মিঠে_আলোয়,পর্ব_৭
ফায়জা_করিম
অনেকগুলো মুখ, আলোর ঝলকানি, খালা-মামা, চাচাদের উত্তেজিত বাক্য বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে মিঠাইর বিয়েটা হয়ে গেল। কাবিনের কাগজে সই করার সময় নিজেকে একটা অনুভূতিশূন্য রোবট মনে হলো মিঠাইর। কেন যে সত্যিটাকে এখনও মানতে পারছে না ও… কেবলই মনে হয়, এই বুঝি অভ্র এসে ওকে বলবে, ” থাম মিঠি.. আমি তোমাকে ফেলে কোথাও যাইনি… এই দেখো। ”
কিন্তু সব স্বপ্ন সত্যি হয়না অথবা হয়তো পুরোপুরি সত্য হয়না। মিঠাইর মনে হওয়াটা আংশিক সত্যি হলো.. অভ্র এসেছে তবে মিঠাইর বিয়ে ঠেকাতে নয় বিয়ের দাওয়াত খেতে।
মিঠাইর বিয়েতে অভ্রর পুরো পরিবারকে দাওয়াত করেছে রেজওয়ান আহমেদ… অভ্র সস্ত্রীক এলো মিঠাইকে তার নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা জানাতে। কী সুন্দর সেজে গুঁজে কাপড়ের রঙ ম্যাচ করে পরে এসেছে ওরা দুজন… ঈর্ষায় পাগল হয়ে গেল মিঠাই।
যাবার আগে অভ্র যখন বলল ভাল থেক মিঠাই.. রাগে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে গেল মিঠাই।
চিৎকার করে বলতে চাইল,”আমি ভালই থাকব অভ্র…আমাকে নিয়ে তোমায় আর কোন চিন্তা করতে হবে না, কখনো না।”
এতে যে কী কষ্ট কাউকে যদি একটু বোঝাতে পারত মিঠাই।
একটা সময় ছিল যখন মিঠাই ক্লাসের পড়াগুলো না পারলেও অভ্রর চিন্তা হতো.. আর আজ সেই সব গল্পের শেষ লাইন লেখা হয়ে গিয়েছে। মিঠাইর নিজেকে একটা সুতো কাটা ঘুড়ি মনে হচ্ছিল.. মুক্ত কিন্তু দিকভ্রান্ত.. কোন কূলকিনারা নাই।
বিদায়ের সময় রেজওয়ান আহমেদ যখন মিঠাইকে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন, মিঠাই তখনও যন্ত্রের মতোই চলছে। কাঁদতে হয় বলে নিয়ম করে ক্ষানিকটা কাঁদলও ও… কিন্তু তবু মনের কষ্টটা কমলো না, বুকের উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে রইল।
“কী হলো মিঠাই.. একদম আইসবার্গ হয়ে গিয়েছ কেন?” অনন্য ছোট্ট একটা কুশন মিঠাইর পিঠের কাছে গুঁজে দিল।
অনন্যর প্রশ্নে খানিকটা অপ্রস্তুত হলো মিঠাই। অভ্র কী করে পারল তাই ভাবছি.. এ কথা বলাটা বোধ হয় এখন আর ওর ঠিক হবে না। বরঞ্চ তার আগেই নিজেকে সামলাতে হবে.. নইলে সবাই ওকে আত্মসম্মানহীন বলার সুযোগ পেয়ে যাবে। মিঠাই হাসল, খুব সুন্দর করে হাসল।
কিন্তু অনন্য মিঠাইর ফাঁকিটা ধরে ফেলল, মুখটা অন্ধকার করে জানতে চাইল,
“এখনও মন খারাপ! এখন তোমার আস্ত একটা বর আছে… তারপরও!”
“তুমি কী সব সময়ই এমন ফান করার মুডে থাক?”
“ফান.. আর আমি! আমি যে কতোটা কটকটে শুটকি দুদিন গেলেই তুমি টের পেয়ে যাবে কিন্তু তার আগে আমি নিজের গালে, আই মিন গায়ে ভালোবাসার দু চারটা সীল ছাপ্পর লাগাতে চাই। এখন তুমি অনুমতি দিলে আমরা কী সেদিকে অগ্রসর হতে পারি? আমরা কিন্তু থ্রি মান্থ প্লাস এক জন আরেক জনকে চিনি।”
অনন্যর কথায় গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল মিঠাইর। কী বলে এই লোক.. এতো তাড়াতাড়ি ফিজিকাল রিলেশনে যেতে চায় অনন্য! আজই তো মাত্র বিয়ে হলো।
“তুমি কী ভয় পেলে মিঠাই? আমি কিন্তু জাস্ট দু একটা চুমো খাওয়ার আবদার করলাম, নাহলে বন্ধু মহলে আমার ইজ্জতটা একদম ডাউন খেয়ে যাবে.. প্লিজ।”
চুমো! তাতেও গা গুলিয়ে এলো মিঠাইর। ভালোবাসা ছাড়া মানুষকে কী এতোটা স্পর্শ করা যায়? কিন্তু আজ হোক বা কাল… বেলতলায় মিঠাইকে যেতেই হবে।
আচ্ছা থাক, তোমার মনে হয় কষ্ট হচ্ছে।
না.. না.. তা নয়।
সত্যি? তাহলে তুমি বরং আমাকে একটা চুমো দাও। অনন্য নিজের কপালটা এগিয়ে দিল মিঠাইর দিকে।
অনন্যপায় হয়ে অনন্যর মন রাখতেই ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল মিঠাই। কিন্তু এই স্পর্শের কোন উত্তাপ নেই মিঠাইর কাছে.. এক টুকরো কাঠের মতো ছুঁয়ে এলো শুধু।
“সূক্ষ্ম তন্তুর বাঁধনে মোড়ান মাংসপিন্ড… তার ভিতরে ভিতরে বয়ে চলা অসংখ্য জালের মতো স্নায়ুর অনভিপ্রেত অনুভূতির আলোড়ন। সেগুলো জমাট বেঁধে যখন তোমার ইন্দ্রিয়কে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে দিবে.. শরীর স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করবে… আমরা তাকে ভালোবাসা বলবো,” এক টুকরো মিষ্টি হাসি দিল অনন্য। “ধন্যবাদ মিঠাই.. আমার কথাটা রাখার জন্য।”
“ইটস ওকে।”
“মিঠাই..”
“হমম…”
“ভালোবাসি”
মিঠাইর মনটা আদ্র হয়ে এল। এই একটা জায়গায় অনন্য আসলেই বোধহয় অনন্য৷ ও বাচ্চাদের মতো মিঠাইর কাছে সবটা উগরে দেয়। অনন্যকে পড়তে আজকাল মিঠাইকে খুব একটা বেগও পেতে হয়না। এই যে মাত্রই কী অকপটে নিজের ভালো লাগার জানান দিয়ে দিল। মিঠাইর বিশ্বাস অনন্য ওকে সত্যি ভালোবাসে, না হলে ওকে জেনেশুনে বিয়ে করত না। কিন্তু মিঠাইর যে আরও সময় চাই, ও অনন্যর মতো করে এগুতে পারছেনা। অভ্রর ভূত এখনও ওর মাথায় চেপে বসে আছে।
“মিঠাই.. আজকের রাতটা আমাদের জন্য স্পেশাল হওয়া উচিত। আমি কী তোমার জন্য বিশেষ কিছু করব যাতে তুমি স্পেশাল ফিল করো,” অনন্যর হাতটা মিঠাইর আঙ্গুলের আংটিটা নিয়ে খেলছে।
“অনন্য..”
“হমম”
“তুমি আমাকে যথেষ্ট স্পেশাল ফিল করিয়েছ.. এতোকিছুর পরেও, অভ্রকে পাওয়ার জন্য আমাকে সাপোর্ট দিয়েছ, আমি হেরে যাওয়ার পরও আমাকে ফেলে পালাও নি.. উল্টো আমি ই আসলে তোমাকে কোন রকম স্পেশাল ফিলিংস দিতে পারিনি, এটা আমার ব্যার্থতা। এরকম হলে আমি আবারো হেরে যাবো। কিন্তু আমি আর হেরে জেতে চাই না। আমি চাইনা আমার মতো তোমার ওয়েডিং নাইটও নষ্ট হোক। আসলে আমি জানিনা আমার মন কতদিনে সেটাপ হবে, আদৌও হবে কিনা… তার জন্য তুমি কেন সাফার করবে? তুমি তোমার প্রাপ্য বুঝে নিতে পারো.. আমার কোন অবজেকশন নেই,” মিঠাই শান্ত মুখে বললো। ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, ও অনন্যকে সুখি হওয়ার সুযোগ করে দিবে। বাবা বলেছে বিয়ে মানে শুধুই ভালোবাসা না.. এটা একটা বড়ো দায়িত্বও। সংসার মানে নাকি দুজন লোক মিলে তিনপায়ে দৌড়ান। যার এক পা তো স্বাধীন কিন্তু আরেক পা বাঁধা। মিঠাই ওর বিয়েটা বাঁচাতে চায়… তিন পায়ের দৌড়টাতে ও কিছুতেই হেরে যেতে চায় না।
“আমাকে কী তোমার খুব লোভী, কামুক পুরুষ মনে হচ্ছে মিঠাই, যে ভালোবাসাহীন একটা সম্পর্ককে জোর করে তোমার মধ্যে রাখতে বাধ্য করবো? আমি কিন্ত তেমন পুরুষ নই।”
“আমি জানি,বুঝতে পারছি। সেজন্যই সংকোচ লাগলেও কথাগুলো বললাম। আসলে সমস্যাটা আমার… আমার মনের মধ্যে একটা অসুখ অনেক দিন ধরে বাসা বেঁধেছে । কিন্তু আমার জন্য তুমি কেন সাফার করবে শুধু শুধু, তোমার তো কোন দোষ নেই। তুমি তো আমাকে নির্ভেজাল ভাবেই ভালবাস। তোমাকে ঠকানোর কোন অধিকার তো আমার নেই। আমি তোমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী.. আমার উপর তোমার অধিকার থাকবে এটাই স্বাভাবিক আর আমি সেটা মানিও। শুধু তোমার কাছে অনুরোধ…. আমার মন খারাপ কিনা এই কথাটা তুমি আর কোনদিন জানতে চাইবে না।”
“তুমি শিওর.. যে এই কথাটা আমার জিজ্ঞেস করা ঠিক হবেনা। ”
“হমম.. কারন যতোবার তুমি এটা জানতে চাইবে আমার মন আরও খারাপ হবে কারন আমি ততোবার তোমাকে মিথ্যা কথাটা বলব। ”
“আচ্ছা…। ”
“মিঠাই…”
“তুমি কী শিওর যে আমি আদর করলে তুমি সেটা নিতে পারবে… তোমার কষ্ট হবেনা? ”
“হবে.. কিন্তু অভ্র আমার জীবনে আর নেই। আসলে আমি যেভাবে ভাবতাম সেভাবে তো ও কোন কালে ছিলই না। এটা মেনে নিতে আমার যতোটা কষ্ট হচ্ছে তোমাকে মেনে নিতে বোধ হয় ততোটা কষ্ট হবে না। আর বিয়ে যখন হয়ে গেছে, আজ কিংবা কাল আমাকে এটার মুখোমুখি হতেই হবে।”
“আজকের পর আমি তোমাকে আর কখনো কষ্ট পেতে দিব না, আমি আছি তোমার পাশে,” দু’হাতে আকড়ে ধরল অনন্য মিঠাইকে।
“জানি..”
“শুধুই জানো?”
“না.. মানিও। তুমি অনেকবার তার প্রমান দিয়েছ।”
মিঠাইর কথায় অনন্যর চোখ দুটো হেসে উঠল।
এই একটা জিনিস মিঠাইর খুব পছন্দ হয়েছে….অনন্যর চোখ দুটো, একটু হাসলেই চোখ দুটো বাঙময় হয়ে উঠে।
মিঠাই টের পেল অনুমতি পেয়ে অনন্যর হাত দুটো ওর গলার কাছে উঠে আসছে.. মিঠাই সেই স্পর্শে মরিয়া হয়ে ভালোবাসা খুঁজতে লাগল… অভ্রকে ভুলতে হলে এই ভালোবাসাকে ওর খুঁজে পেতেই হবে।
বাকি রাতটা মিঠাই এক অদ্ভুত রকম যন্ত্রনা নিয়ে কাটাল। সেই যন্ত্রনা যতোটা না শরীরের তার চেয়ে কয়েক হাজার গুন মনের। কেউ ওর শরীরের প্রতিটি খাঁজে আতিপাতি করে ভালোবাসা খুঁজছে অথচ ও এক স্পষ্ট মরিচীকা মতো.. কেবলই চোখের ধোঁকা.. এক ফোঁটা ভালবাসা অনন্যকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি।
বাথরুমের আয়নায় শরীরের কারুকাজগুলো যখন জানান দিচ্ছিল… ওগুলো অনন্যর ভালোবাসার ছাপ, নিজেকে ততোটা ঘৃনা হচ্ছিল মিঠাইর। ঠিক এমনি করেই নিশ্চই অভ্র ওর বউকে আদর করে… উফফ.. ওর.. ওর কেবলই অভ্রকে
এতো ঘৃনার পরও কেন অভ্রকে ঘিরে ওর চিন্তাগুলো ঘুরপাক খায়.. নিজের উপরই ভীষন রকম ঘৃনা হলো মিঠাইর।
“আমরা কী আজ কোথাও ঘুরতে যেতে পারি ম্যাম?” অনন্য বলল।
“যেতে পারি.. কিন্তু কোথায়? কতদূরে?”
“দেখছি.. আশেপাশের কোন রিসোর্টে যাওয়া যায়.. ওদের অনেক ধরনের প্যাকেজ চলে সব সময়।”
“তাহলে আমরা একরাত থেকে আসতে পারি এমন জায়গা দেখো.. এখন যাব কাল সকালে চলে আসব।”
“আচ্ছা”
“অনন্য…”
“কী?”
“ধন্যবাদ.. কাল রাতটা হয়তো আমাদের বেস্ট রাত ছিলনা কিন্তু সব কিছুর শুরুই যে বেস্ট হতে হবে এমন তো কথা নেই.. যার শেষ ভাল তার সব ভাল। আমাদের শেষটা সুন্দর হবে দেখো,” মিঠাইর গলায় অনুশোচনা ঝরে পড়ল।
“নিশ্চই.. তুমি এ নিয়ে এতো ভেবনা, আমাদের শেষটা সুন্দর হবে.. আমি জানি।”
“তুমি শেষ অব্দি আমার সাথে থাকবে তো, অভ্রর মতো মাঝপথে আমাকে ভুলে যাবে নাতো?”
“একেবারেই না, আমি আসলে খুব চিপকু টাইপের লোক… একবার যা ধরি তাকে গাবের আঠার মতো ধরি সহজে ছাড়ানো যায় না,” অনন্য হো হো করে হাসতে লাগল। ওর হাসিটা এমন যে মিঠাইর দুই গালেও দুটো মিষ্টি টোল পড়তে বাধ্য হলো।
চলবে………