মেঘের অন্তরালে
পর্বঃ ১০
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
নিহান স্তব্ধ হয়ে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত ইসরার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো। পকেট থেকে নিজের রুমাল বের করে কাটা জায়গাটা শক্ত করে বেঁধে দিলো। ইসরার বাবা তখনো মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিহান কিছু না ভেবে দ্রুত ইসরাকে কোলে তোলে বের হয়ে গেলে ইসরার বাবাও পেছনে ছুটে যায়। নিহান বাসায় আসার সময় নিজের বাবার গাড়িটা নিয়ে এসেছিলো। ইসরাকে পেছনের সীটে শুইয়ে দিলে ইসরার বাবা ভেতরে গিয়ে ইসরার মাথাটা কোলে নিয়ে বসলো। নিহান দ্রুত ড্রাইভিং সীটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
ইসরার বাবা বিড়বিড় করে বলছে, আমি খুন করেছি আমার মেয়েকে। আমার জন্য আজ, আমার মেয়ের এমন অবস্থা। আমি খুন করেছি আমার মেয়েকে।
হসপিটালে পৌঁছালে নিহান পুনরায় ইসরাকে কোলে তুলে নিলো। ইসরার বাবা শুধু পুতুলের মতো নিহানের পেছনে যাচ্ছে। সে এখন নিজের মধ্যে নেই।
ইসরাকে ইমারজেন্সি কেবিনে নেওয়া হয়। নিহানের সাদা রুমালটা রক্তে ভিজে গেছে। রুমালের উপর দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পরছে। নিহান আর ইসরার বাবা দু’জনেই ক্লান্ত হয়ে সারিবাঁধা চেয়ারে বসে পড়লো।
ইখতিয়ার আহমেদ এখনো বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে, আমি খুন করেছি আমার মেয়েকে। আমি নিজের হাতে নিজের মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দিয়েছি।
নিহান দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। মেয়েটা এমন একটা স্টেপ নেবে সে ভাবতে পারেনি। যদি ইখতিয়ার আহমেদ না যেতেন তাহলে কী হতো ভাবতেই নিহানের কলিজা কেঁপে উঠছে। নিহান অফিসে চলে যেতো আর ইসরা সারাদিন ওভাবেই পড়ে থাকতো আর একটা সময় হয়তো নিঃশব্দে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতো। পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠলে নিহান বের করে দেখে অফিস থেকে কল দিয়েছে। নিহান উঠে একটু দূরে গিয়ে রিসিভ করলো।
স্যার আমি মিটিংয়ে আসতে পারছি না।
নিহান তুমি এখন এটা কী বলছো ? পুরো প্রজেক্ট তুমি দেখেছো আর তুমি সবচেয়ে ভালো জানো। এখন শেষ মুহূর্তে এসে না করলে আমি বিপদে পরে যাবো।
স্যার আমার খুব কাছের একজন হসপিটালে, অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আমি এখন কোথাও যেতে পারবো না।
ঠিক আছে তুমি শুধু মিটিংটা করেই চলে যেও। ক্লাইট অলরেডি চলে এসেছে। বেশি সময় লাগবে না, তুমি আমাকে বিপদে ফেলো না প্লিজ।
নিহান একটু ভেবে বললো, ওকে স্যার আমি আসছি।
নিহান একবার ইখতিয়ার আহমেদের দিকে তাকিয়ে বের হয়ে গেলো হসপিটাল থেকে। সে জানে না তার যাওয়া উচিত হচ্ছে কিনা তবু যাচ্ছে। আজ মিটিংয়ে না গেলে কোম্পানির অনেক বড় লস হয়ে যাবে। কোম্পানির লস হলে মালিক নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে দিবে না। এদিকে ইসরার কিছু হলে ইসরার বাবা তাকে কী করবে সেটাও তার জানা নেই। নিহান নিজের চারদিকে অন্ধকার দেখছে। বাসায় গিয়ে মিটিংয়ের ফাইল নিয়ে দ্রুত অফিসে চলে গেলো।
এদিকে নার্স বের হয়ে বললো, রোগীর সাথে কে আছেন ?
ইখতিয়ার আহমেদ মাথা নিচু করে কাঁদছিলেন। নার্সের কথায় উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত গলায় বললো, কী হয়েছে আমার মেয়ের ?
রোগীর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে গেছে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত রক্ত নেই। যা আছে তাতে হবে না আরো লাগবে।আপনি তাড়াতাড়ি রক্তের ব্যবস্থা করুন।
আমার আর ইসরার রক্তের গ্রুপ একই। যত রক্ত লাগে আমার থেকে নিন। শুধু আমার মেয়েকে ঠিক করে দিন।
ঠিক আছে আসুন আমার সাথে।
ইখতিয়ার আহমেদ নার্সের সাথে যাওয়ার আগে কল করে পারভীন বেগমকে সংক্ষেপে যতটা পারলেন বলে দিলেন। যত তাড়াতাড়ি পারে হসপিটালে আসতে বললেন। ইখতিয়ার আহমেদ রক্ত দিতে চলে গেলো। পারভীন বেগম কী করবে বুঝতে পারছে না ? এমন খবর পেয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। ইমন কাছেই ছিলো সে ফোনটা নিয়ে হুরকে কল দিলো। হুর সব জানা মাত্রই ইসরার বাড়ি গিয়ে পারভীন বেগম আর ইমনকে নিয়ে হসপিটালে চলে গেলো। হসপিটালে যাওয়ার বেশ অনেক সময় পর ইখতিয়ার আহমেদ আসলেন। রক্ত দিয়ে তাকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। পারভীন বেগম আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না। সবাই চুপচাপ বসে আছে কেবিনের বাইরে, ইসরার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। নিহান কোনোরকমে মিটিং শেষ করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো। মিটিংয়ে একদমই মনোযোগ দিতে পারছিলো না, বস সবটা সামলে নিয়েছে। নিহানকে সবার আগে ইমনের চোখেই পড়লো।
ইমন দৌড়ে গিয়ে নিহানকে মারতে লাগলো আর বলছে, তুমি আমার আপুকে মেরে ফেলেছো ? কেনো মেরেছো আমার আপুকে ? আমার আপু কতো ভালো তুমি কেনো মেরেছো আমার আপুকে ? আমিও তোমাকে মেরে ফেলবো, তোমার মতো বাজে ভাইয়া চাই না আমার।
নিহান ইমনের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে ইমনকে বাধাও দিচ্ছে না। আজ ইমন বড় থাকলে হয়তো নিহানকে এতো সহজে ছেড়ে দিতো না। হুর গিয়ে ইমনকে ছাড়িয়ে নিলো।
কঠিন গলায় বললো, কেনো এসেছেন এখানে ? এখনো বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে সেটা জানতে ?
হঠাৎ ডক্টর বের হলে ইখতিয়ার আহমেদ তার সামনে গিয়ে দাড়ায় আর ভেজা গলায় বলে, আমার মেয়ে কেমন আছে ডক্টর ?
এখন বিপদমুক্ত, একটু আগেই জ্ঞান ফিরেছে। পেশেন্ট মানসিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। উনি রেসপন্স করতে চাইছিলেন না। তাই আমাদের এতো কষ্ট করে হলো। দেখুন সুইসাইড কেইস আমাদের পুলিশকে ইনফর্ম করতে হবে।
আমাদের কোনো অভিযোগ নেই কারো উপর। আমার মেয়ে বেঁচে আছে এটাই অনেক আমার জন্য। আমি চাই না এটা নিয়ে আর কোনো বাড়াবাড়ি হোক। আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি পুলিশকে জানাবেন না।
ডক্টর রাজি না হলে অনেক রিকুয়েষ্ট করার পর রাজি হয়।
আমরা ওর সাথে দেখা করতে পারি ?
পেশেন্ট কারো সাথে দেখা করতে চাইছে না।
ডক্টর চলে গেলে ইখতিয়ার আহমেদ নিহানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
ভেবেছিলাম আবার তোমার সামনে গেলে হাত জোর করে ক্ষমা চাইবো। কিন্তু এখন আর সেটা প্রয়োজন মনে হচ্ছে না। কারণ আমার করা অন্যায়ের খুব ভালো প্রতিশোধ নিয়েছো আমার মেয়ের উপর। আশা করি আর কোনো ক্ষোভ নেই আমার বা আমার মেয়ের উপর। আমি কথা দিচ্ছি আজকের পর আর কোনোদিন তুমি আমার মেয়ের মুখও দেখবে না। আমি নিজে চেষ্টা করবো যাতে ডিভোর্সটা তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। তোমার জন্য নয় নিজের মেয়ের জন্য। এখন তুমি আসতে পারো।
নিহান নিচু গলায় বললো, আঙ্কেল ?
ইখতিয়ার আহমেদ কিছু না বলে নিহানের সামনে হাত জোর করে চলে গেলেন। নিহান মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। হুর নিহানের সামনে গেলো।
সেদিন আপনার অফিসে গিয়েছিলাম ইশুর হয়ে সাফাই গাইতে নয়। ইশু নির্দোষ সেটা প্রমাণ করতে।
ইসরা নিজের ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বের করে নিহানের সামনে ধরলো।
নিহান প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালে হুর বলে, এটা বিয়ে ভাঙার জন্য আপনাকে পাঠিয়েছিলো ইশু। দূর্ভাগ্য সেটা ফুপার হাতে পরে যায়।
বিয়ের আগে হাজারবার ইশু চেষ্টা করেছিলো বিয়েটা ভাঙার। হাজারবার আপনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলো। ফুপার জন্য ওর সব দিকের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। যেটুকু সুযোগ ছিলো সব চেষ্টা করেছে।
নিহান চিঠিটা নিয়ে বললো, আমি একবার দেখা করতে চাই ওর সাথে।
সেটা আর সম্ভব নয় মিস্টার নিহান রেজওয়ান। অনেক উপকার করেছেন, ওকে হসপিটালে আনতে সাহায্য করে। এখন আপনি আসতে পারেন।
ইমন আবার রেগে নিহানের দিকে তেড়ে গেলে হুর ইমনকে টেনে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো।
উপরের সাদা ছাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে ইসরা। একহাতে স্যালইনের ক্যানেলা আর অন্যহাতে রক্তের। মুখটা কেমন ফ্যাকাসে লাগছে তার। ইসরা মনে করার চেষ্টা করলো ইখতিয়ার আহমেদকে কল দেওয়ার পর সে কী কী করেছিলো। কল কেটে দেওয়ার পর ইসরার নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছিলো। নিজের মাথার চুল টেনে কান্না করেছিলো চিৎকার করে।
হঠাৎই মনে হলো, বাবা কেনো আমাকে নিতে আসবে ? সে আসবে না আমাকে নিতে। আজ শুধু তার জন্য আমাকে এতো এতো অপমান মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে। আমি তো তার বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম তাই এভাবে তাড়িয়ে দিয়েছে। না না আমি আবার তাদের বোঝা হতে পারবো না। এর থেকে ভালো হবে এতো দূরে চলে যাবো যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না। সেখানে আমি কারো এতো সমস্যার কারণ হবো না। আমাকে এতো অপমান সহ্য করতে হবে না।
ইসরা আনমনে এসব বলে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজতে থাকে। সাইড টেবিলে আপেলের সাথে রাখা ফল কাঁটার ছুরি তার কাজটা একদমই সহজ করে দিয়েছে। বামহাতের উপর বসিয়ে একটা টান ব্যস এটুকুই।
ইসরা,,,,
কারো ডাকে ঘাড় কাত করে তাকাতেই নিজের গর্ভধারিনী মাকে দেখে চোখের শুকনো জলের ধারা আবার ভিজে উঠে।
একবার আমার কথা ভাবলি না ? একবার মনে হলো না আমার মা, যে আমাকে জন্ম দিয়েছে সে আমার লাশ কীভাবে সহ্য করবে ? একবার আমার মুখটা ভেসে উঠলো না তোর চোখে। আমি কী অন্যায় করেছি ? আমাকে কেনো এতোবড় শাস্তি দিচ্ছিলি ?
মায়ের কথায় ইসরা কেঁদে উঠে বলে, আমাকে মাফ করে দাও মা। আমি আর কখনো এমন ভুল করবো না।
পারভীন বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে আর ইসরাও মাকে জড়িয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।
ইমন কোথা থেকে দৌড়ে এসে বললো, আপু আমি আর কোথাও যেতে দিবো না তোকে। ঐ বাজে ভাইয়াটার সাথে তো একদমই না। তুই আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাবি না কথা দে।
ইসরা ছোট ভাইটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। বড় ভাই হলে হয়তো কিছু করতে পারতো বোনের জন্য। ইখতিয়ার আহমেদ এতোক্ষণ কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো।
মাথা নিচু করে ঢুকে বলে, তুই হয়তো কোনোদিনই তোর পাপী বাবাকে মাফ করতে পারবি না। বিশ্বাস কর মা আমি তোর ভালোর জন্য এসব করেছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি আমার ভালো চাওয়া আমার সন্তানের জীবনে কাল হয়ে আসবে, তবে আর ভুল করবো না আমি। এই সমাজ যা ইচ্ছা বলুক আর করুক আমি তোর পাশে আছি। এবার থেকে যা হবে সব তোর ইচ্ছেতে হবে।
১৮.
হসপিটালের সামনের খোলা জায়গায় একটা বেঞ্চে বসে আছে নিহান। আজ সবকিছু বিষাক্ত লাগছে তার কাছে। নিজের কাজের জন্য প্রচন্ড অনুশোচনা হচ্ছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই আজ। সব তার হাতের বাইরে চলে গেছে। হুরের দেওয়া চিঠিটা এখনো হাতে। খুব বেশি কিছু নয় মাত্র কয়েক লাইনের একটা চিঠি আবার চিরকুটও বলা চলে।
আমি আনজুম ইসরা, যার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তবে সে নই আপনি যাকে দেখেছেন। আপনি যাকে দেখেছেন সে আমার মামাতো বোন হুর ছিলো। এটা আমার বাবার ভয়ংকর পরিকল্পনা। হুরের মতো সুন্দরী মেয়েকে দেখিয়ে নিজের কালো মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা। আপনার ভালোর জন্য বলছি আপনি বিয়েটা ভেঙে দিন। আমি হুরের মতো নই বরং তার বিপরীত। দয়া করে আপনি আমার বাবাকে বলবেন না এসব আমি আপনাকে জানিয়ে দিয়েছি। যত তাড়াতাড়ি পারেন বিয়েটা ভেঙে দিন, আল্লাহ হাফেজ।
আরো একটা মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে যাচ্ছিলে তুমি। পারবে তো নিজেকে ক্ষমা করতে।
কারো কথায় হকচকিয়ে তাকায় নিহান। পাশেই ছেঁড়া আর ময়লা পোশাকে এক পাগল বসে আছে। অন্যসময় হলে হয়তো নিহান ঘৃণায় মুখ কুঁচকে নিতো। কিন্তু পাগলের বলা কথায় সে বিস্মিত। আরো একটা মৃত্যুর দায় মানে কী ?
পাগলটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, বুঝতে পারছো না আমার কথা ? আমাকে চিনতে পেরেছো ? জানি চিনতে পারোনি। মোহিনীকে মনে আছে তোমার, নাকি তাকেও ভুলে গেছো ?
নিহান নিজের অতীত খুঁজে মোহিনী নামের কাউকে পেলো না।
কপাল কুঁচকে বললো, আপনি কোন মোহিনীর কথা বলছেন ?
আজ থেকে সাত বছর আগে তোমার জন্য কেউ আত্মহত্যা করেছিলো আর তুমি এতো তাড়াতাড়ি তাকে ভুলে গেলে।
কথাটা কানে যেতেই নিহানের গায়ের লোম কাটা দিয়ে উঠলো। হ্যাঁ মনে পরে গেছে নিহানের। আজ থেকে সাত বছর আগে তারই জন্য তার ভার্সিটির এক হিন্দু মেয়ে আত্নহত্যা করেছিলো। প্রত্যক্ষভাবে সে দায়ী না হলেও পরোক্ষভাবে সম্পূর্ণ সেই দায়ী।
নিহান ভয়ে ভয়ে বললো, আপনি ?
চিনতে পেরেছো তাহলে ? হ্যাঁ আমি সেই হতভাগী মোহিনীর বাবা। সেদিন তোমাকে আমি একটা ডাইরি দিয়েছিলাম। তুমি হয়তো পড়োনি, যদি পড়তে তাহলে আজ এই হসপিটালের সামনে বসে থাকতে না, সাথে তোমার জন্য আর কোনো মেয়েও মৃত্যুকে আপন করার কথা ভাবতো না। তোমার ভেতরের কুৎসিত মনটা মরে যেতো সেই ডায়রি পড়লে।
নিহান ফট করে উঠে দাঁড়ালো আর নিজের গাড়ির দিকে যেতে লাগলো। লোকটা পেছন থেকে হাসতে হাসতে বললো, চোখের পানির মূল্য তোমাকে দিতে হবে। নিজের কর্মের ফল থেকে কেউ পালাতে পারে না। তুমিও পারবে না, কখনো না।
নিহান গাড়ি নিয়ে বাসার দিকে গেলো, বাসায় পৌঁছে নিজের রুমে পাগলের মতো ডাইরিটা খুঁজতে লাগলো। মোহিনী মারা যাওয়ার পাঁচদিন পর ডাইরিটা মোহিনীর বাবা নিহানের কাছে পাঠিয়েছিলো নিহানের এক বন্ধুর হাতে। মোহিনীর আত্নহত্যা নিয়ে পুলিশ নিহানকে অনেক হয়রানি করেছিলো তাই রাগে ডাইরিটা ছুঁড়ে ফেলেছিলো রুমের এক কোণে। তারপর আর কখনো খোঁজ করেনি সেই ডায়রির। সাত বছর আগের ডাইরি এখন কী খুঁজলেই পাবে ? নিহান সারারুম তন্নতন্ন করে খুজেও ডাইরি পেলো না। এলোমেলো রুমের ফ্লোরে বসে পড়লো মাথায় হাত দিয়ে। হঠাৎ কী মনে করে নিজের মাকে ফোন দিলো।
মা আমার রুমে একটা ডাইরি পেয়েছিলে ?
নিহানের মা তাড়াহুড়োয় বললো, তুই আবার ডাইরি লিখতে শুরু করলি কবে থেকে ?
মা আজ থেকে সাত বছর আগে তুমি আমার রুমে কোনো ডাইরি পেয়েছিলে ?
নিহানের কথা শুনে নিহানের মা একদম চুপ হয়ে গেলো। নিহান বারবার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
নিহানের মা গম্ভীর গলায় বললো, সেদিন বলেছিলাম অতীত হাঁতড়ে দেখ নিজের কোনো অন্যায় খোঁজে পাস কিনা। নিজের অন্যায় নিজের চোখে সহজে পরে না রে নিহান। দেখ তুই নিজেই নিজের করা অন্যায় খুঁজে পেতে সাতটা বছর সময় লাগিয়ে দিলি।
ডাইরিটা কোথায় মা ?
প্রতিদিনের মতো সেদিনও তোর রুম পরিষ্কার করতে গিয়েছিলাম। তোর ডাইরি লেখার অভ্যাস নেই, তাই তোর রুমে ডাইরি দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। কৌতূহলের বশেই ডাইরিটা নিয়ে পড়েছিলাম। সেদিন মনে হয়েছিলো তোর মতো ছেলেকে জন্ম দিয়ে পাপ করেছি আমি। নিজের উপর প্রচন্ড ঘৃণা হয়েছিলো। চোখ দুটোর বৃষ্টি সেদিন থামতেই চায়নি।
মা, ডাইরিটা কোথায় আছে ?
আমার আলমারির একদম নিচের তাকে, জুয়েলারি বক্সের নিচে। আলমারির চাবি ড্রয়ারে আছে।
এতোটুকু বলেই ফোন কেটে দিলো নিহানের মা। যে ছেলেকে নিয়ে সবসময় গর্ব হতো সেই ছেলেকে নিয়ে আজ সাত বছর ধরে লজ্জা হয় নিহানের মায়ের। তিনি নিজেই চান ইসরা চলে যাক নিহানের জীবন থেকে। কারণ নিহানের মতো মানুষ ইসরার মতো মেয়েকে নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে ডিজার্ভ করে না।
চলবে,,,