ফ্রেম_বন্দী_ভালোবাসা,প্রথম পর্ব

ফ্রেম_বন্দী_ভালোবাসা,প্রথম পর্ব
সুরাইয়া_আয়াত

” যার বাপের কোন ঠিক নাই, মাইয়া ভালো চরিত্রের নাকি বাপের মতো গা কেডা জানে আর এই মাইয়ার লগে আমার ছেলের বিয়া দিবো ভাবলেন কি কইরা। যেই দেখছে টাকা পয়সা আসে অমনি হামলায় পড়সে। ”

প্রতিবেশী একটা মহিলাও বলে উঠলেন
“মেয়ের ও বোধহয় স্বাভাব চরিত্র ভালো না, ঘাপটি মেরে সব কাজ সারে। ”
ব্রিশ্রি ভঙ্গিতে বললেন আর বিরষ কন্ঠে কুটুক্তি করে উঠলেন মধ্য বয়সী এক লোক, পাশে ঘটক হিসাবে আখ্যায়িত ব্যাক্তিটি খানিকটা ইতস্তত বোধ করছেন হয়তো ছেলের বাবার থেকে এমন ব্যবহার আশা করেননি। রাগে শিউরে উঠছে স্নিগ্ধতা আর তার মা নতজানু হয়ে আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছে এতো অপমানিত বোধ হতে হয়নি কখনো, শেষ অবধি কি না রক্তের টানে চরিত্র নিয়ে টানাটানি।

রাগে শরীর জুড়ে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো স্নিগ্ধতার, চিরকাল সবটা মুখ বুজে সহ্য করলেও আজ আর না, তেজস্বী কন্ঠে বলল
“মানুষের চেহারায় নয় তার কাজেই তার পরিচয় পাওয়া যায়, আর কতোটুকু বা চেনেন আপনারা আমাদেরকে যে আমাদের চরিত্র নিয়ে টানাটানি করছেন আর আমার বাবাকে তুলে কথা বলছেন। সাহস হয় কি করে আপনাদের। কম বেশি সকলেই জানে বেশ কয়েকবছর আগে আমার বাবা বাসা ছেড়ে রাগ করে বেরিয়ে যান তারপর আর ফেরেননি কই তাই বলে কখনো তো আপনারা আমার আর আমার মায়ের পাশে দাঁড়াননি তো। ”

কথাটুকু বলতেই স্নিগ্ধতার মা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে বলল
“স্নিগ্ধা চুপ কর মা, চুপ কর। ”

স্নিগ্ধতার কথা শুনে ছেলের বাবা বললেন
” মেয়ের তেজ দেখসো, এরে তো। ”

আর কিছু বলতে যাবেন তিনি তার আগে ঘটক ওনাকে সামলানোর পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে চেষ্টা করে বললেন
“ভাইজান এখান থেকে চলেন, ঝামেলা বাড়তাছে, বিয়া যখন দিবেন না কথা বাড়াইয়া লাভ নাই। ”

উনি স্নিগ্ধতাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন
” এই মেয়ের গুমোট ভাঙতেই হইবো। ”

উনি আর বেশি কিছু বলতে পারলেন না তার আগেই ওনাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। প্রতিবেশি মহিলাটি স্নিগ্ধতাকে ঈর্ষান্বিত চোখে তাকিয়ে বলল
“তোরে তো এই এলাকা ছাড়া করেই ছাড়মু আর তোর মা রেও, এইহানে কোন অবিচার চলতে দিমু না। ”
কথাটা বলে বেরিয়ে গেলেন উনি।

স্নিগ্ধতা রাগে ফুঁসছে, ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
“আর কতোবার বলবো যে এসব বিয়ের জন্য আর পাত্র আনবে না, আর কতোবার বারন করবো, কবে শিক্ষা হবে তোমাদের, কবে বুঝবে যে বাবা তোমাকে যেমন ছেড়ে চলে গেছে আমাকেও কোন একজন ছুড়ে ফেলে দিতে পারে, বিয়ে নামক জিনিসটার সাথে দারিদ্র্যতার সমানুপাতিক সম্পর্ক টা তোমরা আজ ও বুঝলেনা? ”

স্নিগ্ধতার এমন কথা শুনে পাশ থেকে ওর পাশের বাসার ফুপি বলে উঠলেন
“রাগ করিসনে মা, আমিই ঘটকরে বলসিলাম বিয়ার কথা এতে তোর মায়ের কোন দোষ নাই, আর আজ না হয় কাল তোর তো বিয়ে দেওন লাগবো তাই না?”

কথাটা শুনে স্নিগ্ধতা দ্রুত পায়ে ঘরে গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে বলল
“আমার সাথে তুমিও এবার এলাকা ছাড়ার জন্য তৌরি থাকো, তোমাকেও আমার সাথে নিয়েই আমি যাবো। ”

ব্যাগটা নিয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বেরিয়ে গেল স্নিগ্ধতা। এলাকার সবার মুখ বন্ধ করার জন্য এর একটা হেস্ত নেস্ত করা দরকার, আজ ওর মাথার ঠিক নেই, সব বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকে তাছাড়া ওর বাবা নেই বলে সবসময় এটা ওটা কটু কথা শুনতে হয় যাতে ওরা অভ্যস্ত। গজগজ করতে করতে রাস্তার ধারে এসে দাঁড়ালো স্নিগ্ধতা, রাস্তার পীচের উষ্ণতায় মনে হচ্ছে যেন পায়ের নীচে কেও আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, ব্যাগের কোনায় 40টাকা মতো পড়ে আছে তা দিয়ে রিকশা ভাড়া সহজেই হয়ে যায় তবে আজকে উষ্ন পিচের ওপর দিয়ে হেটে যাওয়ার ইচ্ছাটা জাগছে প্রবল তাই হাটা দিলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে, আজকে ওর লড়াইটা ওর নিজের সাথে আর মন ও মস্তিষ্ক জুড়ে আগুন জ্বলছে যেন!

ভার্সিটির গেট দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলেই হাতটা জ্বলে উঠতেই আহহ করে হাতটা সরিয়ে নিলো স্নিগ্ধতা, হাতটা দ্রুত ঝাড়া মেরে সেদিকে তাকাতেই দেখলো ফোসকা পড়েছে আর কিছু অংশ ছাল উঠে এসেছে, চোখে জল টলমল করে এলো স্নিগ্ধতার, পারলে যেন জ্বলে যাওয়া অংশ টা কেটে বাদ দিয়ে দেয়, হাত টায় ফু দিতে লাগলেই ফিসফিসানির কন্ঠস্বর পেলো স্নিগ্ধতা
“চল চল এখান থেকে চল, মেয়েটার হাতে পড়েছে,ওই শালা ফেললো ফেললো মেয়েটার হাতেই ফেললো,ভাগ্যিস সৌরভের গায়ে পড়েনি। মেয়েটার জানলে একটা তামাশা হবে, তাড়াতাড়ি চল। ”

কথাটা কান অবধি পৌছানো মাত্রই স্নিগ্ধতা দিক বেদিক না বুঝে সিঁড়ির দিকে যেতেই দেখলো দুটো ছেলে দ্রুত পায়ে হাটছে তাদেরকে দেখে স্নিগ্ধতা বলল
” এই দাঁড়ান, পালাচ্ছেন কোথায়? দাঁড়ান বলছি। ”

ছেলেদেরকে দ্রুত পায়ে হাটতে দেখে স্নিগ্ধতা দৌড়ে ওদের আগে ছুটে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে ওদিকে আটক করে বলল
” কি হলো পালাচ্ছেন কেন? আমার হাতের এই অবস্থা আপনাদের জন্য, এখন কি হবে? ”

ছেলে দুটো একে অপরের দিকে তাকালো, তারপর তাদের দুজনের থেকে একজন বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল
” আমরা আবার কি করলাম হ্যাঁ? ”

স্নিগ্ধতা রেগে দাঁতে দাঁত কিড়কিড় করে বলল
” না বোঝার ভান করছেন কেন? তাছাড়া আপনার মধ্যে সৌরভ বলে কেও একজন আমার হাতে অ্যাসিড ছুড়েছেন, আমার হাতটা অবস্থা কি করেছেন? ”

আর একটা ছেলে কিছু বলতে যাবে তখনই পিছন থেকে কারোর ছিটকে পড়ার সাথে সাথে কিছু ভাঙার আওয়াজ হলো। স্নিগ্ধতা সহ আর দুটো ছেলে পিছন ঘুরে তাকাতেই দেখলো একটা ছেলে ফ্লোরে পড়ে আছে, মাটিতে টেস্ট টিউব ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে আছে আর তার হাতটা কাচের ওপর। ছেলেটাকে পড়ে থাকতে দেখে ছেলে দুটো সৌরভ বলে দৌড়ে ছুটে যেতেই স্নিগ্ধতার মেজাজটা রিতীমতো বিগড়ে গেল, এই ছেলের জন্যই ওর হাতের এই অবস্থা তাছাড়া টেস্ট টিউব থেকে অ্যাসিড পড়তে দেখে ওর ধারনাটা একবারে ওর নিজের কাছে ঠিক প্রমাণিত হলো যে সৌরভ নামের কোন ব্যাক্তিই ইচ্ছাকৃতভাবে অ্যাসিড ছুড়েছে। স্নিগ্ধতা সৌরভকে কিছু বলতে যাবে তখনই নিমেষেই একটা ছেলেকে মাটিতে ছুড়ে ফেলল সৌরভ তারপর মুখে একটা ঘুষি মেরে বিড়বিড় করে কি একটা বলল তা স্নিগ্ধতার কানে গেল না।
আশেপাশে সবাই দেখছে ওদেরকে। ছেলে দুটো মাটিতে পড়ে থাকা ছেলেটাকে নিয়ে কোথায় যেন গেল, তাড়াতাড়ি করে একটা মেয়ে সৌরভের কাছে ছুটে গেল আর বলল
” সৌরভ তোর লাগেনি তো? ”

সৌরভ রাগে ওর হাতটা মুঠিবদ্ধ করে বলল
“নাহ আমি ঠিক আছি। ”

মেয়েটা ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে এক একটা কাচ সরাতে সরাতে বলল
” এটা এক্ষুনি ব্যান্ডেড করাতে হবে, চল। ”

সৌরভ পরে থাকা ল্যাব কোট টা খুলে ছুড়ে মারলো আর বলল
“সর, আমি প্রিন্সিপালের কাছে যাবো। ”

কথাটা বলে চলে গেল সৌরভ, দূর থেকে সব কিছু দাঁড়িয়ে দেখছে স্নিগ্ধতা, সৌরভকে ওর কথা শোনানোর কথা ছিলো কিন্তু তার আগেই তো ও চলে গেল, কিন্তু স্নিগ্ধতা আজকে ছাড়বে না কোনমতেই, আজকের পর থেকে নিজেই অধিকার টুকু নিজে বুঝে নেবে তার পরিকল্পনা করেছে সারাটা রাস্তা। স্নিগ্ধতাও হাটা দিলো, আর দুটো ছেলেকেও কোথাও দেখলো না। ধীরে ধীরে ভীড় কমছে অনেকে সৌরভকে নিয়েই বলাবলি করছে, কি হয়েছে তা কেও কিছু বুঝতে পারছে না, কেও কেও আবার স্নিগ্ধতার পুড়ে যাওয়া হাতটা দিকে তাকাচ্ছে তা দেখছে স্নিগ্ধতা ওড়না দিয়ে ওর হাতটা ঢেকে নিলো আর সৌরভের পিছু পিছু ছুটলো , এখন ওর মেজাজ গরম আছে আর এই সুযোগ।

কথাটা ভেবে স্নিগ্ধতা ছুটলো। প্রিন্সিপালের রুমে প্রথম একদিন ভর্তির জন্য গিয়েছিলো তারপর আর কখনো যাইনি ও, টাকার অভাবে ভর্তি হতে পারেনি স্নিগ্ধতা তাই ওদের পাড়ার এক লোকের সুবাদে যে কলেজে ক্যান্টিনে কাজ করে তাকে দিয়ে অনেক কাকুতি মিনতি করে ভর্তি হয়েছিলো তবে আজ আবার অনেক দিন পর সৌরভকে ধোলাই দেওয়ার উদ্দেশ্যে এখানে দাঁড়িয়ে আছে ও। হাতটা মাঝে মাঝে এতো জ্বালা করছে যে সহ্য করা দায়ী। বেশ অনেকখন হয়ে গেল রুম থেকে কেও বার হচ্ছে না দেখে স্নিগ্ধতা বিরক্ত হলো, চলে যাবে কি ভাবছে সেই সময় একজন স্যার প্রিন্সিপালের রুমের দিকে ঢুকতেই স্নিগ্ধতা কে দেখে ধমকের সুরে বলল
“ক্লাস এখনি শুরু হবে আর তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো? যাও ক্লাসে যাও। ”

স্নিগ্ধতা দ্রুত হাটলো, ও ধমক শুনে ভয় পেয়ে গেছে। রুমে রয়েছে গিয়েই ক্যান্টিন সেদিকে স্নিগ্ধতার চোখ পড়তেই দেখলো যে সৌরভ চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে, মুখে রাগ আর বিরক্তির মিশ্র আভা আর মেয়েটা হাতে মলম লাগাচ্ছে। স্নিগ্ধতা সিঁড়ি থেকে নামলো আর ওদের সামনে যেতেই আগের দুটো ছেলের মধ্যে একটা ছেলে যার নাম আশফি সে বিরক্ত হয়ে বলল
” এই মেয়ে আবার তুমি? যাও এখন। ”

স্নিগ্ধতা রেগে টেবিলের ওপর ধাম করে একটা বাড়ি দিতেই তার আওয়াজ শুনে সৌরভ মুখ থেকে হাত সরিয়ে স্নিগ্ধতার দিকে এক পলক তাকিয়ে পুনরায় আগের মতই করে বসে রইলো।
হাতে ব্যান্ডেড করতে থাকা মেয়েটা স্নিগ্ধতার দিকে না তাকিয়েই বলল
” কি দরকার এখানে, একশন দেখে ক্রাশ খেয়েছো? যাও এখান থেকে। ”

কথাটা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজে লেগে গেল, স্নিগ্ধতা এবার আর কিছুর তোয়াক্কা না করে সৌরভের জমার কলার ধরে বলল
“আপনি আমার হাতে অ্যাসিড ফেলেছেন কেন? দেখছেন কি হয়েছে হাতটা, পুরো পুড়ে গেছে। ”

সৌরভের যেন রাগে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো, অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
” কলার ছাড়ো। ”

মিম বলে মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল
“এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না, জানো তুমি ও কে আর তোমার কি হাল করতে পারে! ”

স্নিগ্ধতা রেগে বলল
” চোরের বন্ধুর বড়ো গলা, আপনি ওনাকে আষ্কাড়া দিচ্ছেন? উনি আমার হাতের ওপর অ্যাসিড ফেলেছেন তার ওপর ভার্সিটি এসে মারপিট করে এটা কোন ধরনের ভদ্রতা?”

সৌরভ পুনরায় বলল
“এই মেয়ে কলার ছাড়ো নাহলে ফলাফল ভাবো হবে না বলে দিলাম। ”

স্নিগ্ধতা কলার ছেড়ে সামনে থাকা কোকের বোতলের কোনটা সৌরভের মুখে ছুঁড়ে মারতেই সৌরভ দু পা পিছিয়ে গেল। স্নিগ্ধতা এতেও যেন শান্তি পেলো না, সারাদিন যা হয়েছে তাতে এটুকু যেন ওর কাছে খুব কম মনে হলো
” কি ভবেন নিজেকে হু? ডন? আপনাদের মতো কিছু গুন্ডাদের জন্য ভার্সিটিতে টিকে থাকা দায়, পড়াশোনা করতে আসেন না, আর খালি দাদাগিরি করেন। নেক্সট নাইম এমন দেখলে ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবো বলে দিলাম। ”

কথাটা বলে স্নিগ্ধতা এক মিনিট ও আর দাঁড়ালো না, দ্রুত চলে এলো, এখন হালকা লাগছে মনটা। স্নিগ্ধতা এবার যেন খুশি মনে ক্লাসরুমে গেল। মিম বলে উঠলো
” কি রে তুই ওই মেয়েটাকে কিছু বললেন কেন? আমাকে বলছি আমি দিতাম দুটো চড়। ”

সৌরভ এক হাত দিয়ে মুখটা মুছে বলল
” সিয়াম। ”

সিয়াম আমতা আমতা করে বলল
” এই তো। ”

সৌরভ এবার একটা নির্বিকার ভঙ্গিতে হেসে বলল
” কি বললো মেয়েটা, গুন্ডা? আবরার সৌরভ গুন্ডা? গুন্ডাদের কাজ কি? ”

সিয়াম মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। সৌরভ গাড়ির চাবিটা টেবিল থেকে নিয়ে বলল
” মেয়েটা যেন আজ রাতে বাসায় না ফিরতে পারে, রাতে যেন আমি ওকে আমার বনানীর ফ্ল্যাটে দেখি। ”

মিম কিছু বলতে যাবে তার আগেই সৌরভ চলে গেল।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here