু স্বপ্নে ভাবতাম। ভাবতাম, আমার যখন নিজের পরিবার হবে তখন আমার পরিবার আমার জন্য এসব করবে। আমার পরিবার আমাকে হেয় করবে না। আমাকে কেন্দ্র করে আমার পরিবার হবে৷ আমি আর একা থাকবো না। আপনি জানেন, খালু মানুষটা ভালো। কিন্তু বড্ড অনুভূতিহীন। তার জীবনটা অংকে অংকে কেটে গেলো। কোন কাজটা লাভ প্রদান করবে কিংবা কোন কাজটা করে লাভ হবে না কিংবা ক্ষতি হবে তিনি সবার আগে এই প্রশ্নের উত্তর খুজেন। জন্মদিন পালন করলে নাকি টাকার অপচয় ব্যাতীত কিছুই হয় না। তাই তিনি এসবে মোটেই সময় নষ্ট করতেন না। প্রতিবার জন্মদিনে রাইসা আপু আমাকে উপহার দিতো৷ এই ধরুন কোনো রঙ্গ পেন্সিল, কিংবা কোনো দামী কাগজ। আমার খুব কেক কাটতে মন চাইতো। কারণ বাবা আমার জন্য কেক নিয়ে আসতেন। আমরা তখন সবাই মিলে কাটতাম। আজ অনেকদিন পর কেক কেটেছি। অনেক বছর পর। তাই আনন্দ হচ্ছিলো। আর আনন্দগুলো অশ্রু রুপে বেরিয়ে এসেছিলো। আমি খুব ভাগ্যবান জানেন। আপনাকে পেয়েছি। আমার প্রাপ্তির খাতায় আপনি এসে জুটেছেন। ধন্যবাদ।
– আমার সাথে কক্সবাজার যাবে?
প্রাপ্তির কথার মাঝেই কথাটা বললো অয়ন। প্রাপ্তি তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমি গেলে অসুবিধা হবে না?
– না, যাবে? তাহলে সকালেই বেরিয়ে যেতে হবে।
– আমার সমুদ্র দেখা হয় নি কোনোদিন। এই প্রথম দেখবো। এই ট্রিপটা খুব স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার জন্য।
অয়ন মুচকি হাসলো। প্রাপ্তির চোখের কোনে আবার পানি জমছে। মেয়েটি খুশি হলে কেঁদে দেয়। এই স্বভাবটা অয়নের খুব ভালোলাগছে। মেয়েটিকে তার খুব ভালোলাগছে। অজান্তেই প্রাপ্তির ঠোঁটজোড়া ছুয়ে দিলো সে। প্রাপ্তি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। কিন্তু অয়নের তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে অতর্কিতেই প্রাপ্তিকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। রাতটা আরোও গভীর হচ্ছে, দুজন সুখ কুড়াতে ব্যাস্ত। শহর থেকে দূরে, বাঁশে ঘেরা এক আধার পল্লীতে_________
সকাল ৫টা,
প্রাপ্তির ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। মোরগের ডাকে নয়, অয়নের ফোনের রিংটোনে। কখন থেকে ফোনটা হুক্কা হুয়া করছে কিন্তু মালিকের হুশ নেই। সে প্রাপ্তিকে বুকে জড়িয়ে ভস ভস করে ঘুমোচ্ছে। প্রাপ্তি নিজেকে খুব কষ্টে অয়নের থেকে ছাড়ালো। ফোনটা এখন বাজছেই। প্রাপ্তি প্রথমে অনেক দ্বিধায় ভুগলো, এভাবে অন্যের ফোন কি ধরা উচিত হবে! কিন্তু পর মূহুর্তে ভাবলো জরুরি কিছুও হতে পারে। আজ অয়নের কক্সবাজার যাবার কথা সুতরাং জরুরি কিছু হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সব দ্বিধা ছেড়ে ফোনটি রিসভ করলো সে। ফোন রিসিভ করতেই এমন কিছু সে জানতে পারবে এটা কল্পনা করে নি। অপরপাশ থেকে…………..
চলবে
[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি