এক_ফালি_রোদ ২৯তম_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
২৯তম_পর্ব

– রাইসা, এটা তোমার ঘর নয়। দোকানে এসে এভাবে সিন ক্রিয়েট না করলেই ভালো হয়। তোমার যদি শপিং হয়ে যায় তাহলে চলো। নয়তো আমি বাহিরে ওয়েট করছি। তুমি শপিং করে আসো।

বলেই গটগট করে দোকান থেকে বেরিয়ে যায় আবরার। রাইসা তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আবরারের এরুপ ব্যবহারের জন্য মোটেই তৈরি ছিলো না সে। চোখের কোনে নোনাজলের ভিড় জমতে থাকে। তাড়াতাড়ি জামাটি দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যায় সে। রাইসাকে বের হতে দেখে আবরার একটা উবার ভাড়া করে। গাড়িটি এলে তারা রাইসার কলিগের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সারাটা রাস্তা একটা কথাও বলে নি রাইসা। শুধু গাড়ির কাঁচ দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিলো সে। অপরদিকে আবরার ও নিজ থেকে কথা বলতে চায় নি তার সাথে। সে জানে তার এরুপ আচারণ রাইসাকে কষ্ট দেয়। কিন্তু সে অপারগ। রাইসার অপূর্ণতাটি তাকে জানতে দিতে চায় না সে। তার জন্য যদি রাইসার চোখে নিচু হতে হয় তাতেও রাজি সে। আবরার কাঁচের জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকায়। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, পাখিরা সব নিজ নিজ গৃহে ফেরার জন্য ছুটছে। শুধু পাখি ই নয়, মানুষও তার গৃহে ফেরার জন্য ছুটে যাচ্ছে। গাড়িতে পিন পতন নীরবতা। পাশাপাশি বসে রয়েছে দুজন মানব মানবী কিন্তু মনে হচ্ছে তাদের ভেতর একটি অদৃশ্য দেয়াল বিদ্যমান যা তাদের দুজনের মনের মাঝে সহস্র ক্রোশ দূরত্ব একে দিয়েছে।

আজ বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেলো প্রাপ্তির। ঘড়ির কাটা সাতটার ঘরে ভীড় করেছে। ছুটতে ছুটতে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো প্রাপ্তি। বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই শেফালী বেগমের সাথে তার দেখা মিলে। শেফালী বেগম তীর্যক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। প্রাপ্তি তার চোখে রাগের ঝিলিক স্পষ্ট দেখতে পায়। আমতা আমতা করে বলে,
– আসলে, মা
– আমি তোমাকে কি কিছু জিজ্ঞেস করেছি? ঘরটা তো হোটেল বানিয়ে রেখেছো তোমরা। যখন খুশি আসছো, তখন খুশি যাচ্ছো। যেমন আমার ছেলে ঠিক তেমন ই তার বউ। একজন ভোরে ঘরে ফিরে তো আরেকজন ভোর সন্ধ্যায়। যতসব। যাও যাও ফ্রেশ হও।
– আমি দেরি কথা রতে চাই নি মা, কিছু নিউমার্কেটে এতো ভিড় ছিলো। আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে।
– আমি তো জানতাম তুমি কলেজে যাও, মার্কেটে যাও তাতো জানতাম না।
– না মা, কিছু কেনাকাটা ছিলো। এখানে তো সেগুলো পাওয়া যায় না। তাই নিউমার্কেট গিয়েছিলাম।
– হাহ, এটা বলো না। বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডাবাজি করছিলে। দেখো প্রাপ্তি, আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি৷ এর পর থেকে যদি সন্ধ্যে করেছো তো দেখবে। আমি ঘরে বিশ্বযুদ্ধ করবো। তোমার কি মাথায় কিছু নেই নাকি! বাড়ির বউ তুমি, আর দিনকাল মোটেই ভালো না। দরকার হলে বাড়ির গাড়ি নিয়ে বের হবে। তবুও একা এতো রাত বাহিরে থাকবে না, এই আমার শেষ কথা বলে দিলাম।

হিনহিনে কন্ঠে কথাটা বলেই বুক বাকিয়ে নিজ কক্ষের দিকে হাটা দিলেন শেফালী বেগম। তিনি কি আদৌ প্রাপ্তির দেরি করার জন্য বকলেন নাকি প্রাপ্তির চিন্তায় বিরক্ত হয়ে বকলেন সেটা ঠিক বুঝতে পারলো না প্রাপ্তি। ক্লান্ত শরীরটা আর চলছে না তার। রুমে যেয়ে গা এলিয়ে দিলে মন্দ হবে না। রুমে যাবার কথায় হুট করে মনে পড়লো অয়ন তো বাসায় ই আছে। সারাটা দিন লোকটার একটিবার খোঁজ ও নিতে পারে নি প্রাপ্তি৷ এখন বাসায় আছে কি না কে জানে! শেফালী বেগমকে জিজ্ঞেস করলে উলটো কথা শুনতে হতো। তাই মস্তিষ্কের নিউরণে আর চাপ প্রয়োগ না করে রুমের দিকে পা বাড়ায় প্রাপ্তি। রুমে প্রবেশ করতেই মনটা বসে যায় প্রাপ্তির। অয়ন রুমে নেই। রুমটি অন্ধকার, শীতল এবং একাকিত্বে ঘেরা। হয়তো কোনো কাজে বেরিয়েছে সে। প্রাপ্তির উত্তেজিত মনটা নিমিষেই শান্ত হয়ে গেলো। ব্যাগটা টেবিলে ছুড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। অয়ন মাঝে মাঝে খুব যত্নশীল আবার মাঝে মাঝে এতো উদাসীন। প্রাপ্তি খাপ খাইয়ে উঠতে পারে না মাঝে মাঝে। ক্লান্ত শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসছে। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমোতে পারলে মন্দ হতো না। চোখ বুজে আসছে। ধীরে ধীরে ক্লান্ত শরীরটা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।

অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত দশটা বেজে গেলো। রাইসা এবং আবরার বাসায় যখন পৌছেছে তখন তার এগারোটা বাজে। রাইসা এখন অবধি একটা কথাও বলে নি আবরারের সাথে। কলিগদের সাথেও খুব একটা হাসাহাসি করতেও দেখে নি তাকে আবরার। আবরার খানিকটা বিরক্ত হলো, এতো রাগের কি কাছে বুঝতে পারছে না সে। এতো কিসের অভিমান! পুরোটা রাস্তা শতাধিকবার তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। খুব কষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে সে। বাসায় গেলে রাইসার সাথে তাকে কথা বলতেই হবে। রুমে ঢুকতেই রাইসার হাতটা টেনে ধরে আবরার। হ্যাচকা টানে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় সে। রাইসা তখন ও নির্বিকার। বিয়ের চারমাস পর এগুলো এখন তার কাছে অনেকটাই দুধ ভাত। আবরারের এমন আচারণে সে অভ্যস্ত। নির্বিকার ভঙ্গিমাতে সে বলল,
– আবরার আমি ক্লান্ত। ঘুমাবো
– কি হয়েছে বলো তো? সেই সন্ধ্যা থেকে তোমাকে দেখছি। আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো কেনো বলতো?
– ভালো লাগছে না আবরার, ছাড়ো আমাকে।
– না ছাড়বো না, আগে বলো কি হয়েছে!
– তুমি জানো না কি হয়েছে? নাকি জেনেও না জানার ভান করে যাচ্ছো!
– মানে?
– আচ্ছা আবরার, আমাকে মানুষ মনে হয় না তোমার? আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কখনোই কি কোনো দাম নেই তোমার কাছে? সব সময় তুমি নিজেকেই দেখে এসেছো। তোমার জেদ, তোমার ইচ্ছা। আমার মাঝে মাঝে দম বন্ধ লাগে জানো তো? প্রশ্ন হয় এটাকে আদৌ ভালোবাসা বলে?
– তুমি ভুল বুঝছো রাইসা।
– হ্যা, সব সময় ঠিক ভুলের হিসেবে আমার অংকটাই মেলে না। আমি ভুল করি। আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না আবরার। হাতটা ছাড়ো। আমাদের সম্পর্কটাকে আবার আগের মতো হতে বাধ্য করো না।

রাইসা নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। আলমারি খুলে একটা জামা বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে। আবরার ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। বুকের কোনায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছে। ব্যাথাটা রাইসার কথার আঘাতে নয়। বরং তার জন্য রাইসা আজ আবারো কেঁদেছে। তার কথাগুলোয় তার চাপা আর্তনাদ লুকিয়ে ছিলো। আজ ও আবরারের মনে পড়ে সেদিনের কথাটা। সেলুলয়েডের ফিল্মের মতো স্পষ্ট, জীবন্ত।

সেদিন ছিলো জুলাই এর একটা বিকেল, প্রতিদিনের কাজ শেষে সেদিনো বাইকে করেই বাড়ি ফিরছিলো আবরার। একেই ক্লান্ত শরীর। উপরে বৃষ্টির তেজে ঢাকা শহর ডুবে রয়েছে। আবরারের একেবারেই ভালো লাগছে না। সে অপেক্ষায় রয়েছে কখন বাসায় যাবে। সিগন্যালে আধা ঘন্টা ধরে বসে রয়েছে সে। এখনো জ্যাম ছাড়ে নি। আবরারের বিরক্ত মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো। সে অপেক্ষা করছে কখন সিগন্যাল ছাড়বে। সিগন্যালটি ছাড়তে বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিলো আবরার। একেই বৃষ্টির বিকেল, উপরে স্পিডটা ছিলো অতিরিক্ত তাই যখন হুট করে একটা গাড়ি সামনে চলে আসে একেবারেই সামলে উঠতে পারে না আবরার। অমনি…………

চলবে

[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here