এক_ফালি_রোদ ২৭তম_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
২৭তম_পর্ব

হঠাৎ করে অয়নের ফোন বেজে উঠলো। ফোনের আওয়াজে প্রাপ্তি তার বুক থেকে সরে গেলো। অয়ন এতে খানিকটা বিরক্ত হলো। প্রাপ্তি সরে যাওয়ায় বুকটা খালি খালি লাগছে। ফোনটা অনবরত বেজেই যাচ্ছে। বিরক্তি নিয়ে রুমে এলো অয়ন। ফোনটা রিসিভ করতেই কানে আসে,
– হ্যালো মিস্টার অয়ন শিকদার, আই এম ফ্রম ব্রাজিলিয়ান এম্ব্যাসি। উই লাইক টু ইনফোর্ম থ্যাট ইউর পেপারস আর রেডি। প্লিজ কাম টুমোরো এন্ড কালেক্ট থোজ। হ্যাভ এ গুড ডে।

ফোনটা কেটে দিলো সেই অচেনা লোকটি। অয়নের মাথায় চিন্তার রেখা ভেসে উঠলো। তার ভিসার কাগজ তৈরি হয়ে গেছে। এক দিকে তার স্বপ্ন তো অন্য দিকে তার সাথে জড়িয়ে থাকা একটি নির্দোষ মেয়ে। কাকে ছেড়ে কাকে বেছে নিবে অয়ন, দায়িত্ব নাকি স্বপ্ন। তখনই প্রাপ্তির শীতল কন্ঠ তার কানে ভেসে আসে,
– কার ফোন ছিলো?

অয়ন প্রাপ্তির চোখে চোখ রাখে। মেয়েটি অবাক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখজোড়া কৌতুহলে ঘেরা। অয়ন মলিন হাসি হাসে, এরপর ধীর কন্ঠে বলে,
– জরুরি কিছু না।

অয়ন আর কিছু বললো না, ল্যাপটপটা নিয়ে বিছানায় বসে গেলো কাজ করতে। প্রাপ্তি অয়নের উদাসীন উত্তরের পর আবারো প্রশ্ন করার সাহস পেলো না। অয়ন ল্যাপটপ খুলে রেখেছে ঠিক ই কিন্তু তার মাথায় চিন্তা রেখা এখনো কাঁটে নি, কপালের বা পাশের শিরাটা দপদপ করছে। মনে হচ্ছে কেউ তার বুকের উপর হাজারো টনের পাথর রেখে দেওয়া হয়েছে। এই ভারটি প্রাপ্তির প্রতি তার দায়িত্বের ভার। ভার বয়ে কতদিন এই সম্পর্কের মাঝে থাকতে পারবে কে জানে!!

দেখতে দেখতে সময়ের স্রোত বইতে লাগলো। এক দিন, এক সপ্তাহ করে করে দু মাস কেঁটে দিল। রাইসা এবং আবিরারের সম্পর্কটা ধীর গতিতে এগোতে লাগলো। এখন তাদের মাঝে অভিমান কিংবা ঘৃণার দেওয়ালটি আর নেই। রাইসা তার অতীত ভুলে আবরারের সাথে নতুন ভবিষ্যতের দিকে পা বাঁড়াতে লাগলো। অপরদিকে প্রাপ্তি এবং অয়নের সম্পর্কটা অনেকটা প্রশ্নে ঘেরাই রয়ে গেলো। একদিকে প্রাপ্তির অয়নের প্রতি জন্মানো অনুভূতিগুলো যেমন গাঢ় হতে লাগলো ঠিক অপরদিকে অয়নের প্রাপ্তির প্রতি দায়িত্বের অক্লান্ত বোঝাটি দিন দিন তার গলায় আটকানো কাঁটার মতো অনুভব হতে লেগেছে, নিজের স্বপ্নের ডানা কেঁটে সংসারের জালে নিজেকে আটকে রেখেছে অয়ন। প্রাপ্তির প্রতি তার ভালোলাগাটুকু তে ইনফ্যাচুয়েশন বা আকর্ষণের নামেই সে ব্যাখ্যা করে। শেফালী বেগম দু মাসেও প্রাপ্তিকে মেনে নিতে পারেন নি। প্রাপ্তির সব কিছুতেই কেনো যেনো তার ত্রুটি অনুভব হয়। অপরদিকে প্রাপ্তি প্রতিনিয়ত তার শ্বাশুড়ির মনে জায়গা করে নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সময়ের গতির সাথে সিকদার ভিলার মানুষগুলোর জীবন ও প্রতিনিয়ত নতুন গল্প লিখছে।

রাত তিনটে,
আবরারের বুকে লেপ্টে রয়েছে রাইসা। আবরার পরম যত্নে তার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। ক্লান্ত নির্ঘুম রাইসা আবরারের বুকে চোখ বুজে রয়েছে। মনে কিছু প্রশ্ন রয়েছে কিন্তু আবরারকে কিভাবে বলবে বুঝে পাচ্ছে না রাইসা। আজকাল রাইসার মন খুব ভালো করেই পড়তে পারে আবরার। অভিমানের দেওয়াল ভেঙ্গে নতুন সম্পর্কে বাঁধা তারা। রাইসার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বললো,
– একটা কথা বলতে এতো ভাবার কি আদৌ প্রয়োজন রয়েছে?
– তুমি কিভাবে জানলে আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই?
– আমি তোমার মন পড়তে পারি। বল না কি বলবে?
– আসলে কাল আমার এক কলিগের বাসায় যাবো। ও প্রেগন্যান্ট, সাত মাস হতে যাচ্ছে। আমার সব কলিগদের হাসবেন্ডরাও যাবে। তাই বলছিলাম কি তুমি কি যাবে আমার সাথে?
– এই সামান্য কথার জন্য এতোবার ভাবতে হয়? যাবো না কেনো? কখন প্রোগ্রাম?
– সন্ধ্যা ৭টায়
– আচ্ছা তুমি তৈরি থেকো
– কি অদ্ভুত না! এই মাতৃত্ব ও কি অদ্ভুত একটি জিনিস। আমার এই কলিগ সবচেয়ে রগচটা টিচারদের একজন। অথচ দেখো কিছুদিন পর তার কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা আসবে। ভাবা যায়? তার চেহারায় আজকাল নতুন জেল্লা দেখা যায় জানো। এই মাতৃত্বের সাধ সবাইকে বদলে দেয়। জানো আমার সব কলিগদের মধ্যে এখন আমি বাকি রয়েছি এই মাতৃত্বসাধ গ্রহণ থেকে।
– রাইসা আমি ঘুমাবো, কাল অফিস ও আছে। এই কথাগুলো কাল বলো।

বলেই রাইসাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজলো আবরার। রাইসা তার কথাটা বাড়ালো না। এইটা নতুন নয়, কেনো যেনো বাচ্চাদের কথা শুরু হলেই আবরার কথাটা কাটিয়ে দেয়। কাজের বাহানা দিয়ে কথা থামিয়ে দেয় নয়তো অন্য কোনো কথা বলে এড়িয়ে যায়। রাইসা এইটা প্রথমবার খেয়াল করে নি। কিন্তু কারণটা এখনো বুঝে উঠতে পারছে না সে। আবরার কি তার সাথে তাদের পরিবারটা এগোতে ইচ্ছুক নয়! এই প্রশ্নটা রাইসার বুকে কাঁটার মতো বিধে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো রাইসার। আবরারের হয়তো সময় লাগবে এই ভেবে আর কথা বাড়ায় না রাইসা। চোখ বন্ধ করে নতুন সকালের আবির্ভাবের অপেক্ষা করে সে। ক্লান্ত শরীরটা কখন ঘুমে বিলীন হয়ে যায় টের ও পায় না সে_________________

ভোর ৪টা,
ফোন বেজে উঠে প্রাপ্তির৷ ফোনের রিংটোনে ঘুমটা ভেঙ্গে যায় তার। অবশ্য আজকাল ঘুম খুব পাতলা হয়ে গেছে। অয়ন বাসায় থাকলে শান্তির ঘুম আসে। কিন্তু সে বাসায় না থাকলে আর ঘুমের ঘ ও চোখে ধরা দেয় না। আজ তিনদিন হলো অয়ন বাসায় নেই। তার কাজের জন্য অন্য জেলায় গিয়েছে। আজকাল প্রচুর কাজে ব্যস্ত থাকে সে। টাকা কামাবার নেশা যেনো জেঁকে বসেছে অয়নের মাথায়। প্রাপ্তি ঠিক করেছে কিছু এক্সিভিশনে তার আকা ছবি দিবে। যদিও সে এখনো পাশ করে বের হয় নি। তবে অয়নকে অর্থনৈতিক সাহায্য তো করতেই পারে সে। ফোনটা রিসিভ করতেই কানে আসে পরিচিত কন্ঠটি,
– দরজাটা খুলো। এতো সকালে বেল দিলে সবাই জেগে যাবে।

কন্ঠটি অয়নের ছিলো। কিন্তু আজ তো তার ফেরার কথা নয়! ছুটে মেইন দরজার কাছে যায় প্রাপ্তি। ঘুমঘুম চোখ ঢলতে ঢলতে দরজাটা খুলে সে। অয়ন কোনো কথা না বলে সোজা নিজের রুমে চলে যায়। মেইন দরজাটা বন্ধ করে প্রাপ্তিও তার পিছু পিছু রুমে যায়। প্রাপ্তি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অয়ন হাত মুখ ধুতে চলে যায়। অয়নের ব্যাগগুলো গুছিয়ে তার বের হবার অপেক্ষা করতে লাগলো প্রাপ্তি। তিনদিনে একটি বার ফোন অবধি করে নি অয়ন। এইটা অবশ্য নতুন নয়। অয়ন কাজে গেলে তার ফোন সবসময় বন্ধ থাকে। অয়ন ওয়াশরুম থেকে বের হতেই কৌতুহল চোখে প্রাপ্তি তাকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনার তো পরশু ফেরার কথা ছিলো। আজ ফিরলেন যে?
– আমি আগে এসে কি কোনো দোষ করে ফেলেছি?
– না, আমি সেভাবে বলতে চাই নি।
– প্রাপ্তি, আমি ক্লান্ত। এখন একটু ঘুমিয়ে নেই? মাথাটা ব্যাথা করছে। তিনদিনে ২ঘন্টাও ঘুমাই নি।

প্রাপ্তি কিছু বললো না। তবে একটা চাপা আর্তনাদ তার হৃদয় করে উঠলো। সে ভেবেছিলো অয়ন হয়তো তার সাথে হাজারো কথা বলবে। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারো এমন কিছুই হয় নি। অয়ন বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। প্রাপ্তি ও তার পাশে শুয়ে পড়লো। অয়ন তখন প্রাপ্তিকে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। ধীর কন্ঠে বললো,
– তোমাকে ছাড়া বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। একদম ঘুম আসতে চায় না। এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবো।

প্রাপ্তি মলিন হাসি হাসে। সে মাঝে মাঝে অয়নকে একেবারেই বুঝতে পারে না। লোকটা তাকে আদৌ ভালোবাসে কি না সেই প্রশ্নের উত্তরটা এখনো খুজে পায় না সে। হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর তার এই ইহজীবনে পাওয়া হবে না।

সূর্যের তীব্র রশ্নি অয়নের চোখে আছড়ে পড়লে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। বেলা কটা বেজেছে সেদিকে একেবারেই হুশ নেই তার। তবে আলোর প্রখরতা বলে দিকে দুপুর হয়ে গেছে হয়তো। বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে অয়ন। চোখ খুলতেই দেখলো…………

চলবে

[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here