এক_ফালি_রোদ
৩৫তম_পর্ব
তাদের কথোপকথন কেউ আড়াল থেকে শুনতে পারে এটা যেনো মস্তিষ্কের নিউরনে কারোর ই সাড়া দেয় নি। রান্নাঘরের আড়াল থেকে তখন একটি ছায়া নিঃশব্দে সরে পড়ে। সেমাই হয়ে গিয়েছে। এখন সবাইকে দেবার পালা। রাইসার ও কাজ শেষ হয়ে গেছে। ফুলিকে দিয়ে সবাইকে ডাইনিং টেবিলে ডেকে পাঠায় সে। শুক্রবারের একটি সকালে সবাই একসাথে নাস্তা করবে এটাই শিকদার ভিলার নিয়ম। কিন্তু বাসায় দুটো ছেলেই এই নিয়মের ধার ধারে না। একজন যে হাটতে বেড়িয়েছে তার এখনো খোঁজ নেই আর অন্যজনের এখনো বিছানাটাও ছাড়া হয় নি। প্রাপ্তি নাস্তাটা টেবিলে দিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায়। আজকের দিনে কতো ঝামেলা হোক এটা সে চায় না। এই কয়মাসে কম কিছু তার নজর এড়ায় নি। নাসির সাহেব এবং অয়নের মাঝের দূরুত্বটি তার বুঝতে সময় লাগে না। তাদের মাঝে ঝামেলা ঝঞ্ঝাট যেনো জোরের ব্যাপার। যদিও অয়ন এখন নিজের এবং প্রাপ্তির সকল খরচ নিজেই চালায়। তবুও নাসির সাহেবের সাথে তার ঝামেলাটা এখনো স্বাভাবিক হয় নি। আজ ও যদি অয়নকে ডাইনিং টেবিলে না দেখেন তবে ঝামেলা শুরু করবেন। প্রাপ্তির মোটেই ভালো লাগে না পারিবারিক মানুষের মাঝে এই ঝামেলা গুলো। রুমে ঢুকতেই দেখলো অয়ন আয়নার সামনে রেডি হচ্ছে। কালো জিন্স আর হালকা আকাশী রঙ্গের চেক শার্টে তাকে বেশ মানিয়েছে। চুল গুলো জেল দিয়ে বেশ কায়দা করে স্টাইল করেছে। প্রাপ্তির একটু অবাক লাগলো, কারণ অয়ন বলেছিলো সে আজ সারাদিন রেস্ট করবে। প্রাপ্তি তার কাছে এসে ধীর গলায় বললো,
– কোথাও বের হচ্ছেন?
– হু, ম্যাগাজিনের এডিটর ফোন করেছিলো। রাতে কক্সবাজার যাবো সেই ব্যপারে।
– ওহ, নাস্তা টেবিলে দেওয়া হয়ে গেছে। খেয়ে বের হন।
বলেই বিছানাটা গুছাতে লাগলো প্রাপ্তি। অয়ন শার্টের কলারটা ঠিক করতে করতে বললো,
– শোনো, বিকেলে বাহিরে যাবো। তোমার তো তেমন কোনো শাড়ি নেই। আসার সময় একটা শাড়ি নিয়ে আসবো নে। কি রঙ পছন্দ তোমার?
– শাড়ি লাগবে না, আমি একটা ভালো থ্রি-পিছ পড়ে নিবো না হয়
– তর্ক করো না, তর্ক ভালো লাগে না। বলো না, কি রঙ্গের শাড়ি আনবো?
– খামোখা টাকা খরচ
– সেটা নিয়ে ভেবো না, বাজেট অল্প। এক-দেড় হাজারের বেশি আমি এফোর্ড করতে পারবো না জানোই তো। বলো, আমার দেরি হচ্ছে
– তাহলে একটা সাদা শাড়ি নিয়ে এসেন। সাদা রঙ আমার খুব ভালো লাগে।
– ঠিক আছে।
বলেই অয়ন রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। প্রাপ্তির অজানা এক কারণে মনটা আপ্লুত হয়ে উঠলো। এই প্রথম তার স্বামী তার জন্য কিছু কিনে আনবে। ভাবতেই অন্যরকম আনন্দের ঢেউ তার তার মনের আঙ্গিনায় আচড়ে পড়ছে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এলো এখনো আবরার বাসায় আসে নি। রান্না শেষে ঘামার্ত অবস্থায় রাইসা রুমে এলো। রান্নাঘরটা পশ্চিমের দিকে হওয়ায় রোদে জ্বলসে যাবার যোগাড়। তারাতারি গোসল করে নামাজ পড়ে নিলো রাইসা। ঘড়ির কাটা দুইটার ঘরে এসে ঠেকেছে। অথচ আবরারের দেখা নেই। একটু পর পর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে রাইসা। তার বারান্দা থেকে বাড়ির কেঁচিগেটটা ভালো ভাবেই দেখা যায়। কিন্তু লোকটা এখনো আসে নি। আজ শুক্রবার, এই সময় সরকারী চাকরীজীবিদের বন্ধের দিন। তাহলে লোকটা কোথায় গেলো! রাইসা ঘরের ভেতর পায়চারী করতে লাগলো৷ ফ্যানের স্পিড অনেক বেশি তবুও ঘামছে সে। হঠাৎ বাইকের হর্ণের শব্দ কানে এলো রাইসার। দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখলো আবরারের বাইক কেঁচিগেট দিয়ে ঢুকছে। এতোক্ষণ পর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রাইসা। আজকে একটা দক্ষযজ্ঞ বাধাবে সে। কোনো আক্কেল বলে জিনিস ই নেই এই লোকের। সেই ভোরে বেরিয়েছে লোকটা এখন সে ফিরেছে। মিনিট বিশেক বাদে আবরার ঘরে প্রবেশ করে। তার মুখে কোনো কথা নেই। সোজা টাওয়ালটি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে। রাইসা ভ্রু কুচকে আবরারের কাজটা দেখলো। তারপর হনহন করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো সে। সকালে লোকটার অপেক্ষায় থেকে নাস্তা করা হয় নি তার। এখন ক্ষুধার মাত্রাটা বেড়েছে। আর রাগের সাথে ক্ষুধার সম্পর্কটা সমানুপাতিক হার৷ রাগ যত বাড়বে ক্ষুধাও ততটাই বাড়বে। তাই খেতে নিতে চলে গেলো রাইসা। আবরার ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে ঘরটা শূন্য পেলো৷ ভেবেছিলো রাইসার প্রশ্নের তীরের সম্মুখীন হতে হবে তাকে। কিন্তু এমনটা কিছু ঘটলো না। এই সুযোগে আলমারিতে নিঃশব্দে ফাইলটা রেখে দিলো আবরার। একটা সত্য লুকাতে দশটা মিথ্যে বলতে হয়। আর সেই দশটা মিথ্যে লুকাতে হাজারটা মিথ্যে বলতে হয়। আবরারের অবস্থাটাও ঠিক তেমন। সত্য মাথে মিথ্যে মিলাতে হচ্ছে তাকে। তবে এতে তার বিন্দু মাত্র গ্লানি নেই। এই শাস্তি সে হাসিমুখে মেনে নিবে, কারণ রাইসাকে সে ভালোবাসে ______________
বিকেল ৪.৩০,
সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, প্রখর রোদের কিরণ বারান্দা থেকে প্রাপ্তির ঘরে ঢুকছে। বারান্দার রেলিং রোদে তপ্ত হয়ে উঠেছে। তবুও বেশ ভালো লাগছে প্রাপ্তির৷ এক কাপ গরম কফি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। ঠান্ডা বাতাসে তার চুল উড়ছে। এই জুন মাসের রোদের তাপটা বেশি থাকলেও আকাশের কোনায় কালো মেঘের ঘনঘটা বেশ ভালো করে বোঝা যায়৷ কোথাও হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দায় বসে এই বিকেলে কফি হাতে বই পড়তে মন্দ লাগছে না প্রাপ্তি৷ একা ঘরে বই তার খুব ভালো সাথী বলা যায়। আকাউকি বাদে কিছু তার একাকীত্বের সাথী হলে তা হলো এই বই। শত শত বাক্য শত শত অনুভূতি একটা বইয়ের মাঝে লুকিয়ে থাকে। প্রাপ্তি এখন যে বইটা নিয়ে বসে রয়েছে তা হলো রবী ঠাকুরের “শেষের কবিতা”। বইটির এই উক্তিটি যেনো প্রাপ্তির মনে গাথা রয়েছে,
“বিয়ের ফাঁদের জড়িয়ে পড়ে স্ত্রী-পুরুষ যে বড়ো বেশি কাছাকাছি এসে পড়ে, মাঝে ফাঁক থাকে না; তখন একেবারে গোটা মানুষকে নিয়ে কারবার করতে হয় নিতান্ত নিকটে থেকে। কোন একটা অংশ ঢাকা রাখবার জো থাকে না।”
প্রাপ্তির একটা কল্পনীয় স্বভাব রয়েছে। তা হলো সে যখন কোনো বই পড়ে তখন নিজেকে সেই চরিত্রে কল্পনা করে। এই যে এখন সে নিজেকে লাবণ্য ভাবছে। কিন্তু সবাই কি লাবণ্য হতে পারে! তবে অমিতের সাথে অয়নের বেশ মিল রয়েছে। কারণ দুজন ভং রচনা করতে পারদর্শী। কবি অমিতের কাছে লাবণ্যের চরিত্রকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন,
“অমিত অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছে, তাদের সৌন্দর্য পূর্ণিমা-রাত্রির মতো, উজ্জ্বল অথচ আচ্ছন্ন; লাবন্যর সৌন্দর্য সকাল-বেলার মতো, তাতে অস্পষ্টতার মোহ নেই, তার সমস্তটা বুদ্ধিতে পরিব্যাপ্ত। তাকে মেয়ে করে গড়বার সময় বিধাতা তার মধ্যে পুরুষের একটা ভাগ মিশিয়ে দিয়েছেন; তাকে দেখলেই বোঝা যায়, তার মধ্যে কেবল বেদনার শক্তি নয়, সেই সঙ্গে আছে মননের শক্তি। এইটেতেই অমিতকে এত করে আকর্ষণ করেছে। অমিতের নিজের মধ্যে বুদ্ধি আছে, ক্ষমা নেই, বিচার আছে ধৈর্য নেই; ও অনেক জেনেছে, শিখেছে, কিন্তু শান্তি পায় নি। লাবণ্যর মুখে ও এমন একটি শান্তির রূপ দেখেছিল যে শান্তি হৃদয়ের তৃপ্তি থেকে নয়, যা ওর বিবেচনাশক্তির গভীরতায় অচঞ্চল”
আচ্ছা তাকে নিয়ে কি কখনো অয়ন এরুপ ভাবে! সেও অয়নের মনে লাবণ্যের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত ব্যাক্তিত্ব হয়ে উঠতে চায়। তার মন জুড়ে, তার চেতনায় বিরাজ করতে চায়। কিন্তু সেটা কখনো হবে! প্রাপ্তি বোঝে অয়ন তাকে সম্পূর্ণ ভালোবাসে না। সে বোঝে অয়ন তার অতীত ভুলতে পারে নি। অয়নের উদাসীনতা তাকে মরীচাময় ছুরির মতো আঘাত করে, তার মনের ভেতর রক্তক্ষরণ ঘটায়, পচন ধরায়। কিন্তু সবুও সে সব সয়ে নেয়। ধৈর্য ধরে, ধৈর্য্যের ফলাফল তো আল্লাহ তায়ালা নিজে দেন। তাই সেও সেই ফলের আশায় প্রতীক্ষা করছে। একটা সময় ঠিক অমিতের মতো অয়নের ভং এর অন্ত হবে। সেদিন হয় লাবন্যের ন্যায় তার কাছে ফিরে আসবে অয়ন। হঠাৎ প্রাপ্তির চোখ কেউ দুহাত নিয়ে চেপে ধরে। হুট করে ঘটনাটা ঘটায় আতকে উঠে প্রাপ্তি। কিন্তু সেই মানুষটির গায়ের গন্ধটি তার বড্ড পরিচিত৷ চোখ বন্ধ করেও সে মানুষটিকে চিনতে পারবে। তাই আপনা আপনি মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো,
– অয়ন
– ধুর কোথায় একটু চমকে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কিছুই হলো না। তুমি বুঝে গেলে কি করে!
– আমি বুঝতে পারি।
অয়ন চেয়ারটা টেনে প্রাপ্তির পাশে বসলো। হাতের বক্সটি প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– যাও রেডি হয়ে নাও।
বক্সটি খুললো প্রাপ্তি। একটা খুব সুন্দর সাদা শাড়ি বক্সে রয়েছে। পাড় টি গাড় নীল, যেনো আকাশ নেমে এসে শাড়িতে। প্রাপ্তির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তার শ্যাম বর্ণের মুখখানা সূর্যের পড়ন্ত রশ্নিতে এক অপরূপ মোহনীয় সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে অয়নের চোখে ভেসে উঠলো। অজান্তেই তার হাতটা প্রাপ্তির কপালের চুল গুলো সরিয়ে দিলো। প্রাপ্তির গালের লাল আভাটা যেনো নেশা ধরিয়ে দিলো অয়নের চোখে। প্রাপ্তি ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– কোথায় যাবো আমরা?
– সারপ্রাইজ, এখন বলবো না। তুমি তৈরি হয়ে নাও। আর শোনো, মাথায় খোপা করো। খোপায় বেশ সুন্দর লাগে তোমায়।
প্রাপ্তি মুচকি হাসি হেসে ভেতরে চলে গেলো। প্রাপ্তি চলে গেলে অয়ন শুণ্য দৃষ্টিতে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রাপ্তি মেয়েটাকে সে ঠকাচ্ছে, প্রতিনিয়ত ছলানা করছে, এটা কি ঠিক হচ্ছে! অবশ্য প্রাপ্তির কাছে আসলে তার সব চিন্তাগুলো ধোয়াশা হয়ে যায়। তাকে হাসতে দেখলে বুকের বা পাশটা স্বস্তি পায়। এই অনুভুতিগুলো মারপ্যাঁচটা ঠিক বুঝতে পারছে না অয়ন৷ অনুভূতি মানুষকে মাঝে মাঝে গোলকধাধায় ফেলে দেয়। যেমনটা তার ক্ষেত্রে হয়েছে। এলোমেলো চেয়ারের উপরের বইটাকে গুছিয়ে ভেতরে আসে অয়ন। প্রাপ্তি শাড়ির কুচি ঠিক করতে ব্যাস্ত। পেটের খানিকটা অংশ বেশ উন্মুক্ত। অয়নের চোখ প্রাপ্তির পেটের বা পাশে তিলে আটকে গেলো। তিলটা তার বেশ ভালো লাগে। প্রাপ্তির গায়ের গন্ধটা বেশ মাতালকরা। ঢুবে গেলে ঢুবে যেতেই ইচ্ছে করে। অয়ন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো প্রাপ্তির পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়না থেকে অয়নের উপস্থিতি দেখতে পেরে ধীর কন্ঠে প্রাপ্তি বললো,
– কি দেখছেন?
– তোমাকে।
– অহ!
পকেট থেকে একটা বেলীফুলের মালা বের করলো অয়ন। মালাটি ডেসিং টেবিলের উপর রেখে বললো,
– খোপায় পড়ো, ভালো লাগবে
বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো অয়ন। প্রাপ্তির খরা পড়া মনোজমিতে আষাঢ়ের এক পশলা বৃষ্টি নেমে এলো। আনন্দের বন্যায় ভাসতে মন্দ লাগলে না। প্রাপ্যের খাতাটা তাকে নিরাশ করছে না অবশেষে।
শুক্রবার দিন হওয়ার আলমারী গুছানোর এর চেয়ে ভালো সময় রাইসা আর পায় নি। সাধারণত অন্যদিনে কলেজ থাকে। বাসায় এসে শরীরটা ছেড়ে দেয় তার৷ তাই আজকে আলমারিটা গুছাবে। আবরার বেশ অগোছালো করে রাখে আলমারীটা। মেজাজ খারাপ হয় রাইসার। জিনিসপত্র অগোছালো থাকলে তার মন্টা ভালো লাগে না। যা ভাবা তাই কাজ, আলমারী থেকে এক এক করে কাপড় নামাতে লাগে রাইসা। হুট করেই একটা ফাইল টুপ করে নিচে পড়ে যায়। ফাইলটা আগে কখনো আলমারীতে দেখে নি রাইসা। তাই কৌতুহলের মাত্রাটা বেড়ে যেয়। ফাইলটা খুলে দেখলো কিছু মেডিকেল রিপোর্ট। রিপোর্ট গুলো উলটে পালটে যা দেখলো তাতে এক মূহুর্তের জন্য মাথা ঘুরে আসলো তার। রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা রয়েছে………
চলবে
[পরবর্তী পর্ব আজ তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি