এক_ফালি_রোদ
২২তম_পর্ব
প্রাপ্তিকে সাজিয়ে, হলুদের ডালা সাজিয়ে নিজে তৈরি হতে যেতে বিকেল গড়িয়ে গেলো রাইসার। এখন ও গোসল অবধি করার সুযোগ পায় নি সে। যেহেতু তাদের বাসায় ই সব হচ্ছে। তাই পুরো ড্রয়িং রুম ফুল দিয়ে ডেকোরেট করা হয়েছে সে। সব কাজ শেষ করেই রুমে এসে বিছানায় বসে রাইসা। নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকু পায় নি সে। তখনই একটা গ্লাস তার সামনে রাখে আবরার। হিনহিনে কন্ঠে বলে,
– লেবুর শরবতটা খেয়ে নাও। সকাল থেকে কিছু পেটে পড়ে নি তোমার। ঠান্ডা আছে, খেলে আরাম লাগবে
– আপনি বানিয়েছেন?
– না আমার ভুত বানিয়েছে। কথা বড্ড বেশি বলো তুমি।
– এতো কষ্ট করার দরকার ছিলো না!
– লেবু চিপতে কষ্ট হয় বলে আমার জানা ছিলো না। আর মনে করো না আমি তোমার জন্য কষ্ট করেছি। আমি চাই না তুমি মেহমানদের সামনে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকো। মানুষ কি বলবে সিকদার বাড়ির ছোট ছেলের বিয়েতে বড় বউ বেহুশ হয়ে গেছে।
বলেই খট করে গ্লাসটা রেখে রুম থেকে বেরয়ে গেলো আবরার। লোকটার প্রতি এখন আর ঘৃণা জন্মায় না রাইসার মনে। তার প্রতি অনুভূতিটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না রাইসা। খানিকটা মিশ্র অনুভূতি। লোকটা তার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত কেয়ারিং, কিন্তু সেটা দেখানোর ধরণটা বেশ অন্যরকম। খানিকটা দায়ে ঠেকে করার মতো। এই ধরুন সে রাইসাকে কলেজ থেকে বাসা নিয়ে আসবে, কিন্তু এটা বলবে না যে সে তার কেয়ার করে বা তার জন্য চিন্তা হয়। উলটো বলবে, রাইসার টাকা বাঁচানোর পদ্ধতি কারণ তার রাস্তায় রাইসার কলেজ পড়ে। অহেতুক কেনো আলাদা উবার ভাড়া খরচ করবে। আজ ও সে নিজ হাতে রাইসার জন্য লেবুর শরবত বানিয়েছে। কারণ রাইসার উপর সকাল থেকে আসলেই অনেক বেশি ধকল যাচ্ছে। কিন্তু সেটা যেভাবে দিলো যেনো দায় ঠেকায় করতে হয়েছে। রাইসা মুচকি হাসে, তারপর আলমারি খুলে হলুদের জন্য কেনা হলুদ জামদানি শাড়িটি বের করে সে। লম্বা শাওয়ারের পর শরীরটা ফুরফুরে লাগছে। আয়নার সামনে দাঁড়ায় রাইসা। নিজেকে আজ অন্য রুপে দেখছে সে। কি অদ্ভুত না! একটা সময় এই লোকটির বউ হবার জন্য তার মনটা উতলা হয়ে থাকতো। অথচ আজ তার হলুদে সাজতে বসেছে। সত্যির সাথে খুব সহজেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে রাইসা। ধর্ম বলা হোক কিংবা দেশী নিয়ম, এদেশের মেয়েদের বিয়ে একবার ই হয়। তারপর ভালোবাসা আপনাআপনি ই তার স্বামীর প্রতি জন্মে যায়। হোক সেই বিয়ে জোর করে তার উপর চাপানো। হোক তার স্বামী তাকে বিয়ের রাতে তার মতের বিরুদ্ধে তার পাশবিক শরীরকে নিজের করতে চেয়েছে। তবুও বাঙ্গালী নারী সেটাই মেনে এসেছে। বিয়ের পর স্বামীর পরিবর্তে অন্য পুরুষের চিন্তা করাটাও একটা পাপ, সমাজ কিংবা ধর্ম তাকে চরিত্রহীনা উপাধি প্রদান করে। রাইসাও তার ভিন্ন নয়। সে আবরারকে ভালো হয়তো বাসে না। তবে আবরারের সাথে একই রুমে একই বিছানায় দিন কাঁটানো সে শিখে গেছে। এখন যদি আবরার তার উপর নিজেকে চাপিয়েও দেয় তাহলেও সে সে মেনে নিবে। খুব একটা খারাপ লাগবে না। অয়ন থাক না মনের একটা কোঠরে, লুকায়িত। যাকে কেউ ছুতে পারবে না, দেখতে পারবে না। যে স্মৃতি কেবল তার হবে। হঠাৎ রাইসার অনুভব হলো তার কাঁধে কারোর স্পর্শ। হুট করেই এমন অনুভূতি হবার কারণে বেশ ঘাবড়ে গেলো রাইসা। আয়নার দিকে তাকাতেই খেয়াল করলো আবরার তার পেছনে দাঁড়ানো। তার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে তার কোমর আকড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। নেশাগ্রস্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। আবরারের চোখের ভাষা আজ রাইসা পড়তে পারছে। কেনো যেনো তাকে বাঁধা দিতে মন চাইলো না। বাঁধা দিয়ে কি হবে, তার সাথেই তো সারাটাজীবন কাঁটাতে হবে রাইসাকে। ধীর কন্ঠে তাকে বললো,
– কি দেখছেন?
– আয়নার প্রতিবিম্বটিকে, হলুদ শাড়িতে যে নারীর প্রতিবিম্বটি দেখা যাচ্ছে। স্বচ্ছ হলুদ গোলাপ যেনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ এই নারীটিতে বিলীন হতে মন চাইছে।
– এই নারীটি যে বড্ড গভীর। যার তল পাওয়াই ভার। পারবেন তো সামলাতে?
– টুকরো করে কাছি
আমি ডুবতে রাজি আছি
আমি ডুবতে রাজি আছি
তোমার খোলা হাওয়া
লাগিয়ে পালে
তোমার খোলা হাওয়া
আবরারের কথায় স্মিত হাসে রাইসা। রাইসার হাসিতে আজ মলিনতা নেই, দুঃখ নেই। আছে শুধু নতুন উম্মাদনা। আবরার তাকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরায়। মুখটা আলতো হাতে তুলে কপালে উষ্ণ ঠোঁটের ছোয়া লাগায়। আকুল কন্ঠে বলে,
– আমরা কি সব ভুলে স্বাভাবিক সম্পর্কে বাঁধা পড়তে পারি না?
-……….
– আমি তোমায় জোর করবো না। গতবার জোর করে তোমার কাছে কেবলই হীন্য এবং ঘৃণার পাত্র হয়েছে। সেই ভুলটা দ্বিতীয়বার করবো না আমি। আমি তোমার মনে রাজত্ব করতে চাই রাইসা।
– ভালোবাসেন আমাকে?
হুট করেই প্রশ্নটি ছুড়ে দেয় রাইসা। অনুসন্ধিৎসার তীব্র কীরণ তার চোখে স্পষ্ট। অধীর আগ্রহে সে আবরারের মুখপানে চেয়ে আছে। আবরারের ইচ্ছে হলো তখনই নিজের অন্তরাত্নাকে তার সামনে তুলে ধরতে। কিন্তু আবরারের কিছু বলা হলো না। তার আগেই শেফালী বেগমের ডাক পড়ে। বাড়ির ছেলের বিয়েতে বউ ঘরে ঘন্টার পর ঘন্টা রুমেই বসে থাকবে সেটা কি হয় নাকি! আবরার মৃদু হাসি দিয়ে বলে,
– মা ডাকছে, অনুষ্ঠান শুরু হবে। চলো যাই। প্রশ্নটা না হয় তোলা থাক
– সব আপনার নিছক বাহানা। উত্তর দিবেন না বললেই হয়।
– বাহানা নয়, সব কিছুর ই একটা সুন্দর সময় লাগে। কোনো এক জ্যোৎস্না রজনীতে না হয় উত্তর দিবো তোমার প্রশ্নের।
– দেরি হয়ে যাবে না?
– মৃত্যুর আগে ঠিক পেয়ে যাবে।
কথাটা শেষ হতেই ছলছল আঁখিতে রাইসা তার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। অভিমানী কন্ঠে বলে,
– বলেছিলাম, এই মৃত্যুর কথা যাতে আর মুখে না আনা হয়।
– বউ বুঝি রাগ করলে? দাঁড়াও।
বলেই পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে আবরার। প্যাকেটটা রাইসার হাতে ধরিয়ে বলে,
– তোমার জন্য কিনেছিলাম, দেবার সনয় হয় নি।
– কি এটা?
– খুলেই দেখো।
প্যাকেটটা খুলতেই দেখে দুটি বেলীফুলের মালা। রাগটা নিমিষেই পানি হয়ে গেলো রাইসার। মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠলো। বেলীফুল তার পছন্দের ফুল। মালাটি নাকের কাছে নিয়ে মন ভরে গন্ধ নিলো সে। আবরার বললো,
– ভালো লেগেছে?
– খুব, এনেছেন যখন পড়িয়ে দিন।
আবরার মৃদু হাসি মালাটির তার চুলের সাথে আটকে দিলো। নতুন উম্মাদনায় ভাসছে দুজন। এ যেনো নতুন সম্পর্কের সূচনা____________
হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হতে হতে আটটা বাজলো। প্রাপ্তি এবং অয়নকে পাশাপাশি বসানো হলো। আত্নীয় বলতে শুরু কাছেন মানুষজন। অয়নের বন্ধুমহলের তেমন কেউ নেই রবিন ব্যাতীত। প্রাপ্তিকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। সাদা জমিন, হলুদ পাড়ের শাড়ি পড়েছে সে, ফুলের গহনা দিয়ে নিপুন ভাবে সাজিয়েছে তাকে রাইসা। চোখে মোটা করে কাজল দেয়া, ঠোটে মিষ্টি গোলাপি রঙ্গের লিপস্টিক। কোনো ভারী সাজসজ্জার বাহার নেই, তবুও মেয়েটির স্নিগ্ধতাই তার সৌন্দর্য হয়ে গিয়েছে। অয়নকেও আজ সুদর্শন যুবক লাগছে। সাদা পাঞ্জাবী, হলুদ কোটিতে বেশ চমৎকার লাগছে তাকে। চুলগুলো এলোমেলো কপালের উপর পড়ে রয়েছে। প্রাপ্তি শুধু আড়ালে আবডালে তার বরকেই দেখে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে নিজ ভাগ্যের উপর নিজের ই বিশ্বাস হচ্ছে না। এতো সৌভাগ্যবান কি সে আদৌও হতে পারবে? এতো সুখ একসাথে তার ঝুলিতে সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন। সামলাতে পারবে তো সে। হঠাৎ অয়নের সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নেয় প্রাপ্তি। লজ্জায় তার গাল লাল বেগুনি হতে লাগে। দুষ্টু হাসি দিয়ে অয়ন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– কালকের পর থেকে আর লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখতে হবে না। সারাদিন তোমার সামনে বসে থাকতে পারবো।
অয়নের দুষ্টু কন্ঠে কথাগুলো শুনে আরোও লজ্জায় মিশে যায় প্রাপ্তি। অয়নের চোখের দিকেও তাকাতে পারছিলো না সে। তাদের খুনসুটির মাঝেই হঠাৎ……
চলবে
[ সবাইকে পহেলা রোজা এবং পহেলা বৈশাখের অগ্রীম শুভেচ্ছা। আজ একটা টার্গেট দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই পর্বটি যদি ৬৫০ লাইক ক্রস করে তবে আগামীকাল পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দুইটি পর্ব পোস্ট করবো। আর যদি না হয় তবে পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাত সাড়ে নয়টায় ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি