এক_প্রহরের_খেলা,২৭ শেষ
মোর্শেদা হোসেন রুবি
বেডে শুয়ে চুপচাপ রাত দশটার সংবাদ দেখছিলাম। একটু আগেই নার্স এসে ইঞ্জেকশান পুশ করে গেছে আর রাতের খাবারগুলো খেয়ে ঔষধ নেবার কথা মনে করিয়ে গেছে। সে নিজেই খাইয়ে দেবে কিনা জানতে চাচ্ছিলো, আমি রাজী হইনি। নার্স হোক চায় যে হোক, আম্মু ছাড়া আর কারো হাতে খাবার রুচি নেই আমার। একজনের হাতে খাবার খুব ইচ্ছে আছে কিন্তু ভাগ্যে আছে কিনা জানিনা। এমনিতে গত কয়েকদিন ধরে আমার খাওয়া আম্মাই খাওয়াচ্ছেন। নায়লা একবার খাওয়াতে চেয়েছিলো, কিন্তু আমার অনীহার কারণে পারেনি। আমি ওকে বন্ধুর জায়গাতেই দাঁড় করিয়ে রেখেছি। বাড়তি খাতিরের সুযোগই দেইনি। আজ সকালে আম্মা ঝিনাইদহ যাবার কারণে দুপুরে সে একটা চান্স নিয়েছিলো কিন্তু সেটাও সেটা সফল হয়নি। বাম হাতে একাই খেয়েছি। এটা অনেকটা না বলে বুঝিয়ে দেবার মতো অবস্থা। এমনিতেও আমি রুমকি ছাড়া আর কাউকে এই অধিকার দেবার কথা ভাবতে পারিনা । তাছাড়া আমি ডান হাতে জোর না পেলেও বাম হাত বেশ ভালোই নাড়াচাড়া করতে পারি। অবশ্য না পারলেও আমি আব্বাকেই বলতাম। তবু এর তার হাতে খেতাম না। আব্বা আজ ভোর থেকেই আমার সাথে আছেন। কারণ আম্মু দলবল নিয়ে ঝিনাইদহ গেছেন রুমকিকে আনতে। আমার অস্থিরতা আর মনখারাপ দেখেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নইলে অামাকে এ অবস্থায় হাসপাতালে রেখে তিনি কোথাও যাবার মত মানসিকতায় ছিলেন না। তাঁর ইচ্ছে আছে আজই ঢাকায় ফিরে আসার কিন্তু সময় কুলাতে না পারলে হয়তো কাল ভোরে রওনে দেবেন। কে জানে কখন ফিরবেন। মন তো চাইছে আম্মু আজই ফিরে আসুক।
কে জানে কখন রুমকিকে দেখবো। আহা, তার জোড়া দাঁতের হাসি। ভাবতে গিয়ে চোখ বুঁজে এলো। প্রতিবারই এমন হচ্ছে। দাঁত ভাবতে গিয়ে অন্য কিছুই ভাবনাতে চলে আসছে। নাহ্, এভাবে নিজেকে কষ্ট দেবার মানে হয়না। আধশোয়া থেকে উঠে সোজা হয়ে বসলাম। খিদেটা এখনও চাগিয়ে উঠেনি যদিও। তারপরেও খাবো খাবো একটা অনুভূতি কাজ করছে। আব্বাকে বললে অবশ্য তিনি খুশি মনেই খাইয়ে দেবেন। কিন্তু আমারই সংকোচ হয় তাঁর হাতে খেতে। অথচ একটা সময় এই আব্বার হাতে কত খেয়েছি। কলেজে ওঠার পর থেকেই আব্বার সাথে দুরত্ব তৈরী হতে শুরু করেছে। আজ চাইলেও আব্বার কাছাকাছি হতে পারিনা।
আব্বা ইতোমধ্যেই দু’বার জিজ্ঞেস করে ফেলেছেন আমি খাবো কিনা। আমি সাফ মানা করে দিয়েছি খিদে নেই বলে। তাছাড়া আজ নায়লাও নেই। ঐ দিন রুড হবার পর থেকে সে একটু সরে সরেই থাকছে। এমনিতে গত কয়েকদিন রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত ঘুরঘুর করছিলো। আজও এসেছিলো সকালে কিন্তু আম্মুর ঝিনাইদহ যাবার সংবাদ শুনে আর দেরী করেনি। রাত আটটার দিকেই চলে গেছে। ভেবেছিলাম কিছু বলবে কিন্তু বলেনি। নিরবেই চলে গেছে। আমাকে আটকানোর কোন পথই ওর কাছে নেই। কারণ আমাদের চার বছরের ঠুনকো সম্পর্কের ব্রেকাপ ও নিজেই ঘটিয়েছে। আর এটা ওর মজ্জাগত। কথার আগে ব্রেকাপ করা আর মেজাজ ঠান্ডা হলে ফোন দিয়ে ডেকে কথা বলা। এতোদিন ওর সেসব ফোন কল পেয়ে ছুটে গিয়ে নিজ থেকেই সমঝোতা করেছি। কারণ সেদিন আমার যাবার কোনো জায়গা ছিলো না। আজ আমার একটা সুন্দর গন্তব্য আছে। সেই গন্তব্যের পানে যাবার লোভে আজ প্রথমবারের মতো নায়লার সাথে সমঝোতার প্রয়োজন মনে করছি না। কেউ আমায় স্বার্থপর বললে বলুক। হু কেয়ার্স।
ফের শুয়ে পড়লাম। খিদে লাগলেও খেতে ইচ্ছে করছেনা মোটেই। বরং হালকা ঘুম পাচ্ছে যেন আমার। চুপচাপ টিভি দেখতে লাগলাম। দেখতে দেখতেই বোধহয় আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। কখন যে চোখটা লেগে এসেছিলো নিজেই টের পাইনি। আব্বার কণ্ঠে সম্বিত ফিরলো আমার। চোখ মেলে দেখলাম তিনি একা একাই কী নিয়ে যেন মন্তব্য করছেন। তার ব্যগ্র দৃষ্টি টিভির দিকে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও চোখ রাখলাম টিভির উপর। শুনলাম আব্বা স্ক্রিণের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া নিউজগুলো শব্দ করে পড়ছেন। পুরোটা শুনে ঘুম ঘুম স্বরেই বললাম, ” এগুলো এখন আর অবাক হবার মতো খবর না আব্বা। আজকাল এসব হরহামেশাই হচ্ছে।”
-” তা তো হচ্ছে। তবে এভাবে নিজের বাড়ীর আশ্রিতাকে কেবল সম্পত্তির জন্য কিডন্যাপ করতে চাওয়াটা অন্যায়। তার উপর মেয়েটা পিতৃমাতৃহীনা। লোকটা এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তি বলেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে মেয়েটাকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিলো। এখন তো তিন পিতা পুত্রই ধরা খেয়েছে। উচিত শিক্ষা হইসে।”
-” হম, নারীশিশুর মামলাগুলো তো বেশ জটিল হয় শুনেছি। সহজে ছাড়া পাবেনা বলেই মনে হচ্ছে তবে এটাই আশ্চর্য যে থানা ওদের মামলা নিয়েছে। ”
-” হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে এটা তোর শ্বশুরবাড়ী এলাকাতেই ঘটেছে। রুমকি এলে জানা যাবে।”
‘রুমকি’ শব্দটা ছোট্ট হাতুড়ীর আঘাত করলো হৃৎপিন্ডে। অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়লো আমার। প্রসঙ্গ এড়াতে বললাম, ” জায়গাটা আগে খুব ভালো ছিলো। আজকাল কেমন যেন ক্রাইম পয়েন্ট হয়ে গেছে। এটা সেটা লেগেই থাকে। ” বলতে বলতেই বাম হাতটা মাথার পেছনে ভাঁজ করে রেখে তাতে মাথা রাখলাম। রুমকি নামটা চুম্বকের মতো টানছে আমাকে। ভাবনার গভীরে ডুব দিয়ে রুমকির সাথে পার করা কিছু সুন্দর মুহূর্ত খুঁজলাম। কোনটা রেখে কোনটা ভাববো। সবগুলোই তো সুন্দর। মুখোমুখি গল্প করা, অবুঝ তর্ক করা, রুমকিকে থামানোর জন্য লজ্জা দেয়া, হুট করে রুমকির একেবারে কাছে চলে যাওয়া। ভাবতে গিয়ে অজানা শিহরণে নড়েচড়ে উঠে ঘুমের ভান করে তলিয়ে গেলাম ভাবনা রাজ্যে। কল্পনার রঙীন রঙে সাজাতে শুরু করলাম ওটাকে।
ঐ অবস্থাতেই টের পেলাম হালকা শীত মতো লাগছে। জানালা গলে বাইরে তাকালাম। আজও বৃষ্টি হবে কিনা কে জানে। কেমন যেন ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। রুমের এসি বন্ধ রেখেছি আমি। নয়তলার জানালা দিয়ে ছোট ছোট বাতাসের ঝাপটা ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাকে। আপনা হতেই চোখ মুদে এলো। টের পেলাম আমার গায়ে চাদর টেনে দিচ্ছে কেউ। এ নির্ঘাত আব্বা। চোখ মেললাম না কারণ জানি তাতে আমার সাজানো স্বপ্নটা নষ্ট হয়ে যাবে। আব্বা আমার মাথার বালিশটা ঠিক করে আমার মাথাটাকে জায়গামতো বসিয়ে দিলেন। বিরক্তি নিয়ে নড়েচড়ে বালিশে মুখ গুঁজলাম। সবসময়ের মতো আজও আব্বা জ্বালাতে এসেছে আমাকে। সেও এরকম একটা সময়ে। এখন রুমকি আমার সাথে আছে। ওর চুলের ঘ্রান পাচ্ছি আমি। এরই মধ্যে আব্বার যন্ত্রণা। কলেজে ভর্তির পর পর যখনই দিনদুপুরে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতাম তখনই আব্বা এসে হাঁকডাক করে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে বলতেন, অসময়ে শুয়ে থাকা কিসের। সেদিন গুলোতে সম-সাময়িক সহপাঠিনীদের নিয়ে ভাবতাম। সারাদিনে যা চোখে দেখতাম অবসরমতো ঘুমের ভান করে তার জাবর কাটতাম। আর প্রতিবারই নিজের বেহাল দশা হবার পর উঠে গোসল করতাম। সেসব দিন ছিলো অন্যরকম। আজ তো নিজের বউকে নিয়ে ভাবছি। সেটাও কী আব্বা দেবেনা। আব্বাগুলোর ভূমিকাই বুঝি এমন। কাবাবে হাড্ডি।
নিরবে পড়ে থাকতে গিয়ে বোধহয় ঘুমিয়েই পড়ছিলাম। আচমকা অতি কাঙ্খিত কণ্ঠে ঝাঁকি খেয়েই ঘুমঘোর কেটে গেলো আমার। চোখ মেলে দেখলাম আম্মা আমার পায়ের কাছে চাদর ঠিক করে দিচ্ছে। আর এটা সেটা গোছাচ্ছে। আম্মাকে দেখে দারুণ চমকে দরজার দিকে তাকালাম কারণ জানি, আম্মা মানেই রুমকি। আমাকে চোখ মেলতে দেখে আম্মাই হেসে এগিয়ে এসে চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন, ” কীরে তোর ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম? ”
আমি তখনও বাকরুদ্ধ। নির্বাক দৃষ্টি দিয়ে বলতে চাইলাম রুমকি কোথায় আম্মা ! কিন্তু আম্মা সেটা লক্ষ্য না করে নিজের মতো করে কথা বলতে লাগলেন। আর আমার ব্যাকুল দৃষ্টি আতিপাতি করে খুঁজতে লাগল আমার স্বপনচারিনীকে। আম্মা বোধহয় সেটা টের পেলেন। স্বর তুলে ডাকলেন, ” এ্যাই, রুমকিকে ছাড়েন তো। ওকে এদিকে পাঠিয়ে দেন। ঋভূর ঘুম ভেঙে গেছে। আপনার এসব কথা পরে জানলেও চলবে। ” বলেই আম্মা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করতে লেগে গেলেন। আর আমার দৃষ্টিসীমায় এসে হাজির হলো রুমকি। ওর ঠিক পেছনেই আমার বাবা। রুমকি মৃদু শব্দে সালাম দিলো আমাকে। আমার অবস্থা এখন শোচনীয়। কী বলব বা করব বুঝতে পারছিনা কারণ আমার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য আব্বা হা করে তাকিয়ে আছেন। আমি নির্বিকারে মাথা নাড়লাম রাশভারী স্কুল শিক্ষকদের মত করে। যেন রুমকি আমার ছাত্রী। স্কুলে ভর্তি হতে এসেছে। আমি চোখ সরিয়ে নিতেই আব্বা বললেন,
– ” কী আশ্চর্য, মেয়েটা তোকে সালাম দিলো আর তুই বোবা মেরে আছিস কেন? জবাব তো দে। সালামের জবাব দেয়া তো ওয়াজিব।”
প্রচন্ড রাগ হলেও আব্বার কথার প্রতিক্রিয়ায় শান্ত মুখে সালামের জবাব দিলাম। মনে মনে আর্তনাদ করে উঠলাম, মা আব্বাকে নিয়ে এখান থেকে যাবে প্লিজ ?
আব্বা বলতে লাগলেন, ” বুঝলে মা। ঋভূর অবস্থা দেখলে তুমি নিজেই ভয় পেয়ে যেতে। ছেলেটার মরণদশা দেখে আসলে সেন্স অফ প্রোপোরশন ঠিক রাখতে পারিনি। আমি জানি, তুমি মনে কষ্ট পেয়েছ। আব্দুল্লাহ ভাই তো…..!”
-” মা খিদে লেগেছে।” মরিয়া হয়ে বললাম আমি। জানি এ ছাড়া রুমকিকে একান্তে পাবার আর কোন সুযোগ নেই। আম্মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি অসহায় চোখে আরেকবার রুমকিকে দেখলাম। রুমকিও আড়চোখে একবার দেখেই চোখ সরিয়ে নিয়েছে। লক্ষ্য করলাম বেচারী এই কদিনেই একদম শুকিয়ে গেছে। তবে চেহারার লাবন্য তাতে বিন্দুমাত্র কমেনি। বরং চোখ দুটো যেন আরো বেশী চকচক করছে। ওকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ রেখে কথা বলার ইচ্ছাটাকে গলাটিপে হত্যা করলাম। এমন বিবেকহীন বাপ-মা আমি জীবনে দেখিনি। নিজে কী সুন্দর আব্বাকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে অথচ মাত্র সকালেই তাকে ছেড়ে গিয়েছিলো সে। আর আমার সাথে আমার বউয়ের কতগুলো দিন পর দেখা। তার উপর মরতে মরতে বেঁচে গেছি দুজনে। আমাদের ফিলিংসটা কী তাদের বুঝে আসছে না ?
মিনিট দশেকের মধ্যেই আমার খাবারের বন্দোবস্ত হলো। রুমকি হাত ধুয়ে আমাকে খেতে বসতেই আব্বা বলে উঠলেন, ” আমি তাহলে বাড়ী যাই কী বলো। সারাদিন বসে থেকে কোমড় ধরে গেছে আমার। বাড়ী গিয়ে একটু ঘুমাবো আমি।”
-” ওমা, তুমি একা যাবে নাকি। আমি যাবো না ? সারাদিন তো দৌড়ের উপর। একটু না ঘুমালে তো আমারও খারাপ লাগবে। রুমকি তো আছেই এখানে। আমিও যাব চলো। ”
দুজনের কথোপকথন নিরবে শুনলাম। বুঝতে পারছি তারা আমাদের নিজেদের মতো করে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে যাচ্ছে। আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম একটি কাঙ্খিত প্রহরের।
=====
পরদিন সকালে চেক আউট করে বেরোনোর পরপরই ফোন এলো আজাদের মোবাইলে। আননোওন নাম্বার থেকে। হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা রিসিভ করতেই শুনলো অতি কাঙ্খিত সেই কণ্ঠস্বরটা। রিনেরিনে কণ্ঠে ধমকাচ্ছে ওকে। আহা, ধমকও বুঝি এতো সুন্দর হয়। সে আস্থার সাথে বললো, ” ধমকা ধমকি করে লাভ নাই। আমি এখন বাসে উঠব। কিন্তু কোন বাসে উঠবো তা জানিনা। যদি রাঙামাটির ঠিকানা পাই তাহলে সোজা রাঙামাটির বাসে উঠব আর তা না হলে সোজা ঝিনাইদহ চলে যাব। থানায় গিয়ে আত্মসমর্পন করে বলব, অদিতিকে আমি কিডন্যাপ করেছি। এই মিথ্যা অভিযোগও আমার তৈরী। তারপর আমার জেল ফাঁসি যা হবার হয়ে যাক সমস্যা নেই। কার জন্য বাঁচবো। আমার কী কেউ আছে নাকি এই দুনিয়াতে ? ”
-” ঢং দেখাবা না বলে দিলাম। ” তেতে উঠলো অদিতি।” তোমার মামাত বোন রুমকি আছে না। তোমার আবার কেউ নেই কে বললো? ”
-” রুমকিও তোমার ঈর্ষার পাত্রী হতে পারে ভাবিনি। প্রথমত সে বিবাহিতা দ্বিতীয়ত আমি ওর মোহে মুগ্ধ ছিলাম, ভালোবাসিনি। ওটা আমি তোমাকেই দান করেছি। অথচ তুমি না বলে আমাকে এতবড় একটা আঘাত দিলে শুধু সন্দেহের বশে?” আজাদের গলায় রাগ না কষ্ট বোঝা গেলো না। অদিতি এবার স্বর নামিয়ে বললো, ” মামা সহ ওদের দু ‘ভাইকে তুমি এ্যারেস্ট করিয়েছ। মামার সদস্যপদ বাতিল হয়ে গেছে তোমার কারণে।”
-” ওহ্, এখনও মামার জন্য শোক করছো আর আমি যে এখানে ধুঁকে মরছি তার কী? ”
-” তো আমি কী করবো ? ”
-” তোমার যখন কিছু করার নেই তো ফোন রাখো। আমি ঝিনাইদহ যাচ্ছি।”
-” সামনে পেলে আরেকটা কামড় বসিয়ে দিতাম তোমাকে। অসভ্য ছেলে।”
-” সেজন্যেই তো বলছি রাঙামাটির ঠিকানা দাও। সামনে এসে শরীর পেতে দেব। কামড়ে মাংস তুলে ফেললেও কিছু বলবো না। ”
-” কেন, এতো কাজ করে দিতে পারল আর আমার ঠিকানা যোগাড় করে দিতে পারল না তোমার লোকজন? ”
-” পারলে তো কাজই ছিলো। এতক্ষণ তোমার সামনে উপস্থিত থাকতাম আমি। কিন্তু রাজন এই কাজটাতেই ফেল মেরেছে। অবশ্য ভুলটা আমারই ছিলো, তোমার সিমটা যে ওরা ফোনে সাজিয়ে রাখবেনা এটাই তো স্বাভাবিক। যাই হোক, আমি রাঙামাটি উঠে নামবো কোথায় বললে না ? ”
কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে অদিতি উচ্চারণ করল-” বরকল।”
====
বাড়ী ফিরেছি আজ দু’দিন হলো। হাসপাতালে দীর্ঘ এগারো দিন কাটিয়ে বাড়ী ফেরা হলো আমার। এই সুযোগে রুমকিরও থরো চেকাপ করিয়ে নিয়েছি। এর মধ্যে নায়লা আরো দুদিন এসেছিলো। সে প্রথমদিন রুমকিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এর পর দিন আমার সাথে কথা বলতে চাইলে রুমকি নিজেই কঠিনভাবে ওকে নিষেধ করে দিয়েছিলো। রুমকির সেদিনের আচরণে আমি যতনা বিস্মিত হয়েছি তারচে বেশী বিস্মিত হয়েছিলো নায়লা। রুমে তখন আমরা তিনজনই ছিলাম।
নায়লা কিছুটা রেগে গিয়ে কিছুটা তীব্রস্বরে বলেছিলো, ” তোমার স্বামী হবার আগে সে আমার বন্ধু। এফেয়ার বাদ দিলেও বন্ধু হিসেবে ঋভূর প্রতি আমার দাবী তোমার চে বেশী। তাছাড়া এটা ঋভূর ব্যক্তিগত ব্যপার।”
রুমকি শান্ত মুখে জবাব দিয়ে বলেছিলো, ” একজন পুরুষের ওপর তার মায়ের পরে স্ত্রী’র দাবী সর্বোচ্চ। এরপরে তার ওপর আর কোনো মহিলার দাবী যদি থাকে সে হলো বোন। বহিরাগত কারো দাবী কখনোই গ্রহনযোগ্য নয়। ঋভূর সাথে আমি আইনত ধর্মত বাঁধা। আপনি নন। দয়া করে ব্যক্তিগত শব্দটার ধুঁয়ো তুলবেন না। একজন স্বামীর সবচে ব্যক্তিগত ব্যপার হলো তার স্ত্রী। এর বাইরে তার যাবতীয় ব্যক্তিগত জিনিসও দেখাশোনা করার দায়িত্ব তার স্ত্রীরই। কাজেই আমি স্ত্রী হয়ে আমার স্বামীর ব্যক্তিগত বিষয়ে এমন কিছু সংযোজন হতে দেবনা যা তার জন্য অপ্রয়োজনীয়। ”
এরপর আর নায়লা রুমকির সাথে কথা বাড়ায়নি। আমাকে রুমকির সামনেই ভেড়া গৃহপালিত পশু বলে গালি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো। সেই থেকে রুমকিও আমার ওপর খানিকটা রেগে আছে। যদিও তা ওর আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে না। সে সবার সামনে আমার সাথে স্বাভাবিক থাকে কিন্তু দোতলায় নির্জনে এলেই কথা বন্ধ করে বসে থাকে। অবশেষে চেপে ধরলাম ওকে। জানতে চাইলাম,
-” কী হলো, নায়লার জন্য আমাকে শাস্তি দিচ্ছো কেন? ”
-” শাস্তি আমি দিচ্ছি না আপনি আমাকে দিচ্ছেন? ” রুমকির রাগের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যেন হঠাৎ অগ্নুৎপাত ঘটালো। বুঝতে পারলাম, নায়লার ভেড়া আর গৃহপালিত পশু শব্দদুটো ওকে কষ্ট দিয়েছে। রুমকি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
-” আপনাকে এমন শান্ত দেখে বরং আমার রাগ লাগছে। পুরুষের এসব মিনমিনে স্বভাব আমার ভীষণ অপছন্দ। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে এভাবে রিএক্ট করতো না।”
রুমকি বাস্তবিকই রেগে গিয়েছিলো। কারণ এ পর্যন্ত তার সব কথা ঠিক থাকলেও হঠাৎ ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো এমন একটি বাক্য যা আমার আত্মসম্মানে আগুন ধরিয়ে দিলো। মুহূর্তেই ক্ষেপে গেলাম আমি। ভয়াবহ ক্ষেপা ক্ষেপলাম। সারাদিন আর রুমকির সাথে ভালো করে কথাই বললাম না। শেষ পর্যন্ত আজাদকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। রুমকি অবশ্য প্রথমটায় স্যরি টরি বলে মাফ চাইলো কিন্তু যখন বুঝলো ব্যপারটা স্যরি পর্যায়ের না তখন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। কিন্তু আমি ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। রুমকির অন্তর থেকে এই রোমান হিরোর নাম নিশানা না মুছে ফেলা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই।
এই মুহূর্তে আমি মোবাইল হাতে বসে আছি। ইচ্ছে আছে রুমকিকে একটু ভয় দেখাবো। তার আগেই মোবাইল বেজে উঠলো আমার। শ্বশুর সাহেব ফোন করেছেন। রাগ ঝেড়ে ফেলে ফোন ধরতেই তিনি কুশলাদি বিনিময়ের পর রুমকিকে চাইলেন। আমি ওর হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে সরে গেলাম। বাপ মেয়ে কথা বলুক। বাথরুম থেকে জামা বদলে ঘরে ঢুকতেই দেখলাম রুমকির মুখ মেঘ থমথমে। না জিজ্ঞেস করে থাকতে পারলাম না। কারণ রাগ হোক যাই হোক, ওটা মন থেকে ছিলো না। তাছাড়া রুমকিকে গোমড়া মুখে দেখতে আমার মোটেই ভালো লাগেনা। কাছে গিয়ে বললাম, ” কী হয়েছে? ”
রুমকি যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিলো। ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো, ” রাগ করবেন না তো ? ”
-” রাগ করবো কেন? ” ভ্রু কুঁচকে কথাটা বলেই মাথা নাড়লাম, ” নাহ্, রাগ করবো না। বলো। ”
-” ইয়ে আব্বা বললো, আজাদ ভাই…..! ”
-” আবার আজাদ ভাই ?” তোয়ালে ছুঁড়ে ফেলে তাকালাম।
-” আরে শোনেন না। ঠাট্টা না। আব্বা বলছিলো ফুপু বাসায় এসে মহা চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে গেছে। আজাদ ভাই নাকি তার অংশ ছেড়ে দিয়েছে আর আমাকে রেজিস্ট্রি করিয়ে নিতে বলেছে। আজাদ ভাই লিখিত সম্মতিপত্র পাঠিয়েছে। ”
-” তারমানে আজাদ আমাকে ফোনে যা বলেছিলো সেটাই করেছে। আর ছেলের এই আচরনে মা সম্মত নন। এজন্যেই তিনি রেগে গেছেন। তো তুমি কী করবে এখন ?” চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে বললাম। রুমকির সাড়া না পেয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। রুমকি চুপচাপ খাটের কিনারায় মুখ নামিয়ে বসে আছে । আমি ওর কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললাম, ” এতো ভাবনার কিছু নেই। তুমি তো আর চাইতে যাওনি। আজাদ নিজ থেকে এটা করেছে। কাজেই তুমি নিউট্রাল থাকো। যা করার তোমার বাবাকে করতে দাও। তবে আমি আর ভুল করেও ঝিনাইদহ পা দিচ্ছি না। তোমারও যাবার প্রশ্ন ওঠেনা। যাদের তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করবে তারা ঢাকা চলে আসবে। আমি আর ও মুখো হতে চাইনা।”
-” সেটা আমিও চাই না কিন্তু ফুপু আবার কী ঝামেলা করে চিন্তা হচ্ছে। ”
-” করুক। ঝামেলা করা যাদের কাজ তারা ঝামেলা করবেই। এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলো আর আমাকে টুপ করে একটা চুমু খাও তো দেখি।”
রুমকি নত মুখেই আমার দিকে তাকালো। বড় মোহময়ী দেখাচ্ছে ওকে। আমি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, ” কাল রাতের টিকিট কেটেছি। এবার সোজা কক্সবাজার। টানা সাতদিন থাকবো সেখানে। ”
-” সত্যিই। ”
-” হম, সত্যিই। এবার দয়া করে হাসো আর ঝিনাইদহের চিন্তা সেখানে পাঠিয়ে দাও। ”
রুমকি এগিয়ে এসে আমার কাঁধে মাথা রেখে বললো, ” আল্লাহ যেন করে সব ঠিক থাকে।”
=====
গত দেড় সপ্তাহ ধরে আজাদ জামাই আদরে আছে। ভেলিয়া আন্টিও মহাখুশি। অদিতি যে এতো ভালো একটা ছেলে পাবে তিনি নাকি ভাবতেই পারেন নি। আজাদ আজই অদিতিকে নিয়ে ঝিনাইদহ রওনা দিতে চেয়েছিলো কিন্তু ভেলিয়া রাজী হন নি। তাঁর অনুরোধে ওরা আরো কিছুদিন থাকতে রাজী হলো।
আজ ওরা বেরিয়েছে কাপ্তাই হ্রদ দেখতে। পথেই আজাদের ফোন বাজলে সে হাঁটা থামিয়ে ফোন রিসিভ করলো। মা করেছে ফোনটা। আজাদ জানে মা ওর ওপর রেগে আছে। ভীষণ রেগে আছে। কিন্তু তারপরেও আজাদ অটল অনড়।
-” হ্যাঁ, মা বলো।”
-” তুই তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিস? “তীক্ষ্ম স্বর জাহানারার।
-” পেপারস রেডী করার পরও একথা বলছো কেন মা ? জায়গাটার হকদার রুমকি। আর আমি ঐটুকু জায়গার জন্য আমি আর ঝামেলা করতে যাবো না। সেকারণে ই ছেড়ে দিলাম।”
-” তাই বলে তুই অতগুলো জায়গা রুমকিকে দিয়ে দিবি? ”
-” আহ্, মা আস্তে। চেঁচিয়ো না তো।”
-” চেঁচাবো না তো কী করবো। তোর ঐ মেয়ের জায়গা জমিও তো ওর মামাদের দখলেই পড়ে রইলো। ওগুলো সে কবে তোকে ট্রান্সফার করবে বলেছে ? ”
-” মা, ওগুলো এমনিই বলেছিলাম। অদিতির সম্পত্তি নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তাছাড়া আমি কেন নিতে যাব ওর। আমার এসব দরকার নেই। এতো টেনশনের জীবন আর ভালো লাগেনা আমার। এবার একটু শান্তিতে থাকতে চাই মা। আচ্ছা, আমি রাখছি। পরে কথা বলবো।”
ফোন কেটে দিয়ে সেটা পকেটে ফেলে অদিতির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো আজাদ। অদিতি কিছুদুর এগিয়ে একটা গাড়ী ভাড়া করছে। আজাদ হাঁটতে হাঁটতেই রাজনের ফোন পেলো। রাজন জানালো, “শাহান সমাদ্দারের জামিন হয়ে গেছে বস।”
-” হম। আর লিটন ? ”
-” না। ওর হয়নি। তবে ঘাপলাটা অন্যখানে। শাহান সমাদ্দার আর ওর বাপ আপনাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। কারণ ওদের দরকার অদিতিকে। আর অদিতি না এলে মামলা নিষ্পত্তি হবেনা। লিটন জেলে পচবে। কী করবেন বস? ”
-” পচুক। ওর মতো ফাত্রাদের পচারই দরকার। সায়মন কোথায়।? ”
-” সেও লিটনের সাথে ভিতরে।”
-” আচ্ছা, দেখি কী করি। নতুন খবর পেলে জানাইস।”
ফোন কেটে দিয়ে অদিতির নিকটবর্তী হতেই সে আজাদের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইলটা বের করে নিলো। তারপর সেটাকে নিজের পার্সে রেখে দিয়ে বললো, ” বিকেলের আগে আর এটা পাবেনা তুমি। এখানে এসেও শান্তি নেই। সারাক্ষণ ফোন আর ফোন।”
-” আচ্ছা, ঠিকআছে। ফোন বন্ধ। এখন শুধু অদিতি আজাদ আর রাঙামাটি।”
-” গুড। ”
দুজনে সারা দিন গোটা কাপ্তাই হ্রদ ঘুরে ঘুরে দেখলো। ফেরার পথে অদিতিই বায়না ধরলো কোরাল মাছের শুটকী দিয়ে ভাত খাবে। আজাদ ওকে নিয়ে বাজারের দিকে চলে এলো। এখানে বেশ সুস্বাদু সব শুটকী পাওয়া যায়। দুজনে ভাত খেয়ে পায়ে হেঁটেই রওনা দিলো। অনেকটা দুর এগুনোর পর আজাদ মোবাইল চাইলো কিন্তু অদিতি মাথা নাড়লো, ” একদম বাড়ী পোঁছে তারপর পাবে।”
আজাদ আর তর্ক না করে হাঁটতে লাগল
। আচমকা সারি সারি গাছের আড়াল থেকে এক লোক বেরিয়ে এলো। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা আজাদকে লক্ষ্য করে পরপর তিনটা গুলি ছুঁড়লো। তারপরই সে যেখান থেকে এসেছে সেখানেই হারিয়ে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমটায় অদিতি হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই চিৎকার দিয়ে ছুটে এসে আজাদকে ধরতেই সে বসে পড়লো। রক্তে ভেসে যাচ্ছে আজাদের পুরো শরীর। সেই অবস্থাতেই সে অদিতিকে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “পারলাম না অদিতি। তোমার উপযুক্ত স্বামী হতে পারলাম না। খুব চেয়েছিলাম। ”
আজাদের মনে হলো ওর সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। অদিতি পাগলের মতো এদিক সেদিক তাকালো একটা গাড়ী বা টমটমের খোঁজে। কিন্তু গুলির শব্দে পুরো এলাকাটা ফাঁকা হয়ে গেছে। দু চারজন যাও বা দেখা যাচ্ছিলো তারাও সটকে পড়েছে। অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো অদিতি। আজাদ আগেই জ্ঞান হারিয়েছে।
====
আজ প্রায় দুই বছর পর রুমকি ঝিনাইদহ এসেছে। ঋভু সব জায়গায় যেতে রাজী হলেও ঝিনাইদহ একেবারেই আসতে চায়না। আজ রুমকির অনুরোধে আসতে রাজী হয়েছে। কারণ রুমকির বাবা গত এক সপ্তাহ ধরে শয্যাশায়ী। তিনি এখন আর জার্নি করে ঢাকা যেতে পারেন না। কাজেই রুমকিকেই আসতে হয়েছে। রুমকি এসেছে শুনে আজ জাহানারা নিজেই যেচে দেখা করতে এলেন। তাকে দেখে রুমকি বেশ অবাকই হলো। ফুপুর সেই তেজ নেই বললেই চলে। বিশেষ করে আজাদ ভাই মারা যাবার পর তার পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। বাবার কাছেই শুনেছে রুমকি আজাদ ভাইয়ের খবর। বেচারা মায়ের জিঘাংসার বলি হলো। ফুপু যদি মামলাটা থেকে সরে না আসতেন আর সমাদ্দারদের আজাদের গন্তব্য বলে না দিতেন তাহলে হয়তো আজাদ ভাইকে এভাবে বেঘোরে প্রানটা খোয়াতে হতো না। জাহানারা রুমকির হাত ধরে আজ কেঁদে ফেললেন। বারবার নিজের কৃতকর্মের জন্য আফসোস করতে লাগলেন তিনি। রুমকি কী বলবে ভেবে না পেয়ে নিরুত্তর রইলো। তবে ফুপুর এরপরের কথাটা শোনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলো না সে। জাহানারা কেঁদে কেঁদে বললেন, ” আমার ছেলের একমাত্র স্মৃতিটাকে নিজের কাছে ধরে রেখেছে ঐ ডাইনিটা। আমাকে দেখতেও দেয়না। আমি লোকমুখে শুনি ও নাকি পুুরো আমার আজাদের মতো হয়েছে। কিন্তু আজ অবধি চোখে দেখলাম না। ডাইনিটারে ফোন দিয়ে কতবার অনুরোধ করে বললাম, আমার নাতিটারে আমারে দেখাও। সে বলে, আমার মতো লোভী মায়ের ছায়াও নাকি পড়তে দেবেনা সে আমার নাতিটার গায়ে। কত বড় পাষান সে রুমু। তোরা একটি বুঝাবি মেয়েটারে। আমি একটাবার আমার নাতিটারে দেখতি চাই।”
ফুপুর উপর্যুপরি অনুরোধে রুমকি এই প্রথমবারের মতো ফোন করলো আজাদের নম্বরে। একজন মহিলার কণ্ঠ শোনা গেলো, ” অদিতি বলছি। কে বলছেন ? ”
-” আমাকে আপনি চিনবেন না। তবে নাম হয়তো শুনে থাকবেন। আমি রুমকি।”
-” ওহ্। চিনেছি। আজাদের কাজিন। জি, বলুন।”
-” কেমন আছেন আপনি? ”
-” আলহামদুলিল্লাহ, বেঁচে আছি।”
-” শুনলাম, আজাদ ভাইয়ের বাবু হয়েছে ! কী নাম ওর।? ”
-” জি, ঠিকই শুনেছেন। ওর নাম আসাদ মুনতাসীর। ”
-” মাশাআল্লাহ। শুনেছি আপনি ঝিনাইদহতেই থাকেন। ইয়ে, বাবুটাকে একবার ওর দাদীর সাথে দেখা করিয়ে গেলে ভালো হতো না ? ”
-” বাহ্, আজ ফুপুর তরফদারী করার জন্য ফোন করেছেন ? কই, আগে তো করেন নি। আজ হঠাৎ ফুপুর জন্য এতো দরদের কারণ কী বলবেন।? ঐ লোভী মহিলা তো আমাকে কোনদিন বৌ বলেই স্বীকার করেনি আজ আমার বাচ্চা কী করে তার নাতি হলো কী করে। ”
-” এটা তো রাগের কথা অদিতি।”
-” রাগের কথা না। এটা আমার ঠান্ডা মাথার সিদ্ধান্ত। ঐ লোভী মহিলার ছায়া আমি আসাদের গায়ে পড়তে দেবনা। ঐ মহিলার কারণে আমার স্বামী মারা গেছে। আজাদের এক জীবনে করা সমস্ত ভুলের জন্য ওর মা দায়ী অথচ তার সমস্ত দায় আজ আমি আর আমার ছেলে বহন করছি। আর আপনি তার হয়ে আমাকে বোঝাতে এসেছেন? ”
-” আমি আসলে খুব দুঃখিত। আসলে আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি। তবে আপনার অনুমতি থাকলে বাবুটাকে দেখতে আসতে চাই। হয়ত কোনোদিন সন্তানের মা হতে পারবোনা বলেই আকাঙ্খা এতো তীব্র। ”
অদিতি চুপচাপ শুনলো কথাটা। তারপর মৃদুস্বরে বললো, ” ঠিক আছে। আসতে পারেন।”
সেদিন বিকেলেই ঋভূকে নিয়ে বেরুলো রুমকি। অদিতির ঠিকানা ফোন করেই জেনে নিয়েছিলো। খুব বেশী দুর নয় বাড়ীটা। বেল বাজাতেই যে মহিলাটা দরজা খুলে দিলো তাকে দেখে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো রুমকি। অসামান্য রূপসী এক মহিলা যার চেহারায় স্থায়ী বিষন্নতা আসন গেড়েছে। রূপম বাইরেই ছিলো। সে জানিয়েছে সে ভেতরে আসবেনা। রুমকি একাই ভেতরে গেলো। আসাদ ঘুমিয়ে আছে। সে অবস্থাতেই ওকে দেখলো রুমকি। বুকটা হু হু করে উঠলো ওর। প্রথমত বাচ্চাটা আজাদ ভাইয়ের অবিকল কপি। দ্বিতীয়ত এরকম একটি সন্তান ওর নেই বলে। অদিতি বিষয়টি বুঝতে পেরে রুমকির মাথায় হাত রেখে বললো, ” আল্লাহ কাকে কখন কী দিয়ে পরীক্ষা নেন তা কেউ বলতে পারেন না। আমাকে স্বামী দিয়ে আপনাকে সন্তান দিয়ে। ”
রুমকি উদগত কান্না আটকে রেখে আলতো করে অদিতির হাতটা ধরে বললো, ” আমি কোনদিন মা ডাক শুনবো না অদিতি।”
-” ধৈর্য ধরুন রুমকি। এভাবে কাঁদবেন না।”
রুমকি চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ” বাবুটা কখন উঠবে ?
-” মাত্রই ঘুমিয়েছে।”
-” ওহ্, আচ্ছা। ইয়ে, আমি একটা কথা বলতে চাই কিন্তু সাহস করতে পারছি না।”
-” বলুন।”
-” আপনাকে যা দেখছি তাতে মনে হয়না বেশীদিন একা থাকতে পারবেন । তাই বলছিলাম, যদি বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন তাহলে আমাকে জানাবেন প্লিজ? ”
-” জানালে কী করবেন ? ” অদিতি ম্লান হাসলো।
রুমকি মুখ নামিয়ে বললো, ” আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ী যখন জানতে পারলেন যে আমার ওভারীতে জটিল সমস্যা আছে, আমার কখনও বেবী হবেনা তখন থেকেই তারা ছেলেকে বিয়ে করানোর জন্য অস্থির হয়ে আছেন। কিন্তু রূপম রাজী নয়। ”
-” তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার স্বামীর সাথে আমাকে বিয়ে দেবেন? ” অদিতি সরাসরি বললো। তার চেহারায় কৌতুহল । রুমকি বিব্রত স্বরে বলল,
-” আপনার সন্তান কী তখন আমার সন্তান হবেনা ? ” অদিতির প্রশ্ন এড়িয়ে গেল রুমকি। অদিতি আবারও হাসলো, তারপর মুখটা শক্ত করে বললো ” না রুমকি। আমি আর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি চাইনা আমার আর আজাদের মাঝখানে আর কেউ আসুক।”
রুমকি ফের বাচ্চাটার দিকে তাকালে অদিতি বললো, ” আপনি যখন খুশি এসে আসাদের সাথে দেখা করে যেতে পারেন। কোনো সমস্যা নেই। ”
রুমকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বেরিয়ে এলে অদিতি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। যতক্ষণ অদিতিকে দেখা যায় ততক্ষণই তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে বাধ্য হলো, জীবনের এই এক প্রহরের খেলায় আসলে আমরা প্রায় সবাই পরাজিত।
সমাপ্ত