এক_ফালি_রোদ
৪র্থ_পর্ব
হল থেকে বেড়িয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালো সে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো সে। বুকের কষ্টগুলো নিকোটিনের ধোঁয়ায় উড়ানোটাই যথার্থ বলে মনে হলো তার। সিগারেটটা খাওয়া শেষ হলেই ফিল্টারের অংশটুকু ফেলে দিয়ে ভেতরে যাবার জন্য পা বাড়ালো সে। তখনই কানে এলো,
– এই যে শুনুন, এটা কি পাবলিক ডাস্টবিন?
কন্ঠটা কানে আসতেই ঘুরে তাকায় অয়ন। পেছনে ফিরতেই ভ্রু আপনা আপনি কুঞ্চিত হয়ে উঠে তার। সামনে থাকা মানুষটি আর কেউ নয়, সেদিনের ওভারব্রিজের ঝামেলাদায়ক মেয়েটি। তাকে এখানে দেখতে পাবার কোনো আশাই ছিলো না অয়নের। তবুও আজ তার সামনে আশ্চর্যজনকভাবেই উপস্থিত মেয়েটি। কিন্তু আজ একদম আলাদা লাগছে মেয়েটিকে। একটি নীল জামদানি পড়ে রয়েছে সে, চুলগুলো খোলা, চোখে গাঢ় করে কাজল দেওয়া, ঠোটে মিষ্টি কালারের লিপস্টিক। শাড়ি এবং ঢেউ খেলানো খোলা চুলে মেয়েটাকে দুদিনেই যেনো বড় বানিয়ে দিয়েছে। মাথা থেকে পা অবধি একবার চোখ বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে অয়ন বললো,
– আপনি এখানে?
– কেনো থাকতে পারি না বুঝি?
– না ঠিক তা নয়, তবে আপনি কি আমাকে ডাকলেন?
– আপনি বাদে কি এখানে আর কেউ আছে? হুম?
অয়ন আশেপাশে চোখ বুলালো, না কেউ নেই। শুধু সে এবং মেয়েটি ই দাঁড়িয়ে আছে। সে কিছু বলার আছেই মেয়েটি তার সদ্য ছিদ্র শাড়ির আঁচলটা দেখিয়ে ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বললেন,
– আমার সাথে আপনার কি শত্রুতা? সেদিন আপনার জীবন বাঁচানোর ঋণ এভাবে পূরণ করবেন? আমার শাড়ি পুড়িয়ে?
– আমি আপনার শাড়ি পুড়িয়েছি?
– না ঠিক আপনি পুড়ান নি এটা পুড়িয়েছে। কিন্তু এটা তো আপনার ই? বলি সিগারেট খাবেন খান না, কিন্তু এই উচ্ছিষ্ট ফিল্টারগুলো এখানে সেখানে ফেলার কি আছে? ভাবুন কোনো অঘটন ঘটে গেলে কি হতো?
সিগারেটের উচ্ছিষ্ট দেখিয়ে মেয়েটি কথাগুলো বললো। অয়নের বেশ অপবাদবোধ হচ্ছিলো। সে আসলেই খেয়াল করে নি, না দেখেই ছুড়ে মেরেছিলো জ্বলন্ত সিগারেটটা। মেয়েটার শাড়ির আঁচল সামান্য পুড়লেও পুড়েছে তো। অয়ন নম্রকন্ঠে বললো,
– সরি, খেয়াল করি নি।
– ইটস ওকে। নেক্সট টাইম খেয়াল রাখবেন। আমার জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো, ব্যাপারটা খারাপ হয়ে যেতো। তখন বেচারা বউ আর বরের অনুষ্ঠানটাই মাটি হয়ে যেত।
– আপনি কি এই অনুষ্ঠানে এসেছেন?
– কেনো আসতো পারি না বুঝি?
– না তা নয়! কার পক্ষ থেকে এসেছেন? বর নাকি বউ?
– কেনো বলুন তো? আমার কথায় বিশ্বাস হচ্ছে না নাকি?
– না আসলে এভাবে আমার বড় ভাইয়ের বৌভাত হচ্ছে, আর আপনি আমাদের পক্ষের নন। বিয়েতেও আপনাকে দেখি নি।
– আপনি কি সবার মুখ চিনে রেখেছেন?
– কেনো বলুন তো?
– এই যে বলে দিলেন বিয়েতে আপনাকে দেখি নি। তাই বললাম। আমি বউ এর পক্ষ থেকে এসেছি। আমার নাম প্রাপ্তি। বউ এর খালাতো বোন। বিশ্বাস না করলে যেয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন। অনাথ হতে পারি ভিখারী নই আমি। যতসব
বলেই মেয়েটি গটগট করে হেটে ভেতরে চলে গেলো। অয়ন এখন মেয়েটির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়েছে। সে এভাবে মেয়েটিকে বলতে চায় নি। কিন্তু তার বলার ধরণ মেয়েটিকে বেশ রাগিয়ে দিয়েছে৷ প্রাপ্তি নামটা অনেকবার শুনেছে রাইসার মুখে। প্রাপ্তি নামের একটি কাজিন সবসময় রাইসাদের বাসায় ই থাকতো। মেয়েটি অনাথ, দশ বছর বয়স থেকে রাইসাদের বাসায় ই মানুষ। রাইসা নিজের ছোট বোনের মতো তাকে ভালোবাসতো। প্রাপ্তি মেয়েটি এমন হবে এটা কল্পনা করে নি অয়ন। মেয়েটি রাইসা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। চেহারায় সামান্য মিল খুজে পাওয়া গেলেও স্বভাবে একেবারেই আলাদা। কি অদ্ভুত না! দুজন নারী ঠিক দুরকম চিন্তাধারা। অথচ একই বাড়িতে তারা মানুষ।
স্টেজে মলিন হাসি একে বসে রয়েছে রাইসা। একটু পর তার বাবা ইসমাইল সাহেব তার কাছে আসলেন। মেয়েটাকে এতো দুদিন পর আজ দেখছেন। বাবাকে দেখেই চোখের কোনায় নোনাজলের ভিড় জমতে লাগলো রাইসার। রাইসার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন,
– কেমন আছিস মা?
– ভালো বাবা, তুমি কেমন আছো?
– এইতো আছি। তোকে না দেখলে ভালো লাগে বল।
– বাবা, সব ঠিক আছে তো কোনো ঝামেলা হয় নি তো আর কেসে?
– না রে মা, জামাই সব সামলে নিয়েছে। একটা ফোনেই হয়ে গেছে। তোর এই ঋণ আমরা কখনো শোধ করতে পারবো নারে মা।
– বাবার জন্য মেয়ে কিছু করলে তা ঋণ হয় না বাবা। মা কোথায় দেখছি না যে
– তোর মা, শেফালী আপার সাথে কথা বলছে। তারা খুব ভালো মানুষ। বিশেষ করে নাসির সাহেব। জামাই ও হিরার টুকরা। সব সামলে দিয়েছে। এখন আর আমাকে জেলের ভাত খেতে হবে না।
ইসমাইল সাহেবের প্রশংসায় ছোট্ট করে “হুম” বলে রাইসা। আজ বাবার জন্য নিজের সর্বস্ব হারাতে হয়েছে রাইসাকে। ইসমাইল সাহেব পেশায় একজন ব্যাবসায়ী। কনস্ট্রাকশনের মোটামোটি ভালোই ব্যাবসা তার। কয়েক মাস আগের কথা, একটা ব্রীজের টেন্ডর পেয়েছিলেন তিনি। ব্রীজের কাজ ভালোই চলছিলো কিন্তু হুট করে অডিটের লোক আসে পরীক্ষার জন্য। অডিটের তৃতীয় দিনেই তারা কাগজপত্রের ভিত্তিতে ইসমাইল সাহেবের নামে টাকা আত্মসাৎ করার অপবাদ দেন। তাদের ভাষ্যমতে ইসমাইল সাহেব সরকারের টাকা হেরফের করে খারাপ মাল দিয়ে ব্রীজ বানাচ্ছেন। সরকারের সাথে এভাবে জালিয়াতি করার অপবাদে তার নামে পঁচিশ লক্ষ টাকার জরিমানা সহ তিন বছরের জেলের হুমকিও দেন তারা। অডিট অফিসারের এমন কথা শুনেই ইসমাইল সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি কখনোই অসদুপায়ে ব্যাবসা করেন নি। অথচ এই ষাট বছরে এসে এমন অপবাদ যেনো কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। এতোদিনের মান সম্মান এক নিমিষেই মিটে যাবে ভাবতেই যেনো মাথা শূন্য হয়ে পড়লেন ইসমাইল সাহেব। মধ্যবিত্ত মানুষের কাজে সম্মান যেনো তাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। সারাটা জীবন কষ্ট করার উদ্দেশ্যই থাকে সম্মান কামানো। সেই সম্মানটাও জলে মিশে যাবে এটা যেনো মানতেই পারছিলেন না তিনি। উপরন্তু তার বাসায় বিবাহযোগ্যা মেয়ে রয়েছে। এই বয়সে বাবা জেলে গেছে শুনলে কেউ মেয়েদের বিয়ে করতে চাইবেন না। এসব চিন্তায় বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বাবা হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে অথৈ সাগরে পড়ে যায় রাইসা। দিক বিদিক না পেয়ে অডিট অফিসারদের পা ধরতে থাকে। সেই সুবাদেই আবরারের সাথে তার পরিচয় হয়। পঞ্চম শ্রেণীর সরকারী অফিসার সে। সে যদি চায় তবে এই ঝামেলা থেকে খুব সহজেই বের করে আনতে পারে ইসমাইল সাহেবকে। রাইসা যখন তার কাছে সাহায্য চায়। তখন সে তার কাছে একটি প্রস্তাব রাখে।
– তুমি তোমার বাবার জন্য কি করতে পারবে?
– কি করতে পারবে মানে? আমি আপনার কথাটা ঠিক বুঝি নি।
– দেখো সবাই জানে সরকারী অফিসার কখনোই ঘুষ ছাড়া কিছু করে না। আমিও সে রকম। আমার নিজের পোস্টের জোরে আমি আপনার বাবার ফাইলটা অফ করে দিবো। এতে আমার কি লাভ?
– কি লাগব আপনার?
– বিয়ে করতে হবে
– জ্বী, জ্বী আমাকে বিয়ে করতে হবে। যদি রাজি থাকেন তবে আমি এটা খুব সহজেই করে দিবো।
– দেখুন আমি
– ভেবে দেখুন। সময় নিন। তবে এতোও নিবেন না যাতে আপনার বাবার ক্ষতি হয়।
আবরারের কথাটা তখন ঠিক আমলে নেয় নি রাইসা। কিন্তু এর দুদিন পর ই উকিল নোটিস আসে ইসমাইল সাহেবের বাসায়। উকিল নোটিস আসার পর আরোও অসুস্থ হয়ে পড়ে ইসমাইল সাহেব। বাবার সম্মান বাঁচাতে নিজের ভালোবাসার ত্যাগ তাকে করতে হয়। অয়নকে ফোন করে সে। নিজের অনুভূতিগুলোকে মাটি চাপা দিয়ে বলে,
– আমার পক্ষে এই সম্পর্কে থাকা সম্ভব নয়
– মানে টা কি?
– মানে টা স্পষ্ট। আমি তোমার সাথে আর কোনো সম্পর্কে থাকবো না
– আমার দোষ?
– দোষ তোমার নয়, আমার। তোমার পেশার সাথে আমি এডজাস্ট করতে পারবো না।
– যেটা দেড় বছর পর মনে হলো তোমার।
– অয়ন বাস্তবে আসো। ফেসবুকের সম্পর্ক আমাদের। ছয়মাস তো শুধু চ্যাট ই করেছি। না আমি তোমায় চিনতাম না তুমি আমাকে। ছয়মাস পর যখন দেখা করেছি সেখান থেকে আমাদের সম্পর্ক। তোমাকে ভালোবেসেছি তোমার স্বভাবের জন্য। তখন এতোকিছু ভাবি নি। এখন ভাবছি। কত কামাও তুমি? বলো? কোনো মাসে পনেরো হাজার, কোনো মাসে বিশ হাজার। তুমি ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার। এটা প্যাশন হিসেবে মানায়, প্রফেশন না। মানলাম দুজনেই চাকরি করবো। কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন অয়ন। আর আমার বাবা তোমাকে কখনো মেনে নিবে না। তাই আলাদা হয়ে যাওয়াটাই বেটার। দেড় বছরে কিছুই যায় আসে না
– তোমার আসে না, কিন্তু আমার আসে রাইসা। প্লিজ একবার ভাবো না। তুমি বললে আমি চাকরি করতেও রাজী। আফটার অল আই হ্যাভ মাই এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশনস।
– অয়ন, মরীচিকার পেছনে দৌড়ে কিছু হবে না। তুমি ভালো থাকো অন্তত। অনেক ভালো মেয়ে তুমি ডিজার্ভ করো।
– কিন্তু আমি তোমাকে চাই।
– রাখছি আমি অয়ন।
সেদিন অনেক কেঁদেছিলো অয়ন। কিন্তু রাইসার হাত বাধা ছিলো। এখন ঠিক তেমনই রয়েছে। বাবা-মাকে এই বয়সে কষ্ট পেতে দেখতে রাজী নয় সে। হলো না হয় ছলনাময়ী, হলো না হয় গোল্ড ডিগার। তাতে কি যায় আসে?
– তুমি সুখে আছিস তো মা?
ইসমাইল সাহেবের প্রশ্নে অতীতের কালো অধ্যায় থেকে বেরিয়ে আসে রাইসা। খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো তার, না বাবা ভালো নেই, দম আটকে আসছে তার, সে মুক্তি চায়। কিন্তু কেনো যেনো কিছুই বলতে পারলো না। কারণ বাবা জানলে কষ্ট পাবে। রাইসা কিছু বলতে যাবে তার আগেই…………………………..
চলবে
[ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, দেরি হয়ে যাবার জন্য। নেটের ঝামেলার জন্য পোস্ট করতে পারি নি। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না।]
মুশফিকা রহমান মৈথি