ফ্রেম_বন্দী_ভালোবাসা,পর্ব:4
সুরাইয়া_আয়াত
ভোরবেলাকার কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে হালকা সূর্যের আলোটা ঘরের ভিতরে পড়তেই সর্ব জায়গায় হালকা উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল সমগ্র রুম জুড়ে। স্নিগ্ধতার ঘুম ভাঙলো, কালকে রাত্রের কথা তার কিছুই মনে নেই, উঠে বসতেই দেখলো একটা ক্ষনিক পরিপাটি বিছানার উপর বসে আছে ও, আশেপাশে তাকানোর সুযোগ মিললো না তার আগে সবকিছু মনে করার একপ্রকার ব্যর্থ চেষ্টা করেও কোন উত্তর না পেয়ে নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হলো। ওর যতটুকু মনে আছে যে ও রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল আর তখন কেউ পিছন থেকে এসে একটা রুমাল দিয়ে ওর নাকে চেপে ধরে, কিন্তু ও না তাদের কণ্ঠস্বর শুনেছে আর না তাদেরকে দেখেছে তাই স্নিগ্ধতা বুঝতে পারেনি যে কে বা কারা এবং তাদের উদ্দেশ্যই বা কি আর ও এখানেই বা কি করে এলো।
কিছু মনে করতে না পারায় নিজের মাথার চুলগুলো স্নিগ্ধতা জোরে টেনে ধরতে বেশ জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো, হয়তো এই মুহূর্তে নিজের হিতাহিত জ্ঞান টুকুও হারিয়ে ফেলেছে ও। আসলে একটা মেয়ের জন্য তার সম্মান টা অনেক বড় জিনিস সেটা এখনো ওর মাঝে অক্ষুন্ন নাকি নেই, নাকি কোন নরপশুর হাতে তা বিলিয়ে গেছে তা স্নিগ্ধতার মনে নেই।
স্নিগ্ধতার চিৎকারের আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল সৌরভের, ওর দিকে তাকালো স্নিগ্ধতা, দেখা মাত্রই কেঁপে উঠলো আর সৌরভও হতবিহ্বল হয়ে স্নিগ্ধতার দিকে নির্বিকার চাহনিতে চেয়ে রইলো। স্নিগ্ধতা অবাক হয়ে সৌরভের দিকে তাকালো, এটা তো সেই মানুষটা যার সাথে ভার্সিটিতে একপ্রকআর রেষারেষি হলো ওর। সৌরভ এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে স্নিগ্ধতা, মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না হয়তো অবাক লাগছে এটা ভেবে যে সামান্য কিছু বিষয়ে কেও এভাবে তার প্রতশোধ নিতে পারে। অবাকের চূড়ান্ত সীমা কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে যেন খুবই কষ্টকর লাগছে স্নিগ্ধতার কাছে। তাহলে কি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সৌরভ ওকে এখানে এনেছে? সেটা ভাবতেই স্নিগ্ধতার চোখে জল চলে এলো। অনেকখন ধরে স্নিগ্ধতার হাবভাবের পরিবর্তন না দেখে সৌরভ এবার সোফা থেকে নিঃশব্দে পা দুটো নামিয়ে স্নিগ্ধতার দিকে হেঁটে গেল, মেয়েটার এতো কাছে গিয়েও তার হাবভাবের পরিবর্তন না দেখে সৌরভ এবার স্নিগ্ধতার দিকে খানিকটা ঝুঁকে গেল।
স্নিগ্ধতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সৌরভও নিস্তব্ধ হয়ে গেল, এই মুহূর্তে মস্তিষ্ক শূন্য প্রায়। শেষমেষ নিস্তব্ধতা আর সহ্যের সব সীমা ছাড়িয়ে সহ্য করতে না পেরে স্নিগ্ধতা ঠাস করে একটা চড় মেরে দিল সৌরভের গালে, চড়ের আওয়াজটা যেন ঘরের প্রত্যেকটা দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিফলিত হয় খানিকটা গমগম করে বেজে উঠলো, স্নিগ্ধতার গায়ের লোম শিউরে উঠলো।
চড় মেরে হাত কাঁপছে স্নিগ্ধতার , সমগ্র শরীর কাঁপছে। স্নিগ্ধতা ঢোক গিলল তবে ভয়ে নয় নিজের আত্মসম্মান এর খাতিরে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল
” আপনারা কি এই সমাজে মানুষ নাকি নরপশু? একটা মেয়েকে রাস্তায় একা পেয়ে তাকে বিছানায় টেনে আনতে ন্যূনতম বিবেকবোধ হলো না আপনার? স্বাধীনতা কোথায় আমাদের? রাস্তা ঘাটে একা চলাফেরা করাও কি অপরাধের? আপনাদের মত পয়সাওয়ালা মানুষদের কাছে টাকাটাই সবচেয়ে বড় জিনিস, আপনারা টাকা দিয়ে পুলিশের মুখ বন্ধ করে দিতে পারেন অনয়াশেই। আর আমার কি হবে? আমি কিভাবে এর জাস্টিস পাবো? এখন যদি আমি পুলিশের কাছে গিয়ে বলি যে আপনি মাঝরাস্তায় জোর করে গুন্ডা ভাড়া করে আমাকে তুলে এনেছেন শুধু আপনার বিছানায় টেনে আনার জন্য আর বদনাম করার জন্য তখন তারা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে? করবে না কারন তাদের মুখ তো টাকা দিয়ে বন্ধ। আর সমাজের কাছে কলঙ্কিনী হব আমি। আপনি টাকা দিয়ে হয়তো তার মুখ বন্ধ করে দেবেন, কলঙ্কিনী হব আমি, বাঁচার ইচ্ছাটাও তিলে তিলে হয়তো মরে যাবে আর তখন আমার নিঃশ্বেস হয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা কি আপনি নেবেন? ”
কথাটুকু বলে থেমে গেল স্নিগ্ধতা, চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। সৌরভ হাত মুঠিবদ্ধ করলো, স্নিগ্ধতার দিকে তাকালো। চোখের শিরা উপশিরাগুলো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে, যাতে চোখটাতে রক্তিম আভা। মেয়েটার চোখের জল যেন সৌরভের হৃদয়কে স্পর্শ করে উঠতে পারছে না। যে অপরাধ ও করেনি তার দোষারোপ করে যাচ্ছে মেয়েটা ক্রমাগত, না পেরে সপাটে একটা চড় মারলো সৌরভ।
চড় খেয়ে স্নিগ্ধতা যেন ছিটকে দূরে পড়ে গেল, সৌরভ রাগী চোখে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধতার দিকে, চড় মেরেও রাগটা কমেনি, এটা তো চড়ের বিপরীচে চড় আর স্নিগ্ধতা এখন যা বললো তার হিসাব? তার হিসাব লাগবেই, অকারনে কোন দোষারোপ নিজের ঘাড়ে নিতে রাজী নয় আবরার সৌরভ, তার ওপর এমন একটা অভিযোগ যেটা মান্য করার মতো নয়, একটা নারীর দূর্বলতা সুযোগ নেওয়ার মতো অভিযোগ? যেখানে সৌরভ কাল রাতে ওকে বাজে ভাবে স্পর্শ অবধি করেনি উল্টে হাতটার যত্ন নিয়েছে ও।
সৌরভ স্নিগ্ধতার হাতটা ধরে এক ঝটকায় নিজের কাছে টেনে আনতেই স্নিগ্ধতা সৌরভের ওপর পড়লো। চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরতেই স্নিগ্ধতা খানিকটা কুকিয়ে উঠলো।
স্নিগ্ধতার একেবারে কাছে গিয়ে সৌরভ বলল
” আমাকে রেপেস্ট প্রমাণ করার এতোই শখ গেলে আগে নিজের ভার্জিনিটি চেক করিয়ে নিও। ”
কথাটা বলে ধাক্কা মেরে বিছানায় ছুড়ে ফেলল স্নিগ্ধতাকে, হাপাচ্ছে স্নিগ্ধতা, ভয়ে ঘামছেও। দরজা ধাক্কা দিয়ে কোথায় বেরিয়ে গেল সৌরভ তা স্নিগ্ধতা বলতে পারেনা।
দৌড়ে স্নিগ্ধতা ওয়াশরুমে ছুটলো, এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে যেন সবকিছু ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। কে ভুল আর কে ঠিক তা জানে না এমনকি নিজেকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে অঝোরে কাঁদছে স্নিগ্ধতা।
কিছুখন পর বিছানা থেকে ওড়নাটা দিয়ে দৌড়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি বেয়ে নামছে আর কাঁদছে, কাওকে চেনে না ও আর না জানে এটা কোথায়। চারতলা থেকে নামতে নামতে নেতিয়ে ফ্লোরে হাঁপিয়ে দৌড়ে পড়ে গেল ও, হাতটা ছিলে গেল আর ঠোঁটটাও কেটে গেল খানিকটা, জ্ঞান হারাবো হারাবো এমন অবস্থায় কেও যেন সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে স্নিগ্ধতার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল
” এই মেয়ে ওঠো, আমি পৌছে দিচ্ছি।”
আর কিছু মনে নেই, পুনরায় জ্ঞান হারালো স্নিগ্ধতা। সিগারেটের অবশিষ্টাংশ দূরে ছুড়ে ফেলে একটা ক্লোরোমিন্ট মুখে পুরে আগের তুলনায় একটু নরম গলায় বলল
” চিন্তা নেই, একা পেয়ে কাওকে লুটে নেওয়ার ধান্দায় সৌরভ কখনো ছিলো না, তাড়াতাড়ি ওঠো দেরি হয়ে যাচ্ছে তুমি রাস্তাঘাট চেনো না। ”
“রাস্তাঘাট চিনি না এটা জেনেও এখানে তুলে এনেছেন কেন? ” এমন উত্তর টাই বোধহয় সৌরভ স্নিগ্ধতার থাকে আশা করেছিলো কিন্তু তা হলো না, স্নিগ্ধতার থেকে আওয়াজ এলো না। সৌরভ এবার মাটিতে বসে স্নিগ্ধতার দিকে বেশ খানিকটা ঝুকে স্নিগ্ধতার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো আর কোন কিছু না ভেবে স্নিগ্ধতাকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসালো।
ড্রাইভ করছে সৌরভ, নিজেকে কেমন কঠোর কঠোর লাগছে যেন, স্নিগ্ধতার দিক একটিবারের জন্য হলেও তাকাবে না এমন পন করেছে। হঠাৎ লুকিং গ্লাসের দিকে তাকাতেই না চাইতেও স্নিগ্ধতার দিকে চোখ পড়লো, ঠোঁট কেটে রক্ত গড়াচ্ছে। দেখা মাত্রই সৌরভ গাড়ি থামালো, নিমেষেই স্নিগ্ধতার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে অনেকখন যাবৎ তাকিয়ে রইলো। গাড়ির মধ্যে ফাস্ট এইড বক্স ছিলো তা থেকে মেডিসিন দিয়ে স্নিগ্ধতার ঠোঁটের রক্তের মুছে মলম লাগিয়ে নিলো।
হঠাৎ ফোনে কল আসতেই দেখলো মিম, কলটা ধরার ইচ্ছেটা এই মুহূর্তে নেই তাই ফোন সাইলেন্ট করে পকেটে রাখতে যাবে তখনই স্নিগ্ধতার দিকে তাকালো। কিছু একটা ভাবলো ভেবে ফোনটা নিয়ে ওর আর স্নিগ্ধতার কিছু ছবি তুললো সৌরভ। সৌরভ ফটোটা জুম করে বলল
” আবরার সৌরভকে চড় মারার সাহস দেখিয়েছে যে তাকে ফ্রেম বন্দী করবোনা এটা কখনো হয়? ”
চলবে,,,,