এক_ফালি_রোদ
২৩তম_পর্ব
দুষ্টু হাসি দিয়ে অয়ন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– কালকের পর থেকে আর লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখতে হবে না। সারাদিন তোমার সামনে বসে থাকতে পারবো।
অয়নের দুষ্টু কন্ঠে কথাগুলো শুনে আরোও লজ্জায় মিশে যায় প্রাপ্তি। অয়নের চোখের দিকেও তাকাতে পারছিলো না সে। তাদের খুনসুটির মাঝেই হঠাৎ সরগোলের শব্দ কানে আসে অয়ন এবং প্রাপ্তির৷ সরগোলের উৎস আর কেউ নন অয়নের মেজ খালা সাহানা বেগম। তার বৈশিষ্ট্য বলতে গেলে এক কথায় “ঘষেটি বেগম” উপাধিটি ই যথেষ্ট। খিটখিটে মেজাজের মহিলাটিকে প্রথম দেখায় বেশ অদ্ভুত লাগলো প্রাপ্তির। বেগ নাক উঁচু ধরণের মহিলা তিনি। আসার পর থেকে কোনো না কোনো খুদ তিনি ধরেই যাচ্ছেন। এখন তার কথা কাটাকাটি বেধেছে ইসমাইল সাহেবের সাথে। তার ভাগ্নে অয়নের জন্য প্রাপ্তি নামক মেয়েটি একেবারেই যায় না তবুও দয়া করে তাকে এ বাড়ির বউ করা হচ্ছে এটা তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন সাহানা বেগম। ইসমাইল সাহেব তার সব টিটকারী কথা শুনেও মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে রেখেছেন। তার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বলে কথা। এখানে তাকে মাথা নিচু করেই থাকতে হবে। এখন আরেকটি মেয়েও এ বাড়ির ই বউ হতে চলেছে। তাই তিনি কথা বাড়াতে চাচ্ছেন না। সাহানা বেগম কথায় কথায় বলেই দিলেন,
– আপনাদের তো দেখছি সবকিছুতেই শুধু ক্ষুদ আর ক্ষুদ। মেয়েটাকেও মানুষ ঠিকমত করতে পারেন নি। করেছেটা কি শুনি? একটু খরচ খরচা করবেন না তা সব কিছুতেই কিপটামি। আর এদিকে মেয়ে শুনলাম বিয়ের আগেই আমাদের ছেলের সাথে। ছিঃ ছিঃ এমন নোংরা মেয়েকে শুধু আমরা বলেই ঘরের বউ করলাম বুঝলেন?
– এভাবে বলবেন না, আমাদের মেয়ের দোষ থাকলে আপনাদের ছেলের ও কিছু দোষ ছিলো।
– আমাদের ছেলে বিয়ে না করলে আপনাদের মেয়ের বিয়ে হত? হাহ যতসব
ইসমাইল সাহেব কথা বাড়ালেন না, পাছে বিয়েটা যদি কেঁচে যায়৷ পাত্রপক্ষের কাজ কথা শোনানো, তারা কথা শুনাবেই। তিনি পাত্রীপক্ষ সুতরাং মাথা নিচু করে কথাগুলো শুনে যেতে হবে। শাহানা বেগমের কথার বুলি আরোও বেড়ে গেলো। প্রাপ্তিকে নিচু দেখানোর একটি সুযোগ তিনি ছাড়তে চাইছেন না। শেফালী বেগম চাইলে তাকে আটকাতে পারতেন, কিন্তু তিনি সেই ইচ্ছেটা প্রকাশ করলেন না। সরগোলের ধ্বনি কানে আসতেই অয়ন প্রাপ্তিকে ধীর কন্ঠে বললো,
– তুমি বস আমি দেখে আসি।
প্রাপ্তি শুধু ঘাড় কাত করে তাকে সম্মতি জানালো। কথার স্বর তার কান অবধি এসেছে। শাহানা বেগমের হিনহিনে গলার অকথ্যকথন তার বুকে তীরের মতো বিধছে। রটানো কথার ভিত্তিতে আজ তার চরিত্রকে মাঝমজলিশে ছিন্নভিন্ন করা হচ্ছে। অজান্তেই চোখে কোন ডুবে এলো নোনা জলের স্রোতে। কারোর স্পর্শ কাঁধে পেলে মাথা তুলে চায় প্রাপ্তি। রাইসা তাকে ইশারা করে। রাইসার ইশারায় ঠোঁটের কোনে মলিন হাসি ফুটে উঠে প্রাপ্তির। কিছু না বলেও চোখের ভাষায় দুবোনের মাঝে কথোপকথন হলো অথচ উপস্থিত মানুষ তার আঁচ অবধি পেলো না।
শাহানা বেগম তার মহান বাক্যঝুলি এখনো বর্ষিয়ে যাচ্ছেন। ইসমাইল সাহেব নতমাথায় নিজের পরিবারের নামে উঠানো অপবাদ মেনে নিচ্ছেন। অন্যসময় হলে হয়তো মহিলাটিকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতেন কিন্তু এখন এই মহিলা তার বাড়ির মেয়েদের খালা শ্বাশুড়ি। তাই তিনি চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করলেন। তখন সেখানে অয়ন এবং আবরার উপস্থিত হয়। আবরার মেহমান আপ্পায়নে ব্যস্ত ছিলো। কিন্তু মেজো খালার কীর্তি কানে আসতেই তাকে ছুটে আসতে হলো৷ অয়নের মহিলাদের বেশি কথা বলা স্বভাব টি পছন্দ হয় না। তাই বিরক্তির স্বরে সে শাহানা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
– এটা তো বিয়ে বাড়ি, একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। অনুষ্ঠানের মাঝে এরুপ আচারণ করাটা বুঝি আমাদের বাড়ির জন্য খুব সম্মানের।
অয়নের কথা শুনে বেশ অপমানিত বোধ করেন শাহানা বেগম। হিনহিনে কন্ঠে বলে উঠেন,
– ওরে ছোকরা, তুই দেখি বেশ সম্মান অসম্মান বুঝে গেছিস। তার বিয়ের আগে চিপায় চুপায় কীর্তি না করলেই তো পারতি। তখন সম্মানের কথা মনে ছিলো না।
– তা তোমার ছেলে যখন সরকারী টাকা খেয়ে ধপ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো, তখন কোন সম্মানের কথা ভেবেছিলো গো। শোনো খালা, বিয়ে খেতে এসেছো খাও। শুধু শুধু অশান্তি করতে যেও না। মানুষটা কিন্তু আমি ভালো নই এবং তুমি সেটা খুব ভালো করেই জানো।
শাহানা বেগম ফুসতে লাগলেন। অয়নের কথাটা তার মোটেই সহ্য হলো না। শেফালী বেগম আগ বাড়িয়ে কিছু বলার আগেই আবরার বলে উঠলো,
– খালা তোমার শরীরটা ভালো না লাগলে রুমে যেতে পারো। অহেতুক এই মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে শরীর খারাপ করার কোনো মানেই নেই।
আবরারের কথার মর্মার্থ বুঝতে বাকি রইলো না শাহানা বেগমের। অপমানের ডোজ এতো বেড়ে গেছে যে তিনি এক মূহুর্ত সেখানে দাঁড়ালেন না। গটগট করে নিজ রুমের দিকে প্রস্থান করলেন। এদিকে শেফালী বেগম দুই ছেলের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন কিন্তু তাতে লাভের লাভ কিছু হলো না। অনুষ্ঠান আবার ও শুরু হলো। একে একে বর এবং কনেকে হলুদ ছোঁয়ানো হলো। ইসমাইল সাহেবের বুক থেকে আজ একটা বোঝা যেনো নেমে গেলো। প্রাপ্তিকে একটা ভালো পরিবারে তিনি বিয়ে দিতে পারলেন। তবে একটা অনুশোচনা মনে রয়েই গেলো, একটা নামহীন, ভিত্তিহীন ভিডিওকে তিনি হাতিয়ার বানিয়েছেন। মনে মনে একটাই বাক্য জপতে লাগলেন,
“প্রাপ্তি যাতে সুখী হয়”_______
নাহলে মৃত্যুর পর ও তিনি দায়ী থেকে যাবেন।
___________________________________________________________________________
দিন পেরিয়ে বিয়ের ক্ষণ গড়িয়ে এসেছে। “কবুল” নামক একটি ছোট শব্দের বাধনে আটকা পড়লো অয়ন এবং প্রাপ্তি৷ এটাই প্রকৃতির নিয়ম। যেমন “কবুল” নামক ছোট একটি শব্দের তিনবার উচ্চারণে দুজন অপরিচিত ব্যাক্তিরা নিজের মাঝে বিয়ে নামক একটি অটুট বন্ধনে আটকে যায়; ঠিক করে তেমন ই “তালাক” নামক একটি ছোট শব্দের তিনবার উচ্চারণে তাদের এই সম্পর্কটি ভেঙ্গেও যায়। অয়ন এবং প্রাপ্তির বিয়ের আয়োজনটি জুম্মাবাদে অনুষ্ঠিত হলো। লাল বেনারসিতে আজ প্রাপ্তিকে ফুটন্ত লাল গোলাপ থেকে কম লাগছে না। এই লাল রঙটি মাঝে মাঝে শ্যাম বর্ণটিকে আরোও বেশি সুন্দর করে তুলে, যেমনটি করেছে প্রাপ্তির ক্ষেত্রে। সবার মুখে একটি কথাই বর এবং কনেকে যেনো একে অপরের পরিপূরক লাগছে। গোল্ডেন শেরওয়ানিতে অয়নকে কোনো রাজপুত্র থেকে কম লাগছে না। বিয়ের অনুষ্ঠানে কোনো ঝামেলা হলো না। খুব সুন্দর এবং শিষ্টতার সাথে বিয়েটা হয়ে গেলো। “কবুল” বলার সময় প্রাপ্তির মনে একটা সুপ্ত শান্তি ছিলো। অজান্তেই একটা ভালোলাগা কাজ করছে অয়নের প্রতি। অপরদিকে অয়নের গলায় যেনো শেকলের মতো লাগছিলো শব্দটি। এতোটা কঠিন হবে একটি শব্দ তার জানাছিলো না। তবুও অনেক কষ্টে সে কবুলটা বললো। বুকের মাঝে একশত টনের পাথরের চাপ অনুভব করলো অয়ন। চাপটা ঠিক কেনো অনুভূত হচ্ছে তার জানা নেই। এই চাপটি কিছুকাল পূর্বেও বোধ হয়েছিলো যখন সে ভালোবাসা নামক মধুরুপী বিষটি চোখ বুঝে পান করেছিলো। অভিনয় করতে করতে কখন যে রাইসা নামক নারী তার মনের গহীনে নিজের পতাকা নাড়িয়ে দিয়েছিলো, এটা নিজেও বুঝতে পারে নি। আজ ঠিক তেমন অনুভুতি হচ্ছে তার। প্রাপ্তি নামক মেয়েটির সাথে সুখে থাকার দুঃস্বপ্ন দেখেছে সে। এই দুঃস্বপ্নটি কবে তাকে ডুবিয়ে দিবে জানা নেই তার। আরোও চাপ অনুভূত হলো যখন বিদায়কালে তার হাতজোড়া ধরে ইসমাইল সাহেব আকুল কন্ঠে বললেন,
– অনাথ মেয়েটিকে দেখে রেখো বাবা, তার কেউ নেই এ দুনিয়ায়।
অয়ন কিছু বলতে পারলো না। খুব বলতে ইচ্ছে হলো — ” চিন্তা করবেন না খালু, আমি প্রাপ্তিকে সামলে রাখবো।”
কিন্তু একটা শব্দ ও মুখ থেকে বের হলো না। এক পিতারুপী অভিভাবক তার আমানতকে বিশ্বাসের সাথে তার হাতে তুলে দিচ্ছেন। তাকে কি মিথ্যে আশ্বাস দিতে পারবে সে! সে কি আদৌও পারবে প্রাপ্তিকে সামলে রাখতে?
প্রাপ্তি এবং অয়নের বাসরের খাট নিজ হাতে সাজালো রাইসা। কেনো যেনো খারাপ লাগছে না। বরং একটা খুশি মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে নিজের ছোট বোন তার দেবরের বউ রুপে তার পরিবারে এসেছে। আজকের পর থেকে এই রুমের মালকিন তার সেই বোনটি ই হবে। ভাবতেই মনটা উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠলো রাইসার। অয়নের জন্য প্রাপ্তির মতো কাউকেই দরকার। ছেলেটা যদি এবার দুঃখের ছায়া থেকে বের হতে পারে। অনেকটা আবরারের মতো। শুধু পার্থক্য একটাই আবরার নিজেই তার মনে আঘাত হেনেছিলো। আবার নিজেই তার মলম বনে গেছে। আবরারের কথা ভাবতেই হৃদস্পন্দন যেনো বেড়ে গেলো রাইসার। লোকটা আজকাল তার মনমন্দিরে জেকে বসেছে। রাইসার ঠোঁটের কোনায় অজান্তেই মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। বাসর সাজিয়ে নিচে গেলো রাইসা। প্রাপ্তি তখন সোফায় যবুথবু হয়ে বসে রয়েছে। রাইসার প্রাপ্তির মনের অবস্থা বুঝতে বেশি দেরি হলো না। প্রাপ্তির হাতটি ধরে বললো,
– চলেন নতুন বউ নিজের রুমে চলো।
রাইসার কথামতো ভদ্রমেয়ের মতো ঘার কাত করে তার সাথে চললো প্রাপ্তি। রাইসা তাকে অয়নের রুমে নিয়ে গেলো। বিছানায় বসিয়ে বললো,
– এখন অপেক্ষা করো, বরমশাই এলো বলে।
– আপু
রাইসা চলে যেতে নিলেই প্রাপ্তি তার হাত টেনে ধরে। প্রাপ্তির চোখে মুখে প্রশ্নের আভা। রাইসা ধীর কন্ঠে বললো,
– কিছু বলবি?
– তুমি আমার উপর রেগে নেই তো?
– রাগবো কেনো রে বোকা?
– অয়ন স্যার এবং আমি
– অতীতের জাল ছিড়ে যখন আমরা দুজন ই এগোতে চাই তবে তুই কেনো সেই অতীতের সুতো টেনে বসে আছিস। আমি তার অতীত প্রাপ্তি। কিন্তু বর্তমান এবং ভবিষ্যতটি কিন্তু তুই। আর তোকে নিজে সেই জায়গা করে নিতে হবে।
রাইসার কথাটা শুনে প্রাপ্তি তাকে জরিয়ে ধরে। রাইসা মৃদু হেসে তার মাথায় বুলিয়ে বলে,
– বোকা মেয়ে একটা।
রাত বারোটা,
ঘরির কাঁটা টিকটিক করছে। রুমে একাই বসে রয়েছে প্রাপ্তি। অয়নের রুমটি বেশ ছোট। ক্রিম কালারে দেয়ালে ঘেরা রুমটিতে আসবাবপত্র ও গোটাকয়েক। দেয়াল জুড়ে কেবল অয়নের তোলা ছবির সমন্বয়। ছবিগুলো যেনো জীবন্ত। প্রাপ্তি হাত দিয়ে ছুতে লাগলো ছবি গুলোকে। লোকটা কেমন সেটা তার গুনেই বোঝা যায়। প্রাপ্তির খানিকটা লজ্জাও লাগতে লাগলো। লোকটার সাথে আজ তার বাসর রাত। কি কথা বলবে সে! তাকে দেখলেই তো হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। কথাগুলো জট পেকে যায়। আচ্ছা লোকটি কি তার হাতটা ভালোবেসে ধরবে! অজানা প্রশ্নগুলো মনের মাঝে এক অজানা ভালোলাগা তৈরি করছে। কিন্তু লোকটি কোথায়? একা একা ঘরে বসতে ভালোলাগে! তখনি দরজা খোলার শব্দ কানে এলো প্রাপ্তির। বুক ধুকপুক করছে। এই বুঝি অয়ন এলো! পায়ের শব্দ স্পষ্ট হতে লাগলো। লোকটি তার কাছে আসছে। ভয়ে, লজ্জায় শিটিয়ে গেলো প্রাপ্তি। এই অনুভূতিটি তার এই প্রথম। এর আগে জানাই ছিলো না সেও লজ্জা পেতে পারে। প্রাপ্তি লাজুক ভাবে ঘুরে তাকালো। তার সামনে অয়ন দাঁড়ানো। নেশাগ্রস্ত চোখে দেখে যাচ্ছে সে প্রাপ্তিকে। অয়নকে দেখে মনে একটু খটকা লাগলো প্রাপ্তির। কিন্তু প্রাপ্তি কিছু বলার আগেই অয়ন তার ঠোঁট জোড়া দখলে নিয়ে নিলো। অয়নের এরুপ কান্ডে..……………..
চলবে
[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি