তুমিই_আমার_প্রিয়_নেশা
পর্ব:17
Suraiya_Aayat
কিছুখন পরপর নূর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে ,নূরের জীবনটা সেই চার দেওয়ালে বন্দী ঘরটাতে থেমে থাকলেও দেওয়ালে আটকানো ঘড়িটাতে সময়ের কাটাগুলো থেমে নেই, সময় বহমান তা কখনো করোর জন্য থেমে থাকে না ৷ নূর কিছুখন অন্তর অন্তর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর সময়ের ঢেউ কাটিয়ে চলেছে ৷ আয়াশ বেরিয়েছে অনেক সকালে আর এখন সকাল 10 টা বাজতে চলল , মাঝে 2 থেকে 3 ঘন্টা কেটে গেছে আয়াশের ফেরার নাম নেই ৷ নূর একটা শুকনো ঢোক গিলল, ওর গলা ধরে আসছে, ঢোক গিলতে গেলেও গলায় ব্যাথা অনুভব করছে , কষ্টটা ধীরে ধীরে ওর মনকে আয়ত্ব করে নিচ্ছে ক্রমাগত ,চোখের কোনে জলরাশির ভিড় তা চোখের পাতার ওঠা নামাতেই গড়িয়ে পড়ার জন্য যথেষ্ট ৷ নুর কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা ধরলো ৷ আয়াশকে ফোন করবে ভাবছে , এতখন কেবল অপেক্ষা করেছে , কিন্তু কল করেনি ৷ মনের মাঝে থাকা হাজারো দোটানার সীমারেখা পার করে নূর কল করলো ৷ ফোনটা লাউডে দিয়ে রেখেছে , কানে ধরবার ক্ষমতা পাচ্ছে না , যদি পাছে হাত থেকে পড়ে যায় ফোনটা তাই ৷ বেশ কয়েকবার রিঙ হয়ে কলটা কেটে গেল, ওপাশ থেকে কোন রেসপন্স এলো না দেখে নূর ফোনটা ওর পাশে ছুড়ে ফেলল ৷ কান্না পাচ্ছে খুব ৷ কিছুখন থমথমে মুখে সামনের দিকে চেয়ে থাকার পর ঠোঁট উল্টে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল ৷ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে আর বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে কান্না করছে নূর ৷ কিছুখন কান্না করে ধীরে ধীরে হাতের ওপর ভর রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লো ৷ মনে মনে ভাবতে লাগলো যে একমাত্র অসুস্থ থাকলেই সবার কাছে নিজের গুরুত্ব বোঝা যাই ৷ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আর কান্নার রেশে মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে নূর ৷ কিছু সময় পর কখন যে দু চোখ জুড়ে ঘুম চলে এলো তা নূর জানেনা ৷
বেশ কিছুখন পর ইফার গলার আওয়াজে ঘুম ভাঙলো
” ভাবী ও ভাবী , ওঠো তোমার জন্য নাস্তা এনেছি খেয়ে ঔষুধ খেয়ে নাও ৷”
নূর ঘুমে ভার চোখ নিয়ে ইফার দিকে তাকালো, মেয়েটা অনেক সতেজতা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে হাতে আছে একটা ট্রে ৷ নূর ধীরে ধীরে ওঠার চেষ্টা করতে গেলেই ইফা হাতের ট্রে টা টেবিলের ওপর রেখে নূরকে উঠে বসতে সাহায্য করতে নিলেই নূর আধো আধো গলায় বলল
” ইফা তুমি !”
ইফা নূরের পাশে বসে বলল
” আই এম সরি ভাবী আমি জানতাম না যে ভাইয়া বাসাতে নেই, যদি জানতাম তাহলে তোমাকে একা থাকতে দিতাম না , ভাইয়া একটু আগে ফোন করে না বললে তো জানতেই পারতাম না ৷
নূর চোখের ওপর হাত রেখে চোখটা হাত দিয়ে ঢলা দিয়ে ঘুমের রেশটা কাটিয়ে বলল
” উনি তোমাকে ফোন করেছিলেন ?”
ইফা খাবারের ট্রে টা নূরের পাশে রেখে বলল
” জ্বী ভাবী ৷ ভাইয়াই তো বললো তার বাসায় ফিরতে দেরি হবে তাই আমি যেন তোমাকে খাইয়ে দিই ৷ ”
কথাটা শুনে নূরের বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো, আয়াশ ইফাকে কল করেছিলো কিন্তু ওকে কলব্যাক করার সুযোগ পাইনি ৷ আভিমানের মেঘটা কষ্টের কালো পাহাড়টার গা ঘেঁষে ছুয়ে যাচ্ছে , বুঝতে পারছে না এখন ওর কিরকম ব্যাবহার করা উচিত ৷ নূর চুপ করে আছে দেখে ইফা বলল
” আমি বুজেছি তুমি ভাইয়ার ওপর রেগে আছো তাইনা ? রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক তোমার এই সময়ে তার তোমার পাশে থাকা উচিত কিন্তু ভাইয়া খুব ব্যাস্ত না হলে কখনো এমনটা করতো না ৷”
নূর মিথ্যা ইফাকে উদ্দেশ্য করে ওর মুখে একটা মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলল ৷
” আমি কিছু মনে করিনি ইফা , উনি সত্যিই অনেক ব্যাস্ত মানুষ, আমি ব্যাতিত ওনার জীবনটা যে অনেকটা প্রশস্থ আর সুন্দর তা আমি বুঝি ৷” একরাশ অভিমানের সুরে কথাটা বলল নূর কিন্তু নূরের এমন ঘোরালো প্যাচালো কথার অর্থ বোঝার ক্ষমতা ইফার নেই তাই ও কিছু বুঝলো না তাই একটু অবাকের সহিত বলল
” ভাবী কি বললে আর একবার বলবে ঠিক বুঝলাম না ৷”
নূর ইফার গালে হাত রেখে আগের তুলনায় মুখের হাসিটা আরো বেশি প্রশস্থ করে কথা ঘোরানোর জন্য বলল
“তুমি নাস্তা করেছো ইফা ?”
ইফাও নুরের দিকে মুচকি হেসে বলল
” হমম করেছি ভাবি , তুমি অনেকখন না খেয়ে আছো জানি তোমার অনেক ক্ষিদে পেয়েছে তাই আর কোন কথা না তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও ৷”
নূর ট্রে টা হতে নিয়ে বলল
” আমার সাথে তুমিও খাবে কোন কথা শুনবো না ৷”
ইফা চোখ মুখ কুচকে বলল
” নাহ ভাবী আমি খাবো না, তুমি খাও আমার খিদে নেই ৷”
নূর পরোটাটা ছিড়তে গিয়ে হাতে অল্প ব্যাথা পেলো, চুখ মুখ কুচকে ফেলল ব্যথায় তবুও ইফাকে খুব একটুও বুঝতে দিলো না, কিন্তু ইফা নূরের ব্যাথার আভাস পেয়ে নূরের কাছ থেকে ট্রে টা নিয়ে পরোটা ছিড়ে নূরের মুখের সামনে ধরে বলল
” নাও ভাবী হা করো ৷ ”
ইফার এমন কাজে নূরের চোখে জল চলে এলো ৷ ওর মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে খুব , ছোটবেলায় যখন ও খেতে চাইতো না তখন ওর আম্মু ওকে কতো রূপকথার গল্প বলতো আর ওকে ভুলিয়ে ঠিক পুরোটা খাবার খাইয়ে দিতো ৷
ইফা নূরের দিকে তাকিয়ে বলল
” ভাবী তুমি কাঁদছো কেনো ? আমি কি তোমাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলে ফেললাম ?”
নূর ইফার মাথায় হাত রেখে বলল
” তোমরা এত ভালো কেন বলতে পারো ?”
ইফা মুচকি হেসে বলল
” ভাবী তুমিও না, আসলে আমরা তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি, তাই তোমাকে সবসময় হাসি খুশি দেখতে চাই , তুমি অন্যের বাড়ির মেয়ে বলে আমরা কি তোমাকে অবহেলা করবো বলো ?একদিন তো আমাকেও অন্য বাড়িতে যেতে হবে , তাই আমারা যদি এখন থেকেই নিজেদের মন মানসিকতা বদলাতে পারি তাহলে অন্যদের ধারনাও পাল্টাতে পারবো ৷”
নূর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো , বিয়ের প্রথম দিন যেদিন ও এই বাড়িতে পা রেখেছিলো সেদিন এই বাড়িটা আর বাড়ির মানুষগুলোকে কতোটা কঠিন আর নিষ্ঠুর বলে মনো হতো নূরের কাছে কিন্তু আজ এই মানুষ গুলোকে ও হারাতে চাইনা কোনভাবেই ৷
ইফা বলে উঠলো
” আরে ভাবী কেঁদোনা আজকে তো তোমার খুশি হওয়ার কথা কারন আজ তো তোমার বাসার লোক আসবে তোমাকে দেখতে ৷”
নূর ওর হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মুছে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ইফার দিকে তাকিয়ে বলল
” তোমাকে কে বলল?”
ইফা মুচকি হেসে বলল
” আরে ভাবী আজকে ভোরেই তো আহান ভাইয়া বলে গেলেন যে তোমার বাসা থেকে তোমাকে দেখতে লোকজন আসে তাই তাদের যেন ভালো করে খাতির আপ্যায়ন করা হয় ৷”
নূর জল খেয়ে বলল
” বলে গেলেন মানে ? উনিই মানে আহান ভাইয়াই কি আমার বাসাতে আমার অসুস্থতার কথা বলেছেন?”
ইফা পরোটা নূরের মুখের সামনে ধরে বলল
” হমম, আহান ভাইয়াই তো তোমার ভাইয়াকে ফোন করে বলেছে আর তারা জানিয়েছে যে তারা তোমাকে আজকে দেখতে আসবে ৷ আর আহান ভাইয়া তো আজকে সকালে ইউকে চলে গেছে কবে ফিরবে বলে যাইনি , বলেছে সময় হলে ফিরে আসবে ৷”
নূর এতসব এক সাথে শুনে অবাক না হয়ে পারলো না, আহানের জন্য একটু খারাপ ও লাগছে কারন নূর ভাবছে আহান হয়তো নূরের কড়া কথা শুনে চলে গেছে, এদিকে আহানের প্রতি রাগ ও হচ্ছে কারন আহানের জন্য নূরের ভাইয়া আয়াশকে কথা শুনিয়েছে তাই সকাল থেকে আয়াশের মনটা কেমন হয়ে গেছে ৷ ইফা আর একটু খাওয়াতে গেলে নূর বলে উঠলো
” ইফা আমি আর খেতে পারছি না গো, এর বেশি আর আমার পেটে ঢুকবে না, প্লিজ আর জোর করোনা ৷”
ইফা নূরের দিকে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
” আচ্ছা ভাবী তাহলে একটু পর আমি আবার আসবো তোমাকে গোসল করিয়ে দিতে ৷ ততখন তোমার খুব বোর লাগলে তুমি টিভি দেখো ৷”
কথাটা বলে নূর টিভি চালিয়ে দিয়ে চলে গেল ৷
নূর বিছানায় মাথা হেলান দিয়ে আছে, আর কতখন একটা মানুষ বিছানায় শুয়ে বসে থাকতে পারে ! নূর ভাবলো ওয়াশরুম যাবে কিন্তু সকালের মতো তো আর আয়াশ নেই তাই ও নিজেই যাবে বলে বিছানা থেকে নামলো,প্রথমবার পড়ে যেতে নিলেও নিজেকে সামলে নিলো ৷ তারপর গুটিগুটি পায়ে ধীরে ধীরে জানালার কাছে গেল , জানালার গ্রিল ধরে হাটতে গেলেই বাইরের দিকে চোখ গেল ৷ আয়াশের খালাম্মু উনি হাতে একটা ট্রেতে করে বেশ কিছু খাবার নিয়ে বাসার পিছনের রাস্তা দিয়ে হেটে কোথাও যাচ্ছেন, নূর প্রথমে ভাবলো এটা হয়তো ওর চোখের ভ্রম তাই আরো ভালো করে দেখলো,হ্যাঁ উনিই হাতে একজনের নাস্তা নিয়ে যাচ্ছেন ৷ হঠাৎ উনি দ্রুত যেন কোথাও মিলিয়ে গেলেন নূর বুঝতে পারলো না, উনি কোথায় গেলেন নূর বুঝলো না ৷ দারোয়ান বা কাজের বুয়াকে তো উনি কখনো খাবার দিতে যান না তাহলে উনি কোথায় গেলেন , তাও আবার এমন রাস্তায় গেলেন যেখানে নূর কখনো যাইনি এবং এ বাসার মানুষজন সেদিকে যাই বলে নূর জানতো না ৷ নূর তবুও বেশি কিছুখন দাঁড়িয়ে রইলো যদি ওনাকে ফিরতে দেখেন, কিন্তু বেশ কিছুখন হলো উনি ফিরছেন না দেখে নূর আর অপেক্ষা না করে ওয়াশরুম চলে গেল ৷
___
” বৌমা শোনো শাড়ি পরেছো ভালো কথা কিন্তু পা বেধে আবার পড়ে যেওনা, সাবধানে হাটবে, আয়াশ বাসায় থাকলে না হয় ও একাই তোমাকে কোলে করে সারা বাসা ঘোরাতো কিন্তু না জানি ছেলেটা কোথায় গেছে এখনো তো বাসায় ফিরলো না ৷ একটু পরই তোমার বাসার সবাই আসবে,রান্নাবান্নাও কমপ্লিট ,আমি শুধু এবার গোসলে যাবো ৷”
নূরের শাড়ির কুচিটা ঠিক করতে করতে বললেন আয়াশের খালাম্মু আফরোজা বেগম ৷
নূর কেবলই ওনার সকালের কথাটা ভাবছে , উনি কোথায় গিয়েছিলেন ঠিক ! আচ্ছা ওনাকে কি জিজ্ঞাসা করা উচিত? এরকম হাজারো কল্পনা জল্পনার রেশ কাটিয়ে নূর বলল
” আচ্ছা আন্টি আপনি সকালে বাসার পিছনের দিকে ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন?”
উনি যেন কথাটা শুনে প্রথমে একটু চমকালেন তারপর স্বাভাবিক ভাবেই বললেন
” কই বউমা কোথাও যাইনি তো, আমি তো সকালে নাস্তা বানানোর পর রান্না ঘরেই ছিলাম, তুমি হয়তো ভুল দেখেছো ৷”
ওনার বলা কথাটা শুনে নূর থেমে গেল, কিছু বলল না আর ৷ আসলেই উনি এতোটাই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বলেছেন যে তার ওপর সন্দেহের আঙুল তুললে নূর নিজেই হয়তো মিথ্যা বলেছে বলে প্রমানিত হবে, কিন্তু নূর ঠিক দেখেছে যে উনিই ছিলেন কিন্তু কথাটা উনি অস্বীকার করলেন ৷ নূর অবাক হলো একটা বিষয়ে, সাধারনত মানুষ মিথ্যা কথা বলতে গেলে তার কন্ঠস্বরে পরিবর্তন আসে, তার কন্ঠস্বর কাঁপে , শরীরের অঙ্গভঙ্গির পরিবর্তন হয় কিন্তু ওনার বেলায় তেমন কিছুই ছিলো না উনি বড্ড বেশিই স্বাভাবিক ছিলেন ,আর নূর একটা মিথ্যা কথা বলতে গেলেই ওর মাঝে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায় যাতে স্পষ্ট যে কেউ ধরে ফেরবে যে ও মিথ্যা কথা বলে ৷নূর আর কথা বাড়ালো না, চুপচাপ রইলো, ওর কথার মাঝে আফরোজা বেগম নূরের হাতে এক জোড়া চুড়ি পরিয়ে বললেন
” এটা তোমার শাশুড়ির , ওর অনেক ইচ্ছা ছিলো তোমাকে এগুলো নিজের হাতে পরাবে কিন্তু ওর ইচ্ছাটা পূরন হলো না , যাই হোক আমি তো আছি, কখনো নিজেকে একা মনে করবে না কেমন ! আর চিন্তা করো না আয়াশ ঠিক তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে ৷”
কথাটা বলে উনি চলে গেলেন ৷ ওনার যাওয়ার পানে নূর তাকিয়ে রইলো ৷ আসলেই ও অনেক ভাগ্যবতী যে ও এমন একটা পরিবারের বউ হয়ে এসেছে ৷
চলবে,,,,