টক্কর,শেষ পর্ব
সাহেরা_খান
ফোনটা পকেটে চালান করে দিয়ে ওসি সাহেব চেয়ারে বসে পড়লেন। কিবরিয়া ব্যস্ত হয়ে পানি এগিয়ে দেয়। হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে টেবিলেই রেখে দেন। মুখটা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আছে তার। তিনি ভাঙা হৃদয়ে বললেন,
“মানিক আর তার দলবলকে পাকড়াও করার চেষ্টা করেছিল। তারা নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল, খবর ছিল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। কিন্তু দুই একজনকে জীবিত ধরতে পারলেও মানিক ক্রস ফায়ারে অক্কা পেয়েছে। এত কাছে এসেও শেষ পর্যন্ত এভাবে ব্যর্থ হবো ভাবিনি। তীরে এসে তরী ডুবে গেল।”
কিবরিয়াও বেশ হতাশ হয়ে গেল খবরটি শুনে। ওসি সাহেবের বিরস বদন দেখে সে সান্ত্বনা হিসেবে বলল,
“স্যার, আমরা তো রানাকে পেয়েছি। ওর শাস্তির ব্যবস্থা করলে কিছুটা সাধ পূরণ হবে আশা করা যায়।”
আশার আলো দেখতে পেয়ে ওসি সাহেব কিছুটা আনন্দিত হয়ে বললেন,
“মানিক মরেছে ভালো হয়েছে। এবার দেখি রানা কীভাবে পার পেয়ে যায়। সব রেকর্ড চেক করে প্রমাণ সংগ্রহ করে ফেলেন। তারপর আগামীকাল চলেন হাসপাতালের দিকে যাওয়া যাক! কায়রা ম্যামকে পুরো খবরটা জানিয়ে আসব।”
ওসি সাহেব পুরোপুরি শিওর হওয়ার উদ্দেশ্যে থানার কর্মকর্তাদের বিস্তারিত তথ্য পাঠানোর আবেদন করলেন। মামলার আসামি হওয়ায় তাদের সব তথ্য যাচাই করে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করতে হবে। তিনি কোনো ফাঁকফোকর রাখতে চান না। যদি কোনো ধোঁকাবাজি হয়ে থাকে তাহলে পরবর্তীতে ভীষণ সমস্যায় পড়তে হবে। খবরটা গুজব কি না তারও পরীক্ষা করা দরকার। পরিচিতদের মাধ্যমে ওসি সাহেব বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছেন।
কিবরিয়া পুনরায় কল রেকর্ড শোনায় মনোযোগ দেয়। গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো নোট করে রাখে সে। প্রতিটি কল রেকর্ড শুনছে আর ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে। গায়ের লোমকূপ পর্যন্ত শিউরে উঠছে। সব কাজ শেষ হলে সে চোখ বন্ধ করে বিস্তারিত ভাবতে থাকে। মন অন্যদিকে ফেরানোর জন্য তমার কথা ভাবতে শুরু করে সে। তার মুখচ্ছবি চোখের সামনে ভাসতেই সে রোমাঞ্চিত হলো। সব ক্লান্তি যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। তমা নামের মেয়েটা ওর কাছে যাদুকরী এক নাম। মুহূর্তেই মন ভালো করে দেওয়ার টনিক।
*
রানার জ্ঞান ফিরে এসেছে। কিবরিয়া খবরটি শুনেই পুনরায় থানায় পাঠানোর কথা জানিয়ে দিলো। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার উদ্দেশ্যে আবারও থানায় নিয়ে আসা হলো। রানাকে দেখে এখন চেনাই যাচ্ছে না। চোখের নিচে কালি আর শরীর জুড়ে রয়েছে অসংখ্য দাগ। বিদ্ধস্থ রানাকে দেখে নিলেন ওসি সাহেব। কল রেকর্ড থেকে পাওয়া প্রমাণ সামনে রেখে ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“এখনো তুই অস্বীকার করবি সবকিছু? তবে এখন স্বীকার কর বা না কর প্রমাণ তো আমরা পেয়েই গেছি। তুই আর মানিকের গ্যাং মিলে যে কাজ করেছিস তার সব প্রমাণ এখন এখানে আছে। আমাদের আর কিছুই দরকার হবে না।”
কথাগুলো বলে ওসি সাহেব চোখে চোখ রেখে শীতল কণ্ঠে বললেন,
“আরেকটা কথা তুই জানিস না। মানিক ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। তার পুরো দলবলসহ খতম হয়ে গেছে। এখন শুধু তুই বাকি আছিস। সিদ্ধান্ত নে কী করবি। আমরা ভাবছি তোকে ক্রসফায়ারেই দিয়ে দেবো। বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ!”
রানার গলা শুকিয়ে গেল। মৃত্যু ভয় তাকে গ্রাস করে নিলো। শুকনো ঢোক গিলে সে বলল,
“স্যার আমাকে একটা সুযোগ দেন প্লিজ। আমাকে কাজগুলো করাতে বাধ্য করা হয়েছে। সাহেলা আমার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে শেষে সুযোগ নিয়েছে। ব্লাকমেইল করে বাধ্য করেছে খুন করতে।”
ওসি সাহেব চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। রানা সব স্বীকার করবে তা ভেবেই প্রস্তুতি নিলেন। রেকর্ডারের মাধ্যমে তার কথা রেকর্ড করা শুরু করেন। পাশেই কিবরিয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সে কল রেকর্ড থেকে অনেক কিছু জেনেছে তাই তার কোনো ভাবান্তর হচ্ছে না। রানা মাথা নিচু করে রেখেছে। অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে সে বলল,
“আমার সাথে ওর পরিচয় হয়েছিল শপিংমলে। প্রথম দেখাতেই আমি প্রেমে পড়ে যাই। প্রতিনিয়ত আমি তার পেছনে ঘুরতে শুরু করি। সে আমাকে পাত্তা না দিলেও একসময় হুট করে নিজেই যেচে ভাব জমায়। তারপর সম্পর্কটা আস্তে আস্তে প্রেমের দিকে গড়ায়।”
চুপ হয়ে গেলে ওসি সাহেব ঝাড়ি মেরে বললেন,
“ভনিতা বাদ দিয়ে ডিটেইলস বল। কিছুই বাদ দিবি না। প্রতিটি বর্ণনা আমি শুনতে চাই।”
রানা আবারও বলতে শুরু করে ধমক খেয়ে,
“ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে একপর্যায়ে। একদিন হুট করে জিজ্ঞেস করল, আমি ভালোবাসার প্রমাণ দিতে পারব কি না? সাহেলার কথা শুনে হেসে ফেলি৷ তারপর ওকে আশ্বস্ত করি। ও যা বলবে তা করতে আমি প্রস্তুত আছি। এটা বলার পরে ও আমাকে বলে একজনকে নির্যাতন করে খুন করতে হবে।”
ওসি সাহেবের মুখ দেখে রানা বুঝতে পারল তিনি ভীষণ রেগে গিয়েছেন কথাটি শুনে। চোখ নিচে নামাতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“তোকে বলল আর তুই রাজি হয়ে গেলি? অন্য কোনো কিছু ভাবার সময় হয়নি? পরবর্তীতে ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না?”
রানা অনুতপ্তের সুরে বলল,
“আমি বাধ্য হয়েছিলাম। আমি ভালোবাসায় অন্ধ হলেও এই কাজে প্রথমে রাজি হইনি। কিন্তু ও আমাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো ভিডিয়ো করে রেখেছিল। এছাড়াও আমাকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখানো শুরু করে। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে নিজের পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে রাজি হয়ে যাই।”
“কীভাবে কী করেছিলি? কে কে সাথে ছিল?”
রানা মাথা না তুলেই বলল,
“শপিং করতে বেরিয়েছিল ওর বোন। প্রথম দেখায় আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। দুজনে দেখতে একইরকম। ভড়কে গিয়ে তাকে সাহেলা ধরে নিয়েছিলাম। পরে ভুল ভাঙে আমার। সাহেলা নিজের বোনের সাথে এরকম কিছু করতে চায় আমি ভাবতে পারিনি! কল দিয়ে শিওর হয়ে নিয়েছিলাম এই মেয়েই কি না। এরপর মিথ্যে বলে সাহেলার বোনকে অপহরণ করি। আমার সাথে আর কেউ ছিল না। সব কাজ আমি নিজে করেছিলাম।”
ওসি সাহেব কিছুটা ধাক্কা খেলেন! নিজেকে সামলে কিবরিয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে তিনি উত্তেজনাবশত জিজ্ঞেস করলেন,
“তুই একা ছিলি মানে? মানিক আর তার গ্যাং ছিল না সাথে? তুই কি তাহলে কায়রাকে অপহরণ করেছিলি?”
রানা নামটা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি কায়রা নামটা আজ প্রথম শুনলাম। যাকে অপহরণ করেছিলাম সে মায়া ছিল।”
ওসি সাহেব চ-কারান্ত শব্দ করে বললেন,
“তুই যদি মায়াকে অপহরণ করে থাকিস; তাহলে তোর গার্লফ্রেন্ড সাহেলাকে কেন মানিক খুন করল? তার সাথে কী শত্রুতা ছিল?”
রানা ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবার চেষ্টা করল। সে বলল,
“স্যার, আমিও ঠিক জানি না। মায়াকে আমি খুন করে রাস্তায় ফেলে রেখেছিলাম। কেউ তাকে দেখে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সে কোমায় আছে তা জানতে পারি সাহেলার মাধ্যমে। তারপর তো সাহেলার সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। কিছুদিন আগে আমি ওর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে ফোন বন্ধ পাই। এরপর আপনাদের খপ্পরে পড়লাম। আমি সত্যি বলছি স্যার। বিশ্বাস করেন, এই ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।”
ওসি সাহেব প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন নিজের উপরই। তিনি কেসটা মেলানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার মাথায় চরকির মতো একটা কথাই ঘুরছে। রানা যদি কায়রাকে আক্রমণ করে তাহলে আবিরাকে কেন মানিক আক্রমণ করল? এসবের পেছনে কায়রা ছিল না তো! আবিরার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কাজটি করেছে? কিবরিয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বেরিয়ে আসতে বললেন। দুজনে কেবিনে ফিরতেই ওসি সাহেব ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। তিনি আফসোসের সুরে বললেন,
“ইশ্! মানিক যদি বেঁচে থাকত তাহলে এরকম বিভ্রান্তি হতো না। কায়রার ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে। তিনি কি সত্যি কথা বলেছেন আদৌ?”
কিবরিয়া কিছু একটা ভেবে বলল,
“স্যার আমার মনে হয়, কায়রা ম্যামের ঘনিষ্ঠ কেউ জড়িত। হয়তো সে এসব জানতে পেরে তার হয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে।”
সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না মোটেও। তিনি জোর দিয়ে বললেন খোঁজ নিতে। জমজ হওয়ায় বেশ ঘাপলা তৈরি হয়েছে। কে খুন হলো আর কে হাসপাতালে আছে তা যাচাই করতে হবে আগে। কেনই-বা নিজের বোনের সাথে এরকম নোংরা কাজ করল রানাকে ব্যবহার করে। এখানে মানিকের ভূমিকা কী ছিল, সে কেন কাজটি করল? অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে ওসি সাহেবের। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“এখনই চলেন হাসপাতালে যাওয়া যাক । আমার ভীষণ খটকা লাগছে। আবিরা আর কায়রা জমজ বোন। যেহেতু দেখতে হুবহু একরকম তাদের নিজেদের মধ্যে কী ঝামেলা ছিল সেটা জানতে হবে। তিমন সাহেব স্ত্রীর ব্যাপারে কিছুই জানতেন না এটা কীভাবে হয়? আবিরা যদি রানার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকে এতে তো তার বোঝার কথা ব্যাপারটা।”
মগজে আরেকটি কথা বাড়ি মারতেই তিনি কিবরিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
“এই কাজটি তিমন সাহেব করেননি তো? নিজের হাসপাতাল যেহেতু তিনি সুযোগ নিতেই পারেন। কায়রার সাথে কিছু চলছে না তো আবার? অসুস্থ হওয়ার ভান করে সব পরিকল্পনা করেছে কি না! দ্রুত চলেন, হাসপাতালে গিয়ে সার্চ করলে কিছু একটা পাওয়া যাবে অন্তত আমার বিশ্বাস।”
ওসি সাহেব তড়িঘড়ি করে হাঁটতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পরে সেটা দৌড়-এ পরিণত হয়। কিবরিয়া তার আগে গিয়ে গাড়ি বের করে। গাড়িতে উঠেই নির্দেশ দিলেন গতি বাড়াতে। সর্বোচ্চ গতি বাড়াতে চাইলেও কিবরিয়া ব্যর্থ হয়। ঢাকা শহরে নিম্ন মূল্যে কিছু পাওয়া যায় কি না সন্দেহ আছে; তবে জ্যাম একদম ফ্রিতে পাওয়া যায়। কিবরিয়া ক্ষোভটা গাড়ির উপর ঝাড়ল। জ্যাম ছুটতেই সে আবারও চালাতে শুরু করে। ১ ঘণ্টার পথ অতিক্রম করতে দুই ঘণ্টা লেগে গিয়েছে। নেহাৎ আজ ভাগ্য ভালো ছিল বোধহয় দ্রুতই পৌঁছে যেতে পেরেছে। গাড়ি থেকে নেমেই তাড়াহুড়ো করে ভেতরে প্রবেশ করে তারা। নার্সকে দেখার সাথেই ওসি সাহেব জোরে বললেন,
“দ্রুত ডাক্তার রঞ্জন বিশ্বাসকে ডেকে আনুন। বলবেন এখনই আসতে। কোনো অজুহাত চলবে না।”
নার্স কিছুটা অবগত থাকায় বিনাবাক্যব্যয়ে ছুটল। সাথে করে ডাক্তার রঞ্জন বিশ্বাসকে না এনে অন্য কাউকে নিয়ে এসেছে। অপরিচিত ডাক্তার আসায় ওসি সাহেব ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন তাকে দেখে। তিনি প্রায় চিৎকার করে বললেন,
“আমি তো আপনার সাথে দেখা করতে চাইনি। ডাক্তার রঞ্জন বিশ্বাসকে ডাকুন, যান।”
স্বল্প বয়সি ডাক্তার ছেলেটি ওসি সাহেবের রাগ দেখে মিনতি করে বলল,
“অফিসার আপনি আগে শান্ত হোন প্লিজ। আমাকে সবটা ক্লিয়ার করতে দেন। তারপর না হয় আপনি বলবেন।”
ওসি সাহেব চোখ ছোটো করে বিরক্তি প্রকাশ করলেন। তিনি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন। ডাক্তার তাকে বলল,
“ডাক্তার রঞ্জন বিশ্বাস তিমন স্যারকে নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে গেছেন কাল রাতেই। স্যারের অবস্থা বেগতিক হওয়ায় ইমার্জেন্সি ফ্লাই করতে হয়েছে।”
ওসি সাহেব আরও একবার ধাক্কা খেলেন। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাওয়ায় কিবরিয়া বলল,
“কায়রা ম্যাম আছেন? আপনি তার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেন।”
ডাক্তার হতাশা প্রকাশ করে বলল,
“আসলে তিনিও তিমন স্যারের সাথে গিয়েছেন চেকআপ করাতে। হাসপাতালে এখন কেউ নেই।”
ওসি সাহেবের মাথা ঘুরছে। তিনি নিজেকে শাপ-শাপান্ত করছেন। হতাশায় বিরক্তিতে কিবরিয়াকে বললেন,
“সিঙ্গাপুর যাওয়ার ব্যবস্থা করেন ইমিডিয়েটলি। ডিটেইলস জানার চেষ্টা করেন তারা কোথায় আছে। এয়ারপোর্টে খোঁজ নেন দ্রুত। সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে বলেন। যত লোকজন লাগে কাজে লাগিয়ে দেন। আবিরা আর কায়রার সব বর্ণনা জেনে নেন। এই দুই বোনের চক্কর কী সেটা জানা দরকার আগে।”
নিজেই নিজেকে বলতে শুরু করলেন,
“কে মারা গেল আবিরা না কায়রা? মূল কালপ্রিট কে ছিল? তিমন সাহেব যদি আবিরার সাথে প্রেম করেছিলেন তাহলে কেন তাকে ধোঁকা দিলো সে? বিয়েটা আসলে কার সাথে হয়েছিল? আবিরা না কি কায়রা? সাহেলা আর মায়া নামের ব্যাপারটা ঠিক কী? আবিরা বিয়ের আগে ভালো থাকলেও বিয়ের পরে কেন খারাপ হয়ে গিয়েছিল?”
সব প্রশ্ন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। উত্তর মিলছে না বিধায় অস্বস্তিতে ভুগছেন। কিবরিয়াকে সাথে করে ফিরে আসেন দ্রুত। তারা কেউ-ই থেমে নেই। এক এক করে সব তথ্য সংগ্রহ করতে লোক লাগিয়ে দিলো।
*
আবিরা আর কায়রা দেখতে একইরকম হলেও তাদের আলাদা করার জন্য তিলের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হতো। আবিরার গলার নিচে বেশ বড়ো একটা তিল থাকায় সবাই চিনতে পারত সহজে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দুজনকে আলাদা করার চেষ্টা করছে কিবরিয়া। তার মাথা চক্কর দিতে শুরু করে যখন সে দুজনকে আলাদা করতে সক্ষম হয়। ওসি সাহেবের কাছে ছুটে গিয়ে সে হাঁপাতে শুরু করে। ওসি সাহেব অন্যান্য তথ্য জোগাড় করার চেষ্টা করছেন। তিনি কিবরিয়াকে দেখে অবাক হয়ে বললেন,
“পেছনে তো পাগলা কুত্তা দেখতে পাচ্ছি না। না কি তমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার খবর জেনেছেন?”
সিরিয়াস সময়ে এরকম রসিকতা ওর পছন্দ হলো না। চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে বলল,
“স্যার এসব কিছুই হয়নি। আমি দুজনকে আইডেন্টিফাই করতে সক্ষম হয়েছি। আমার মনে হচ্ছে এটা কোনো ছোটো খাটো চক্কর ছিল না। বছর খানেক ধরে অনেক পরিকল্পনা করে পুরো ঘটনা ঘটানো হয়েছে। নিজেদের মধ্যে কী ঝামেলা ছিল জানি না তবে প্রতিশোধের খেলা ছিল নিশ্চিত। একজন আরেকজনকে টক্কর দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। তবে আমার ধারণা হচ্ছে এর মূল পয়েন্ট ছিল তিমন সাহেব। তাকে পাওয়ার জন্য লড়াই হয়েছিল বোধহয়। তবে ভালোবাসার জয় হয়েছে।”
ওসি সাহেব পুরোপুরি শিওর এখন। তিনি মুচকি হেসে বললেন,
“আমারও এটাই মনে হচ্ছে। যে ফাঁদ পেতেছিল সে-ই নিজের জালে ফেঁসেছে। ক্ষতি তো সামান্য হলো। কথায় আছে না? ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার।’ এখন খোঁজ নিয়ে দেখেন তারা কোথায় গা ঢাকা দিয়েছে।”
কিবরিয়া বিমানবন্দরে খোঁজ নিতে গেল। তাদেরকে অনেক আগেই তথ্য চেয়ে অনুরোধ করা হয়েছিল। এক এক করে সবগুলো থেকে রিপোর্ট চলে আসলো। কিবরিয়া এসে হতাশাজনক হাসি দিয়ে বলল,
“তাদের কোনো খোঁজ নেই স্যার। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এয়ার রুট ব্যবহার করেনি। হয়তো অন্য রুটের মাধ্যমে ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে পৌঁছেছে।”
কিবরিয়া পরবর্তী নির্দেশের জন্য অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকল। ওসি সাহেবের ফোনের টোন বাজতেই তিনি মোবাইল হাতে নিলেন। ঠোঁটের হাসি চওড়া হতেই তিনি তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন,
“রানাকে আবিরার উপর নির্যাতন করার অভিযোগ গঠন করে মামলা সাজিয়ে ফেলেন। আর আপনার বিয়ের ব্যবস্থা দ্রুত করেন। তিমন সাহেবের বিয়ে করা দেখে আমার বিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। দেখেন দুজনকে কত সুন্দর মানিয়েছে।”
মোবাইল ফোনে কিবরিয়া হাসোজ্জল দম্পতিকে দেখে নিজেও রোমাঞ্চিত হলো। লজ্জায় মুখ নিচু করে রাখল সে। ওসি সাহেব হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
‘বলেন তো এটা আবিরা না কায়রা?’
কিবরিয়া হেসে ফেলল। সে মাথায় টোকা দিয়ে বলল,
“দুজনের ছবি দেখে আইডেনটিটি বের করার জন্য সব মুখস্থ করে ফেলেছি স্যার। তাদের জন্য শুভকামনা। আমি আইনের লোক হয়েও অপরাধীকে সাপোর্ট করলাম। তিমন সাহেব লোকটা একদম খাঁটি প্রেমিক।”
ওসি সাহেব সন্তুষ্ট হয়ে ফোনের ছবিতে পলকহীন তাকিয়ে থাকলেন। অবশেষে ভালোবাসার পূর্ণতা পেল। এরকম জীবনসঙ্গিনী সবাই চায়। তিমন সাহেবও ব্যতিক্রম ছিল না। নিরপরাধ লোকটির সুখী হওয়ার অধিকার আছে।
সমাপ্ত