এক_ফালি_রোদ ৩২তম_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
৩২তম_পর্ব

বাসায় যখন মেয়েটির ছবি দেখানো হয়, তখনই প্রথমবার আবরার মেয়েটির ছবি দেখে। মেয়েটিকে কোনো এক অজানা কারণে বেশ মনে ধরে আবরারের৷ এক রাইসাকে না পেলেও তার ভালোবাসা অন্য কোনো রাইসার জন্য না হয় তোলা থাক। আবরারের হবু বউ এর ছবিটি তখন হাত বদল হতে হতে অয়নের হাতে পড়ে। অয়নের তার হবু ভাবীকে নিয়ে মারাত্নক কৌতুহল ছিলো। কিন্তু ছবিটি দেখা মাত্র অয়ন স্তব্ধ হয়ে যায়। তার ভাবনার গহীনে যে নারীর বিস্তারণ সেই নারীর ছবি ই তার সামনে রয়েছে। যে নারীকে এতোদিন নিজের মনমন্দিরে পুজে এসেছে সেই নারটির সাথেই তার বড় ভাই এর বিয়ে ঠিক হয়েছে। এখন যদি আবরারের সাথে কথা না বলা হয় তবে যে বড্ড দেরি হয়ে যাবে। তার যে আবরারের সাথে কথা বলতেই হবে এবং সেটা আজ রাতেই

রাত ১১টা,
ছাঁদের এক কোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আবরার। বৃষ্টি শেষে প্রকৃতি বেশ ঠান্ডা হয়ে যায়। আজ ও প্রকৃতি বেশ ঠান্ডা। সারাদিনের বর্ষণের পর এখন ক্ষান্ত দিয়েছে ক্লান্ত আকাশ। মেঘের জন্য চাঁদের দেখাও মিলছে না। সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে আবরার। এই মাসের শেষেই তার বিয়ের ডেট পড়েছে। মনের মাঝে একটা খচখচানি লেগেই রয়েছে। মেয়ের বাবা ইসমাইল সাহেব তাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন তার মেয়ে যাতে কোনো ভাবেই নিজের অপূর্ণতার কথা টের না পায়। আবরার ও নিজেকে নিজে কথা দিয়েছে, মেয়েটিকে কোনোদিন কষ্ট দিবে না। নিজের মনের রাণী বানিয়ে রাখবে। কিন্তু এই বেহায়া মন এখনো রাইসা নামক মেয়েটাকে ভুলতে পারে নি। মনের এক কোনায় এখনো সেই মেয়েটার বাস রয়েছে। ভালোবাসায় হয়তো জং ধরে আছে কিন্তু এখনো তাকে ভোলা সম্ভব হয় নি। তবে অতীতের ছাপ বর্তমান এবং ভবিষ্যতে সে পড়তে দিবে না। যে আসছে তাকে সুখী করতে যদি সব কিছু উজার করে দিতে হয় তাও রাজী রয়েছে সে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে আবরারের। সিগারেটটি শেষের দিকে, ছাদের কর্ণিশে সিগারেটড়ি নিভিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় আবরার। তখনই সেখানে অয়ন উপস্থিত হয়। অয়নের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে বেশ অবাক হয় আবরার। অবাক চোখে তাকে জিজ্ঞেস করে,
– তুই ঠিক আছিস তো?
– ভাই, এই বিয়েটা ভেঙ্গে দে।
– যা তা বলার একটা লিমিট থাকে অয়ন। বিয়ে ভেঙ্গে দেবো মানে? উলটা পালটা কিছু খেয়েছিস নাকি?
– ভাই, প্লিজ তুই এই বিয়েটা ভেঙ্গে দে।
– বারবার এক কথা না বলে আয়াকে কি কারণটা বলবি? কেনো ভেঙ্গে দিবো দিবো?

আবরারের প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে অয়ন। অয়নের নিরবতা দেখে আবরার খানিকটা বিরক্ত হয়। তারপর বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলে,
– তোর কাছে উত্তর না থাকলে, আমি রুম যাবো। কালকে আমার অফিস রয়েছে।
– ভাই ও আমার গার্লফ্রেন্ড। প্লিজ রাইসার সাথে বিয়েটা ভেঙ্গে দে তুই। আমরা দুজন দুজন কে খুব ভালোবাসি।

অয়নের কথাটা শুনে এক মূহুর্তের জন্য থমকে যায় আবরার। সব যেনো এক মূহুর্তের জন্য তালগোল পাকিয়ে যায়। তার চোখে মুখে হাজারো প্রশ্নের আভা দেখা যায়। মাথাটা যেনো ঝিম ধরে যায়। কাঁপাস্বরে বলে,
– তুই সত্যি বলছিস?
– হু, আমি সত্যি বলছি। আচ্ছা তুই তো নিজেই বলেছিলি তুই রাইসার সাথে সম্পর্কে জরাতে চাস না। তাহলে?
– এক মিনিট, এক মিনিট। কি বলছিস! সব মাথার উপর থেকে যাচ্ছে আমার।
– তাহলে আমি প্রথম থেকেই বলি। রাইসা সেই মেয়েটি, যার সাথে তুই আমাকে দেখা করতে বলেছিলি। তোর সাথে যার “প্রোফাউন্ডলি মি” পরিচয় হয়েছিল। আসলে সেদিন আমি তোর কথা মত ক্যাফেতে ওর সাথে দেখা করতে যাই। কিন্তু তুই যা যা শিখিয়ে দিয়েছিলি, আমি কিছুই বলি নি। মেয়েটা তোর সাথে দেখা করার জন্য এতো আগ্রহী ছিলো যে আমি ওকে কিছুই বলতে পারি নি। ও আমাকে তুই ভেবে নেয়। আমি তোর সম্পর্কে কিছুই বলতে পারি নি। ভেবেছিলাম একটা সময় সব সত্যি বলে দিবো। কিন্তু মেয়েটির মায়ায় জড়িয়ে পড়ি। মেয়েটি আমাকে তুই ভাবতে থাকে।
– কিন্তু সেটা তো মিথ্যে।
– জানি কিন্তু মেয়েটির সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো আমার মনে জায়গা করে নেয়। তাই আমি তার ভুল ধারণাটি ভাঙ্গি নি। কিছুদিন পর যখন ওকে মনের কথা বলি, ও হাসি মুখে সেটাকে এক্সেপ্ট করে। আমি জানি আমি মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু তুই তো মেয়েটিকে ভালোবাসিস না। আর তুই তার থেকে সব সম্পর্কের ইতি টানে তে চাস। তাই তো তুই আমাকে তোর হয়ে ওর সাথে দেখা করতে বলেছিলি। বলেছিলি যাতে মেয়েটিকে তোর সম্পর্কে সব বাজে কথা বলি যাতে সে তোকে ঘৃণা করে; তুই তো চাস নি মেয়েটি যেনো তোর জন্য অপেক্ষা করে, তাহলে সে আমাকে ভালোবাসলো নাকি অন্যকাউকে কি যায় আসে?
-………
– আমি তোকে এই কথাটা এক বছর ধরে বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারি নি। ভাই প্লিজ, আমি রাইসাকে এবং রাইসা আমাকে খুব ভালোবাসে।
– রাইসা আমাকে ভালোবাসে, তোকে নয় অয়ন। আমি কিছুই বলতাম না, যদি তুই ওকে সত্যিটা জানিয়ে ভালোবাসতি। অয়ন এটাকে আর যাই হোক ভালোবাসার নাম দেওয়া যায় না।
– মেয়েটি তোর প্রতি এতোটাই দূর্বল হয়ে পড়েছিলো যে তার এক্সিডেন্টের পর তোর সবসময় নক করতো। তোর অবহেলা একেবারেই মেনে নিতে পারে নি। সেদিন আমি ওকে তোর শেখানো অনুযায়ী কথাগুলো বলতে পারি নি। আর ধীরে ধীরে ওর মায়ায় জড়িয়ে পড়ি। আমি জানি মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে আমি আমাদের সম্পর্কটা শুরু করেছি। আমাদের সম্পর্কের ভিত্তিটা মিথ্যের উপরে। কিন্তু ওর প্রতি আমার ভালোবাসাটা মিথ্যে নয়। প্লিজ ভাই আমি তোর কাছে আমার ভালোবাসাটা ভিক্ষে চাইছি।

আবরার কোনো উত্তর দেয় নি অয়নকে। কি উত্তর দিবে নিজেও বুঝতে পারছে না। কে যেনো সব কিছু অসহ্য লাগছে তার কাছে। মস্তিষ্কের কোষগুলো যেনো কাজ করা বন্ধ করে নিয়েছে। খুব অসহ্য চাপ অনুভূত হচ্ছে। যে ভালোবাসাটিকে বুকের কোনে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিলো আজ সেই মেয়েটির সাথেই স্রষ্টা তার জুটি লিখে রেখেছে। অথচ মেয়েটি তার ভাই এর প্রেমিকা। নিজের উপর রাগ হতে লাগলো। নিজের একটা ভুলের মাশুল তাকে নিজেই দিতে হচ্ছে। সেদিন কেনো সে রাইসাকে সব সত্যিটা বললো না! কেনো রাইসার সাথে দেখা করতে গেলো না। নিজের ভুলের মাশুল তাকে আজ এতো কঠোর ভাবে দিতে হচ্ছে৷ দু হাতে মাথা চেপে ধরে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো আবরার। নিজের ভুলের জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষটির সারাটা জীবন অপূর্ণতার কালো মেঘে ঢেকে দিয়েছে, যখন তাকে আগলে রাখতে চাচ্ছে তখন ও অয়ন তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কি করবে সে, কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না আবরার৷ জীবনের অংশের হিসেবটা কিছুতেই মিলাতে পারছে না সে। একের পর এক সিগারেট ধরাতে লাগলো। নিকোটিনের নেশায় মানসিক চাপ কমানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো সে। কিন্তু সব বৃথা, সব কিছুই বৃথা! অসহ্য যন্ত্রণা তাকে গ্রাস করছে। পুরুষ মানুষ কাঁদতে পারে না। নয়তো চিৎকার করে কাঁদতো আবরার। আজ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে। যদি রাইসা অয়নের সাথে সুখী থাকে তবে সেটাই সই। কিন্তু অয়ন কি রাইসার অপূর্ণতা মেনে নিবে!

বিকেল ৪টা,
অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলো আবরার। আজকাল নির্ঘুম রাত্রিযাপন করছে সে। কাজেও মন নেই তার। ক্যাফেতে ডেকেছে অয়নকে। বাসায় এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছে না। আজ কিছু কথা অয়নকে সরাসরি বলবে সে। অয়ন যদি সত্যি রাইসাকে ভালোবাসে তবে সব কিছু মিলেই তাকে ভালোবাসবে। আর যদি তা না হয় তবে নিজের ভালোবাসাকে এভাবে কষ্ট পেতে দিবে না আবরার। ক্যাফেতে পৌছাতেই অয়নের সাথে তার দেখা হয়। আবরার অয়নের মুখোমুখি বসে৷ অয়ন তখন তাকে প্রশ্ন করে,
– কি চিন্তা করলি?
– সেটা নাহয় পড়ে বলি, আগে আমার প্রশ্নের কিছু উত্তর দে
– হুম বল
– তুই কেনো ভালোবাসিস রাইসাকে?
– এটা কেমন প্রশ্ন? ওকে আমার ভালো লাগে তাই
– কি ভালোলাগে? ওর কি এমন গুন যা তোর ভালো লাগে?
– ওর পূর্ণতা আমার ভালোলাগে।
– মানে?
– ও নিঁখুত, ওর মাঝে একটা ভুলের অবকাশ নেই। আমার সকল অপূর্ণতায় ও পূর্ণতা প্রদান করে। ওর সবকিছু মিলিয়ে আমি ওকে ভালোবাসি
– তোর তো বাচ্চা খুব ভালো লাগে তাই না! আচ্ছা, যদি এমন হয় ও যদি কখনো মা না হতে পারে তাহলেও কি তুই ওকে ভালোবাসবি?

আবরারের প্রশ্নে থমকে যায় অয়ন। ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তারপর……….

চলবে

[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here