শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা ১৩তম_পর্ব

শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
১৩তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

নবনীতার ঘুম ভাঙ্গলো ভোরে। বাস তখন খাগড়াচড়ির আঁকাবাকা সরু পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। রাতে বেশ শীত করছিলো, এখন শীতটা করছে না নবনীতার। তার গায়ে কম্বল টেনে দেওয়া। যতদূর মনে পড়ে সে কম্বল নেয় নি ঘুমানোর সময়। সত্যি বলতে কখন ঘুমিয়ে গেছে তার মনে নেই। নবনীতা পিটপিট করে চোখ খুললো। চোখ খুলতেই এক মাতাল কড়া গন্ধ নাকে এলো তার। বেশ সুন্দর মাতাল কড়া গন্ধ। মাথা তুলতেই চোখ ছানাবড়া হবার জোগাড় নবনীতার। দিব্বি শান্তের কাধে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে ছিলো। তার গায়ে কম্বলটাও হয়তো সে টেনে দিয়েছে। ঘুমের মধ্যে কখন এমন অঘটন ঘটলো কে জানে? নবনীতা চট জলদি মাথা সোজা করে বসলো। নিজের অসর্তকীকরণ কাজে নিজেই লজ্জায় লাল, গোলাপী হচ্ছে সে। এদিকে শান্ত তখনো ঘুমে বিভোর। নবনীতা আড়চোখে একবার শান্তের দিকে তাকালো। সূর্যের স্নিগ্ধ আলো পড়ছে তার শ্যাম মুখে, কোমলপ্রভায় কালো দাঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা শান্ত, কোমল মুখশ্রী দেখতে অত্যন্ত সুদর্শন লাগছে। টানা টানা আখিপল্লব, খাড়া নাক তার সৌন্দর্য যেনো আরো বর্ধিত করেছে যেনো। নবনীতা কিছু সময় শান্তের দিকেই তাকিয়ে থাকলো। এক অজানা মোহ রয়েছে এই পুরুষটির চেহারায়। মাঝে মাঝে নবনীতার মনে হয় স্রষ্টা বহু সময় নিয়ে তাকে বানিয়েছেন। একটা খুদ নেই লোকটির। এভারেজ বাঙ্গালীর আদর্শ পছন্দ বললে বাড়তি বলা হবে না। নবনীতার অজান্তেই হাসলো। তারপর নজর দিলো বাহিরে। সরু পাহাড়ী রাস্তায় চলছে তাদের বাস। আশেপাশের প্রকৃতিতে এক অনন্য স্নিগ্ধতা। ছোট বড় বহু পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছে। পিচের আকাবাকা রাস্তাটি দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেত শত বছর পূর্বে এখানে পাহাড় কেটে রাস্তা বানিয়েছে। কিছু কিছু পাহাড় রাস্তার গা মেয়ে মাথা উঁচিয়েছে। তবে তার মাঝে লুকিয়ে রয়েছে ভয়ংকর ঝুঁকি। নৌকা যেমন দুলতে থাকে নবনীতাদের বাসটিও দুদিক দুলছিলো। একটা ভুল, আর বাসটি তলিয়ে যাবে খাঁদে। জমিন থেকে ঠিক কত উচুতে রয়েছে তা জানা নেই নবনীতা। তবে মেঘের আস্তরণ হয়তো খুব বেশি দূর নেই। নবনীতার মনে হলো পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্য ভয়ংকর। যেমনটা তার পাশের পুরুষটি। সুদর্শনের সাথে সাথে চরম ভয়ংকর। নবনীতাও ভয় পায়, ভয় পায় পুনরায় আসক্তিতে জড়াতে। ভয় পায় পুনরায় মায়ায় জড়াতে। একটা ভুল, পুনরায় তলিয়ে যাবে সে আবেগের খাঁদে।

বাস থেকে নেমে চাঁদের গাড়িতে উঠলো নবনীতা এবং শান্ত। গাড়িতে করেই রওনা দিলো বাগাইহাট আর্মি ক্যাম্প। সেখান থেকে সেনাবাহিনী স্কটে করে যাবে। সেনাবাহিনীর স্কট দুটো সময় ই পাওয়া যায়। সকাল ১০টা এবং বিকেল ৩টা। তাই গাড়ির ড্রাইভার লাদামপং দ্রুত বেগে গাড়ি ছোটাচ্ছেন। এখন ঘড়িতে সময় পৌনে নয়টা। দেড় ঘন্টার যাত্রা সোয়া এক ঘন্টায় তাকে পাড় করতে হবে। লাদামপং তাদের ট্যুর ড্রাইভার। দুদিন বাদে তিনি ই তাদের পুনারায় নিয়ে যাবে ফেলে আসা বাসের কাছে। পাহাড়ী টানে স্পষ্ট বাংলা বলেন তিনি। নবনীতার খুব মজা লাগছে তার বাংলা কথাগুলো শুনতে। বাগাইহাট আর্মি ক্যাম্পে এসে গাড়ি থামে। নাস্তা করানোর জন্য থামে জিপ। নবনীতাকে শান্ত বলে,
“কি খাবে বলো, এর পর খাবার সুযোগ হবে না।“
“চা পাওয়া যাবে?”
“খালি পেটে চা খেলে শরীর খারাপ করবে। এখনো খাড়া রাস্তা শুরু হয় নি। বমি, বমিও লাগবে।“
“ভারী কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। তবে বিস্কুট, কলা পেলে এনেন।“
“আচ্ছা এখানে দাঁড়াও।“

বলেই শান্ত গেলো ক্যান্টিন এ। নবনীতা খেয়াল করলো পাহাড়ী অঞ্চলে ঠান্ডা একটু বেশী ই লাগে। সূর্যের আলোতে সেই প্রখরতা নেই। সেই কাঠিন্য নেই। কোমল সূর্যের কিরণ তার গায়ে খেলা করতে ব্যাস্ত। নবনীতা অসীম আগ্রহে তাকিয়ে আছে পাহাড়ের চুড়া গুলোর দিকে। হঠাৎ গা টা ঝিনঝিন করে উঠলো নবনীতার। তার অনুভব হলো কেউ সরু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নবনীতার প্রথমে মনের ভূল মনে হলো। কারণ আশেপাশে সে এবং কিছু যাত্রী ব্যাতীত কেউ নেই। তারা নিজেরা ছবি তুলতে ব্যাস্ত প্রকৃতির, নিজেদের। সুতরাং তার দিকে তাকানোর সময় নেই তাদের। কিন্তু মিনিট পাঁচেক বাদেও অনুভূতিটা সুগাঢ় হতে থাকে। নবনীতার বুকে এক অজানা ত্রাশ জেকে বসে। ফলে ভীত নজরে পেছনে তাকালো সে। না কেউ নেই, বরং সব গাড়িগুলো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অধিকাংশ ক্যাম্পে নিজেদের পরিচয় এবং কতদিন সাজেক থাকবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েছে। নবনীতার লোম দাঁড়িয়ে গেছে। মনের ভুল ভেবে নিজেকে বুঝ দিয়ে সামনে তাকায় সে। তখনই কেউ তার ঘাড়ে হাত রাখে। নবনীতা রীতিমতো কেঁপে উঠে। চমকে পাশে তাকায়। তখন শান্ত ধীর গলায় বলে,
“কি হয়েছে? আমি তো।“

শান্তের প্রশ্নের উত্তর দেয় না নবনীতা। শুধু ফ্যালফ্যাল নজরে তাকিয়ে থাকে। ভয়ে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। শান্ত আলতো হাতে তার গালে হাত রাখে। আর নরম ভাবে বলে,
“ভয় পেয়েছিলে কোনো কারণে?”

নবনীতা এবার ও কোনো কথা বলে না। শুধু মাথা নাড়িয়ে “না” বলে। শান্ত আর প্রশ্ন করে না। বরং ব্যাম্বো চাটা এগিয়ে দেয় নবনীতার দিকে। ঠোঁটে হাসি একে বলে,
“আচ্ছা, আমি এসে গেছি। এখন আর ভয় নেই। এই নাও চা খাও। এটা এখানে স্পেশালিটি। খেয়ে দেখো তো কেমন? তবে তার আগে এই কলা আর টোস্ট টা খেয়ে নাও। এর পর জয়ট্রিপ খাবে তারপর চা।“

নবনীতা এবার একটু নর্মাল হয়। কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা মনের ভুল ভেবে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে সে। তারপর কলা এবং বিস্কুটটি খায়। তারপর চুমুক দেয় ব্যাম্বো টি তে। আর শান্ত ধরায় একটা সিগারেট। আর পাঁচ মিনিট পর সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে তারা। শান্ত সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে আড়চোখে নবনীতা দেখতে থাকে। আসমানী রঙ্গে নবনীতাকে অন্যরকম স্নিগ্ধ লাগছে। প্রভাতের সোনালী রোদে সোনার ন্যায় ঝলমল করছে তার মুখটি। কিন্তু কোথাও যেনো এক সূক্ষ্ণ ভয়ের রেখা দেখতে পাচ্ছে সে। এই মিনিট পনেরোর মাঝে কি এমন ঘটেছে যা নবনীতার উজ্জ্বল মুখখানা পাংশু বর্ণ করে দিয়েছে?

ফর্মালিটি শেষ করে চাঁদের গাড়ি পাড়ি দেয় মাছালং বাজারের দিকে। যেহেতু যাত্রীরা অনেকেই নাস্তা করে নি। তাই সেই বাজারেই তাদের নাস্তার ব্যাবস্থা। নাস্তা শেষে লাদামপং গাড়ি স্তার্ট দিলো। এক পাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। গাড়ি গুলো সাজেক ছেড়ে ফেরার পথে আগাচ্ছে। যেহেতু সরু পাহাড়ী রাস্তায় দু লাইনে গাড়ি চলাচল অসম্ভব। তাই সেই গাড়িগুলো থেমে রয়েছে যেনো এই লাইনের গাড়ি গুলো যাবার সুযোগ পায়। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উপরে অবস্থিত সাজেক যাবার রাস্তাগুলো তার সৌন্দর্যের মতো ভয়ংকর। খাঁড়া রাস্তাগুলোর উপরে ওঠার সময় একই সাথে কোনো গাড়ি নিচে নামলে দূর্ঘটনা নিশ্চিত। লাদামপং খুব দক্ষের সাথে উচ্চ গতিতে গাড়িটি এগিয়ে নিচ্ছে। সামনে বসার কারণে অবাক নয়নে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে নবনীতা। তার দৃষ্টি পাহাড়ের ভয়ংকর অপরূপ সৌন্দর্যের দিকে। অবাক নয়নে বাচ্চাদের মতো তাকিয়ে আছে সে। একবার আকাশ তো একবার খাঁদ। চোখ ঘুড়িয়তে মেঘের রাজ্যকে উপলদ্ধি করছে সে। আর শান্ত তাকিয়ে রয়েছে নবনীতার দিকে। চাঁদের গাড়ির পেছনে মোট ছয়জন। সামনে দুজন। আটজন যাত্রী নিয়ে চলছে গাড়ি। ছাঁদের মালামাল। কিশোর বয়সে এই ছাঁদে উঠেই সাজেক গিয়েছিলো শান্ত। তবে সেখানে তার কলেজ বন্ধুরাই ছিলো। কিন্তু এয়ার যাত্রাটা তার স্ত্রীকে নিয়ে। একেবারে কাছাকাছি বসে রয়েছে তারা দুজন। যেখানে নবনীতার নজর দূর মেঘের সাড়িতে, সেখানে শান্তের নজর। তার কানের পেছনের নজরকাড়া গাঢ় কালো তিলে। মেঘের খেলায় হয়তো কারোর মনচিত্তে এক অতূলনীয় চিত্র তৈরি হচ্ছে। চিত্রটি তার পাশে বসে থাকা সাধারণ গড়ণের শ্যাম নারীর। চিত্রটি নবনীতার। অজান্তেই শান্তের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।

অবশেষে বারোটা নাগাদ সাজেক ভ্যালীতে পৌছায় তারা। “মেঘ মাচাং” রিসোর্ট বুক করা হয়েছে শান্ত এবং নবনীতার জন্য। নবনীতা দোলনায় বসে অপেক্ষা করে শান্ত এর জন্য। শান্ত ততক্ষণে রিসিপশনে গিয়ে উডেন ভিলার চাবিটি নিয়ে নেয়। তারপর তারা প্রবেশ করে তাদের রুমে। নবনীতা তার বেগটি রেখেই ছুটে যায় বারান্দার দিকে। বারান্দাটি পুরোই ঝুলন্ত। প্রথমে ভয় করলেও বারান্দার দোলনায় বসে মেঘ দেখতে অপূর্ব লাগে। এখন মেঘ উপরে থাকার জন্য মেঘের স্পর্শ না পেলেও পাহাড়ের দৃশ্য টি চমৎকার লাগছে নবনীতার। তখন শান্ত নবনীতার বাচ্চামী দেখে হাসে। মেয়েটাকে অনেক দিন বাদে এমন হাসিখুশি দেখাচ্ছে। মন্দ লাগছে না তাই শান্তের। নবনীতা দোলনা বসে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। তখন শান্ত তাকে বলে,
“তুমি সিনারি দেখো, আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।“

নবনীতা ছোট্ট করে হু বলে। তারপর আবার বাহিরের দিকেই নজর দেয়। সাজেকের অসীম সৌন্দর্যে সে যেনো হারিয়ে যেতেও রাজী। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে নবনীতা দাঁড়ায় বারান্দার কর্ণিশে। অবাক চাহনীতে দেখতে থাকে পাহাড়। ঠিক তখন ই একটা ক্যামেরার আওয়াজ শুনতে পায় সে। পাশ ফিরতেই দেখে…………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here