তোমাতে রহিব বিলীন,পর্ব-০৩
লেখনীতে- Ifra Chowdhury
.
.
পরেরদিন ভার্সিটিতে গিয়ে সরাসরি রুহিকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তোর পেয়ারের পরাগ ভাইয়া নাকি এক্সিডেন্ট করেছে? তাহলে সে কাল দিব্যি সুস্থ মানুষের মতো আমার সাথে কথা বললো কীভাবে?’
আমার প্রশ্নে রুহি আমতা আমতা করে বললো,
‘স্যরি রে দোস্ত। আমি আসলে ভুল ইনফরমেশন পেয়েছিলাম। পরাগ ভাইয়ের বন্ধু রুবেল ভাই ফোনে বলছিলো, কার নাকি এক্সিডেন্ট হয়ে গিয়েছে। আর সেখানে পরাগ ভাই ছাড়া উনার বাকিসব বন্ধুরা ছিলেন। তো আমি সেই প্রেক্ষিতেই ভেবে নিয়েছিলাম এক্সিডেন্টটা বোধহয় পরাগ ভাইয়েরই হয়েছে।
আর তোকেও তো তা নিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছিলাম৷’
‘তা তোর যদি এতো তোর পরাগ ভাইকে নিয়ে চিন্তা থাকে, তাহলে প্রেমটা তুইই করতে পারিস উনার সাথে। শুধু শুধু আমায় ফাঁসাতে গেলি ক্যান? যত্তসব আজাইরা চ্যালেঞ্জ!’
রুহি এবার হাসি হাসি মুখ করে বললো,
‘পরাগ ভাই আমার ক্রাশ অবধিই ঠিক আছে। কিন্তু প্রেমটা তুইই কর।’
রুহির কথায় ভীষণভাবে অবাক হলাম। বললাম,
‘হোয়াট! উনি তোর ক্রাশ? লাইক সিরিয়াসলি? এমন মানুষ কারো ক্রাশও হতে পারে? আশ্চর্য! খুবই আশ্চর্য!’
‘উনি আমাদের ক্যাম্পাসের প্রায় অনেকের ক্রাশ। শুধু তোর কাছেই উনি অসহ্যকর। আচ্ছা তুই উনাকে সহ্য করতে পারিস না কেন বল্ তো?’
‘সবাই তো আর সহ্য করার মতো হয় না। তাই সহ্য করতে পারি না। কিন্তু তোর এতো জ্বলে কেন?’
‘কারণ তোর মতো একটা লঙ্কাবতী বান্ধবী সবসময় আমার সাথে থাকে, তাই আমি বারংবার রবি সিমের মতো জ্বলে উঠি।’
আমি এবার ঝাঁঝালো কন্ঠে বললাম,
‘রুহি!’
রুহি আমার কন্ঠঃস্বর শুনেই দৌঁড়ে পালালো। আমিও ওর পেছন পেছন ছুটতে লাগলাম। আচমকা কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। অনেকক্ষণ দৌঁড়ানোর ফলে খুব বেশি হাঁপাচ্ছি। কপালের চুলগুলো চোখের উপর আচঁড়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে চোখের উপরের চুলগুলো সরিয়ে মাথা উঁচু করে তাকাতেই দেখি পরাগ ভাই আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত কিনা উনার সাথেই আমার ধাক্কা খেতে হলো? একেই বলে কপাল!
আমি দ্রুত উনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। দু’কদম পিছিয়ে আসতে উনি আমার হাত ধরে ফেললেন।
আমি কটমট করে বললাম,
‘এটা কোন ধরনের অসভ্যতা পরাগ ভাই? আমার হাত ধরেছেন কেন?’
উনি রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বললেন,
‘ঠিক যে কারণে তুমি আমার বুকে মাথা রেখে ছিলে এতোক্ষণ, ঠিক সে কারণেই আমি তোমার হাত ধরেছি।’
‘মানে? আমি তো ইচ্ছে করে আপনার বুকে মাথা রাখিনি। আর ওটাকে বুকে মাথা রাখাও বলে না। আমি তো জাস্ট ধাক্কা খেয়েছি আপনার সাথে৷ আর সেটাও অনিচ্ছাকৃতভাবে। কিন্তু আপনি তো ইচ্ছাকৃত ভাবে আমার হাত ধরে রেখেছেন।’
উনি আবারও হাসলেন। তারপর বললেন,
‘আমি কীভাবে বুঝবো কাজটা তুমি অনিচ্ছাকৃত করেছো?’
‘আজব! আপনি কিন্তু আমায় রাগিয়ে দিচ্ছেন। হাত ছাড়ুন আমার। নাহয় চিৎকার করে পুরো ডিপার্টমেন্টের লোক জড়ো করে ফেলবো আমি। ‘
‘করো না? করো। যা ইচ্ছা করো। কিন্তু হাত ছাড়বো না। চলো আমার সাথে৷’
পরাগ ভাইয়ের জোরের সাথে আমি পেরে উঠছিলাম না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আমি শত চেষ্টা করেও চিৎকার করতে পারলাম না। আমার কণ্ঠনালী দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছিলো না। আর উনিও আমায় টানতে টানতে কদম গাছটার তলায় নিয়ে গেলেন। তারপর ধীরে ধীরে আমার হাতটাও ছেড়ে দিলেন। রাগে আমার শরীর রি রি করছে। কান গরম হয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে যেন। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারছিলাম না।
পরাগ ভাই আমার দিকে একটা পানির বোতল ছুঁড়ে দিয়ে বললেন,
‘পানিটা খেয়ে নাও৷ ভালো লাগবে তোমার।’
আমিও ঢকঢক করে প্রায় অর্ধেক বোতল পানি খেয়ে নিলাম। আমার সাথে কী হচ্ছে আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না।
আচমকাই পরাগ ভাই এক ঝুড়ি মরিচ এনে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন।
মুখে লাজুকতা এনে বললেন,
‘সারাজীবনের জন্য আমার শুধু আমারই লঙ্কাবতী হয়ে থাকবে, স্মিহা?’
উনার এহেন কান্ডে আমার চোখদ্বয় ছানাবড়া হয়ে গেলো। মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গিয়েছে। কী বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না। উনি সম্ভবত আমার অবস্থা বুঝতে পারলেন। তাই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষন দু’জনেই চুপ রইলাম।
তারপর উনি নিজ থেকেই বললেন,
‘বাসায় যাও। সময় নাও। কিন্তু উত্তরটা যাতে হ্যাঁ-ই হয়।’
কথাখানা বলে উনি উলটো হাঁটা আরম্ভ করলেন। পিছন ফিরে একবারও তাকালেন না। আমিও অবাক নয়নে উনার চলে যাওয়াটা দেখলাম।
মাথা ঘুরছে আমার। যেকোনো মুহুর্তে হয়তো অজ্ঞান হয়ে যেতে পারি। তাই তাড়াহুড়ো করে ক্লাসরুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম৷
_____________
সেদিন আর প্রিয়দের কিচ্ছু জানালাম না। বাসার ফিরে আপাকেও কিছু বললাম না। মাথার ভিতর রাজ্যের প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। প্রশ্নগুলোর সমাধান না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠছিলাম। ঠিক সেই মুহুর্তেই আননোউন নাম্বার থেকে ফোন আসলো। আমি কিছু না ভেবেই তৎক্ষণাৎ ফোনটা রিসিভ করে নিলাম।
ও পাশ থেকে পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো।
খুব নরম করেই বললেন,
‘মায়া শব্দটা দু’ অক্ষরের হলেও এর গভীরতা অনেক। যেদিন থেকে তোমার ঐ দু’চোখের মায়ায় আটকে গিয়েছে সেদিন থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার তোমাকে লাগবেই লাগবে। তোমায় ভেবে ভেবে কতো প্রহর কেটে গিয়েছে তা নিজেও টের পাইনি।
গোধূলির ধূলোয় মিশে থাকা আলোর ঝাপসা চাহনিতে আমি তোমাকেই পড়ি।
সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা
অথবা রাত্রী প্রহর,
শূন্যতার ভীড়ে মনে মনে তোমাকেই পড়ি। এক শিশি মদ্যপানে কিছু মাতাল বাক্যে তোমাকে পড়ি৷
তুমি আমার মুখস্থ বিদ্যা,
জ্ঞানের ভান্ডার!
তোমাকে পড়তে ভীষণ ভালো লাগে, তাই তো আমি তোমাতেই শুদ্ধ!’
অপরিচিত এই পুরুষালি কন্ঠের জোর এতোটাই তীব্র যে নিমিষেই আমার হৃদয়ের কঠিন বরফগুলো গলতে শুরু করলো। অন্যরকম এক ভালো লাগার আবেশ আমার সর্বাঙ্গে ছুঁয়ে গেলো।
আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,
‘কে? কে আপনি?’
ওপাশ থেকে মৃদু হাসির শব্দ পেলাম। তার ভয়ংকর কন্ঠে আবার বলে উঠলো,
‘যাকে তোমার ভীষণ রকমের অসহ্যকর মনে হয়, সে।’
আমি নীরবতা পালন করলাম মিনিট দুয়েক। ঐ কাঠখোট্টা মানুষটা এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে, এটা তো জানতাম না। আমি প্রশংসা করতে বাধ্য হলাম,
‘বাহ, আপনি তো চমৎকার কথা বলেন। ভাগ্যিস আজ ফোন করলেন, নাহয় আপনার এই গুণটা তো অজানাই থেকে যেতো।’
পরাগ ভাই এবার হো হো করে হেসে উঠলেন৷ বললেন,
‘যাক, অবশেষে স্বীকার তো করলে, আমারও কিছু গুণ রয়েছে। তা ভাবা হলো তোমার?’
‘কী ভাববো?’
‘সে কি! লঙ্কাবতীর স্মৃতিশক্তি এতো দুর্বল? সকালে এতো সাহস সঞ্চয় করে নোবেল পাওয়ার মতো একটা কাজ করলাম আর তুমি তা বেমালুম ভুলে গেলে?’
‘কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো আমার কাছে নোবেল নেই, পরাগ ভাই। নোবেল তো আপনি পাবেন না।’
‘তুমিই তো আমার নোবেল। তুমি আমার হয়ে যাও, তাহলেই হবে লঙ্কাবতী।’
আমি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললাম,
‘আপনি জানেন? আপনি খারাপ, প্রচন্ড খারাপ, ভীষণ রকমের খারাপ। নাহলে কেউ কাউকে লঙ্কা দিয়ে প্রপোজ করে? আবার আপনি আশা করছেন, আমি তাতে সম্মতি জানাবো? কোনোদিনই না। হুহ!’
‘ওমা! যার সাথে যেটা যায়, তাকে তো সেটা দিয়েই প্রপোজ করা উচিত। অন্তত আমি তো তাই মনে করি।’
উনার এমন কথায় আমি প্রচন্ড রেগে গেলাম। কড়া গলায় বললাম,
‘ফোন রাখুন। আপনি আসলেই ইতর, বদমাশ, খচ্চর। আমি জীবনেও আপনার প্রস্তাবে রাজী হবো না। আমি তো লঙ্কাবতী, আমাকে কেন প্রপোজ করেছেন? যান না? যান। মিষ্টি কোনো মেয়েকে গিয়ে প্রপোজ করুন গিয়ে।’
পরাগ ভাইয়ের হাসিটা আরো প্রশস্ত হলো। উনি টেনে টেনে বললেন,
‘কিন্তু… আমার তো ডায়াবেটিস, তাই তো এই লঙ্কাবতীকেই আমার চাই। যেনো জীবনটা ঝালে ঝালে কেটে যায় আর আমিও সুস্থ থাকি। মিষ্টি কেউ জীবনে এলে তো আমার ডায়েবিটিস বেড়ে আমি মরেই যাবো।’
উনার কথা শুনে রাগের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম। উনি ফোন রাখবেন না তা ঢের বুঝতে পারছি। তাই নিজ থেকেই ফোন রেখে দিলাম। ইচ্ছে করছে ডুকরে কাঁদি। এই ইতর মানুষটার সাথে কীভাবে প্রেম করবো আমি? কীভাবে?
হাতেও তো মাত্র তিনদিন সময় আছে। তিনদিনের জন্য রাজী হয়ে যাবো? তারপর চ্যালেঞ্জ জেতার পর উনাকে বলবো আমি এই তিনদিন প্রেমের অভিনয় করেছি। আমার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে চ্যালেঞ্জ জেতা, তাই রাজী হয়েছি।
ফোনে টুংটাং শব্দ হলো আবারও। মেসেজ এসেছে উনার নাম্বার থেকে।
‘কাল ক্লাসের পরে পাশের রেস্টুরেন্টে মিট করো। দরকার আছে।’
মেসেজ দেখে মনে হচ্ছে আমি উনার প্রেমিকা হয়ে গিয়েছি। আদেশ করছেন আমায়। হুহ! যাবো না রেস্টুরেন্টে। যা করার করে নিস ইতর ব্যাটা।
পরক্ষণেই ভাবলাম আমার জেতার জন্য হলেও এই তিনদিন এই অসভ্য লোকের কথা শুনতে হবে। তারপর যা হয় হোক।
রাতে আপাকে সবটা বললাম। আপা শুনে বললো,
‘শোন্, এলোমেলো ভাবে যাস না। সুন্দর করে সেজেগুজে যাস। আফটার অল, তোর প্রথম ডেটিং বলে কথা।’
আপা আমার সাথে মজা নিচ্ছে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। আমিও বললাম,
‘প্রেম সম্পর্কে তো দেখছি তোমার ভালোই ধারণা আছে। তা দুলাভাই কি জানে যে তার বউ প্রেমে এতো এক্সপার্ট? ‘
আপা হেসে বললো,
‘তোর দুলভাইয়ের সাথে তো আমার বিয়েটা হয়েছে প্রেম করেই।’
‘এ্যাঁ! কিন্তু আমি তো জানি তোমাদের এরেঞ্জ ম্যারেজ? তাহলে প্রেম কীভাবে?’
‘আসলে আমরা প্রেম করেছি ঠিকই কিন্তু বাসায় কেউ জানে না সেটা। সবাই তো জানে আমাদের এরেঞ্জ ম্যারেজই।’
‘কিন্তু কেন?’
আপা মন খারাপ করে বললো,
‘আসলে আমাদের বাসায় আমার প্রেম মেনে নিলেও ওর বাসায় মানতো না। আমার শ্বশুর এসব পছন্দ করেন না। তাই তোর দুলাভাইয়ের জব হওয়ার পর যখন ওর বিয়ের কথা হচ্ছিলো, তখন ওর এক বন্ধু শ্বশুরমশাইকে দিয়ে আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। তারপর সবদিক থেকে মিলে গেলেই আমাদের বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হয়।
তাই আজও কেউ জানে না আমাদের প্রেমের কথা।’
‘বাব্বাহ আপা তুমি তো খুব ডেঞ্জারাস। বাসার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রেম করে ফেললে অথচ, একটা কাকপক্ষীও টের পেলো না। গ্রেট আপা, গ্রেট!’
আপা আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
‘এ জন্যই তো বলি আমার বুদ্ধিমতো কাজ কর। তুইও প্রেমে পিএইচডি করে ফেলবি।’
আমি ঘুম ঘুম কন্ঠে বললাম,
‘আমি এমনিতেও তিনদিন প্রেম করে প্রেমের রেকর্ড গড়ে ফেলবো আপা। এখন ঘুমাই। শুভ রাত্রি।’
.
.
চলবে…