এক_ফালি_রোদ
৯ম_পর্ব
রবিনের প্রশ্নে থমকে যায় অয়ন। আজকাল কাজের বাহানা দিয়ে প্রায়ই বাসায় যায় না সে। গেলেই রাইসার সাথে দেখা হয়। তাই বাসায় গেলেও প্রচুর রাত করে যায়। আর খুব ভোরে বেরিয়ে পরে। রবিনের কথায় চুপ করে থাকে অয়ন। বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। অবশ্য দোষটা তো তার ই ছিলো। সে তো সব জেনেও ভালোবাসা নামক বিষ পান করেছে। অয়নকে চুপ করে থাকতে দেখে রবিন আবারো একই প্রশ্নই করলো। মুখে মলিন হাসি টেনে অয়ন বললো,
– যে আমার নয় তাকে বিয়ের প্রশ্নই উঠে না।
– মানে?
অয়ন কিছু বলতে যাবে তার আগেই বিকট শব্দ কানে আসে তাদের। ফিরে তাকাতেই দেখে রবিনের বিশাল লাইটটা নিচে পড়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে রয়েছে। আর ঠিক তার পাশে হাটু গেড়ে বসে রয়েছে প্রাপ্তি। পায়ের খানিকটা অংশ হাত দিয়ে চেপে হয়েছে সে। অয়ন এবং রবিন দেরি না করে প্রাপ্তির কাছে ছুটে যায়। প্রাপ্তি অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। অয়ন তার কাছে এসে হাটু গেড়ে বসলো। ধীর কন্ঠে বললো,
– দেখি, কতটুকু লেগেছে!
– আমি ঠিক আছি স্যার। কিন্তু হয় নি।
– দেখাতে বলছি তো?
অয়নের রুদ্র কন্ঠে খানিকটা কেঁপে উঠলো প্রাপ্তি। হাতটি আস্তে করে সরিয়ে নিলো। সে। কাচের খানিকটা পায়ে গেথে গেছে তার। প্রচুর রক্ত পড়ছে। প্রাপ্তির যেনো সেদিকে খেয়াল নেই। তার চোখ আটকে আছে লাইটটির ভাঙ্গা অংশগুলোর দিকে। কেনো হবে না, কত বড় ক্ষতি হয়ে গেলো। কোথায় স্যারের বন্ধু তাকে কম দামে ক্যামেরা দুতে সাহায্য করলেন কিন্তু সে তার ই এত্তো বড় ক্ষতি করে দিলো। অয়ন রবিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
– দোস্ত, আমি ওকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি। তোর লাইটের ক্ষতিপূরণটা আমি পরে দিয়ে দেবো না হয়?
– তুই চিন্তা করিস না, ব্লিডিং হচ্ছে তো ওর। আগে ওকে দেখ। লাইট এ নিয়ে কত ভাঙ্গলো।
– থ্যাংক্স রে।
বলেই প্রাপ্তিকে কোলে তুলে নিলো অয়ন। অয়ন এমন সাংঘাতিক কর্মকান্ডে চোখজোড়া বিস্ফোরিত হয়ে উঠলো প্রাপ্তির। গালের দুধার স্বয়ংক্রিয়ভাবে টমেটোর ন্যায় লাল হয়ে উঠলো। সে অবাক, হতবাক, এক কথায় নির্বাক। হবে নাই বা কেনো? এভাবে কোনো পুরুষের সংস্পর্শে সে এই প্রথমবার এসেছে। তাও যদি পুরুষটি তার পরিচিত হতো কিংবা প্রেমিক হতো তাহলে একটি কথা ছিলো। কিন্তু এ পুরুষটি যে তার কোর্স টিচার। আমতা আমতা করে প্রাপ্তি বললো,
– কি করছে আপনি? নামান আমাকে?
– মানে কি?
– মানুষ দেখছে তো?
– এই শোনো, তোমাকে কোলে নেবার শখ আমার ও নেই। তুমি এখন হাটতে পারবে না। কাঁচটি বিধে রয়েছে। এখন বেশি নড়লে চড়লে তোমার পায়ের আঘাত পারবে বই কমবে না।
বলেই গটগট করে হাটা শুরু করলো অয়ন। প্রাপ্তি কিছু বলতে পারলো না। শুধু নিজের অসহায়ত্বের উপর এক রাশ ক্রোধ প্রকাশ করলো চোখ মুখ খিঁচে রেখে। অয়নের তাতে কিছুই যায় আসে না। সে তো তার মতোই হেটে চলেছে। গন্তব্য যেকোনো একটি হাসপাতাল৷ প্রাপ্তির মাথাটা ঠিক অয়নের বুকের কাছে। হৃদস্পন্দন খুব স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে লোকটির। এই প্রথম কারোর হৃদস্পন্দন এতো নিখুঁতভাবে শুনছে সে। কোনো এক অজানা কারণে ব্যাপারটি মন্দ লাগছে প্রাপ্তির, হয়তো এই অনুভূতিটি নতুন বলে কিংবা অন্য কোনো অজানা কারণ। কারণটা জানতে চাইছে না প্রাপ্তি। কিছু কিছু কারণ অজানা থাকাটাই হয়তো ভালো____________________
হাসপাতালের বেডে বসে রয়েছে প্রাপ্তি। অয়ন পাশের চেয়ারে বসে মোবাইল টিপে যাচ্ছে। প্রাপ্তির পায়ে ড্রেসিং করে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, এক সপ্তাহ পানির সংস্পর্শে না আসতে। হাটা চলা কম করতে। অবশ্য এখন ব্যাথার অনুভূতি হচ্ছে বেশ, তীব্র একটি ব্যাথা। জ্বলন সহ ব্যাথা, এই ব্যাথাকে বাংলা ভাষায় কি বলে তা প্রাপ্তির জানা নেই। আপাতত মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে তা হল, বাসায় যাবে নাকি হোস্টেলে? খালু যদি জানে এমন একটা কান্ড ঘটিয়েছে তাহলে তার আর রক্ষে হবে না।
– আমি রাইসাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি। তাই চিন্তা করো না। আন্টি আসছেন তোমাকে নিয়ে যাবেন।
অয়নের নির্বিকার ভঙ্গিমাতে বলা কথাটায় চিন্তার সাগর থেকে বের হয় প্রাপ্তি। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– খালা আসছে?
– হু!
– রাইসা আপুকে বলার দরকার ছিলো না। খামাখা চিন্তা করবে। এমনেই আবরার ভাই অসুস্থ।
– আন্টির নাম্বার তো আমার কাছে ছিলো না। তাই ওকে বলাটাই ব্যাটার মনে হয়েছে। আর এমনিও তোমার রেস্টের প্রয়োজন
মোবাইল থেকে চোখ না উঠিয়েই অয়ন বললো কথাটা। প্রাপ্তি কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো। মনটা খচখচ করছে। লোকটাকে কতটা বাজে পরিস্থিতিতে ফেলিয়ে দিলো সে। আসলে তখন অবাক চোখে রবিনের স্টুডিও দেখতে দেখতে কখন যে লাইটটার সাথে ধাক্কা খেয়ে গেলো বুঝতে পারে নি৷ শুধু তাই নয়, লাইটটাকে অনেক ক্ষণ যাবৎ ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টাও সে করেছিলো। কিন্তু লাভ হয় নি। লাইটটা নিয়েই পড়ে গেলো। প্রথমে লাইট ভাঙ্গার খরচা তারপর পায়ের চিকিৎসার খরচা। অয়ন নামক মানুষটির উপর তার ঋণ যেনো বেড়েই চলেছে। আমতা আমতা করে বললো,
– সরি, আমি আপনার আজ অনেক ক্ষতি করে দিয়েছি।
– হুম বুঝলাম,
– আমি টাকা জমিয়ে আপনাকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিবো।
– রাইসা ঠিক বলেছিলো, তুমি খুব আত্মনির্ভর একটা মেয়ে। সবকিছু নিজে নিজে করতে চাও। কিন্তু মানুষ চাইলেও আত্মনির্ভর হতে পারে না। কেনো জানো? কারণ তারা মানুষ। তাদের সময়ে অসময়ে অন্যের উপর ভরসা করতে হয়, নির্ভর করতে হয়। এই নির্ভরশীলতার একটা গ্রাফ আছে। একটা পর্যায় অবধি এটা কারোর চোখে পড়ে না। কিন্তু সেই পর্যায়টা শেষ হয়ে গেলে সেটা সবার চক্ষুশূল হয়ে উঠে। তুমি চিন্তা করো না। সময় হলে ঠিক চেয়ে নিবো। আর বাসার কথাও ভেবো না, রাইসা আছে তো। সে একা হাতে সবকিছু সামলে নেয়। বাসাটাও ঠিক সামলে নিবে চিন্তা করো না।
অয়নের কথার মর্মার্থ বুঝতে কষ্ট হলো না প্রাপ্তির। অয়নের দিকে অবাক নয়নে সে তাকিয়ে রইলো। এতো কঠিন কঠিন কথা কি সুন্দর সরল ভাষায় বুঝিয়ে দিলো। হুট করেই মনের মাঝে একটি চিন্তা খচখচ করতে লাগলো। না চাইতেও প্রশ্নটি ছুড়ে দিলো,
– আপনি কি এখনো রাইসা আপুকে ভালোবাসেন?
প্রশ্নটি এতোটা কঠিন নয়। কিন্তু তবুও মুখে যেনো তালা লেগে গেলো অয়নের। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সে প্রাপ্তির দিকে। কি উত্তর দিবে সে!
মহীমা বেগমের রুমে বসে রয়েছে রাইসা। দাদীজানের সাথে তার বনিবনা বেশ চমৎকার। অবশ্য এ বাড়ির এমন কেউ নেই যাকে সে পছন্দ করে না। আবরার ব্যাতীত সে সবার সাথেই মিলেমিশে গেছে। মহীমা বেগমের বয়স হয়েছে, প্রায় ষাটোর্ধ বয়স তার। শরীরে নানাবিধ সমস্যা। কবে ঢাক পড়ে তার ঠিক নেই। তবুও মনে ক্ষীণ আশা আছে নাতীর ঘরের পোতা দেখার। বাঁচার এই ক্ষীণ আশার জন্যই সে এখনো বেঁচে রয়েছে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মহীমা বেগম বললেন,
– তোমার হাতের চাটা আমার খুব ভালো লাগ জানো?
– এইজন্যই তো আমি নিজের হাতে বানিয়ে এনেছি।
– শুনেছিলাম তোমার নাকি কলেজ শুরু হয়ে গেছে? তা যাচ্ছো না কেনো?
– আমি ছুটি টা এক্সটেন্ড করেছি দাদীজান। আসলে
– আবরার অসুস্থ বলে?
– হু
– আসলে ছেলেটাকে নিয়ে মাঝে মাঝে খুব চিন্তা হয় জানো। অয়নের একটা ব্যাপার আমার খুব ভালো লাগে, ও খুব শক্ত। যত কষ্ট হোক না কেনো সব কিছু হাসিমুখে আলিঙ্গন করে সে। তার মনের ভেতর কিছু লুকিয়ে রাখে না। রাগ হয়ে সেটা ঝেড়ে দিবে, কষ্ট হলে কেঁদে নিবে। কিন্তু আবরার আলাদা, কখনো ওর মনে কি রয়েছে এটা বুঝতে পারি না। যা ওকে বাহির থেকে দেখা যায় সে তেমন নয়৷ অনেক ভীতু, অনেক নরম। ওর সাফল্য অয়নের চেয়ে অনেক বেশি, হয়তো ওর সাফল্যের ছায়া অয়নকে মলিন করে দিয়েছে। কিন্তু অয়নের স্বভাব, ওর আত্মবিশ্বাস ওকে ঠিক একদিন উজ্জ্বল করে তুলবে। দুইজন ভাই হলেও আবরার খুব আলাদা, ওর কিছু স্বভাব ওকে ভেতর থেকে মলিন করে দিয়েছে। ওর সাফল্য টুকু বাদ দিয়ে যে আবরারটা সেটা অনেক অন্যরকম। অনেক ভীরু, অনেক কাবু।
মহীমা বেগমের কথাটা শুনে মনে মনে মলিন হাসি হাসে রাইসা। মহীমা বেগম নিজের নাতিকে এখনো চিনে উঠলেন না। কতোটা খারাপ সেই মানুষটা হতে পারে সেটা শুধু রাইসাই জানে। রাইসাকে চুপ করে থাকতে দেখলে মহীমা বেগম বলেন,
– একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি?
– জ্বী বলুন!
– তুমি আবরারকে ভালোবাসো না তাই না?
হুট করে মহীমা বেগমের এমন প্রশ্নে হতচকিত হয়ে যায় রাইসা। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। তখনই……
চলবে
[শবে বরাতের জন্য আজ রাতে গল্প দিবো না। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি