এক_ফালি_রোদ ১৩তম_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
১৩তম_পর্ব

– আমি যাবো না। আমাকে জ্বালিয়েন না।

প্রাপ্তির কন্ঠে এবার খানিকটা ক্ষোভ ছিলো, ছিলো সুপ্ত রাগ। মেয়েটিকে কম দিন হয়নি অয়ন দেখেছে। এই প্রথম তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে দেখছে। কিন্তু এখানে জেদের ব্যাপার নয়। ব্যাপারটা তার সেফটির। তাই সে না চাইতেও তাকে জোর করতে হবে। প্রাপ্তির কাছে গিয়ে তার হাত থেকে তুলিটা জোর করে কেড়ে নিলো অয়ন। এরপর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,
– এখানে জেদকে প্রাধান্য দিতে পারছি না সরি। চলো আমার সাথে?

বলেই জোর করে টেনে নিয়ে যেতে নিলে প্রাপ্তি তার হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। পুরুষ মানুষের হাত এমনেই শক্ত হয়, তার উপর যদি হয় সুঠামদেহী তাহলে তো কোথায় নেই। অয়নের হাতের কবল থেকে নিজেকে ছুটানোর কোনো উপায় না পেয়ে এটা করতে বাধ্য হয় সে৷ কিন্তু কিসের কি? অয়ন তার হাত ছাড়ে নি। বরং সূক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো অয়ন,
– হয়ে গেছে? এবার চলো।

এবার যেনো আরোও বিরক্ত লাগছে প্রাপ্তির। অয়নের উপর আজ তার মারাত্নক মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সব মিলিয়ে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না সে। একেই মনের মাঝে কষ্টগুলো দলা পেকে রয়েছে। কোথায় একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো, এই লোকটার জন্য হয়তো তাও হয়ে উঠবে না। তীব্র কন্ঠ বলে উঠলো,
– আপনাদের সমস্যা কি? একটু বলবেন আমাকে? আমাকে একটু শান্তি দিতে কি খুব সমস্যা আপনাদের? আমি তো কারোর কোনো কিছুতে বাধা হই না, তাহলে আমাকে নিয়ে সবার কেনো সমস্যা?
-………
– কি হলো বলছেন না কেন? কি দোষ করেছি আমি? আমি অনাথ এটা কি আমার দোষ? নিজের সব দায়িত্ব নিজে নিতে পছন্দ কথা করি এটা আমার দোষ? একটা প্রজেক্টের কাজে নিষিদ্ধপল্লীতে কি গেছি আমার চরিত্র নিয়ে কথা উঠতে লাগলো, বাসায় গেলেও কুড়ে কুড়ে থাকতে হয়। আমি একটু নিঃশ্বাস নিতে চাই। একটু বাঁচতে চাই। আমাকে প্লিজ একটু একা ছেড়ে দিন। আমার একটু ভালো থাকতে ইচ্ছে করে। আমার একটু

আর কথা বলতে পারলো না প্রাপ্তি৷ সশব্দে কাঁদতে শুরু করলো। কথাগুলো কান্নার আর্তনাদের চাপা পড়ে গেলো। এতোক্ষণ আটকানো নোনাজলের স্রোত বাধ মানলো না আর। হঠাৎ প্রাপ্তিকে এভাবে ভাঙ্গতে দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। মেয়েটা তার সামনে কাঁদছে, একবার ভাবলো শান্তনা দেবে, কিন্তু শান্তনা দিয়েও কি লাভ! এর চেয়ে মনের মাঝে আটকে থাকা ক্ষোভ, যন্ত্রণা গুলো নোনাজলের স্রোতের সাথে ভেসে যাওয়াটা ঢের ভালো। প্রাপ্তি কাঁদছে আর অয়ন অপলক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। কেনো! সে নিজেও জানে না, কিন্তু মেয়েটির কান্নারত মুখখানা বড্ড মায়াবী। এতোদিন চোখে না পড়লেও আজ অনুভব হচ্ছে মেয়েটা মারাত্নক মায়াবী, শ্যাম বর্ণের মেয়েদের প্রচন্ড মায়াবী লাগে। তাদের মুখখানা যেনো সৃষ্টিকর্তা নিখুঁতভাবে বানিয়েছেন। এক অসামান্য শিল্পকর্ম, শিল্পীর অপরিসীম মেধার বহিঃপ্রকাশ যেনো। এই মূহুর্তে প্রাপ্তিকেও অয়নের কাছে এক অপরুপ চিত্রকর্মের মতো মনে হচ্ছে। এ যেনো অন্যরকম মায়া। প্রাপ্তির চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে, নাকের ডগাটা টমেটোর মতো দেখাচ্ছে; তবুও সুন্দর লাগছে। কে জানে কেন!!

বেশ কিছুক্ষণ পর প্রাপ্তি কান্না থামালো। নিজের ওড়নাখানা দিয়ে নিজের চোখ মুছে নিলো সে। মনটা বেশ ঝরঝরে লাগছে, আজ বহুবছর অর সে কেঁদেছে এভাবে। পূর্বে কবে এভাবে কেঁদেছিলো খেয়াল নেই তার। মনেও করতে চাচ্ছে না সে। কিন্তু অবাককর ব্যাপার একটাই সেটা হলো, সে অয়নের সামনে কেঁদেছে। এবং অয়ন এখনো তার হাতখানা ধরে রেখেছে। তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। লোকটার মাথার তার যে দু পাঁচটা ছেড়া সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে প্রাপ্তি। খানিকটা অস্বস্তিও লাগছে না। এভাবে পাগলের মতো কাঁদার পর ও তার রিয়েকশন খুব স্বাভাবিক। আমতা আমতা করে প্রাপ্তি বললো,
– আসলে এভাবে কাঁদতে চাই নি
– ইটস ওকে। নো প্রবলেম। কিন্তু এবার আমাদের তোমার বাসার দিক যাওয়া উচিত। আংকেল আন্টি তোমার অপেক্ষা করছে হয়তো।
– আমার অপেক্ষা কেউ করবে না। আমার ও বাড়ি যেতে ভালো লাগে না।
– কেনো বলো তো?
-…….
– আচ্ছা বলা লাগবে না। কিন্তু এখানে তো বসে থাকা যাবে না তাই না?
– আমাকে একটা থাকার ব্যাবস্থা করে দিবেন?
– হ্যা?
– হু, একটা বাসা। যেখানে আমি থাকবো। নিজের আত্নসম্মান নিয়ে।
– পাগল টাগল হয়ে গেলে নাকি? জানো ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া কতো দাম? আর তুমি ব্যাচেলর, তোমার বাড়ি পাওয়া আরোও প্যারাদায়ক।

অয়নের কথা শুনে চুপ করে যায় প্রাপ্তি। আসলেই ওই নরক থেকে তার মুক্তি নেই। সে কখনোই ও বাড়ি ছাড়তে পারবে না। নিজের বাসস্থানটা তার কোনোকালেই হবে না। হঠাৎ অয়ন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। অয়নকে এভাবে হাসতে দেখে বেকুব হয়ে যায় প্রাপ্তি। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে অয়ন বলে,
– তুমি সত্যি দুনিয়াটা খুব কম চেনো। মন থেকে চাইলে কিছুই এতো কঠিন নয়। আমার কিছু ফ্রেন্ডস ব্যাচেলর থাকে। তুমি বললে কথা বলতে পারি। ভাড়াটাও তুমি টিউশনস করে দিয়ে দিতে পারো৷
– উনারা মেয়েই তো?
– বোকা তুমি? আমি ছেলেদের সাথে থাকতে বলবো? কিন্তু এখন তুমি ডিসাইড করো তুমি কি ওদের সাথে থাকবে কি না। একা একা থাকাটা এতোও কঠিন যেমন নয়, সোজাও নয় কিন্তু
– আমি পারবো, আমি ও বাড়ি থেকে বের হতে চাই।

প্রাপ্তির উদ্বিগ্নতা দেখে অয়নের ভ্রু যুগল একত্রিত হয়ে গেলো। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– কি এমন হয়েছে যে তুমি এতোটা ডেস্পারেট হয়ে গেছো ওই বাড়ি ছাড়ার জন্য?

অয়নের প্রশ্নে আবারো মৌনতা ধারণ করে প্রাপ্তি। অয়ন আর ঘাটালো না। খামাখা কারোর কাটা অংশ খুঁচিয়ে পচন ধরানোর মানে নেই। প্রাপ্তিকে পৌছে দিতে দিতে রাত নয়টা বাজলো। প্রাপ্তির ভয় হচ্ছে, আবার না জানি খালুর কাছে কথা শুনতে হয়। কিন্তু পরমূহুর্তে মনে হলো, খালু কিছু বললে চুপচাপ সব শুনে নিবে। আর অয়ন যা বললো সেভাবে একটা ব্যাচেলর বাসা বা ম্যাস খুজার চেষ্টা করবে। বাইক থেকে নামতে নামতে সে বললো,
– ধন্যবাদ আর সরি
– কেনো?
– ধন্যবাদ আমাকে বাড়ি পৌছে দেবার জন্য, আর সরি তখন কামড় দেবার জন্য।
– রাক্ষসী মেয়ে তুমি, মাংস তুলে দিয়েছো একেবারে।
– এইজন্যই সরি।
– ব্যাপার না, ভেতরে যাও। আমি দেখছে ওই ব্যাপারটা।

অয়নের কথাটা শুনে বেশ নিশ্চিন্ত হয় প্রাপ্তি। ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। আর এদিকে অয়ন ও মুচকি হাসি দিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়। অয়ন ভেবেছিলো সে একটি মেয়েকে সুস্থভাবে বাড়ি পৌছে দিয়েছে। কিন্তু তার অজানা ছিলো ভবিষ্যতে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে, সেটা শুধু সেই মালিকই জানেন যিনি আমাদের সবার ভাগ্য রচনা করেন____________

হঠাৎ করেই রাইসার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। রাতে এভাবে কখনোই তার ঘুম ভাঙ্গে না। কিন্তু আজ যে কি হলো! রুমের লাইট জ্বলছে। চোখখানা কচলে ঘড়ির দিকে তাকানো সে। ঘড়ির কাঁটা তখন ৩টার ঘড়ে ভীড় জমিয়েছে। খেয়াল করলো বাথরুমের দরজাটা ভেজানো এবং লাইট জ্বলছে। পাশ ফিরতেই দেখলো পাশের জায়গাটা ফাঁকা। তারমানে আবরার বাথরুমে রয়েছে। বাথরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ স্পষ্ট। রাইসার একটু চিন্তা হলো। সে কিছুক্ষণ ডাক দিলো আবরারকে। কিন্তু কোনো সাড়া পেলো না। চিন্তাটা আরো গাঢ় হলো। এবার ধীর কন্ঠে বললো সে,
– আবরার আমি ভেতরে আসছি।

এর পরেও কোনো সাড়া না পেলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে রাইসা। বাথরুমের ভেতরে যেতেই পা থেকে যেনো মাটি সরে গেলো রাইসার। ভেতরে আবরার…………..

চলবে

[ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here