রঙ চা
পর্বঃ০৯,১০
লেখা – মাহফুজা_মনিরা
নিশুতিকে একদৃষ্টিতে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রায়াণ লজামাখা মুচকি হাসি দিলো। সেই হাসি যেন নিশুতির বুকে তোলপাড় শুরু করলো। নিশুতি বিরবির করে বললো,
——-এই হাসি যে কাউকে পাগল করে দিতে বাধ্য….বাধ্য…
প্রায়াণ শুনেও না শোনার ভান করলো। বিছানা ছেড়ে উঠে ডিভানের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
———সারাদিনে তো কিছু খাওনি। ক্ষিদে পায়নি??
সেই মুহুর্তেই নিশুতির মনে হলো তার পেট মোচড় দিয়ে উঠছে। নিশুতি পেটে হাত চেপে বললো,
———খুব পেয়েছে।
———কি খাবে??
———ঝাল ঝাল মুরগীর মাংস দিয়ে সাদা ভাত।
প্রায়াণ আবারো হাসলো নিশুতির কথা শুনে। নিশুতি মুগ্ধ হয়ে সে হাসি দেখলো। আচ্ছা ছেলেটা কি হাসির ডিব্বা! এত হাসে কেন?
——–তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবারের অর্ডার করে আসছি।
প্রায়াণ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নিশুতির তখন মনে পড়লো প্রায়াণ তো একটা চেক চেক নেভি ব্লু শার্ট পড়েছিল কাল রাতে। তাহলে এখন এই কালো টি-শার্ট পেলো কোথায়!!
কিছুক্ষণ বাদেই প্রায়াণ এলো। সাথে একজন রিসোর্ট বয়। তার হাতে ট্রে….ট্রে তে খাবার। সে এসে খুব আলগোছে ডিভানের উপর সব খাবার গুছিয়ে রেখে চলে গেলো।
নিশুতি ঝাপিয়ে পড়লো খাবারের উপর। কাল রাত থেকে পেটে একফোঁটা পানিও পড়ে নি তার।
নিশুতি একমনে গিলে যাচ্ছে আর প্রায়াণ তার দিকে চেয়ে আছে। নিশুতি বুঝতে পেরে লজ্জা পেলো। খাওয়া থামিয়ে মিহি কণ্ঠে বললো,
——–এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? লজ্জা করছে আমার।
প্রায়াণ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নিশুতির পাশ থেকে উঠে পড়লো। টি শার্টের গলা ঠিক করতে করতে বললো,
——–খেয়ে নাও। আমি একটু নিচে যাচ্ছি।
নিশুতি প্রায়াণের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো,
——–কোথায় যাচ্ছেন?
——–কফি নিয়ে আসতে।খাবে?
নিশুতি কিছু সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,
——–খাবো।
———ঠিক আছে। দুটো কফি নিয়ে আসি তাহলে।
নিশুতি মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানায়। প্রায়াণ বেরিয়ে যেতে নিলেই নিশুতি ডাকে,
——–শুনোন।
প্রায়াণ পেছন ঘুরে তাকায়।
——–কিছু বলবে??
——–আপনি এই জামা প্যান্ট কোথায় পেলেন??
প্রায়াণ স্মিত হেসে বলে,
——–দুপুরে তুমি ঘুমিয়ে ছিলা যখন বাহির থেকে রুম তালা মেরে বের হয়েছিলাম। পাশেই একটা ছোট্ট শপিংমল আছে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কিছু কিনে নিয়ে আসলাম।
নিশুতি বিষ্ময়ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে বললো,
——-আপনি আমাকে একা রেখে চলে গেছিলেন?
——-হ্যাঁ তো??
নিশুতি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
——-আপনি পারলেন একা ফেলে যেতে? যদি কিছু হয়ে যেতো আমার!
প্রায়াণ আমতাআমতা করে বলে,
——–আমি তো বাহির থেকে তালা মেরেই গেছিলাম! কে কি করবে তোমার??
নিশুতি প্রায় চেঁচিয়ে বললো,
——–আমি একা রুমে থাকতে পারিনা। ভয় করে আমার।
প্রায়াণ হেসে ফেললো। মেয়েটা যত সাহসী দেখায় নিজেকে তত আসলে না!
নিশুতি কটমট করে প্রায়াণের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রায়াণ কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলে,
——-ওকে বাবা আর যাবো না তোমাকে একলা ফেলে। এবার কফি আনতে যাবো কী??
নিশুতি মিনমিনে স্বরে বলে,
———তাড়াতাড়ি আসবেন।
——–আচ্ছা।
প্রায়ান বেরিয়ে যায়। নিশুতি ভাবতে থাকে সে তো একা থাকতে পারে না৷ তাহলে যদি প্রায়াণ না আসতো তখন কি করতো বা একা একরুমে থাকতোই বা কিভাবে!! নিশুতি মনে মনে ভাবে প্রায়াণ কি করে তার মনের খবর বুঝে যায় কে জানে! তবে ভালোই হয়েছে প্রায়াণ এসে। নয়তো সে হয়তো একদিনও লুকিয়ে থাকতে পারতো না সিলেট…
প্রায়াণ কফি হাতে এসে দেখে নিশুতির খাওয়া শেষ কিন্তু সে রুমে নেই। প্রায়াণ হালকা গলায় ডাকে,
——–নিশুতি…নি…
নিশুতি বারান্দা থেকে মুখ বের করে জবাব দেয়,
——-আমি বারান্দায়। কফি নিয়ে এখানেই আসুন।
প্রায়াণ দরজা লক করে বারান্দায় আসে। বারান্দায় দুটো বেতের সোফা পাতা মুখোমুখি। নিশুতি তার একটায় বসা। প্রায়াণ অন্য সোফায় বসে। নিশুতির হাতে কফি তুলে দেয়।
নিশুতি বারান্দা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে বলে,
——-দেখুন। কি সুন্দর প্রাকৃতিক চিত্র!
প্রায়াণ দায়সারাভাবে জবাব দেয়,
——–এর থেকেও বেশি সুন্দর অনেক জায়গা সিলেটের। সিলেট মানেই একটা সুন্দরের কারখানা। এখানের সব কিছু সুন্দর। এখানের পথঘাট, লোকালয়, মানুষজন, তাদের আচার ব্যবহার, তাদের লাইফস্টাইল,তাদের খাওয়া দাওয়া…সব….সবকিছুই সুন্দর।বেশি সুন্দর এদের থাকার এই প্রকৃতি।
নিশুতি মুগ্ধ দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে থেকে জবাব দেয়,
——-হুম। আসলেই…
তারপর দুজনেই চুপচাপ। থেমে থেমে কফিতে চুমুক দিচ্ছে দুজনেই।
হঠাৎ করে প্রায়াণের পকেটে থাকা ফোন বেজে উঠে। প্রায়াণ ফোন বের করে। একবার তাতে চোখ বুলিয়ে ফোন কেটে দেয়। তারপর আবার পকেটে ফোন ঢুকায়। নিশুতি আঁড়চোখে পুরো ব্যাপারটা খেয়াল করে।
কিন্তু এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করে না সে। পায়ের উপর পা তুলে শাহী ভঙ্গিতে কফিতে চুমুক দিয়ে বলে,
——-রিসিপশনে কি পরিচয় দিয়েছেন আমাদের??
প্রায়াণের কফি খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রশ্নের ভয় টাই পাচ্ছিল সে।
নিশুতি আবারো বলে,
——-কি হলো বলুন!
প্রায়াণ প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায়।
——-তেমন কিছুই না। আচ্ছা নিশুতি কতদিন এভাবে পালিয়ে বেড়াবা??
নিশুতি কাঠ গলায় বলে,
——কথা ঘুরাবেন না। উত্তর দিন।
প্রায়াণ মাথা নিচু করে দুর্বল গলায় বলে,
——আসলে ভাই বোন পরিচয় তো আর দিতে পারিনা! আর বিএফ জিএফ পরিচয়ও দেওয়া যেতো না। এতে খারাপ ভাবতো অনেকেই! তাই হাজবেন্ড ওয়াইফ…
——-স্বামী স্ত্রী পরিচয় দিয়েছেন আমাদের এইতো?
প্রায়াণ নিশুতির দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে জবাব দেয়,
——-হুম।
নিশুতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
——-ভালোই করেছেন। এই পরিচয় টাই ঠিক আছে।
প্রায়াণ অবাক হয় প্রচুর। কিন্তু প্রকাশ করে না। স্বাভাবিক হয়ে বলে,
——-কেন? এই কথা কেন বললে??
নিশুতি জিহ্বে কামড় কাটে। সে নিজেও জানে না এই কথা সে কেন বললো বা কেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো!
নিশুতি কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
——–আসলে জিএফ বললে মানুষ আমাকে খারাপ নজরে দেখতো। ভাবতো একটা মেয়ে কি করে জিএফ এর সাথে একরুমে একসাথে থাকছে! ব্যাপারটা কেমন না?? তাই এটাই ঠিক আছে। স্বামী স্ত্রী কে নিয়ে তো কেউ আর খারাপ কিছু ভাববে না।
প্রায়াণ স্বস্তি পায়। যাক নিশুতি তাহলে মাইন্ড করেনি। নিশুতি প্রায়াণের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসি দেয়।
আবারও প্রায়াণের ফোন বেজে উঠে। সাথে সাথে প্রায়াণের মুখেও বিরক্তি ভাব চলে আসে একটা। নিশুতির চোখে পড়ে তা। প্রায়াণ ফোন টা কেটে দিয়ে সাইলেন্ট করে দেয়।
নিশুতি বিষয় টা লক্ষ করে। খুব স্বাভাবিক গলায় বলে,
——–কে ফোন করছে বারবার? ধরছেন না যে!
প্রায়াণ কণ্ঠে রাগ নিয়েই বলে,
——-কেউ না বাদ দাও।
নিশুতি আর কথায় বাড়ায় না। যার যার পারসোনাল ম্যাটার থাকতেই পারে! সেটাকে বেশি খোঁচাখুঁচি করা উচিত না কারোরই।
নিশুতি আবার কফি খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
.
.
নাসির হোসেনের সামনে ঠান্ডা হয়ে বসে আছে আজহার হোসেন। নাসির হোসেনও শান্ত চোখে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে নিজের বড় ভাইকে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শান্ত গলাতেই বলে,
——-নিশু কই নাসির?
নাসির হোসেন সেই লেভেলের অবাক হওয়ার ভান করেন। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় বলেন,
——-নিশুতি কই মানি? ও বাসায় নেই?? আমার ভাতিজি কই???
তারপর শারমিন হোসেনের দিকে অগ্নি দৃষ্টি বর্ষণ করেন। শারমিন হোসেন ভয়ার্ত গলায় বলে,
——আমি কিছু করিনি। নিশুতিকে সকাল থেকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি এই ব্যাপারে কিছুই জানিনা।
নাসির হোসেন চটে যান। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলেন,
——-ভাবী তুমিই গায়েব করছো নিশুতিকে। আমি সিউর। বলো কই আছে আমার ভাতিজি!
শারমিন হোসেন ভয় পান। তিনি ছবিতে এমন বহুত কাহিনী দেখেছে যেখানে সৎ মেয়ের কিছু হলে পুলিশ এসে আগে ধরে সৎ মাকে।
শারমিন হোসেন এবার প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে বলেন,
——-বিশ্বাস করো ভাই। আমি কিছু করিনি। আমি কিছু জানিনা।
আজহার হোসেন উঠে দাড়ান৷ নাসির হোসেন কে উদ্দেশ্য করে বলে,
——তুইও জানিস না নিশু কই??
——আজব তো! আমি কিভাবে জানবো!
আর নিশুতি বাসা ছেড়ে পালাবেই বা কেন?? কিছু করছো তোমরা??
শারমিন হোসেন মুখ ফসকে বলতে নেয় নিশুতিকে বিয়ে দেওয়ার কথা। আজহার হোসেন চোখ রাঙানি দিয়ে উঠে। এই খবর নাসির জানলে কেয়ামত করে ছাড়বে। নিশুতি তার কলিজা…
আজহার হোসেন কিছু না বলে বেরিয়ে যান। শারমিন হোসেন ব্যাগ কাধে চাপিয়ে বলেন,
——–আমরা আরো ভেবেছিলাম নিশুতি তোমার কাছে এসেছে ভাই তাই তোমার কাছে আসছিলাম। এখন তো দেখছি তুমিই জানো না ওর খবর! আচ্ছা আজ যাই। ওর কোনো খবর পেলে জানাবো।
শারমিন হোসেন চলে যায়। পা কাঁপছে তার। নাসির হোসেন কে জমের থেকেও বেশি ভয় পায় সে।
তারা চলে যেতেই নাসির হোসেন ভেতরের ঘরে যান। ইফতির নাম্বারে ফোন করে।
——-হ্যালো কাকা।
——-ভাইয়েরা চলে গেছে। আমার উপর সন্দেহ করেনি।
——-আমার উপরেও করেনি। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে অন্য জায়গায়।
নাসির হোসেন কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে বলেন,
——–কী?
——–যদি আব্বু আম্মু পুলিশে মিসিং ফাইল করে তখন?
নাসির হোসেন মৃদু হাসেন।
——–নিশুতি চলে যাওয়ায় তাদের ভালোই হয়েছে।আমি চিনি আমার ভাই ভাবী কে। বুঝছো? দেখবা আজকেই তারা ভুলে যাবে যে নিশুতি নামের তাদের কেউ ছিল! তারা জীবনেও যাবে না থানায়।
ইফতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
——–না গেলেই ভালো কাকা।
——–হুম। নিশুর সাথে কথা হইছে?
———হ্যাঁ সকালে হইছিল। আর হয়নি। ভাবছি এখন কল করবো আবার।
———আচ্ছা। রাখছি তবে।
——–ওকে কাকা।
ইফতি ফোন রেখে দেয়। ফোনে টাকা নেই তার। নিচে যেয়ে টাকা ভরতে হবে। নিশুতিকে ফোন করতে হবে দ্রুতই। মেয়েটা কি অবস্থায় আছে কে জানে!!
.
.
.
নিশুতি তার ব্যাগ এর জামা কাপড় গুলো ভাঁজ করছিল। প্রায়াণ বারান্দায় বসা।
হঠাৎ একটা রিনরিনে আওয়াজ তার কানে ভেসে উঠে।
——-ব্যস্ত ছিলাম তাই ফোন ধরিনি।
——–হুম আমি বরিশাল আছি। স্পোর্টস টিমের সাথে এসেছি। ম্যাচ আছে এখানে। খেলা শেষে চলে আসবো।
——–তুমিও নিজের খেয়াল রেখো। রাখছি বায়।
প্রায়াণ কথা বলছিল কারো সাথে ফোনে। নিশুতি কান পেতে সব শুনে ফেলে। এরপর আবার বিছানার উপর গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে সে৷ কার সাথে কথা বললো প্রায়ান! আর কেইবা এত ফোন করে প্রায়াণ কে! গার্লফ্রেন্ড??
নিশুতির বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠে। হুট করেই চোখ ভাঙা কান্না পায় তার। নিশুতি নিজেও বুঝতে পারছে না কেন প্রায়াণের গার্লফ্রেন্ড থাকবে শুনে তার এত খারাপ লাগছে! তাহলে কি প্রায়াণের জন্য তার মনেও কোনো সফট কর্ণার আছে? আচ্ছা,প্রায়াণ তো বলেছিল সে নিশুতিকে ভালোবাসে। তাহলে আবার গার্লফ্রেন্ড আসলো কোত্থেকে!! একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়না নিশুতি। প্রায়াণ বারান্দা থেকে রুমে আসে। নিশুতিকে থম মেরে বসে থাকতে দেখে আৎকে উঠে সে।
——-এই নিশুতি। নিশু….
নিশুতির গায়ে হাত রাখতেই নিশুতি নেতিয়ে পড়ে বিছানায়। প্রায়াণের সারা শরীর কেঁপে উঠে। মেয়েটা হুট করে এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলো!!!
.
.
রাত ১০ টা। নিশুতি গভীর ঘুমে। জ্ঞান ফিরে এসেছে অনেক আগেই কিন্তু এখন ঘুমে আছে। প্রায়াণ তার মাথার কাছে বসে আছে। খানিক বাদে বাদে নিশুতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।
হঠাৎ একটা শব্দ ভেসে আসে প্রায়াণের কানে। প্রায়াণ শব্দের উৎস খুঁজে পায় নিশুতির ব্যাগের ছোট পকেট টায়।
প্রায়াণ চেইন খুলতেই দেখে একটা ছোট বাটন ফোন। কেউ ফোন করছে…
আননোন নাম্বার!
প্রায়াণ সাত-পাঁচ না ভেবে কল রিসিভ করে।
——–হ্যালো।
ছেলে কণ্ঠ শুনে ইফতি খট করে ফোন রেখে দেয়। মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে তার। নিশুতির ফোন কে ধরলো এটা! কে আছে নিশুতির সাথে….নিশুতি কোনো বিপদে নেই তো!!
চলবে…..
রঙ চা
পর্বঃ১০
লেখা – মাহফুজা_মনিরা
জালাল শেখের চিল্লাফাল্লা তে মিনু শেখ হাত মুছতে মুছতে বেডরুমে আসেন।
——-কি সমস্যা তোমার? কি হইছে? চিল্লাও ক্যান??
——-তোমার আদরের ছোট ছেলে কই? দুই রাত বাসায় নেই সে!! আমি সারাদিন বাহিরে থাকি থেকে খেয়াল করতে পারিনা। আজ পিউ না বললে তো জানতামই না।
মিনু শেখ গরম চোখে পিউর দিকে তাকান। পিউ কাচুমাচু হয়ে বলে,
——–আব্বুই বলছিল প্রায়াণ ভাইকে ডাকতে। তখন আমি বলে দিয়েছি তার বাসায় না আসার কথা।
মিনু শেখ দাঁতে দাঁত ঘষেন। পারলে পিউকে চিবিয়ে খান এখনি! উটকো ঝামেলায় ফেলে দেয় মেয়েটা খালি।
মিনু শেখ বেশ শান্ত গলাতেই বলেন,
——-প্রায়াণ বরিশাল গেছে। ওর স্পোর্টস টিম এর সাথে। কি নাকি খেলা আছে শুনলাম!
——-কই এই ব্যাপারে তো আমাদের কিছু বললো না।
——-আমাকে তো বলে গেছে নাকি?? এত চিল্লাচ্ছো কেন তাহলে? বাচ্চা না ও।
জালাল শেখ রাগে গজগজ করতে করতে বিছানার উপর বসে টিভি ছাড়েন। মায়ের জন্য ছেলেদের ব্যাপারে কিছু বলাই যায় না!! এহ! আহ্লাদ!
প্রেমা দরজার দোরে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনতে পায়৷ তার মন বলছে প্রায়াণ ভাই বরিশাল নেই। সে অন্য কোথাও আছে। কিন্তু কোথায়!?
.
.
ফোনের শব্দে নিশুতির ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙতেই সে তার জীবনের দ্বিতীয় ধাক্কা টা খায়। প্রায়াণ তাকে ঝাপ্টে ধরে ঘুমোচ্ছে!!!
নিশুতি চিবুকের উপর হাত,নিশুতির গায়ের উপর এক পা আর প্রায়াণের মাথা টা মিশুতির গলার কাছাকাছি..!!
ছিঃ!
নিশুতির গা গুলিয়ে উঠে। থরথর করে কাপতে থাকে সে। আচ্ছা গভীর কিছু হয়ে যায়নি তো..!
নিশুতির ফোনের রিং পড়ে কেটে যায়। আবার রিং বেজে উঠে৷ ফোন টা ধরা উচিত। নিশুতি নড়ে উঠে। প্রায়াণ তাকে যেভাবে লেপ্টে রেখেছে নিজের সাথে এতে তার সাধ্য নেই উঠার।
নিশুতি রিনরিনে কণ্ঠে প্রায়াণ কে ডাকে,
——–এই যে শুনছেন….!
নিশুতি নড়াচড়া বাড়িয়ে দেয়। প্রায়াণের ঘুম ছুটে যায়। পিটপিট করে চোখ মেলতেই সে নিজেকে নিশুতির এত কাছাকাছি আবিষ্কার করে। প্রায়াণ লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। নিশুতিও উঠে গায়ের ওড়না সামলায়। প্রায়াণের দিকে তাকাতে ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে সে। তারপর এক দৌড়ে বারান্দায় চলে যায়।
———-হ্যালো ইফতি।
ইফতি ওপাশ থেকে রাগ চাপানো গলায় বলে,
———-তুই আমার থেকে কিছু লুকোচ্ছিস বোন??
নিশুতি হকচকিয়ে যায়। এমন প্রশ্ন কেন করলো ইফতি! সে কি প্রায়াণের ব্যাপারে জেনে গেছে সব?? এখন কি তারও উচিত ইফতিকে সবটা বলে দেওয়া??
———কি হলো কথা বলছিস না কেনো??
ইফতির ধমকে নিশুতি বাস্তবে ফিরে। নিজেও গলায় হালকা রাগ এনে বলে,
———-আমি তোর থেকে বড় ইফতি!!
ইফতি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে,
———-সরি।
———-হুম।
অনেকটা শান্ত গলায় বলে,
———আমার থেকে কিছু লুকোচ্ছিস আপু??
নিশুতি অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
———কেন বলতো?
ইফতি কথা না পেঁচিয়ে সোজাসুজি বলে,
———কালকে রাতে আমি তোকে কল দিয়েছিলাম। একটা ছেলে ধরেছিল। ছেলেটা কে? কে আছে তোর সাথে??
নিশুতি নির্বাক হয়ে পড়ে। ইফতি যদি নিশুতিকে ভুল বুঝে!!
নিশুতি চাপা গলায় বললো,
———বলবো কিন্তু আগে প্রমিস কর যে তুই আমাকে একদম ভুল বুঝবি না।
ওপাশ থেকে ইফতি বলে,
———আচ্ছা বল।
নিশুতি একটা লম্বা দম ফেলে বলতে শুরু করে,
———সেদিন রাতে যখন আমি পালাচ্ছিলাম,প্রায়াণ ভাইয়ার সামনে পরে যাই। সে আমার থেকে সবটা শুনে। আর আমি যে পালাচ্ছি সেটাও…এরপর ভাইয়া আমাকে একা কিছুতেই ছাড়তে রাজী হচ্ছিল না। বলছিল তুমি একা একটা মেয়ে,সিলেট যাবা। অচেনা অজানা জায়গা। যদি কোনো বিপদ ঘটে। তাই….
ইফতি আগ্রহী সুরে বলে,
———–তাই??
———–তাই প্রায়াণ ভাইয়া আমার সাথে আসছে। বর্তমানে সে আমার সাথেই আছে। আর যতদিন আমি পালিয়ে থাকবো ততদিন সেও আমার সাথে সাথে থাকবে। এটাও বলছে।
ইফতির মাথায় বাজ পড়ে যেন!! যার জন্য এত কিছু সেই কিনা এখনো নিশুতির সাথে…!!!
ইফতি অনেকটা চেঁচিয়ে বললো,
——–মাথার তার মার সব ঠিক আছে তো তোর? নাকি ছিড়ে গেছে?? তুই জানিস না তাকে নিয়েই এত সমস্যা হলো আর সেই তাকে নিয়েই তুই কীনা!! জানাজানি হয়ে গেলে কি হবে ভাবছিস একবারো?
নিশুতি চুপ করে থাকে।
ইফতিও চুপ । সে কি বলে নিশুতিকে বকবে বুঝতে পারছে না।
নিশুতি দুর্বল গলায় বলে
——-আমি নিজেও জানিনা আমি কেন তার সাথে আসছি। হয়তো একা একা সাহস হচ্ছিল না তাই…!
ইফতি রাগী গলায় বলে,
——–সাহস না হলে আমাদের বলতি। আমি অন্য কোনো ব্যবস্থা করতাম কাকার সাথে কথা বলে। তাই বলে…..! নিশুতি তুই কত বড় একটা ভুল করছিস।বুঝতেছিস??
——–শোন বেশি চিল্লাবি না। এত ঝামেলা আমার সহ্য হয়না!! আমি উনাকে দুদিন বাদে পাঠিয়ে দিবো বুঝিয়ে সুজিয়ে। কেউ জানবে না কিছু৷ তুই ও কাউকে কিছু বলবি না। কাকাকেও না।
ইফতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
——–তোর যেটা ভালো লাগে তুই সেটাই কর। আমি এই বিষয়ে কিছু জানিনা। রাখছি।
ইফতি ফোনের লাইন কেটে দেয়৷ নিশুতির বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এত কষ্ট! এত যন্ত্রণা…!
এরকম জীবন কেন হয় মানুষের..!
নিশুতিকে বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রায়াণ তার পিছে গিয়ে দাঁড়ায়।
নরম গলায় বলে,
——-নিশু।
সেই ডাকে এত আবেগ…এত টান…
নিশুতি মুহুর্তেই সমস্ত কষ্ট ভুলে শিউরে উঠে। ধরা গলায় বলে,
——-হু।
——–আমার দিকে ফিরো। কি হয়েছে তোমার?? আসলে রাতে তুমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলা। পরে আমি তোমার মাথার কাছেই বসেছিলাম সারাক্ষণ। কখন যে ওভাবে তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছি আমি নিজেও জানিনা।
প্রায়াণ মাথা নিচু করে বলে,
——–আ’ম সরি।
নিশুতি প্রায়াণের দিকে ফিরে তাকায় না। সে চায় না তার চোখে জমা নোনা পানি প্রায়াণ দেখুক। বারান্দার গ্রিল দিয়ে বাহির পানে মুখ করেই বলে,
——-ইটস ওকে। আমি জানি আপনি কিছু করেন নি ইচ্ছাকৃতভাবে৷ জানেন,আমি আমার জীবনে শুধু বিশ্বাস করেছিলাম আমার আম্মু কে৷ সে আমার বিশ্বাস এর মর্যাদা সবসময় রাখছে। দ্বিতীয় বিশ্বাস করি আপনাকে। আপনিও আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন আশা করি।
প্রায়াণ কিছুটা স্বস্তি পায়। নিশুতি তাকে ভুল বুঝেনি এই তো ঢের!
প্রায়াণ হালকা কেশে স্নিগ্ধ গলায় বলে,
——-আই উইল নেভার ব্রেক ইউর ট্রাস্ট। আই প্রমিস।
নিশুতি ছোট্ট করে জবাব দেয়,
——-হুম।
তারপর দুজনেই চুপচাপ। নিশুতি বাহির দেখছে আর প্রায়াণ নিশুতির পেছনের দিকটা৷ মেয়েটার ঘাড়ে একটা ছোট কালো তিল আছে। ঈশ! কি সুন্দর দেখাচ্ছে…!
প্রায়াণের ঘোর কাটে কারো চাপা কান্নার শব্দে। নিশুতি থেমে থেমে কেঁপে উঠছে। নিশুতি কি কাঁদছে…?
প্রায়াণ এর হৃদযন্ত্র টা ধক করে উঠে। সে একটানে নিশুতিকে নিজের দিকে ঘোরায় এবং প্রায় আচমকাই নিশুতি প্রায়াণ কে খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরে কেঁদে উঠে। প্রায়াণ ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল।
নিশুতি প্রায়াণের বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদছে। প্রায়াণ কোনো প্রশ্ন করে না৷ হয়তো মেয়েটার মনের গভীরে কোনো ক্ষত আবার মাথা নেড়ে উঠেছে! কাদুক না মেয়েটা। কেঁদে যদি শান্তি পায়,নিজেকে হালকা মনে করে তবে তাই বেশ…
প্রায়াণ আলগোছে নিশুতিকে জরিয়ে ধরে।
অনেকক্ষণ কাঁদে নিশুতি।
অ….নে…..ক…. ক্ষ….ন
তারপর নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় প্রায়াণের বুক থেকে। প্রায়াণ ও ছেড়ে দেয় নিশুতিকে।
নিশুতি চোখ মুছে ভেতরের ঘরে পা বাড়ায়। আজ তার ভীষণ মনে পড়ছে নিজের মাকে… কেন কে জানে!
.
.
প্রায় প্রতিদিনই একটা মেয়ে নদীর পাড়ে এসে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রকৃতি অনুভব করে নাকি কোনো কিছু নিয়ে ভাবে শান তা জানে না।
তবে আজ মেয়েটা একটু বেশিই অন্যমনস্ক। চোখের নিচে হালকা কালির আভাস, মুখটা বিবর্ণ।
শান ধিমি পায়ে মেয়েটার দিকে আগায়। মেয়েটার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে,
——–আজকে প্রকৃতি একটু বেশিই উদাসীন। তাইনা??
মেয়েটা প্রথমে জবাব দেয় না। খানিক পরে জবাব দেয়,
——-হয়তো!
শান এতদিন পুরোপুরি মেয়েটাকে দেখতে পারেনি। দূর থেকেই দেখে এসেছে। আজ একদম কাছাকাছি থেকে দেখতে পেয়ে তার চোখজোড়া থমকে যায়। কী ভীষণ মিষ্টি মায়াবী মুখ খানা!!
শান মেয়েটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
——-আ’ম শান চৌধুরী। এন্ড ইউ?
মেয়েটা হাত বাড়ায় না। উদাসী ভাবেই বলে,
——আমি নম্রতা৷ মিস নুসাইবা নম্রতা।
শান হাত সরিয়ে নেয় দ্রুতই। আননোন একটা মানুষের সাথে কেনই বা হাত মেলাবে একটা মেয়ে!! শান নিজেই নিজেকে গালি দেয়। বেকুব গাধা কোথাকার!!
শান একটু দূরে সরে দাঁড়ায় মেয়েটার থেকে। মেয়েটার চোখে ক্লান্ত,মুখে রিক্ততা। কি হয়েছে মেয়েটার..!
———আপনাকে প্রায় প্রতিদিন এখানে আসতে দেখি মিস!
———হুম আসি। অফিস শেষ করে এখানেই আসি। ভালো লাগে। চুপচাপ ঠান্ডা প্রকৃতি!
শান মাথা ঝাকায়।
——–হুম। তাই তো আমিও আসি। শহরের ব্যস্ত জীবনে এরকম ঠান্ডা প্রকৃতি মনে রিফ্রেশমেন্ট এনে দেয় একচুয়ালি।
নম্রতা মাথা কাত করে সম্মতি জানায় শান’য়ের কথার সাথে।
শান চুপ।
নম্রতাও চুপ।
নিরবতা ভাঙে শান ই..
——-আজকে অন্যদিনের থেকে একটু বেশিই উদাসী আপনি। জানতে পারি কেনো?
নম্রতার কেন জানি হুট করে শান কে খুব আপন মনে হয়। তার মনে জমে যাওয়া পাথর গলানো যে খুব দরকার। নয়তো… একজীবনে বেঁচে থাকাই যে বৃথা!
নম্রতা নদীর ছলছল স্রোতের দিকে তাকিয়ে বলে,
———একজন কে ভীষণ ভালোবাসি। তার সাথে আমার বিয়েও ঠিক হয়ে আছে। কিন্তু সে,আমাকে হয়তো ভালোই বাসে না!!
শান কপাল কুঁচকায়। এত সুন্দর মিষ্টি একটা মেয়েকে কোন গাধা ভালো না বেসে থাকতে পারে!!
শান ফট করে বলে,
——-কে সেই গবেট যে এত মিষ্টি কাউকে ভালোবাসে না??
নম্রতা মৃদু হাসে শানের কথা শুনে। শান সেই হাসির দিকেও অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সে তো জানতো এরকম হাসি শুধু উপন্যাসের নায়িকাদের হয়। বাস্তবেও হয়! শান আজ না দেখলে সত্যিই জানতো না।
নম্রতা মৃদু হাসি মুখেই বলে,
——–গবেট টার নাম প্রায়াণ। একই ভার্সিটির স্টুডেন্ট আমরা।
চলবে…..