এক_ফালি_রোদ
২৬তম_পর্ব
বৃষ্টির তীব্রতা এবং বজ্রপাতের আঘাতে আযানের ধ্বনি ক্ষীন হয়ে আসছে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো প্রাপ্তির। বুকের বিশ্বাসের প্রদীপটিও ক্ষীন হতে লাগলো। নামায পড়ার উদ্দেশ্যে রুমে যেতেই পা জোড়া আটকে গেলো প্রাপ্তির। অজান্তেই চোখ ভিজে এলো। দরজা ঠেলে তখন অয়ন কাকভেজা অবস্থায় রুমে প্রবেশ করেছে অয়ন। লাইট জ্বেলে গামছা খুঁজতে লাগলো সে। কাঁপা স্বরে প্রাপ্তি তাকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি কখন এলেন?
প্রাপ্তির প্রশ্নে খানিকটা চমকে উঠলো অয়ন। রুম অন্ধকার হয়ে থাকার জন্য সে প্রাপ্তিকে খেয়াল করে নি। অপলক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো প্রাপ্তির দিকে। একটি মিষ্টি গোলাপি সুতির শাড়ি পড়ে রয়েছে প্রাপ্তি। আঁচল মাটিতে গড়াচ্ছে। বৃষ্টির ছিটায় শাড়ির কিছু অংশ ভিজে রয়েছে। শ্যামমুখে এখনো বৃষ্টির পানি লেপ্টে রয়েছে। ঢেউ খেলানো লম্বা চুলগুলো বাতাসের উম্মাদনার সাথে তাল মিলিয়ে উড়ছে প্রাপ্তির। গোলাপের পাঁপড়ির ন্যায় ঠোঁটজোড়া কাঁপছে তার। চোখের কোন চিকচিক করছে। অয়নের ইচ্ছে হলো কিছুক্ষণ সে প্রাপ্তিকেই দেখবে। সারাদিনের ক্লান্তির পর প্রাপ্তির স্নিগ্ধ মুখখানি তার উত্তপ্ত হৃদয়ে শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো। ঘোরলাগা চোখে অয়নকে তাকিয়ে থাকতে দেখে খানিকটা অস্বস্তিবোধ হলো প্রাপ্তির। কপালের চুলগুলো চুলের পেছনে গুজতে গুজতে ধীর গলায় বললো,
– সবাই খুব চিন্তা করছিলো, সেই সকালে বেরিয়েছিলেন। একটু বলে গেলে হতো না? আমি ফোন ও করেছিলাম। ফোনটা বন্ধ ছিলো।
– এক কাপ চা পাওয়া যাবে?
অয়নের উকটো প্রশ্নে প্রাপ্তি একটু অবাক হলো। প্রাপ্তির অবাক চাহনী দেখে সে মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
– ঠান্ডা লাগছে, আমি কাপড় পালটে নিচ্ছি। তুমি একটু চা নিয়ে আসো। বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে সব প্রশ্নের উত্তর দিবো।
বলেই গামছা কাধে রেখে একটা টি-শার্ট এবং থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো অয়ন। প্রাপ্তি কিছু বললো না। তাড়াতাড়ি নামায পড়ে অয়নের জন্য চা বানাতে ছুটলো সে। তার বর এই প্রথম তার কাছে কিছু খেতে চেয়েছে। অজানা ভালো লাগার মৃদু বাতাস তার উদ্বিগ্ন মনকে শান্ত করে দিলো। প্রাপ্তি সবার জন্যই চা বানালো। রাইসা তখন রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছিলো। রাইসা প্রাপ্তির গালের লাল আভা দেখে আন্দাজ করে নিলো প্রাপ্তির হুট করে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়ার কারণ। সে কিছু বললো না। মনের মাঝের খচখচানি শুধু মনেই সীমাবদ্ধ রাখলো। সে মন থেকে চায় অয়ন যাতে সুখী হয়। প্রাপ্তি সেই পরশ পাথরের মতো, যার স্পর্শে অয়নের জীবনের কলুষতা দূর হয়ে যাবে। প্রাপ্তি সবার জন্য চা বেড়ে অয়নের জন্য চা এবং নাস্তা নিয়ে নিজ রুমে গেলো। অয়ন এখনো গোসল সেরে বের হয় নি। সেই সুযোগে নিজেকে আয়নায় দেখে নিলো প্রাপ্তি। আজ সারাদিনের খাটুনির ক্লান্তি তার চেহারায় স্পষ্ট। অয়নের অপেক্ষায়, চিন্তায়, তার সাজার কথাই মাথায় ছিলো না। কেউ দেখলে বলবে না, আজ তার শ্বশুরবাড়িতে প্রথম দিন। ঝটপট নিজের মুখটি ভেজা গামছা দিয়ে মুছে নিলো প্রাপ্তি। এলোমেলো চুলগুলো আচরিয়ে খোপা করে নিলো। নিজেকে পরিপাটি করার অহেতুক চেষ্টা করতে লাগলো সে। হঠাৎ করে প্রাপ্তি থমকে গেলো। কি করছে সে! নিজেকে এতো সাজাবার কি আছে! সে তো এমন কখনোই ছিলো না! কারোর জন্য সাজা, কারোর ভালোলাগা মন্দ লাগা নিয়ে ভাবার কথা কখনোই চিন্তা করে নি সে। আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলো প্রাপ্তি। বড্ড অচেনা লাগছে আয়নার বিপরীতের শাড়ি পড়া মেয়েটিকে। তবে কি প্রেমে পড়ে গেলো সে? হৃদ মাঝারে তবে কি অয়ন নামক পুরুষটির বিচরণ হচ্ছে? কথাগুলো ভাবতেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে প্রাপ্তির। তখন দরজা খোলার শব্দ শুনতে পায় প্রাপ্তি। পেছনে ঘুরতেই চোখ সরিয়ে নেয় সে। অয়ন তখন কেবল একটি কালো থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে চুল মুছতে মুছতে বের হয়। বুকের ভেজা লোমগুলো লেপ্টে রয়েছে তার বলিষ্ট বুকে। চুল থেকে এখনো পানি পড়ছে। থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ার জন্য পায়ের লোম অবধি দেখা যাচ্ছে। প্রাপ্তির রোবটের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। এক বিচিত্র অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে গেলো সে। তার গালে রক্ত জমতে লাগলো। বুকের ধুকপুকানি যেনো তীব্র হচ্ছে। পালিয়ে যেতে পারলে হয়তো ভালো লাগতো। অন্য পাশ ঘুরে গলা খাকারি দিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
– আপ… আপনার চা, ঠা…ঠান্ডা হয়ে যাবে
– তুমি বারান্দায় নিয়ে যাও। আমি টি-শার্ট পরে আসছি।
– হুম
বলেই ট্রে হাতে বারান্দায় ছুটলো প্রাপ্তি। প্রাপ্তি খেয়াল করলো তার বুক এখনো কাঁপছে। লজ্জায় গালের তাপমাত্রাও বেড়ে গেছে। ধীরে ধীরে অয়ন নামক আসক্তির নেশা তার নিউরণের প্রতিটি কনায় পৌছাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে লোকটির মাঝে নিজেকেই বিলীন করে দিচ্ছে।
– বৃষ্টির সময় চা আর পেয়াজু আমার কতোটা ভালো লাগে তোমাকে বুঝাতে পারবো না। আমি তো শুধু চার কথা বলেছিলাম। তুমি তো পেয়াজু ও বানিয়ে এনেছো।
অয়নের কথায় ঘোর ভাঙ্গে প্রাপ্তির৷ পাশে তাকাতে দেখে অয়ন তার পাশে বসেছে। ধীর কন্ঠে প্রাপ্তি বলে,
– আমি পেয়াজু বানাই নি। রাইসা আপু বানিয়েছে।
– ওহ
– দুপুরে খেয়েছেন?
– হুম খেয়েছিলাম, তুমি?
– হুম। আচ্ছা কোথায় গিয়েছিলেন এতো সকালে? আমি উঠে আপনাকে পাই নি।
– একটা ম্যাগাজিনের এডিটরের কল ছিলো। সেখানেই গেলাম। শুট ছিলো কিছু। কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে কাজের মাঝে বুঝতে পারি নি।
– ওহ!
– ভয় পেয়েছিলে? কি ভেবেছিলে আমি পালিয়ে গিয়েছি?
-……………….
– প্রথমে সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে ভাবলাম পালিয়ে যাবার জায়গাটুকু আমার এখনো হয় নি। পালিয়ে যাবার জন্য শুধু ইচ্ছে নয়, টাকার ও প্রয়োজন। এই ম্যাগাজিনের কাজ টুকু শেষে বেশ মোটা অংকের টাকা পাবো। ততদিনে ভিসাটাও হয়ে যাবে। তারপর একবারেই ফুট
অয়ন প্রাপ্তির কোনো সাড়া না পেয়ে প্রাপ্তির দিকে তাকালো৷ প্রাপ্তি তখন মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। প্রাপ্তি কিছু বলছে না দেখে আলতো হাতে তার মুখটা উচু করলো অয়ন। নোনা জলের বিন্দুটি তখন প্রাপ্তির চোখ থেকে টুপ করে অয়নের হাতে পড়লো৷ অয়ন দেখলো প্রাপ্তির চোখ জোড়া লাল হয়ে রয়েছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে নিঃশব্দে মেয়েটি কাঁদছে। কেনো যেনো অয়নের প্রাপ্তির কান্নারত মুখখানি আলতো করে ছুয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। আলতো করে উষ্ণ ঠোঁটটি ছোয়ায় প্রাপ্তির তপ্ত অশ্রুপাত করা চোখজোড়াতে। তারপর ধীর কন্ঠে বলে,
– এভাবে কাঁদতে আছে? মানুষ ভাববে কি অমানুষ পুরুষ। নতুন বউ কে অত্যাচার করে।
– ভাবলে ভাবুক। আসলেই করে তো
অভিমানী কন্ঠে প্রাপ্তি কথাটা বলে। অয়ন হো হো করে হেসে উঠে। প্রাপ্তির চোখের নোনা অশ্রু মুছতে মুছতে বলে,
– তাই বুঝি? আমি অত্যাচার করি?
– না নয়তো কি? আমাকে একা ফেলে পালিয়ে যাবার কথাটা কে বলছিলো শুনি? আপনাদের সবার খুব ভালো লাগে না আমাকে একা করে দিতে? বাবা একা করা দিয়েছে, এরপর মা এখন আপনিও
হিচকি তুলে কেঁদে উঠে প্রাপ্তি৷ অয়ন এক মূহুর্ত দেরি না করে তাকে নিজের বেষ্টনীতে আবদ্ধ করে। প্রাপ্তি বেশ কটা কিল ঘুতো দেয় অয়নের বুকে। তারপর হাল ছেড়ে তার বলিষ্ট বুকখানায় মুখ লুকিয়ে কাঁদে। অয়ন পরম আবেশে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে বলে,
– আমি মজা করছিলাম। এতোটাও কাপুরুষ নই। তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো। আসলে ম্যাগাজিনের কিছু শুটের জন্য ভোরে বের হতে হয়েছিলো। তুমি তখন ঘুমাচ্ছিলে। তোমাকে জাগাতে ইচ্ছে হলো না। এখন আমি একা নই। শুধু স্বপ্নের পেছনে ছুটলে হবে না। কামাই ও করতে হবে। তোমার এবং তোমার পড়াশোনার খরচ তো চালাতে হবে তাই না? বাবার কাছে হাত পাতার স্বভাব আমার নেই। এই ধরো কাল বিকেলে বাসে খুলনা যাবো তারপর সুন্দরবন। ওখানে কিছু শট রয়েছে। তোমাকে নিয়ে যেতাম কিন্তু ওখানে বউ এলাউ না। জানি তোমার রাগ হবে। কিন্তু কিছু করার নেই।
– হুম, বুঝলাম। তবে এমন মজা আর কখনো করবেন না। ঠিক আছে?
– হুম, ঠিক আছে।
প্রাপ্তি ছোট বাচ্চার মতো অয়নের বুকে মুখ গুজে থাকলো। অয়ন তাকে পরম যত্নে জড়িয়ে ধরেছে। তার দৃষ্টি বাহিরের দিকে। বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তার গাড়িগুলো নিজেদের গন্তব্যে ছুটছে। আর অয়নের মস্তিষ্ক একটি কথা আওড়াতে লাগলো,
“বিয়ে নামক অমৃতরুপী বিষ যখন পান করেছি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়তে আমাকে হবেই”
হঠাৎ করে অয়নের ফোন বেজে উঠলো। ফোনের আওয়াজে প্রাপ্তি তার বুক থেকে সরে গেলো। অয়ন এতে খানিকটা বিরক্ত হলো। প্রাপ্তি সরে যাওয়ায় বুকটা খালি খালি লাগছে। ফোনটা অনবরত বেজেই যাচ্ছে। বিরক্তি নিয়ে রুমে এলো অয়ন। ফোনটা রিসিভ করতেই…………
চলবে
[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি