তার শহরের মায়া 💜সিজন_২,সূচনা_পর্ব
writer_Liza_moni
আজ কত শত দিন চলে গেল,
হারিয়ে গেলো মুখের হাসি।
আমি আজও যে আমার না হওয়া
মানুষ টাকে ভালোবাসি।
আরো যাবে দিন,যাবে আরও সময়
আমি কাটাতে পারবোনা,,
তার শহরের মায়া।
গোধূলি লগ্ন। ছাদের রেলিং ধরে ক্লান্ত ভরা চোখে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অনু। হালকা বাতাসে চুল গুলো মুখের উপর এসে পড়ছে। চোখে মেয়েটার কাজল আঁকা।গাঢ় করে কাজল এঁকেছে আজ কত দিন হয়ে গেল। হালকা কাজল সব সময় থাকে তার চোখে। মানুষ যেনো বুঝতে না পারে মেয়েটা রাত জেগে চোখের নিচে কালি ফেলেছে। মানুষ যেনো বুঝতে পারে আসলে চোখের নিচে কাজলের কালির জন্যই কালো হয়েছে। অদ্ভুত এই মেয়েটা। চুপ চাপ থাকতেই যেন ভীষণ ভালো লাগে তার।
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে পাশ ফিরে তাকায় অনু। বড় বোন তনু কে দেখে মুচকি হেসে বললো,,এই সময় তুই এখানে কেন?কখনো তো আসতে দেখিনি তোকে।
ছোট বোনের কথায় হাসলো তনু। দুই হাত দিয়ে অনু কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,, তোর সাথে আকাশ দেখতে চলে এলাম। সপ্তাহের এই একটা দিনই একটু ফ্রী থাকি। দুই বোন কত দিন ধরে গল্প করিনা বলতো?
শেষ কবে একটু মন খুলে কথা বলেছিস মনে আছে তোর?
অনু হাসলো। তনুর কথায় সায় দিয়ে বললো চল আজ তোকে অনেক কথা বলবো। কিছু অজানা কথা।
অনুর মা ছাদে এসে দুই মেয়ের উদ্দেশ্যে বললো,,
:- অনু,তনু কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আজান দিবে।নিচে যা আর নামাজের প্রস্তুতি নে।
দুই বোনের মুখ মলিন হয়ে গেল।তারা সব সময় ভুল সময় ঠিক করে আড্ডা দেওয়ার।আজ ও আর দুই বোনের এক সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়ার সময় হবে না।
মা চলে গেলে অনু আর তনু দুই জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।তনু ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,,
সমস্যা না। সামনের শুক্রবার না হয় সারা বিকেল জুড়ে আড্ডা দিবো।
অনু কিছু বললো না।তারা এতই ব্যস্ত যে দুই বোন মন খুলে একটু কথা ও বলতে পারছে না।
তনু ছাদ থেকে নিচে চলে গেল।অনু বোনের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
“”তনিমা তনু আর অনুমেঘা রাজমিম দুই বোনের নামের সাথে তেমন মিল নেই।স্বভাবে ও আলাদা দুই বোন।তনু খাগড়াছড়ির একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করে। দিনের বেশিরভাগ সময় তার সেখানেই কাটে।আর অনু, অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী। পড়ালেখার খাতিরে ঢাকায় হোস্টেলে থাকে।ঢাকায় চার মাস এক নাগাড়ে থাকাতে অনুর দম বন্ধ হয়ে আসছিলো নিজের শহরের জন্য।তাই ছুটে আসলো নিজের জন্ম শহর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়। নিজের শহরের প্রতি এক অদ্ভুত মায়া কাজ করে তার।””
.
.
নামাজ পড়ে সোফায় পা তুলে গালে হাত দিয়ে বসে আছে অনু। সবাই ব্যস্ত।মা রান্না ঘরে নাস্তা বানাচ্ছে।বাবা মসজিদ থেকে এখনো ফিরে আসেনি।তনু বিছানায় আধশোয়া হয়ে পরীক্ষার খাতা কাটছে।
অনু সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তনুর রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই একনাগাড়ে চার বার কলিং বেল বেজে উঠলো।অনু থমকালো। বুকের মাঝে ধক করে উঠলো তার। এমন করে একজনই কলিং বেল বাজায়।
অনুর শাহসে কুলাচ্ছে না এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেওয়ার।সে নিশ্চিত তার সেই মানুষটি দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
রান্না ঘর থেকে মা চিল্লিয়ে বললো,,
অনু দরজা খুলে দে। দেখ তো কে এসেছে?তোর আব্বু আসছে মনে হয়।
অনু দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে দিয়ে সরে গেল সে। দৌড়ে রুমে গিয়ে রুমের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।প্রায় পাঁচ মাস পর আজ দেখলো সেই মুখখানি।
.
.
দরজার সামনে কাউকে না দেখতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে গেলো মাহিরের।বুঝলো এটা কার কাজ হতে পারে। মাহির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
মুখে হাসি ফুটিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসতে বসতে বললো,,ফুফি এক গ্লাস পানি দিও তো। তোমাদের এই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আমার জান বের হয়ে যায়।ফুফা কে বলে একটা লিফটের ব্যবস্থা করতে হবে।
অনুর মা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে এক পানি নিয়ে মাহিরের হাতে দিলেন।
এই বাড়িতে লিফট? তুই মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছিস মাহির।
তুই আসলি।আর আমি ভাবলাম তোর ফুফা আসছে।এত দিন পর কেমনে মনে পড়লো আমাদের কথা?
মাহির পানি খেয়ে বললো,, তোমাদের কথা সব সময় মনে পড়ে কিন্তু ব্যস্ততার জন্য আসা হয় না।
বুজলাম।সবাই ব্যস্ত। আমার দুই মেয়ের মতো।
অনুমেঘা আসছে ঢাকা থেকে?
হ্যাঁ ওতো আজ তিন দিন হলো বাড়িতে এসেছে। সামনের সপ্তাহে চলে যাবে।
ওহ। অনেক দিন হলো পিচ্চি রে দেখি না।তাই জিজ্ঞেস করলাম।
.
.
অনুর মা রান্না ঘরে চলে গেলেন।নুডুলুস রান্না করেছেন তিনি। সাথে মালাই চা। এখন সবার জন্য সেগুলো বেড়ে নিয়ে আসবেন বলেই রান্না ঘরে চলে গেল।
মাহির পকেট থেকে মোবাইল বের করে গেমস খেলতে লাগলো।
.
দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে অনু। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো হাতের উপর।
মায়া খুব খারাপ একটা জিনিস। না দেয় ভালো থাকতে আর না দেয় ভুলে থাকতে।
.
.
এক বাটি নুডুলুস এনে মিহিরের হাতে দিলেন অনুর মা। এমন সময় তনু ড্রইং রুমে এসে সোফায় বসলো।মা তার হাতে ও এক বাটি নুডুলুস ধরিয়ে দিলেন।
কয়েক বার অনু কে ডাকলেন অনুর মা।অনু সাড়া দিলো না।
অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছেন মাহির ভাই।
তনুর কথায় মাহির তনুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,, আমার থেকে ও বেশী ব্যস্ত তুই বুঝলি তনু।নাম করা স্কুলের ম্যাম বলে কথা।
খোঁচা দিবেন না একদম। আপনি একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যদি আমাদের মতো সাধারণ জনগণকে এই ভাবে খোঁচা মেরে কথা বলেন তাহলে কী করে হবে বলুন তো?
মাহির হাসলো।
তনু এবার অনু কে ডাকলো। অনু সাড়া দিলো এবার।চিল্লিয়ে বললো,,
আপু আমি একটা কাজ করতেছি পরে আসছি।
মাহির ভাইয়া এসেছেন দেখা করবি না?
একটু পর আসছি।
তনু আর কিছু বললো না। মায়ের হাতের মালাই চা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
.
.
অনু বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সে। ধবধবে ফর্সা না। হলদেটে ফর্সা যাকে বলে। তবে অনেক ছেলের ভালবাসা পাওয়ার যোগ্যতা আছে। কিন্তু তার যে অনেক ছেলে না। একজন ছেলের ভালবাসা দরকার।
অনু ওয়াস রুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিলো। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়ে এসে আবারও ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো।কাজল নিয়ে চোখে দিলো।গাঢ় করেই দিল আজ। হালকা না হয় আবার আগামী কাল থেকে দিবে।
.
.
রুম থেকে বের হয়ে এসে সোফায় বসা মাহির আর তনুর দিকে এক নজর তাকিয়ে মুচকি হেসে মাহিরের উদ্দেশ্যে বললো,,
আসসালামুয়ালাইকুম মাহির ভাইয়া। কেমন আছেন?
মাহির চোখ তুলে অনুর দিকে তাকালো। তার মুচকি হেসে বললো,,
ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই?
আমি তো বিন্দাস আছি।
তনুর পাশে গিয়ে বসলো অনু। মায়ের উদ্দেশ্যে বললো, আম্মু আমাকে শুধু মালাই চা দিও।আর কিছু না।
.
.
রাত আটটা অব্দি মাহির অনুদের বাড়িতে থাকে। বাড়িতে কল আসায় সে চলে যায়। রাতের খাবার খেয়ে যায়নি সে।কারন সে জানে তার মায়ের সাথে এক সাথে বসে খাবার না খেলে তার মা খাবার ছুঁয়ে ও দেখবে না।তাই এত জোর করার পর ও ডিনার করার জন্য রাজি হয়নি সে।
.
.
মধ্যে রাত।সবাই ঘুমে মগ্ন। কোলাহোল পূর্ণ শহর এখন প্রায় শান্ত।অনুর চোখে ঘুম নেই।বেলকনির গ্রিলে হাত রেখে আলোকিত চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবনায় মগ্ন সে।
,,অতীত,,
কিশোরি অনু সেদিন হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পড়া এক যুবকের প্রেমে পড়েছিল। তখন সবে মাত্র সে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের গন্ডি পেরিয়ে সেকেন্ড ইয়ারে পা রেখেছে।কিশোরি মন।বয়সটা তখন ১৭ হবে,,যাকে দেখছে তাকেই ভালো লাগছিল তার।এই বয়সটাই এমন। আবেগে ভরা একটা সময়।অনুর ক্ষেত্রে ও একই। কিন্তু এমন ভালো লাগার মধ্যে যে ভালোবাসা হয়ে যাবে তা কখনো ভাবেনি সে।যে মানুষটাকে সে ভালোবেসে ফেলেছিলো সে হলো মাহির।তার মামাতো ভাই।
অনুর মামাতো বোন মাহিমার বিয়েতে হলুদ হিমু কে দেখে কিশোরী মনে প্রেমের ছোঁয়া লাগে।
মাহিরের সাথে কথা বলতে ও তখন তার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছিলো। ঠিক মত তার সামনে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছিলো না অনু।মনে হচ্ছিলো যদি মাহির বুঝে যায় অনুর মনে তার জন্য প্রেম জমেছে। তখন কী হবে?
.
.
মাহিমার বিয়ের মাস খানেক পর কাজিন দের সাথে ট্রুথ অর ডেয়ার খেলায় মত্ত হয় মাহির। অনেক কনফিডেন্স নিয়ে সে ডেয়ার নিলো।
এক কাজিন তাকে ডেয়ার দেয় অনুমেঘাকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে। এবং ২ মাস তার সাথে রিলেশন চালিয়ে যেতে।
ডেয়ার পূরণ করার জন্য মাহির অনু কে একদিন প্রেমের প্রস্তাব দিয়েই বসে।এটা যে ডেয়ার তা জানে না অনু।মাহিরের প্রপোজাল পেয়ে অনু যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিল।
নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারিনি সে।
”
অনু শুন,,
সেই ছোট বেলা থেকেই আমি তোকে পছন্দ করি। ভালোবাসি বলতে পারিস। কোনো দিন তোকে বুঝতে দিইনি। তুই আমার সারা জীবনের সঙ্গী হবি?”
সেই সময় এই সাজানো মিথ্যা কথা গুলোই অনুর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর ভালোলাগার কথা মনে হয়েছিল।সে ও যে মনে মনে এই মানুষটার শহরের মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে।
সেদিন মাহিরের মিথ্যে প্রেমের জালে আটকা পড়ে অনু। খুব নিখুঁত ভাবে অভিনয় করে দুই টা মাস মাহির তার সাথে। এতটাই নিখুঁত অভিনয় যে অনুর কখনোই ভুলেও মনে হয়নি মাহির হঠাৎ করেই কেন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিবে?
কিশোরী অনুর মন তখন পড়ে ছিলো মাহিরের কাছে।মাহিরের রাগি কন্ঠে বলা কথা গুলো মুচকি হেসে হজম করতো অনু।অনু মেয়েটা ছোট থেকেই চুপচাপ ধরনের।
শুনেছি বাড়ির ছোট মেয়েরা বড্ড চঞ্চল হয়।রাগী হয়। কিন্তু অনু সে রকম নয়।অনু অভিমানী ভীষণ। অল্পতেই অভিমান করে বসে।
মায়ের মোবাইল দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হতো মাহিরের সাথে।কলেজে যাবার সময় মাঝে মধ্যে মাহির এসে নিয়ে যেতো।
সেদিন ছিল ২মাস শেষ হবার শেষ দিন।
কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরছিল অনু। মাহির বাইক নিয়ে এসে পথ আটকায় অনুর। মাহির কে দেখে অনুর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।
মাহির অনু কে বাইকের পিছনে উঠে বসার জন্য চোখ দিয়ে ইশারা করলো।অনু মুচকি হেসে উঠে বসে বাইকে।
বাড়ির রাস্তা পেরিয়ে অন্য এক রাস্তায় নিয়ে যায় মাহির। বিশাল বড় একটা মাঠের পাশে বাইক থামিয়ে অনুর হাত ধরে হাঁটতে থাকে মাঠে।শরতের নীল আকাশ।তার মাঝে তুলোর মত সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে।অনুর চোখে মুখে খুশি উপচে পড়ছে।কাশ ফুল দেখে সেদিকে দৌড়ে গেল অনু।
মাহির পকেটে হাত ঢুকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে অনুর কান্ড দেখছে।
অনেক লাফালাফি করে সুন্দর একটা কাশফুল নিয়ে আবারো মাহিরের কাছে দৌড়ে এসে হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাতে থাকে অনু।
মাহিরের দিকে ফুলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,
ফুলটা সুন্দর না?কী নরম তুলতুলে,,
অনুর হাত থেকে ফুল টা নিয়ে মাহির ভালো করে দেখে মাটিতে ফেলে দিলো।
মাহিরের কাজে অবাক হলো অনু।
ফুলটা ফেলে দিলেন যে?
তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে অনু।
কী কথা বলুন?
মাহির হাঁটতে থাকে।আর মাহিরের পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকে অনু।
চলবে,, 🍁