রঙ_বেরঙে,পর্ব-২
সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(৪)
বাকীরাতটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মেয়েটার উপর পাশবিক নির্যাতনকরে নিজের পুরুষত্ব ফলাও করেছে নির্বেদ।
বিছানার একপাশে কালো কম্ফোর্টারে আবৃত প্রণয়ীর নগ্ন দেহ প্রায় অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে।
সকালের আলো চোখেমুখে এসে লাগতেই চোখমুখে এসে পড়তেই উঠে বসলো নির্বেদ। সামনে কাউচের উপর পড়ে রয়েছে তার শার্ট। শার্ট টা দেখেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো।আনিকা উপহার দিয়েছিল তাকে।
তাদের নবম প্রণয় দিবস উপলক্ষে।বিনিময়ে সে আনিকাকে কি দিয়েছিল?
হ্যাঁ মনে পড়েছে। এক জোড়া রুপার নুপুর।
মেয়েটার নুপুরের প্রতি খুব ভালোলাগা রয়েছে। নির্বেদ এর ইচ্ছে ছিল আনিকাকে তার ২৫ তম জন্মদিনে ২৫ জোড়া নুপুর উপহার দিবে। চমকে দিবে মেয়েটাকে। কিন্তু তার বেকারত্ব তাকে গ্রাস করে নিয়েছিল। টুকটাক ব্যবসার জন্য আনিকা তার জমানো সব টাকা গুছিয়ে নিয়েছিল। দুজনে মিলে ছোট্ট একটা ব্যবসা শুরু করবে৷
আনিকা নিজ হাতে বানানো পিঠে গুলো নিয়ে। তাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে, সেই সংসারের জন্য দুজনে অনেক পরিশ্রম করবে।দিন রাত পরিশ্রম করে যখন একে অপরে ক্লান্ত হয়ে যাবে তখন নাইয়ে নিবে ভালোবাসার জলে।
কাল দুপুর অবধি তাদের স্বপ্নগুলো কত রঙের ছিল।আজ তাদের জীবনটা শুধুই বেরঙের।
ফ্রেশ হতে এসে ওয়াশরুমের আয়নার দিকে নজর পড়লো।বুক জুড়ে কামড়ের দাগ। মেয়েটা যেমন পেরেছে তাকে আঁচড়ে কামড়ে তার থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। কিন্তু পারেনি,তার পৈশাচিক অনুভূতি থেকে।
গায়ে পানি লাগতেই জ্বলতে শুরু করেছে নির্বেদের পুরো শরীর।
কাল রাতে রাগ দমাতে পারেনি সে।
যখন সে জানতে পারলো আনিকা কোনো দিন হাটতে পারবে না।পারলেও অনেকটা ঝুঁকি থেকে যাবে।
তখন সব রাগ গিয়ে পড়েছিল ঘুমন্ত প্রণয়ীর উপর।
ভালোবাসার মানুষগুলো অমূল্য সম্পদ। তাদের কোনো দুঃসংবাদ মানব মস্তিষ্ককে ক্ষণিকের জন্য বিকল করে দেয়।
(৫)
ফুলিখালা সকালের চা নিয়ে এসে দরজায় কড়া নাড়ছে তার পিছনে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন প্রণব সাহেব।চেহারায় খুশি খুশি ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।আজ থেকে তার দায়িত্ব ফুরিয়েছে। না হলে মেয়েটা এত বেলা অবধি ঘুমায় না।সকালবেলা উঠে বাবার ঘরের দিকটায় বসে থাকে সে।
রামিশা বেগম মারা যাওয়ার পর থেকে দিন শুরু হয় মেয়ের মুখ দেখেই।
নির্বেদ যখন দরজা খুলল,প্রনব সাহেব হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“হে জেন্টেলম্যান! গুড মর্নিং।”
“শুভ সকাল।”
“প্রণয়ী?উঠেনি?”
“এখনো না।”
“আমি একবার ডাকবো?”
ফুলি খালা ততক্ষণে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেছে। প্রণয়ীকে বেগতিক অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গেলেন তিনি।ছোট্ট থেকে নিজ হাতে পালন করা মেয়েকে যদি স্বামী নামক মানুষটা এমন নির্যাতন করে যখন মেয়েটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী তখন মরে যেতে ইচ্ছে করে। দুচোখের পানি আটকে রেখে ফুলি খালা বললেন,
“ভাইজান আসার দরকার নাই।জননীরে আমি ডাইকা তুইলা আনতেছি।আপনি নিচে যান জামাই বাবাজীরে নিয়া।টেবিলে নাস্তা দিছি।ঠান্ডা হইয়া যাইবো।”
প্রনব সাহেব বিনাবাক্যে কথা মেনে নিয়ে নির্বেদকে নিয়ে নিচে চলে গেলেন।
খাবার টেবিলে বসে নির্বেদ সজলকে ম্যাসেজ করলো,
“আনিকা কেমন আছে?”
“ভালো নেই।তুই ভালো থাকতে দিয়েছিস?”
“খেয়েছে কিছু?”
“স্যালাইন চলছে।রক্ত ক্ষরণ হয়েছে অনেক।”
“বাঁচবে তো?”
নির্বেদ খেয়াল করছিল তার দুহার অনবরত কাঁপছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। তবুও সে তাকিয়ে আছে ফোনের স্ক্রীনের দিকে।সেদিকে তাকিয়েই টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো ফোনের স্ক্রিনে।
“এ যাত্রায় বেঁচে যাবে। জানিস ওর গায়ে বেশ জ্বর।ওর মা খুব কাঁদছে রে।”
“আন্টির মাইগ্রেন এর সমস্যা আছে। তাকে মেডিসিন এনে দে। সাথে গ্লুকোজ পানি।উনার শরীর বেশি ভালো না।”
“এতই যখন ভাবিস তবে ছেড়ে দিলি কেন?”
“প্রতিটা ব্যর্থ প্রেমিকের একটা ব্যর্থ গল্প থাকে।”
(৬)
মা! মা! পানি!
গোলাপি কম্ফোর্টারের অনেকটায় লাল রক্তের দাগ।
পুরো শরীর খুবলে খেয়েছে নির্বেদ।তাকে উঠিয়ে কোনো ভাবে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলেন ফুলি খালা।হাঁটতে পারছে না মেয়েটা। শরীরে পানি লাগতেই কাঁদতে লাগলো সে।
বাবাটা মারা গেলে এই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েটার কী হবে?
তার ভাই যে মেয়েকে পছন্দ করেছে সে মেয়ে মেনে নিবে না এই পাগলীটাকে। স্বামী অবশ্যই তাকে পুরো জীবন ভালো রাখবে না।
ফুলি সে নিজেই তো এই বাড়ির আশ্রিতা।তার বা সামর্থ্য কী?
প্রতিবন্ধী মানুষগুলো কেন এই সমাজের কাছে বোঝা?
বাবা মা ছাড়া কেন তাদের কেউ আপন হয় না?
সমাজ কেন তাদের নিয়ে সব সময় হাসিতামাশা করে?
একটু সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেই তো এই মানুষগুলোও স্বাভাবিক একটা জীবন পেতে পারে।
ডক্টর মাহিয়া রুহী বিগত বছর তিনেক যাবত প্রণয়ীকে কনসাল্ট করে।
মেয়েটাকে খুব পছন্দ করে প্রণয়ী।ছুটির দিনগুলো সে প্রণয়ীর সাথে কাটাতে পছন্দ করে।এই দিনটায় সে প্রণয়ীকে নিয়ে তার মতোন মানুষগুলোর সাথে দেখা করতে নিয়ে যায়। প্রণয়ী ছোটো বাচ্চাদের অংক শেখায়।
হ্যাঁ প্রণয়ী একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়েও গণিত বিষয়ে সে যে কোনো হিসেব খুব দ্রুত আয়ত্ত করে নিতে পারে। গণিত ছাড়া অন্য কোনো বিষয় সে খুব একটা মনে রাখতে পারে না।সে ছবি আঁকতে পারে না,ভালোভাবে কোনো ভাষাও বুঝে না। যদি কোনো কিছু সে ভালোবেসে থাকে তবে গণিত।
পুরো দিন সে হাতের কড় গুলে হিসেব করে৷ যেকোনো ধরনের গাণিতিক সূত্রাবলী বা জটিলতা প্রণয়ী খুব স্বাভাবিকভাবে বুঝে নিতে পারে যেখানে সে নিজের কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারে না।
এজন্য মাহিয়া রুহী তাকে নিয়ে সব সময় বলে,
“প্রতিবন্ধী নয়, তারা স্পেশাল হয়।আমাদের সৃষ্টিকর্তা সাধারণ মানুষ হিসেবে সব দিয়েছে কিন্তু স্পেশাল চাইল্ডদের সৃষ্টিকর্তা কোনো এক বিষয় খুব মেধা দান করে। যেমন প্রণয়ী গণিতে সে সেরা।আংকেল যেভাবে পারেন ওর লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।”
মাহিয়া রুহীকে কল দিয়ে ফুলীখালা সবটা বললে সে দ্রুত হাজির হয়।
এখনো প্রনব সাহেব কিছু জানেন না।
মাহিয়া নির্বেদকে মনে মনে পৃথিবীর সব’চে জঘন্য গালি দিয়ে বলল,
“শালা পার্ভাট একটা। ওকে তো আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।”
চলবে