শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা অন্তিম_পর্ব

শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
অন্তিম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

আজ নীলয় ভেতর থেকে চূর্নবিচূর্ণ। শান্ত উঠে যেতে নিলে নীলয় বলে উঠে,
“ওই লোকটা এখন কোথায়?”
“আইসিউ তে, তোর কি মনে হয় আমি ওই হারামীকে ছেড়ে দিবো? আর শুনবি না ওকে নবনীতার পিছু নিতে কে বলেছিলো?”
“কে??”
“নীতি, মানে তোর নিজের বড় বোন।“

শান্তের কথাটা শুনে থমকে যায় নীলয়। একজন মেয়ে কিভাবে আরেকজন মেয়ের ক্ষতি করতে পারে? এটাও কি সম্ভব? নীলয়ের হতভম্ব চেহারাটা দেখে হেসে উঠে শান্ত। তারপর তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,
“আমিও অবাক হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম নিজের বোন এতোটা নিচে কি করে নামবে? যখন ওর কাছে কারণ জিজ্ঞেস করেছি তখন আরো ও বেশি অবাক হয়েছি। নীতি ভাবতো নবনীতা তোকে চিট করছে, সে তোকে এক কথায় মুরগী বানাচ্ছে। আমার সাথে নবনীতার বিয়ের কথা হয়েছিলো, এটা কেউ না জানলেও নীতি জানতে পারে সায়মা ভাবীর কাছ থেকে। তারপর থেকেই তার নবনীতার উপর সন্দেহ হয়। নবনীতা আর আমাকে কথাও বলতে দেখে সে। সে ভেবেছে নবনীতা হয়তো টু টাইমিং করছে, দুজনকে ঝুলাচ্ছে, এই সন্দেহ এর কারণ আমার লিজিট মনে হয় নি। পরে জানতে পারলাম, সে মূলত তোর সাথে নবনীতার বিয়েতে হ্যাপি ছিলো না, নীতির ননদ সুহানার সাথে তোর বিয়ের কথা বার্তা এখন চলছে। এটাই কারণ ছিলো মূলত। তবে এটা ঠিক নীতি কখনোই চায় নি নবনীতার কোনো ক্ষতি হোক, সে শুধু কিছু ফেক ছবি তুলাতে চেয়েছিলো। নবনীতা কার সাথে কথা বলে, তোর ব্যাতীত নবনীতার কোনো পুরুষ বন্ধু ছিলো কি না? এসব! টিপিক্যাল স্টার জলসা প্লট।“

শান্তের কথাগুলো নীলয় চুপ করে শুনছে। তার ঠোঁটে যেনো কুলুপ এটেছে। নিচের বোনের উপর রাগ হচ্ছে। ঘরের শত্রু বিভীষণ শব্দটা নীতির জন্যই যেনো প্রযোজ্য, তবে নীতিকে দোষ দিয়ে কি হবে! তার তো কম দোষ নেই। সে কি করে পারলো নিজের নীতুকে ভউল বুঝতে। সেদিনের নীতুর ক্রন্দনরত মুখখানা এখনো চোখে ভাসে, সেই সন্ধ্যায় কর্দমাক্ত লাল বেনারসিতে এসেছিলো মেয়েটি। এক রাশ আশা নিয়ে, তার নীলয় তাকে ফিরিয়ে দিবে না। যতই কিছু হয়ে যাক, তার নীলয় তার হাত ছাড়বে না। অথচ নীলয় ক্রুর ভাবে চূর্ণ বিচূর্ন করে দিয়েছিলো নবনীতাকে। তার আশাহত কাতর চাহনী এখনো মনে আছে নীলয়ের। নিজের কর্মে নিজের পস্তাচ্ছে সে। শান্ত উঠে দাঁড়ালো। হিনহিনে স্বরে বললো,
“নীতির শাস্তি আমি ওকে দিয়েছি। সবসময় মেরে, অত্যাচার করে কিংবা টাকা পয়সা দিয়ে আঘাত করলেই শাস্তি হয় না। মাঝে মাঝে মানুষের দুর্বল জায়গায় আঘাত করলেও শাস্তি দেওয়া যায়। আমি সেটাই দিয়েছি। আর একটা কথা, নবনীতা এখন আর তোর নিতু নয়। ও আমার শ্যামলী। সুতরাং ওর দিকে নজর দেবার ভুলটা করিস না। আমি কতোটা ক্রুর হতে পারি সেটা তোকে বুঝিয়ে বলার দরকার হয় নেই। আসছি। ভালো থাকিস”

বলেই ক্লাব থেকে বেড়িয়ে গেলো শান্ত। গাড়ি স্টার্ট দেয় সে। নীলয়ের মতো ভীতু পুরুষের অনুশোচনার সাক্ষী হতে চায় না সে। মা একবার বলেছিলো,
“কারোর অনুশোচনার সাক্ষী হতে নেই, তাহলে তার প্রতি দয়া জন্মায়।“

নীলয়ের প্রতি দয়াশীল হতে চায় না শান্ত। লাল নীল শহরের পিচের রাস্তা চিরে এগিয়ে যাচ্ছে শান্তের গাড়ি, এই দশ-বারো দিনে ঘতে যাওয়া সকল ঘটনাগুলো এক এক করে তার চোখের সামনে ভাসছে। প্রতিটা মানুষের ভেতরেই একটা পশু লুকিয়ে থাকে, মাঝে মাঝে সেই পশুটা বেড়িয়ে আসে। শান্তের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিলো। সে কোনো গুন্ডা নয়, কোনো ক্ষমতাশালী পুরুষ নয় যার টাকার কাছে সবাই নত। তবে সে একজন স্বামী, যতই ভদ্র মুখোশ পড়ে থাকুক না কেনো নিজের স্ত্রীর অবমাননা সে সইতে পারে নি। তাই তো শাকিল আজ আইসিউ তে। শাকিল নীতির বাসার অপজিটে মুদির দোকানে চাকরি করে, দোকানের বেতনের পাশাপাশি যদি কিছু আলগা ইনকাম হয় তবে ক্ষতি কি? তাই শাকিল নীতির প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। তার কাজ ছিলো নবনীতার দিকে নজর রাখা। কিন্তু ওই যে কথায় আছে,
“”মানুষ এবং অমানুষের পার্থক্য হলো তার বিবেক। বিবেক যখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়, তখন ই মানুষের খোলস ভেদ করে পশু বেড়িয়ে আসে।”

শাকিলের ভেতরের পশুটিও বেড়িয়ে আসে। সে ভাবে কেননা এই উছিলায় একটা কিশোরীকে ভোগ করা যাক। এর আগেও সে এরুপ কাজ দু একবার করেছে। তার গ্রামের কিশোরী নিজের বাসার সম্মান রক্ষার্থে সবটুকু চেঁপে গিয়েছিলো। আর শাকিল মারের ভয়ে শহরে এসে পড়েছিলো। নতুন শহরে এলেও পশু প্রবৃত্তি তার শুধরায় নি। তাই হাত বাড়িয়েছিলো নবনীতার দিকে।

সেদিন নবনীতা ধস্তাধস্তিতে তাকে ফেলে দেয় নি, বরং ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছিলো। সে চেয়েছিলো শাকিল যেনো মরে যাক। সে কয়েকবার শাকিলের উপর আক্রমণ ও করেছিলো। এই ঘটনা শান্তের অজানা থাকতো যদি না সে শাকিলকে আবিদের মাধ্যমে কিডন্যাপ করতো। শান্ত শাকিলের থেকে সত্য বের করতে তাকে অনেক টর্চার করে, তার হাত ভেঙ্গে দেয়, চোখে এতো আঘাত করে যেনো শাকিল কখনোই চোখে স্পষ্ট না দেখে। তখন শাকিল আর্ত্নাদ করে বলেছিলো,
“আপনের বউ একটা পাগল। ঐ পাগলরে নিয়ে আমি কি করাম?”

নবনীতার এই ব্যাতিক্রম স্বভাবের অস্তিত্ব সাজেকেও পেয়েছিলো শান্ত, যখন নবনীতা শ্রাবণের উপর আক্রমণ করেছিলো। শ্রাবণ সেখানে নিজের পরিচয় না দিলেও শ্রাবণ মূল পেশা সে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। নবনীতার আচারণ তার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিলো। সেকারণেই সে শান্তকে এতোগুলো কথা বলেছিলো নবনীতা বিষয়ক। নবনীতা এক ধরনের মানসিক রোগ। তার রোগটাকে বলা হয়, agoraphobia। নবনীতা নিজেকে শক্ত দেখালেও সে একজন ভীত মানুষ। সে ভয় পায় তার আশেপাশের মানুষকে, কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। এটার সূচনা হয় তার ছোট বেলার একটা ঘটনায়। শান্ত তার মানসিক রোগের কারণ খুজতে যখন সেলিম সাহেব এবং শারমিন বেগমকে নবনীতার কথা জিজ্ঞেস করে তখন তার ছোট বেলার ঘটনাটা বলে। যখন নবনীতা অনেক ছোট, মাত্র পাঁচ বছর বয়স তখন একটা পশুর লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিলো তার উপর। পশুটি তার কেউ না বরং সেলিম সাহেবের এক কলিগ ইমরান।

ইমরান তখন প্রায় ই নবনীতাদের বাসায় আসতো। ছোট্ট নবনীতা তখন আংকেল আংকেল বলে ইমরানের কাছে যেতো। ইমরান তাকে খুব আদর করতো বলে তার সাথে ইমরানের সম্পর্কটাও খুব ভালো ছিলো। সেলিম সাহেব ও কখনো ইমরানের উপর সন্দেহ করতো না। এক বৃষ্টিস্নাত রাতে ইমরান এসেছিলো নবনীতাদের বাসায়। অন্যদিনের মতো সেদিনো সে নবনীতার সাথে খুব খেলছিলো। শারমিন বেগম মেয়েকে ইমরানের কাছে রেখে রান্নাঘরে গিয়েছিলো, ইমরান সেই ফাঁকে নবনীতাকে খুবলে খেতে চেয়েছিলো। তার গোপন অঙ্গে স্পর্শ করেছিলো। নবনীতা ব্যাথাও পাচ্ছিলো, কাদো কাদো স্বরে বলছিলো,
“আংকেল আমার ব্যাথা লাগছে।“

এই ঘটনাটা নবনীতার জীবনে একটা কালরাত ছিলো। পিতৃতূল্য মানুষের পাশবিক রুপ সে নিতে পারে নি। সেদিন ঠিক সময়ে শারমিন বেগম তা এলে ইমরান হয়তো তার উদ্দেশ্যে সফল হতো। নিজের পশুত্ব নিয়ে ছিন্নভিন্ন করে নিতো একটা ফুল। পিষিয়ে ফেলতো একটা কোমল ছেলেবেলা। শারমিন বেগম সেদিন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলো ইমরানকে। সেলিম সাহেব চেয়েছিলেন মেয়ের হয়ে লড়তে, কিন্তু মধ্যবিত্ত নামক শব্দতে আটকে গিয়েছিলেন। শারমিন বেগম তাকে বাঁধা দেন,
“আমরা নাহয় একটা পশুকে শাস্তি দিবো কিন্তু আমার মেয়ে? তার কি হবে? সে তো ঘুটে ঘুটে মরবে? সমাজ তাকে কলুষিত চোখে দেখবে। এরচেয়ে আমরা অন্য জায়গায় চলে যাই। নতুন জায়গায় নবনীতাও সামলে যাবে”

কথাটা ভুল ছিলো, নবনীতা সামলায় নি। বরং তার ভয়টা গাঢ় হয়েছে। নিগাঢ় ভয় প্রতিনিয়ত তাকে তাড়া করেছে। তাইতো সেদিন শান্তের উপর চড় বসাতে সে দুবার ভাবে নি। নিজের ব্যাগে এন্টিকাটার নিয়ে ঘুরে, শুধু নিজেকে বাঁচাতে। সেদিন মলেও সে শাকিলের উপর হামলা করে। তাকে আহত করে। সে ভাবে হয়তো একটা পশুকে সে মেরে ফেলেছে। যতই শক্ত হোক না কেনো, খুন করার সাহস এবং তারপর তা বয়ে নেওয়া সহজ নয়। তাই তার মস্তিষ্ক এই স্মৃতিটিকে পুরোপুরি মুছিয়ে ফেলে। তাই তো তার মনে থাকে নীতি তার সাথে ওয়াশরুমে গিয়েছিলো। কিন্তু নীতি যে তাকে মাঝরাস্তায় বাহানা দিয়ে আবার দোকানে ফেরত এসেছিলো তা নবনীতার মনে নেই। এই কথাগুলো হয়তো নীলয়কে বলতে পারতো শান্ত। কিন্তু সে বলে নি। সে চায় না কেউ তার শ্যামলীকে পাগল বলুক। এখন শকিল আইসিউ তে, তার চিকিৎসা শান্ত ই করাচ্ছে। আর নীতি, নীতির শাস্তি আরোও চমৎকার। তার স্বামী সোহান একটি মেয়েতে মগ্ন হয়েছে। তাদের পরকীয়া চলছে, শান্ত এই সত্যিটাই নীতিকে জানিয়েছে। মানুষের দূর্বলতাকে আঘাত করলেই তার হাটু ভেঙ্গে দেওয়া যায়। নীতির সাথেও শান্ত সেটাই করেছে। নীতি ভুগছে এক অসহনীয় যন্ত্রণায়, সে চাইলেও সোহানের সাথে বিচ্ছেদ হতে পারছে না, কারণ তার বাচ্চাটা ছোট। আর যতই হোক, সোহানের টাকা পয়সা আছে। সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে চাইছে না। তাই তো সে এখন তার ভাইয়ের বিয়েটা সোহানের ছোট বোনের সাথে দিতে চাইছে। নীলয়কে সত্যিটা বলে সেই প্লানের উপর ও শান্ত পানি ফেলে দিয়েছে। শান্তের মাঝে মাঝে নিজেকে শয়তান মনে হয়। কিন্তু মানুষরুপী পশুদের থেকে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে একটু খারাপ তো হতেই হবে। এতে যদি পরকালে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হয়, তা সে মাথা পেতে নিবে। কিন্তু তার পরিবারকে সে আগলে রাগবে। এটাই তার মা তাকে শিখিয়েছে। গাড়ি চলছে, শান্ত গাড়ি চালাচ্ছে। গান বাজছে, শান্তের পছন্দের গান,
“ক্ষনিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে ক্ষনিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে ‘হারাই-হারাই’ সদা হয় ভয়
‘হারাই-হারাই’ সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে
আশ না মিটিতে হারাইয়া- পলক না পড়িতে হারাইয়া-
হৃদয় না জুড়াতে হারাইয়া ফেলি চকিতে
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না”

রাত ১০টা,
শান্ত এখনো ফিরে নি, নবনীতা অপেক্ষা করছে শান্তের জন্য। সকলের খাওয়া হয়ে গেলেও নবনীতা খায় নি, সে তার দাঁড়িওয়ালা হনুমানের সাথেই খাবে। ডাইনিং টেবিলে রাখা খাবারগুলোকে সে ঢাকতে ব্যাস্ত তখন হেনা বেগম সেখানে আসে। তার রুমে পানি নেই, সে পানির বোতলটা নিয়ে যাবে। নবনীতাকে খাবার ঢাকতে দেখে সে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। নবনীতা তখন বলে,
“কিছু লাগবে মা?”
“আমি চাইলেই দিবে?”

হেনা বেগমের হঠাৎ প্রশ্নে খানিকটা ঘাবড়ে যায় নবনীতা। মাস কেটে গেলেও মহিলাকে খুব ভয় হয় তার। আমতা আমতা করে বলে,
“বলুন মা, সাধ্যের মধ্যে হলে ইনশাআল্লাহ দিবো”
“তোমাকে আমি কেনো আমার ছেলের জন্য পছন্দ করেছি জানো?”
“জ্বি না”
“তোমার এই স্পষ্টবাদী চরিত্রের জন্য। কম তো বয়স না আমার, কম মহিলা দেখি নি আমি? বলতে পারো চুলগুলো মানুষ ভেজেই পাকিয়েছি। তাই সবার স্বভাব আন্দাজ করতে আমার দু মিনিট লাগে না। তুমি যেদিন প্রথম আমার ছেলেকে রিজেক্ট করেছিলে তখন ই আমার তোমাকে মনে ধরেছিলো। একটা মেয়ের অর্থের প্রতি প্রলোভন নেই, ব্যাপারটা আমার মনে দাগ কেটে ছিলো। তুমি জানতে আমাদের অবস্থা। এই বাড়িতে টিউশন করিয়েছো, সুতরাং আমাদের অবস্থা জেনেও আমার ছেলেকে না করাটা আমাকে অবাক করেছিলো। তখন একটা জিদ হয়েছিলো তোমাকে এই বাড়ির বউ বানাবো। কিন্তু শান্ত নারাজ, সে তোমাকে অপছন্দ করে। পরে যখন দেখলাম তুমি আমার ছেলেকে ছেড়ে নীলয়কে বাছলে তখন আমি বুঝলাম, তোমার কাছে সম্পর্কের মূল্য কতটা। আমার আফসোস হলো, আমার শান্তটা একটা ভালো মেয়ে হারালো। কিন্তু ভাগ্য দেখো, যাই হোক না কেনো সেই তোমাকেই আমার ঘরের বউ করে আনলো। যখন নীলয় তোমাকে বিয়ের দিন ছেড়ে গিয়েছিলো আমি সময় নষ্ট করি নি। মানুষ কি ভাববে? আমাকে সন্দেহ করবে, আমাকে নানা কথা বলবে, এটা যেনো মাথায় ই আনি নি। সুযোগ বুঝে তোমার আর শান্তের বিয়ের কথাটা পেরে দিলাম। হয়তো তোমার আমার প্রতি রাগ হয়েছে, কিন্তু নিজের ছেলের ভালো কোন মা চায় না। আমি শুধু একটা জিনিস চাইবো, আমি যদি না থাকি আমার ছেলেটাকে দেখো। এটুকুই আমার চাওয়া, এটা তোমার সাধ্যের ভেতরে।“

হেনা বেগমের কথা শেষ হবার পর নবনীতা ধীর স্বরে বলে,
“মা, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। যাকে ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনা করতে পারি না, তাকে ছেড়ে যাবার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না।“

হেনা বেগমের মুখের প্রসন্নের হাসি ফুটে উঠে। নবনীতার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন পরম যত্নে। তারপর পানির বোতল নিয়ে চলে যান ভেতরে।

শান্তের ফিরতে ফিরতে রাত হয়, জ্যামে গুলসান থেকে আজিম্পুর আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়। কলিং বেল চাপতেই ঢুলু ঢুলু চোখে দরজা খোলে নবনীতা। হাই তুলে বলে,
“এতো দেরি হলো যে?”
“জ্যাম ছিলো, মহারানী।“
“ব্যাঙ্গ করছেন?”
“সেই জো আছে।“
“থাক, হয়েছে। এবার ঘরে এসে উদ্ধার করুন।“

শান্ত হাসে। খাওয়া শেষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে শান্ত, হাতে বেনসনের এক দলা নিকোটিন। দৃষ্টি তারা ভরা আকাশের দিকে। তখন বারান্দায় আসে নবনীতা। বিয়ের এক মাস কেটে গেছে কিন্তু শান্ত এবং নবনীতার সম্পর্কটা আগামী স্তরে পৌছায় নি। এখন হয়তো তাদের মধ্যে একটা শক্ত বন্ধন আছে, বিশ্বাস আছে। ঝগড়া হলেও তা হয় খুনসুটির। কিন্তু তাদের সম্পর্কটা স্বামী স্ত্রী থেকে বন্ধুত্বের বেশি। শান্ত নবনীতাকে পেতে চায়, একান্ত ভাবে নিজের করতে চায়। কিন্তু একটা বাঁধা যেনো রয়েই গেছে, বাঁধাটা হলো নবনীতা। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে শান্ত কিছুই করবে না। এই অসহনীয় দ্বিধা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এমন সময় বারান্দায় পা রাখে নবনীতা। চুপ করে শান্তের পাশে দাঁড়ায় সে। নবনীতার অস্তিত্ব অনুভূত হতেই সিগারেট ফেলে দেয় শান্ত। নবনীতা চুলে বেনুনী পাকাতে পাকাতে বলে,
“আজ এতো দেরি হল যে? কাজ ছিলো বুঝি?”
“হ্যা, খুব ইমপোর্টেন্ট কাজ।“
“ওহ, ঘুমোবেন না?”
“আসছে না যে ঘুম”

নবনীতা কথা পায় না, অনেক কথা আছে তবুও হাতড়াচ্ছে কি বলা যায়। শেষমেশ চুপ করেই দাঁড়িয়ে থাকে। নবনীতার নীরবতা দেখে শান্ত নিজ থেকে বলে,
“অভয় দিলে একটা কথা বলবো শ্যামলী?”

শান্তের মুখে প্রেমঘন “শ্যামলী” ডাক শুনে ধক করে উঠে নবনীতার হৃদয়। পিপাসু হৃদয়টা যেনো তৃপ্তি পেলো বহুকাল বাদে। কি আছে এই শব্দে? এতো মধুর কেনো তা? নবনীতার নীরবতা নিরাস করে শান্তকে। সে বলে,
“থাক, পড়ে বলবো।“
“না, না থাকবে কেনো বলুন”
“তোমার খারাপ লাগবে”
“কেনো?’
“তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু চাওয়ার আছে যে?”
“কি?”
“তোমাকে”

শান্তের কথা শুনে লাল-বেগুনী হয় নবনীতা। মাথা নত হয়ে যায়, পা জোড়া ঘুটে আকড়ে থাকে মাটি। খুব লজ্জা করছে তার। শান্ত নবনীতার দিকে ফিরে বলে,
“দিবে আমায় শ্যামলী?”

নবনীতা হালকা করে মাথা নাড়ায়। এ যেনো জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওনা শান্তের। পরম আদরে জড়িয়ে নেয় তার শ্যামলীকে। দীর্ঘচুম্বন করে তার ওষ্ঠে। রাতের নিঝুম আকাশ সাক্ষী এই মানবমানবীর প্রেমঘন মূহুর্তের। শীতল বাতাস বইছে, দোলা দিচ্ছে দুটি মন। ভেঙ্গে চুড়ে একাকার হচ্ছে সকল বাঁধা, তপ্ত স্পর্শে এক হচ্ছে দুটো হৃদয়।

পাঁচ বছর পর,
শ্রাবণের কেবিনে বসে রয়ছে নবনীতা। তার সেশন চলছে। শান্তের আকুল নিবেদনের কাছে তাকে তো ঝুকতেই হতো। শান্ত তাকে আশ্বাস দিয়েছে কখনোই তার হাত ছেড়ে দিবে না। তবে তাই বলে সারাটাজীবন একটা কালো স্মৃতির ভয় মনে পুষে রাখবে নবনীতা তা সে মানতে নারাজ। তাই অনেক কষ্টে তাকে রাজী করিয়েছে শান্ত। বিগত পাঁচ বছর যাবৎ শ্রাবণের আন্ডারে সে চিকিৎসা নিচ্ছে। এখন সে অনেকটাই সুস্থ। এখন নবনীতা আর ভয় করে না। তার মনে হয় না কেউ তাকে দেখছে, তার মনে হয় না কেউ তাকে ক্ষতি করবে। এই জিনিসটা অবশ্য সম্ভব হয়েছে শুধু শান্তের জন্য। সে এক সুরক্ষা বলয়ের ভেতরে রেখে দিয়েছে যেনো নবনীতাকে। এই পাঁচ বছরে অনেক কিছু পাল্টেছে, নবনীতার কোল আলো করে এক পুত্র এসেছে। তার নাম ঈশান। শান্তের নামের সাথে মিলিয়ে রাখা। বাবা ছেলের খুব মিল। একসাথে নবনীতাকে জ্বালায়। এদিকে স্নেহা এখন ক্লাস টেনে পড়ে। কিন্তু এখনো সে তার হিটলার চাচীকে ভয় পায়, ঈশানকে পেলেই বলে,
“এতোদিন আমাকে পড়িয়েছে, এখন তোর পালা। চাচী যখন তোর ক্লাস নিবে, আমি দেখবো আর মজা নিবো।“

নবনীতার জীবন যেনো একেবারে পারফেক্ট। নীলয় হুট করেই দেশের বাহিরে চলে গিয়েছে। কারণটা নবনীতা জানে না। শান্ত তাকে জানতে দেয় নি। তবে যাবার আগে বলেছিলো,
“পারলে আমাকে ক্ষমা করো নীতু, আর সুখে থেকো।“

নীলয়ের এই দুই লাইনের মানে জানা নেই নবনীতার। হেনা বেগম এখন রিটায়ার্ড করেছেন কোম্পানি থেকে। মারুফ এখন সব সামলায়, শান্তের ফার্ম টাকে এজ এ সেকশন হিসেবে তাদের কোম্পানির সাথে জয়েন করা হয়েছে। নীতির জীবনটা এখনো দূর্বিসহ। সে প্রায় ই নবনীতার কাছে আফসোস করে। কান্নাকাটি করে। নবনীতার দয়া হয়। কিন্তু কিছু বলে না। অন্যের জন্য নবনীতা এখন আর ভাবে না। নিজের স্বামী সন্তানের জীবনে সে সুখে আছে, বেশ আছে।

শ্রাবনের সেশন শেষ হতে হতে আজ সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। শ্রাবণ মুচকি হেসে বললো,
“মিস, আর সেশনের দরকার নেই। ইউ আর এবসুলিউটলি ফাইন নাও।“
“থ্যাংক্স “
“থ্যাংক্স আমাকে না, নিজের হাসবেন্ডকে দিবেন। সে ছিলো বলেই, নবনীতার ভেতর থেকে ভয়টা দূর করা গেছে।“

নবনীতা হাসে, তারপর কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়। বিল্ডিং থেকে বের হতেই দেখে শান্ত দাঁড়িয়ে আছে ছাতা হাতে, আজকের দিনটা খুব ভালো করে স্মরণ আছে নবনীতার। পাঁচবছর আগে এমন ই এক সন্ধ্যায় ছাতি হাতে সামলেছিলো শান্ত তাকে। সেদিন বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে শহরের রাস্তায় হাটছিলো এক হৃদয়ভগ্ন যুবতী। সেদিনো ছিলো শ্রাবণের শেষ সন্ধ্যা, আজও শ্রাবণের শেষ সন্ধ্যা। সেই মানুষটি এখনো সামলে যাচ্ছে এই নারীকে, শুধু পার্থক্য একটাই এখন এই নারীটি আর ভগ্ন হৃদয়ের যুবতী নয়। বরং একজন পূর্ণ নির্ভীক নারী______________

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here