আপনাকেই_চাই
পর্ব_০৬
Sumaiya_Moni
দিন যতো যাচ্ছে ইহিতার টর্চার,শাসনের পরিমাণও ভাড়ছে।বহু কষ্টে অহান ইহিতার টর্চার মুখ বুঁজে সহ্য করে নিচ্ছে। না চাইতেও অহানের ইহিতার সব কথা শুনতে হচ্ছে। প্রতিদিন সকালে ইহিতা অহানকে ফজরের নামাজ পড়তে উঠায়। যা অহানের কাছে সব চাইতে কষ্টকর বিষয় ছিল। তবুও,কথা তো শুনতেই হবে।আর কথায় কথায় গাল টেনে দেওয়া তো আছেই।এই কাজটায় অহান বেশি বিরক্ত ও রাগ হয়। এটা ছাড়াও ইহিতা অহানের ফোন থেকে মেয়েদের সব নাম্বার ডিলিট করে দেয়।
সময়,দিন,মাস কেঁটে যায়।
কেঁটে যায় পুরো পাঁচ মাস। এখন অহানের কাছে ইহিতার সব টর্চার গুলো মুখস্থ হয়ে গেছে। কখন কি বলতে তা অহান জানে। তারপরও সুযোগ পেলে অহান ত্যাড়ামি করতে পিছুপা হয় না। অহানের ত্যাড়ামি ঠিক করার জন্য ইহিতা তো আছেই! এক মেডিসিনই সোজা অহান।
ইহিতা অহানকে দিয়ে জামা ইস্ত্রি করাচ্ছে। ইহিতা দাঁড়িয়ে থেকে বলে দিচ্ছে কিভাবে জামা ইস্ত্রি করতে হয়। অহান ঠিক সেই ভাবেই ইস্ত্রি করছে।
-“ঠিক মতো করো,ভালো মতো ধরে নেও।” হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে ইহিতা।
-“করছি।”
-“হ্যাঁ,ঠিক মতো করো।”
কথা না বলে জোরে জোরে মেশিন দিয়ে জামা ঘষতে থাকে। রাগে অহান দাঁত কিড়মিড় করছে। ইহিতা অহানের কাছ থেকে চলে এসে, আরাম করে সোফায় বসে আঁচার খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর অহানের কাজ শেষ হয়। ইহিতা অহানকে বলে,
-“ফ্রিজে আইসক্রিম আছে,নিয়ে এসো।”
-“আপনি না আঁচার খাচ্ছেন?”
-“আইসক্রিমও খাব।”
-“খাদক কোথাকার!” মনে মনে বলে অহান।
-“যাবে,নাকি?”
“যাচ্ছি” বলেই অহান বিরক্তি নিয়ে ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করে ঠাস করে লাগিয়ে হনহনিয়ে ড্রইংরুমে আসে। আইসক্রিমের বাটি ধাপ করে রাখে টেবিলের উপর।
-“ভদ্রতা শিখো নাই।”
-” না শিখি নাই,তার চেয়ে বড় কিছু থাকলে আমি আছি।” বলেই অহান রুমে চলে আসে।
ইহিতা অহানের রাগ দেখে মৃদ হাসে। ফোনের রিংটোন বাজতে থাকে। ইহিতা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে হামিদা বানু কল দিয়েছে। ফোন নিয়ে রুমে চলে আসে।
হামিদা বানুর সাথে ইহিতার অনেকক্ষণ কথা হয়। ফোন কেঁটে দেওয়ার পর ইহিতা আইসক্রিমের বাটি ফ্রিজে রেখে গোসল করতে চলে যায়। অহান বাথটবে বসে একা একা নিজের সাথেই কথা বলছে।
-“জানি না কিভাবে ইহিতার কাছ থেকে মুক্তি পাবো। জীবনটা আমার অতিষ্ট,বরবাদ। আজকে ছুটিরদিনও শান্তি নেই। হুকুমজারি করে করেই মারবে আমায়।” রাগ নিয়ে গোসল সেরে বের হয় অহান।
ইহিতা গোসল সেরে নামাজ পড়তে বসে। অহান মসজিদে যায় নামাজ পড়তে। নামাজ শেষে বাসায় এসে টেবিলে খাবার সাজাতে থাকে। ইহিতা রুম থেকে বের হয়ে দেখে অহান খাবার বাড়ছে। ইহিতা খুশি হয়ে অহানের গাল টেনে খেতে বসে। দু’জনের খাওয়া শেষ হলে বিকেলের দিকে ঘুরতে বের হয়। রাতে বাসায় এসে জানতে পারে অহান ও রিফাতের আরেকটি ফ্রেন্ড এসেছে। আর সে মেয়ে। নাম আনিকা। আনিকা ওদের সাথেই চায়না পড়তে এসেছে। তবে ওদের সেকশনে ভিন্ন ছিল। আনিকা আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা করে। ওদের থেকে ভালো পজিশনে আছে আনিকা।
তিন বছর আগে আনিকার সাথে অহানের কোনো একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়। এর পর থেকেই আনিকা অহানের সাথে যোগাযোগ বিছিন্ন করে দেয়। রিফাতের সাথে ওর কথা হলেও। অহানের সাথে কথা হয় না। অহানও আনিকার সাথে কখনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনা। আজ এতদিন পর আনিকা দুই দিনের ছুটি নিয়ে ইহিতা ও রিফাতের সাথে দেখা করতে এসেছে। এবং এই দুইদিন রিফাতের ফ্ল্যাটেই থাকবে।
আনিকা ইহিতার সাথে দেখা করতে আসে। অহান আনিকাকে দেখেও ইগনোর করে বাসা থেকেই বেরিয়ে যায়। আনিকার এতে বেশ খারাপ লাগে। কারণ ভুলটা অহানেরি ছিল। ঝগড়া টা অহানেই করেছে।
-“ভাবি কিছু বুঝতেছো? অহান কি ভালো হবে?”
-“জানি না। তবে,আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।”
-“এতদিন পর অহানের সাথে দেখা হলো। তবুও,আমার সাথে কথা বলল না।” মন খারাপ করে বলে আনিকা।
ইহিতা আনিকার কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“কষ্ট পেও না। জানোই তো অহানের ইগো একটু বেশি। দেখবে একদিন অহান কথা বলার জন্য তোমাকে খুঁজবে।”
-“জানি না এটা সত্যি হবে কি না।”
-“আন্টির সাথে কথা বলো না?”
-“অহানের আম্মুর কথা বলছো?”
-“হ্যাঁ।”
-“বলি তো।”
-“আমি কয়দিন আগে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। তখন তার সাথে দেখা করে এসেছি।”
-“ওহ!”
-“আমার আব্বু,আম্মু বিয়ের কথা বলছে। কিন্তু আমি না করে দিয়েছি। তারপরও তারা ছেলে দেখছে।” কথাটা বলতে বলতে আনিকার চোখ থেকে পানি চলে আসে। কষ্ট! চাপা কষ্ট লুকিয়ে আছে আনিকার বুকে। ভালোবাসার কাঙ্গাল সে। ভালোবেসেও ভালোবাসার মানুষটিকে পাচ্ছে না। প্রতিনিয়তে ভেতর থেকে ভেঙে যাচ্ছে। ইহিতা আনিকার মাথাটা বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। আনিকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। এতক্ষণে কারো মাথা ঠেকিয়ে কাঁদার স্থান পেল। নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ইহিতাকে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। কান্না কন্ঠে বলে,
-“ভাবি সে কেন বুঝে না,আমি ওঁকে কতটা ভালোবাসি। ওঁকে বোঝার শক্তি কি আল্লাহ দিবে না!”
-“ইনশাআল্লাহ, দিবে। নিজেকে শক্ত করো আনিকা।” মাথায় হাত বুলিয়ে বলে।
রাতে খাওয়ার সময় ইহিতা আনিকার ব্যাপারে কথা বলতে নিলে রাগ দেখি অহান খাওয়া ছেড়ে উঠে রুমে চলে যায়। অহান চাইছে না আনিকার বিষয় কোনো কথা শুনতে। ইহিতা দোটানায় পড়ে যায়। একদিকে আনিকা,আরেকদিকে অহান। এতদিনের বন্ধুত্ব কি সব শেষ!
পরেরদিন….
লাঞ্চ টাইম।
অহান ওর কেবিনে বসে কিছু একটা ভাবছে। অফিসের বাকি কর্মচারীরা ক্যান্টিনে ছিল। হাতে থাকা কলম বার বার উপরে ছুড়ে দিচ্ছে আর ক্যাচ ধরছে। ভাবনায় এতটা মশগুল হওয়ায় লাঞ্চ করতেও যাচ্ছে না। অহান লাস্টের বার আর কলম ছুড়ে মারে না। হাতের মুঠোয় চেপে নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে।
ইহিতা আনিকাকে আজ ওদের বাসায় দুপুরের খাবার খেতে বলেছে। রিফাত অসিফে ছিল বিধায় ওঁকে বলতে পারেনি। সারাদিন আনিকার সাথে সময় পার করে ইহিতা। আনিকা খুবি মিশুক ও ফ্রেশ মাইন্ডের। বাহিরের গার্ডেনে গিয়েও অনেকক্ষণ হাঁটাচলা করে দু’জনে। খুব সুন্দর একটা সময় কাঁটায় তারা।
রাতে অহান বাসায় আসার আগেই আনিকা রিফাতের ফ্ল্যাটে চলে আসে।কারণ আনিকা অহানের ইগনোর মেনে নিতে পারছে না। অহান ঠিক দশটার দিকে বাসায় ফিরে। কলিং বেল বাজতেই ইহিতা দরজা খুলে দেয়। অহান মাথা নিচু করে ছিল। চোখ তুলে ইহিতার দিকে তাকাতেই মুচকি হাসে ইহিতা। কিন্তু অহান গম্ভীরমুখে ইহিতার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ ওঁর চেহায়া অন্যরকম দেখাচ্ছে। যেন মনে হচ্ছে কোনো অশরীর ভর করেছে শরীরে। ইহিতার হাসি মিলিয়ে যায় অহানের এমন গম্ভীরমুখ দেখে। একটু কাছে গিয়ে কপালে,গলায় হাত রেখে দেখে জ্বর এসেছে কি না।
কিন্তু শরীর ঠান্ডা ছিল। ইহিতার কেমন অদ্ভুত লাগছে অহানের চাহনি। নেশাও করেনি অহান। তবুও,এভাবে তাকিয়ে তাকার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না ইহিতা। গেট খোলা রেখেই ভেতরে চলে আসে । বলে,
-“ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি খাবার ভাড়ছি।”
অহান গম্ভীরমুখে দরজা ঠাস করে লাগিয়ে ইহিতার দিকে ঘুরে তাকায়। হাতের ব্যাগ নিচে ফেলে দেয়। ইহিতা কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে অহানের দিকে ঘুরে তাকায়। নিচে ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখে অহানের দিকে তাকায়। অহান একি ভাবে ইহিতার দিকে তাকিয়ে আছে। ইহিতা ভ্রু কুঁচকে বলে,
-“কি হয়েছে তোমার? তুমি এমন বিহেভ করছো কেন?”
-“এত দিন তো কিছু হয়নি। কিন্তু এখন হবে।” গম্ভীর কণ্ঠে বলে অহান এক পা ইহিতার দিকে বাড়ায়।
-“মানে? কি হবে?” ইহিতা সন্দেহ চোখে তাকিয়ে বলে।
-“আপনি আমার ওয়াইফ। আমি আপনার স্বামী। আমাদের তো ফাস্ট নাইট হয়নি। তো বলুন,কোন রুমে ফাস্ট নাইট করতে চান। আপনার রুমে,নাকি আমার রুমে?”
-“অহান! মুখ সামলে কথা বলো।” রেগে চিল্লিয়ে বলে ইহিতা।
-“কেন? স্ত্রীর অধিকার চাওয়া তো কোনো অপরাধ নয়। এটা তো আমার হক।” ইহিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে অহান।
ইহিতা পিছিয়ে গিয়ে রাগী কন্ঠে বলে,
-“কিসের অধিকার? কোনো অধিকার নেই তোমার। ওখানেই দাঁড়াও। নয়তো আমি আম্মুকে ফোন দেবো।”
-“দেন! আম্মুকে ফোন দেন। বলুন আমি আপনার কাছে অধিকার চেয়েছি। আরো যা বলতে মন চায় বলুন।” তাচ্ছিল্য স্বরে বলে অহান।
ইহিতা চুপ হয়ে যায়। আসলেই অহান তো ঠিকিই বলেছে। কিভাবে বলবে আম্মুকে? কিন্তু বলতে তো হবেই। ইহিতা ভয়ে ভয়ে পিছাতে থাকে। অহান ইহিতার দিকে আগাতে থাকে।
-“অহান ভালো হচ্ছে না কিন্তু। কাছে আসবে না একদম।” আঙ্গুল তুলে পিছিয়ে গিয়ে বলে।
অহান ইহিতার কথা শুনে না।
-“অহান স্টপ! অহান।” কাঁপা কন্ঠে বলে।
অহানের থামার কোনো গতি নেয়। ইহিতার দিকে এগিয়েই যাচ্ছে।
-“অহান থামো বলছি।অহান! “জোরে বলে।
তবুও,থামছে না অহান। ইহিতা দৌড়ে ওর রুমে যেতে নিলেই অহান ইহিতার হাত ধরে ফেলে। দেয়ালের সাথে মিশিয়ে ধরে ইহিতার কাছে যেতে নিলেই ইহিতা ওঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অহানকে ধাক্কা মেরে সজোটে কোষে গালে একটি চড় মেরে দেয়।
চড় দেওয়ার ফলে অহানের ঘাড় ডান দিকে কাত হয়ে যায়। সেভাবেই দাঁড়িয়ে রয় অহান। ইহিতার চোখ নিমিষেই ভরে উঠে জ্বলে। ছলছল করা চোখে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে,
-“আমি ত,,তোমার ভাবি হই! বউ না।”
অহান তাচ্ছিল্য হাসি দেয়। ইহিতার কাছ থেকে দূরে সরে বলে,
-“কোনটা বিশ্বাস করব আমি? আপনি আমার ভাবি হন এটা,নাকি বউ হন এটা? কোনটা বলুন?” জোরে চিল্লিয়ে বলে অহান। ইহিতা অহানের প্রশ্নের উত্তর দেয় না। দৌড়ে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে পিঠ দরজার সাথে ঠেকিয়ে কাঁদতে থাকে। অহান উত্তর পায়নি তাঁর। রাগে ড্রইংরুমের সেন্টার টেবিল লাথি মেরে বাসা থেকে বের হয়। বড় বড় পা ফেলে রিফাতের ফ্ল্যাটের সামনে আসে। জোরে জোরে কলিং বেল সহ দরজা ধাক্কাতে থাকে। আনিকা ও রিফাত সবে মাত্র খাবার খেতে বসেছে। এমন ভাবে কলিং বেল বাজাতে ও দরজা ধাক্কাতে দেখে আনিকা টেবিল ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই অহানকে দেখতে পায়। চোখেমুখে লেগে আছে প্রচণ্ড রাগের আভা।
অহান আনিকাকে পাশে সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেই রিফাকের গেঞ্জি ধরে টেনে টেবিল থেকে উঠিয়ে মারতে শুরু করে। আর জোরে জোরে বলে,
-“কেন করেছিস আমার সাথে এটা? কেন বলেছিস আমার সম্পর্কে সব আম্মুকে। বল কেন বলেছিস।” বলেই ঘুষি মারতে থাকে অহান।
ফের অহান দেয়ালের সাথে রিফাতকে ঠেসে ধরে ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে,
-“বন্ধুত্বের এই পরিনাম দেখালি। বেইমান কোথাকার।” বলেই এলোপাতাড়ি ঘুষি মারতে থাকে রিফাতকে।
আনিকা এতক্ষণ রিফাতকে মারতে দেখে চুপ করে রয়। কিন্তু যখন অহানের মুখে এসব কথা শুনে তখন আর চুপ থাকে না। অহানের কাছে এসে শার্টের কলার ধরে টেনে ওঁর কাছে নিয়ে জোরে থাপ্পড় মেরে চিৎকার করে বলে,
-“রিফাত কিছু বলেনি,আমি বলেছি তোর আম্মুকে সব।”
কথাটা শুনেই অহান অবাক চোখে তাকায় আনিকার দিকে।
অহান বুঝতে পারছে না আনিকা কিভাবে বলল এসব? আনিকা তো এসব কিছু জানতো না। না এতদিন দেখা হয়েছে ওঁর সঙ্গে। তাহলে আনিকাকে কে বলল? রিফাত! নাকি আনিকা নিজে থেকেই সব জেনেছে অহানের বিষয়?
.
.
.
.
.
.
Continue To………