শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা ১১তম_পর্ব

শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
১১তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

সবার অবস্থা খারাপ হলেও নীতির অবস্থাটা যেনো একটু বেশি খারাপ। যে মেয়েটি তার ভাইয়ের বউ হবার কথা ছিলো এখন সে শান্তের বউ। এজন্য সে ঠিক মত কথা ও বলতে পারছে না নবনীতার সাথে। খানিকটা লজ্জাও করছে। এর মাঝেই শান্ত এসে দাঁড়ায় তার কাছে। ফাঁক বুঝে কথাটা পাড়ে সে,
“মাইন্ড না করলে একটা কথা বলবো?”
“হ্যা, বল। মাইন্ডের কি আছে?”
“আচ্ছা সেদিন তুই নবনীতাকে ওয়াশরুমে একা ফেলে কেনো চলে এলি?”

শান্তের প্রশ্নে চমকে যায় নীতি। অবাক কণ্ঠে বলে,
“আমি তো ওর সাথে যাই ই নি তাহলে একা ফেলার প্রশ্নই উঠে না।“
“তুই ওর সাথে যাস নি বলছিস?“
“আরে বাবা, যাই নি। একবার তো বললাম। নবনীতা তোমাকে বলেছে না আমি তার সাথে গিয়েছি? মিথ্যে বলছে নবনীতা। হ্যা, এটা ঠিক ও আমাকে ওর সাথে যেতে বলেছিলো, ও নাকি লিফট ভয় পায়। কিন্তু বাবু কঁদছিলো তাই আমি যাই নি। অদ্ভুত শান্ত ভাই, অহেতুক আমার উপর দোষ চাপাচ্ছো? বিয়ে হতে না হতেই মেয়েটা তার রঙ দেখাচ্ছে। মিথ্যে বলে আমাকে জড়াচ্ছে”

নীতি খানিকটা ভড়কে গিয়েছে। তার কন্ঠ কাঁপছে, দৃষ্টি বিচলিত। কোনো কারণে সে কিছু একটা লুকিয়ে যেতে যাচ্ছে। শান্ত তীর্যক দৃষ্টি প্রয়োগ করলো নীতির দিকে। তার কপালে ঘাম জমেছে, কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবলো নীতিকে চেপে ধরা যাক। কিন্তু ঘরে প্রচুর মানুষ। একেই নীতি খানিকটা হাইপার হয়ে আছে। অবস্থা বেগতিক হয়ে যাবার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে। এতো মানুষের মাঝে নবনীতার সেদিনের ব্যাপারটা দিয়ে একটা সিন হোক সেটা শান্ত চায় না। যতই হোক, মেয়েটা এখন তার সাথে জড়িত। সবার সামনে তার দূর্বলতাকে ঘাটানোটা জগন্য মানসিকতার প্রমাণ দিবে। তাই শান্ত কথা বাড়ালো না। বরং ঠোঁটে হাসির প্রলেপ একে বললো,
“তুই সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিস কেনো? আমি তোকে দোষ দিচ্ছি না। আসলে সেদিন ও হারিয়ে গিয়েছিলো তো, তাই আমি ভেবেছি তুই কেনো ওকে একা ফেলে এসেছিস। আর নবনীতা আমাকে কিছুই বলে নি। সেদিন তুই ওর সাথে সারাক্ষণ ছিলি। তাই আমার ওয়াইল্ড গেস ছিলো। সরি, তুই হাইপার হইস না।“

শান্তের কথায় খানিকটা শান্ত হলো নীতি। সে তার ঠোঁটের উপর জমা ঘাম মুছে নিলো। তারপর বললো,
“আমি একটু আসছি শান্ত ভাই, বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি রুমে। ও হয়তো জেগে গেছে।“

কথাটা শেষে একমিনিট ও দাঁড়ালো না নীতি। ছুটলো রুমের দিকে, যেখানে তার বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। তবে শান্তের তীর্যক দৃষ্টি নীতি থেকে নড়লো। নীতির ভাবভঙ্গি চরম সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। শান্ত তাকে এই প্রশ্নটি করতেই সে চমকে যায়। রীতিমতো প্যানিক করে, হাইপার হয়ে যায়। তার গলার স্বর তীব্র হয়ে যায়। ধরেই নেওয়া হোক, সে সেদিন নবনীতার সাথে ওয়াশরুমে গিয়েছিলো। তারপর নবনীতাকে একা ফেলে সে চলে এসেছে। এটা এতো বড় কোনো ঘটনা নয়। তবে এতে এতোটা রিয়েক্ট করার কি আছে। সেদিন নবনীতাকে যেভাবে পাওয়া গিয়েছে সেটা কেবল নীলয় এবং শান্ত জানে। তাহলে নীতি এতোটা ভয় কেনো পেলো। শুধু ওয়াশরুমে ছেড়ে আসার জন্য কেউ তাকে শাস্তি দিবে না। আর যদি এটা ধরা হয় যে, নীতি সত্যি বলছে। তবে নবনীতা কেনো মিথ্যে বলবে। ঘটনা রীতিমতো প্যাচিয়ে গোলকধাঁধা হয়ে যাচ্ছে। শান্ত বা হাতে ভ্রু সংযোগস্থলের চামড়া চেপে ধরলো। তার মাথা ব্যাথা করছে। সে কি অহেতুক একটা ঘটনা নিয়ে চিন্তা করছে? এই ঘটনার রহস্য উম্মোচন হলে তার কি লাভ? কথাটা ভাবতে ভাবতেই আড়চোখে নবনীতার দিকে তাকালো সে। হেনা বেগমের পাশে ভদ্র মেয়ের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে ম্লান হাসি। ম্লান হাসিটা শ্যামলীর মুখে বড্ড বেমানান। হুট করেই এক অজানা টান অনুভব করলো শান্ত। তার বুকে ক্ষীণ কষ্ট অনুভব হলো। কেনো? উত্তর জানা নেই শান্তের। তবে নবনীতার ম্লান হাসিটা তার ভালো লাগে নি। হয়তো মেয়েটির সেই প্রাণোজ্জ্বল এক চিলতে হাসির জন্যই এতো মাথা ব্যাথা। সেদিন তার সাথে কি হয়েছিলো সেটা জানতেই হবে। শুধু শ্যামলীর জন্য নয়, তার মায়ের জন্য ও। রহস্যের সাথে সাথে নিজের মায়ের প্রতি ভ্রান্ত ধারণার ও সমাপ্তি হবে____________

সময়ের স্রোত কারোর জন্য থেমে থাকে না। সে তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যায়। মানুষকেও তার সাথেই এগিয়ে যেতে হয়। নবনীতাও এগিয়েছে। তার বর্তমান জীবনের সাথে ক্রমে তাল মেলাচ্ছে সে। বিয়ের দশ দিন হয়ে গিয়েছে। এখন এই আজীমপুরের দোতালা বাড়িটি তার নিবাস। প্রতিরাতে শান্ত এর সাথেই একই বিছানায় ঘুমায় সে। প্রতিদিন এই বাড়ির মানুষের সাথেই তার উঠাবসা। জীবনের গতি ও চলছে সর্বোচ্চ গতিতে। কলেজে যাওয়া শুরু করেছে নবনীতা। বান্ধবীদের মাঝে তার এবং নীলয়ের ব্যাপারটা নিয়েও কানাগুসা চলছে। কিন্তু নবনীতার রুক্ষ স্বভাবের জন্য কেউ মুখের উপর প্রশ্ন করতে পারে না। নবনীতা বুঝতে পারে, তাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু সে। সে বুঝতে পারে তাকে নিয়েই অফ টাইমে সবাই গল্প করে। তাকে দেখলে মুখে কুলুপ আটে। কিন্তু সে কিছু বলে না। সব বুঝেও অবুঝ সাজে। মাঝে মাঝে অবুঝ সাজতে ভালো লাগে। মানুষ শান্তনা দেয়, কিন্তু পেছনে হাসাহাসি করে। করবে না কেনো? জীবন্ত সিনেমা হয়ে গিয়েছে তার জীবন। তবে একটা ব্যাপারে সে ভাগ্যবতী বলা চলে, যখন হেনা বেগমকে আবদার করেছে,
“মা, আমি কলেজ যাওয়া শুরু করতে চাই।“

তিনি তার দিকে কোমল চাহনী দিয়ে বলেছে,
“আমিও এটাই ভাবছিলাম। আজকালকার মেয়ে হয়ে পড়াশোনা করবে না এটা কি হয়! আমাদের সময় তো মেয়েদের পড়াশোনা করলেও যা, না করলেও তা। কিন্তু তোমাদের সময় আলাদা। ২০২১ সালে এসে গ্রাজুয়েট না হলে দাম নেই। তুমি তোমার পড়ালেখা শুরু করো।“

নবনীতা এক অন্যনারীকে দেখেছিলো সেদিন। একজন নারী, অন্য নারীকে টেনে নিচে নামাতে নয় বরং উপরে ওঠার সিড়ি হচ্ছে। হেনা বেগমের প্রতি তার মনোভাবটা মিশ্র। মহিলা অসম্ভব দাপটে, সামিয়া প্রচুর ভয় পায় তাকে। কিন্তু অজানা কারণে নবনীতার ভয় হয় না। কিন্তু সে হেনা বেগমের ভক্ত এমনটাও নয়। তবে অজানা কারণে তাকে সম্মান করতে ইচ্ছে হয় নবনীতার। এ বাসার সবার সাথে বেশ মানিয়ে নিলেও একটা মানুষের সাথে অংক মিলে না নবনীতার। সে হলো শান্ত। চরম মাত্রার বিরক্তিকর। নবনীতার সব কাজে তার একটা না একটা টিপ্পনী কাটতেই হবে। সেদিনের কথা, শখ করে কাবাব রোল বানিয়েছিলো নবনীতা। সবাই প্রশংসা করলেও শান্তের বক্তব্য,
“ইহজীবনের এতো টক রোল আমি খাই নি।“

ব্যাস লেগে গেলো যুদ্ধ। না না, এ যুদ্ধ গুলি বারুদের নয়। এটা মুখের বাণীর যুদ্ধ। যা যেকোনো সময় যখন তখন শান্ত এবং নবনীতার মাঝে লেগে যায়। মাঝে মাঝে হেনা বেগম অতীষ্ট হয়ে উঠেন। তার মনে হয় এরা মানুষ নয় বরং আমেরিকা এবং রাশিয়া। তাই হেনা বেগম ঠিক করেছেন তার ছেলে এবং বউ মাকে ঘুরতে পাঠাবেন। সেই কারণেই ডেকে পাঠিয়েছেন তাদের নিজের ঘরে। সামনে নবনীতার সেমেস্টার ব্রেক। এক সপ্তাহের ছুটি। তাই তিনি দুটোকে ঘুরতে পাঠাতে চান। সাজেক, নীলগিরি হয়ে সেইন্ট মার্টিন। এজেন্সির সাথে কথা বলা শেষ। এখন দুজনকে রাজী করানোর পালা।

রাত ১০টা,
দরজায় কড়া নাড়ে শান্ত। সাথে নবনীতাও আছে। হেনা বেগম তখন ঔষধের ডিব্বা থেকে রাতের খাওয়ার আগের ঔষধ খুজছেন। কড়া নাড়ার শব্দে তিনি ডিব্বা রেখে উত্তর দেন,
“আসো”
“মা, তুমি ডেকেছিলেন?”
“হ্যা, বসো।“

শান্ত এবং নবনীতা সামনে এগিয়ে বিছানায় বসে। হেনা বেগম ভনিতা ছাড়াই বলেন,
“অফিস থেকে সপ্তাহ খানেক ছুটি নিতে হবে শান্ত”
“হঠাৎ ছুটি?”
“হানিমুনে যাবে, ছুটি ছাড়া কিভাবে হবে?”
“কার হানিমুন?”

শান্তের অবান্তর প্রশ্নে চোখ কুচকে তাকান হেনা বেগম। শান্ত শুকনো ঢোক গিলে বলে,
“মা, মাত্র তো বিয়ে হল। এমনেই এক সপ্তাহ গেছে বন্ধ। আর ছুটি নিলে আমার ব্যাবসা লাটে উঠবে।“
“আমাকে ব্যাবসা শিখিও না শান্ত। তোমার মতো দশজনকে কেনার মতো জ্ঞান আছে। ব্যাবসা ব্যাবসার জায়গায় থাকে, পরিবার পরিবারের জায়গায়। আমি চাই তোমরা একটু নিজেদের মধ্যে সময় কাটাও। বিয়েটা তো আর পাঁচটা বিয়ের মতো হয় নি।“
“কিন্তু মা…”
“আমি তোমাকে যা বলছি করো, আমি অযথা কথা বলবো না।“

হেনা বেগম ধমকের সুরে কথাটা বলে। শান্ত তখন কথা আগানোর সাহস পায় না। কিন্তু সে জানে সে এখন যেতে পারবে না। খুব কষ্টে সেদিনের ফুটেজগুলো যোগাড় করার একটা উপায় পেয়েছে শান্ত। শান্ত সেদিনের যা ফুটেজ ছিলো সেখানে নবনীতার উপস্থিতি ছিলো, সেই সকল ফুটেজ তার এসিসটেন্টকে দিয়ে জোগাড় করাচ্ছে। বেচারার অবস্থা নাজেহাল। শুধু শান্তের ভয়ে কাজটা করছে সে। এখন ঢাকা ছেড়ে যাবার পক্ষপাতী নয় শান্ত। কিন্তু হেনা বেগমের কথার অমান্য ও করতে পারছে। শান্তের মুখটা চুপসে যাওয়ায় নবনীতা বাধ সাদে,
“মা, আমার তো ভার্সিটি খোলা। আমি কিভাবে যাবো?”
“সেমেস্টার ব্রেক শুরু হচ্ছে পরশু থেকে, আমি সেটা জানি নবনীতা।“

হেনা বেগমের বুদ্ধির সামনে সবাই কচি খোকা। নবনীতার মিথ্যে ধরা পড়ে যাওয়ায় বেশ লজ্জায় পড়ে গেলো সে। বাধ্য হয়ে দুজন ই মাথা নত করে মেনে নিলো হেনা বেগমের আদেশ।

রুমে যেয়েই বারান্দায় গেলো শান্ত। তার মেজাজ অতি খারাপ, এখন সিগারেট খেতে হবে। এই ক দিনে এই ব্যাপারটার সাথে পরিচিত নবনীতা। ঠিক সেই সময়ে স্নেহার আগমণ ঘটে। তার হিটলার চাচী বেড়াতে যাচ্ছে, এতে তার ভীষণ আনন্দ। এই সাতদিন তার কোনো পড়াশোনা নেই। তাই খুশি মনেই চাচীর রুমে ঢুকে সে। স্নেহাকে দেখেই নবনীতা বলে,
“স্নেহা, এখানে বসো। তোমার এই সাতদিনের হোম ওয়ার্ক বুঝিয়ে দেই।“

নবনীতার এমন কথা শুনেই মুখটা কালো হয়ে যায় স্নেহার। বেচারীর আনন্দে খুব নিখুঁতভাবে পানি ঢেলে দেয় নবনীতা। তাই আষাঢ়ের কালো মুখ নিয়েই পড়তে বসে সে।

বারান্দায় একের পর এক সিগারেট পুড়াচ্ছে শান্ত। এই ঘুরতে যাওয়া নামক খড়াটা তার মা গলায় ঝুলিয়ে তাকে মুসিবতে ফেলে দিয়েছে। কি করবে সে ঘুরতে যেয়ে? সারাটা দিন দুজন কি মোবাইলে ঢুবে থাকবে? নবনীতা এবং সে কথা বললেই ঝগড়া হয়। সেখানে সাতটা দিন চব্বিশ ঘন্টা তার সাথে থাকাটা নিতান্ত কষ্টের কাজ। শান্ত আগামী সাত দিনের কথা চিন্তা করছে এবং সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। এর মধ্যেই তার মোবাইলটা টুং করে বেজে উঠে। লক খুলতে তার এসিসটেন্ট আবিদের মেইল। মেইল এসেছে দেখেই বুকটা ধক করে উঠে শান্ত এর। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে মেইলটা ওপেন করে সে। মেইল ওপেন করতেই………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here