একটু একটু ভালোবাসি,সূচনা পর্ব
লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
ভরা রেস্টুরেন্টে সবার সামনে একটা অপরিচিত ছেলে আমার কপালে শব্দ করে চুমু দিয়ে সটান হয়ে আমার সামনের চেয়ারে বসে পড়লো। আমি আকস্মিক ধাক্কাটা সামলাতে না পেরে বিস্ময়ে থ মেরে রইলাম। মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেছে। ছেলেটা ঠোঁটে মুচকি হাসি বজায় রেখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমার পাশে আমার বান্ধবীও হতভম্ব চোখে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে।
ছেলেটার এমন নির্লিপ্ত চেহারা দেখে আমার অস্বস্তির পরিমাণ আরো বেড়ে গেলো। রেস্টুরেন্টের সবার চোখ আমাদের দিকে। আমি ধীরেধীরে অনুভব করলাম, আমি লজ্জা পাচ্ছি। ভীষণ পরিমাণে লজ্জা পাচ্ছি। কোনো ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করার ক্ষমতা কোনোকালেই আমার ছিলো না। বেশি কথা বলা আমার পছন্দ না। কিন্তু এই লোকটাকে কিছু বলা প্রয়োজন। অপরিচিত একটা মেয়েকে পাবলিক প্লেসে টুপ করে চুমু খাওয়ার অপরাধে অন্তত দু’চারটা বকা হলেও দেওয়া দরকার। কিন্তু লোকটার চাহনি দেখে কিছু বলার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেললাম। আশ্চর্য! এই লোকটা এমন করে তাকিয়ে আছে কেন?
—-সিরাত ডার্লিং! আমি তোমাকে অনেক মিস করছিলাম। চলো একটা হাগ করি….
কি সাংঘাতিক কথাবার্তা আল্লাহ! ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার গলা বেয়ে ঘাম ছুটে গেলো, অতিরিক্ত পানি পিপাসায় পিপাসিত হয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হওয়ার পথে। নির্ঘাত এই লোকটা পাগল। নাহ্ এক মুহূর্ত থাকা যাবে না এখানে। নাহলে, এই লোক আমাকে আজ মেরেই ফেলবে।
আড়চোখে একবার রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে তাকিয়ে আরেকবার অসহায় চোখে লোকটার দিকে তাকালাম। এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন, আমাকে চেনে। আমি নিজেও কনফিউজড হয়ে ভাবলাম, আমি কি আদৌ লোকটাকে চিনি? উরুতে রাখা ব্যাগটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে দিলাম একটা ভোঁ দৌড়। এমন দৌড় দিলাম যেন, নবাব সিরাজুদ্দৌলার চিরশত্রু মীর কাশেম আমাকে তলোয়ার নিয়ে তাড়া করছেন। একটা চলন্ত বাসে উঠে সোজা বাড়িতে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।
রাতে,
সেই দুপুরবেলা বাড়িতে পৌঁছানোর পর শাওয়ার নিলাম, ঘুমালাম, আম্মুর সাথে গল্প, ছোট ভাইয়ের সাথে খুনসুটি এত কিছু করলাম তবুও, ঐ পাগল লোকটার কথা এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারছি না। লোকটার উপর এখন ধীরেধীরে রাগ লাগছে। প্রতিক্রিয়াটা এতক্ষণ পর ধীরেধীরে উদয় হলো। তখন লোকটার সামনে এলে কি হতো! রাগে আপাদমস্তক জ্বলছে। এতো বড় সাহস! চিনি না, জানি না হুট করে চুমু খাবে কেন?
রাগের মাথায় পড়াতে মন বসাতে পারলাম না, কপাল কুঁচকে আছে। বারবার লোকটার চাহনি চোখের সামনে ভাসছে। ঐ লোকটাকে আরেকবার সামনে পেলে মেরেই ফেলবো। বেয়াদব, অসভ্য, ইতর! কাঁদো কাঁদো হয়ে মায়ের সামনে গেলাম।
— মা জানো আজ একটা লোক আমাকে কি করেছে?
মায়ের মুখের রং মুহূর্তেই পাল্টে গেলো।
—- কে কি করেছে?
হুঁশ হলো আমার। ইশশ! কি করতে যাচ্ছিলাম আমি? চুমুর মতো একটা লজ্জার ব্যাপারকে আমি বলে দিচ্ছিলাম!!! এমনিতেই মা আমার বিয়ে নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। আর বাবা জানলে তো কলেজ যাওয়ায় বন্ধ করে দেবে। হতাশ মুখে মাকে কিছু না বলে নিজের রুমে চলে এলাম।
একটুপর ইফতি এলো রুমে৷ বললো বাবা আমাকে ডাকছে। বুকে হাতুড়িপেটানো শুরু হলো আমার। বাবাকে আমি যমের মতো ভয় পায়। বাবা কি এই চুমুর ব্যাপারটা কোনো প্রকারে জানতে পেরেছে? জানলেও জানতে পারেন৷ কারণ রেস্টুরেন্টের অবস্থান বাবার অফিসের আশেপাশেই। খানিকটা দ্বিধাবোধ নিয়ে বাবার সামনে দাঁড়ালাম। বাবার মুখ গম্ভীর, আমার ভয় হলো খুব। যদিও উনার মুখ সবসময় এমনই থাকে৷ হিম ধরা গলায় বললাম,
— বাবা আমাকে ডেকেছো?
বাবা এবার গম্ভীর চোখে তাকালেন।
—- আজ নাকি রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলে দুপুরে? কার অনুমতি নিয়ে?
বুক ধুকপুক করছে৷ নির্ঘাত বাবা জানতে পেরেছে। আজ আমাকে মেরেই ফেলবে হয়তো।
—- মাকে বলে গিয়েছিলাম৷ শিলাও ছিল আমার সাথে৷
বাবা এবার ধমকে উঠলেন,
—– কিসের মা! আমাকে একবারো বলার প্রয়োজনবোধ করোনি। কলেজে পড়ো, ছোট নেই তুমি। বাচ্চা দুটো মেয়ে কোনো অভিভাবক ছাড়া হুট করে এতোদূরে গেলে কোন সাহসে? যদি কিছু হয়ে যেতো? আমাকে একবার অন্তত ফোন করতে পারতে৷ যাও পড়তে বসো। এরপর থেকে বাইরে যেতে হলে, তোমার মা এবং আমি দুজনের কাছেই পারমিশন নিয়ে বের হবে৷
— জ্বি বাবা।
মুখ কালো বাবার সামনে থেকে চলে আসলাম। বাবা এসব ব্যাপারে খুবই স্ট্রেইট। ঠিকই বলেছেন তিনি৷ আজ যদি বড় কেউ আমার সাথে থাকতো, তাহলে এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না।
আমি আনজুমান সিরাত। ইংলিশ নিয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে অধ্যয়ন করছি। আমার ছোট ভাই ইফতি
চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে৷ মা-বাবা আর আমার ছোট ভাই মোট চারজনের সদস্য নিয়ে ছোট পরিবার আমাদের। বাবার সরকারি চাকরিজীবীআর মা গৃহিণী। বাবা-মা শাসনের কোনো কমতি রাখেনি তবুও এই ছোট্ট পরিবারে ভালোবাসার কোনো কমতি নেই৷ এককথায় হ্যাপি ফ্যামিলি। ছোটবেলা থেকেই বেশ ভালো ছাত্রী আমি। এই পড়াশোনার চক্কর আর মা-বাবার চাপে কোনোদিন রিলেশনের মতো একটা সম্পর্কে জড়ানোর সময়-সুযোগ হয়নি। টানা একমাসের পকেটমানি জমিয়ে আজ দুপুরে আমার বান্ধবী শিলার সাথে শহরের বেশ নামি-দামি একটা রেস্টুরেন্টে চাইনিজ খেতে গিয়েছিলাম ৷ সেখানেই ঘটলো অঘটন। এক অর্ধপাগল লোক আমার গালে চুমু দিয়ে আরো বলে, ডার্লিং চলো হাগ করি!!! ভয়ে আমার কলিজা এতোটুকু হয়ে গিয়েছিলো তখন৷ এমন সিচুয়েশনে পড়তে হবে আমি কখনো ভাবতেও পারিনি।
একরাশ চিন্তা নিয়ে কম্পমান হাতে শিলাকে কল করলাম। বেচারির কি অবস্থা কে জানে!! প্রথম রিংয়েই রিসিভ করলো সে। কাঁদো কাদো গলায় বললাম,
— হ্যালো শিলা! আমার কি হবে এখন? খুব ভয় করছে রে…
—– আমাকে তখন একা বাঘের খাঁচায় ফেলে এখন জিজ্ঞেস করছিস কি হবে?
—- প্লিজ এভাবে বলিস না।
শিলার ব্যবহার বরাবরই ঐরকম। ভালো করে কারো সাথে কথা বলেনা৷ বললেও ঘ্যাটঘ্যাট করে বলে। আমার বেশিরভাগ সমস্যা শিলা’ই সল্ভ করে।
—- ভয়ের এখনো কি দেখেছিস! ঐ ছেলেটা কি করেছে জানিস? জোর করে তোর নাম্বার নিয়েছে।
—- কিইইইই? তুই দিয়ে দিতে পারলি নাম্বারটা?
—- না দিয়ে কি করবো! হুমকি দিচ্ছিলো আমাকে। গান দিয়ে নাকি শুট করবে।
ভয়ের পরিমাণটা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো।
— তুই গুলি দেখেছিলি?
—- না দেখিনি। তবে আমার মনে হয়েছে লোকটা মিথ্যে বলেনি। দোস্ত কি করবি কিছু ভেবেছিস?
—- ভাবাভাবির কিছু নেই৷ আমি এক্ষুনি মোবাইল সুইচড অফ করে রাখবো। বিকেল থেকে আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে আমার মোবাইলে।
শিলার কল কেটে আমি মোবাইলটা বন্ধ করে রাখলাম। হতে পারে ঐ আননোন নাম্বারটা ঐ পাগল লোকটার। ঐ লোকটাকে এই জীবনে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে এসব করার মানে কি? আমার নাম্বার দিয়ে কি করবে? দেখেতো ভদ্রই মনে হয়েছিল কারণ লোকটা রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে ঢোকার সময়-ই আমার নজর সেদিকে যায়। বেশ লম্বা-চওড়া, বেশ স্বাস্থ্যবান, স্যুট-বুট পড়ে সাহেব সেজে, শেষে কিনা এমন একটা অভদ্র কাজ করলো! এখন যদি আম্মু কোনোভাবে ব্যাপারটা জেনে যায়, আমার বিয়ে কনফার্ম করেই ছাড়বে। আমি এখনই বিয়ে করতে চাইছি না।
টেনশনে আমি সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। একপ্রকার ছটফট করেই কাটিয়ে দিলাম। এক অজানা ভয়ে বুক দুরুদুরু করে কাঁপছিল। যখনই চোখ সামান্য লেগে আসছিলো, ততবারই মনে হয়েছে এই বুঝি কেউ আমার গালে চুমু দিলো, এই বুঝি সর্বনাশ হলো….. সারারাত দুই গালে হাত রেখে কাটিয়ে দিলাম আমি। মনে মনে হাজারবার প্রার্থনা করতে লাগলাম, আর কোনোদিন যাতে ঐ লোকটার সাথে দেখা না হয়। যদি দেখা হয়, হয়তো এক চেয়েও ভয়াবহ কাজ করে বসবে লোকটা। আর আমিও কোনো প্রতিবাদ করতে পারবো না। কেনো যে এই প্রতিবাদ করে সরাসরি কিছু বলার ক্ষমতা দেয়নি আল্লাহ! এখন আমার রাগ লাগছে ধুর!
চলবে?