এক_ফালি_রোদ ৩৪তম_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
৩৪তম_পর্ব

প্রাপ্তির ঘুম ভাঙ্গলো সূর্যের তীর্যক রশ্নির উত্তপ্ত গরমে। নিজেকে অয়নের বুকে আবিষ্কার করলো সে। এই দৃশ্য খুব দুষ্কর। হাতে গোনা যাবে এমন সকাল। আজ তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। আর বিয়ের পর এই দিনটি এই প্রথম। মনে হাজার স্বপ্ন ডানা মেলেছে। তাই আজ মনটা আনন্দে গদগদ হয়ে রয়েছে। অয়নের রোদ একেবারেই পছন্দ নয়। চোখ মুখ কুচকে সে শুয়ে রয়েছে। তখনই প্রাপ্তির মাথায় একটা উটকো বুদ্ধি চেপে বসলো। অয়নের সাথে কখনোই মজা করবার সুযোগ সে পায় নি প্রাপ্তি। এই সুযোগটা হাতছাড়া করলো না সে৷ নিজের চুলগুলোর কিছু অংশ একত্রিত করে অয়নের চোখে মুখে সুরসুরি দিয়ে লাগলো। এতে অয়নের চোখ মুখ আরোও কুচকে আসলো। কিন্তু সে চোখ খুললো না। এবার প্রাপ্তি হাত দিয়ে সূর্যের দিকটা ঢেকে দিলো। এতে করে অয়নের কপালের ভাজগুলো সটান হয়ে গেলো। প্রাপ্তির আজ বেশ মজা লাগছে। এবার সে হাতটি সরিয়ে দিল, এতে জানালার ফাঁক দিয়ে আসা তীর্যক সূর্যের কিরণ অয়নের চোখেমুখে আছড়ে পরলো। অয়নের কপালের ভাজ আরোও একবার দৃশ্যমান হলো। প্রাপ্তির এমনধারা দুষ্টুমিগুলো মিনিট বিশেক ধরে চলতে লাগলো। একটা পর্যায়ে অয়নেরর ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরেও অয়ন বুঝতে দেয়নি সে জেগে আছে। প্রাপ্তি যখন আবারো আগের মত চোখের সামনে হাত আলোটি ঢাকতে যাচ্ছিলো, তখন ই খপ করে হাতটি ধরে ফেললো। প্রাপ্তির দিকে বাকা হাসি দিয়ে বললো,
– সকাল সকাল আমার ঘুম কেঁচে দেবার বুদ্ধি আটলে বুঝি?
– আপনি জেগে আছেন?

অয়নের কথাশুনে বেশ লজ্জা পেয়ে যায় প্রাপ্তি। সে তো মনের আনন্দে তার শখের ঘুমের সাথে লুকোচুরি খেলছিলো। কিন্তু এভাবে ধরা পড়ে যাবে বুঝতে পারে নি। অয়ন প্রাপ্তির প্রশ্নের উত্তর স্বরুপ বললো,
– সেই কখন থেকে! চোখ বুঝে তোমার দুষ্টুমিগুলো সহ্য করছিলাম৷
– তাহলে উঠলেন না কেনো?
– দেখছিলাম তোমার খেলা কতোক্ষণে শেষ হয়!
– হয়েছে হয়েছে, এবার আমাকে ছাড়ুন। এবং নিজেও উঠে পড়ুন।
– তোমাকে ছাড়ার কথাটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমি উঠবো কেনো?
– বাড়ে বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে যে? আপনি এই বেলা অবধি পড়ে পড়ে ঘুমোবেন?
– হ্যা, কারণ রাতে আমার জার্নি করতে হবে, এখন ঘুমোলে রাতে আর সমস্যা হবে না।

অয়নের কথাটি শুনে বেশ থমকে যায় প্রাপ্তি। তার তো কতোকিছু ছক কাটা ছিলো, আজ তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। আজ তার জন্মদিন। যদি তার বয়সটি এখন জন্মদিন পালনের নয়। তবুও দিনটি তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিয়ের পর এই প্রথম জন্মদিন তার। খালাবাড়ি থাকাকালীন সেভাবে করে জন্মদিন কখনোই পালন করা হয় নি তার। রাইসা ব্যাতীত কারোর মনেই থাকতো না দিনটির কথা। প্রাপ্তি ভেবেছিলো বিয়ের পর সব কিছু পালটে যাবে। কারণ এখন তার আপনজনের খাতায় কিছু মানুষ নাম লিখিয়েছে। কিছু স্বপ্নগুলো স্বপ্নই রয়ে গেলো। আজ রাতে আবারো কিছুদিনের জন্য অয়ন চলে যাবে তার কাজে। প্রাপ্তি নীরবতা ভেঙ্গে মলিন হাসি একে বললো,
– ওহ, বেশ আপনি রেস্ট নিন। আমি নিচে যাচ্ছি।

বলেই খাট ছেড়ে উঠে গেলো সে। অয়নের চোখে প্রাপ্তির হাসির মাঝের মলিনতাটি লুকালো না। কিন্তু সে কিছু জানার চেষ্টা করলো না। আজকাল সবকিছুই তার কেমন যেনো ছন্নছাড়া লাগে তার। নিজেকে জেলখানার কয়েদির নেয় মনে হয়। কারণ সে নিজের মাঝে নেই। মিথ্যের নাটক করতে করতে সে নিজেকে মিথ্যের সাথে জড়িয়ে ফেলছে। প্রাপ্তির সাথে ছলনা করতে করতে নিজের সাথেও যেনো ছলনাই করছে সে। সে তো জীবিত নয়। তার আত্নাটা মরে গেছে। শুধু এই পার্থিব শরীরটাকে যন্ত্রের ন্যায় সে টেনে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে খুব পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। পালিয়ে যাবার পথ ও তৈরি। কিন্তু তার এভাবে পালিয়ে যাবার পর বেঁচারী প্রাপ্তির কি হবে ভেবে আর পালাতে পারে না সে। মেয়েটি ভালোবাসা নামক আগুনে ঝাপ দিয়েছে। মেয়েটিকে ফেরাবার উপায় নেই। হয় সে এখান থেকে ঝলসে ছাই হয়ে যাবে নতুবা এখানেই সে দগ্ধ হয়্র সোনার খনি পাবে। কিন্তু সোনার খনি পাবার সম্ভাবনা নেই। মাঝে মাঝে অয়নের মনে প্রশ্ন জাগে,
“আমি এই মেয়েটিকে ভালো কেনো বাসতে পারি না? কেনো মেয়েটিকে মন থেকে আপন করে নিতে পারি না?”

পরমূহুর্তে মন তাকে উত্তর দেয়,
“তুমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছো, যে নিজেকে ভালোবাসে না সে কাউকে ভালোবাসতে পারে না; সে শুধু ছলনার আশ্রয় নেয়”

মনের উত্তর শুনে অয়ন থেমে যায়। মনের উপর তার জোর নেই। মন যে তার দরজাটি বন্ধ করে রেখেছে। তবে অয়নের খুব অনুতাপ হয়, মেয়েটি তাকে ভালোবাসে। সে অনুভব করতে পারে প্রাপ্তির ভালোবাসা। কিন্তু মনের দরজাটা একবার যেহেতু বন্ধ হয়ে গিয়েছে সেটাকে দ্বিতীয়বার খোলার ইচ্ছে তার নেই। আর মৃত মানুষ অন্তত কাউকে ভালোবাসতে পারে না।

দিনটি শুক্রবার। তাই ঘর গমগম করছে। নাসির সাহেব বসার ঘরে পেপার হাতে বসে রয়েছেন। অপেক্ষা কখন ফুলি চায়ের কাপটি নিয়ে আসবে। তাদের বাসায় একটি পারমানেন্ট কাজের মেয়ে রয়েছেন যার নাম ফুলি। ফুলি মেয়েটির যখন বয়স এগারো তখন সে এ বাড়িতে আছে। মহীমা বেগমের সাথে সে গ্রামে থাকতো। ফুলির মা যখন বেঁচে ছিলো তখন মহীমা বেগমের দেখাশোনা করতো। হুট করেই এক রাতে তার পেটে ব্যাথা শুরু হয়৷ রাতের বেলায় গ্রামে কবিরাজ কই পাবে ভেবে বাড়ির লোকেরা তাকে ঘরোয়া চিকিৎসা দিতে লাগে। কিন্তু তাতে কিছুতেই নিস্পত্তি মিলে না। ভোরে দিকে দু-তিনবার রক্ত বমি করেই পরলোকে পা বাড়ায় ফুলির মা। ফুলির বয়স তখন এগারো, বাবার ছায়া সে কখনোই পায় নি। তাই ফুলির মা মারা যাবার পর, মহীমা বেগম ফুলিকে এই বাড়ি নিয়ে আসেন। মেয়েটি এখন আঠারোতে পা রেখেছে। নাসির সাহেব ফুলিকে মেয়ের মতোই দেখেই তাই তাকেও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রাখেন নি। ফুলির কাজ মহীমা বেগমের দেখভাল করা, সে শেফালী বেগমকে “আম্মা” এবং নাসির সাহেবকে “আব্বা” বলে। ফুলির অপেক্ষার অন্ত ঘটলো, সে চায়ের কাপ হাতে হাজির হলো। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই নাসির সাহেব বললেন,
– কি রে, আজ এতো দেরি করলি যে?
– আর কইয়েন না আব্বা, ভাবী দুনোজনে রান্নাঘর ধকল করে লাইছে
– তাই নাকি?
– হ, তা তোর আম্মা কই?
– আম্মায় প্রথমে ঢুকতে গেছিলো। পরে ভাবীরা তারে বাইর করে দেছে। আজকে স্পেশাল নাস্তা বানানো হইতাছে।
– ওহ, তা তোর ছোট ভাইজান কি ঘুমেই রয়েছে।
– মনে হয়।
– আচ্ছা যা, দাদীকে একা ছাড়িস না।
– আইচ্ছা
– ঠিক ভাবে বল
– আচ্ছা।

ফুলির একটা বাজে স্বভাব সে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। কেউ শুধরে না দিলে সে তার কথার ধরণ বদলায় না। নাসির সাহেব আবারো পেপারে মন দিলেন।

আবরার সকালে যে হাটতে বেড়য়েছে এখনো ফেরে নি। রাইসা, ঘুম থেকে উঠে তাকে দেখতে পায় না। গতকাল এতোটা রাগ না করলেও হতো। কিন্তু নিজের ভেতরের ঝড়টিকে আটকাতে পারে নি সে। আবরারের সাথে কথা বলতে হবে। এভাবে নিজেদের মাঝে দূরত্ব বাড়িয়ে তো লাভ নেই, কারণ যে আসবে সে ভালোবাসার প্রদীপ হয়ে আসবে। সুতরাং সে আর মনে রাগ পুষে রাখবে না। আবরারের সাথে তার মুখোমুখি হওয়াটা খুব প্রয়োজন।
– আপু, মিষ্টিটা একটু দেখ তো। ঠিক আছে নাকি আরো দিবো?

প্রাপ্তির প্রশ্নে ধ্যান ভাঙ্গে রাইসার। প্রাপ্তি নিজ হাতে সেমাই বানাচ্ছে। রাইসা একটু চেখে দেখলো। মিষ্টিটা একটু বেশি। কিন্তু সে কিছু বললো না। কারণ প্রাপ্তির জন্মদিন আজ। সে নিজ মন থেকেই এই সেমাইটা বানাচ্ছে। চুলার ভাজিটুকু নাড়তে নাড়তে রাইসা জিজ্ঞেস করলো,
– আচ্ছা, অয়ন কি গিফট দিলো রে তোকে?

রাইসার প্রশ্নে থমকে যায় প্রাপ্তি। তার স্বামী তো জানেই না আজ তার জন্মদিন। তাই তার জন্য উপহার আনার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু সেটা রাইসাকে জানাবে না প্রাপ্তি। তাই বললো,
– আমার জন্য গতকাল রাতে সে অনেক কিছু করেছে। আমার পছন্দের রঙ্গের একটি শাড়ি কিনে এনেছিলো। জানো আপু, সে আমার জন্য খুঁজে খুঁজে বেলী ফুলের মালাও এনে রেখেছিলো। এর চেয়ে বেশি আর কি চাইবো বলতো
– যাক, ভালো লাগলো। অয়ন আর তুই নিজেদের মাঝে বেশ গুলেমিলে গেছিস।

প্রাপ্তির বুকটি কাঁপছে। সে মিথ্যে কথাটা কতো গুছিয়েই না বললো। নিজের প্রতিভায় নিজেই অবাক হচ্ছে। প্রাপ্তি আর কথা বাড়ালো না। সেমাই এর দুধটা কমে এসেছে। এখন সেমাই দিয়েই বন্ধ করে দিবে সে। রাইসাও তার কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। তাদের কথোপকথন কেউ আড়াল থেকে শুনতে পারে এটা যেনো মস্তিষ্কের নিউরনে কারোর ই সাড়া দেয় নি। রান্নাঘরের আড়াল থেকে তখন………..

চলবে

[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here