যাত্রাশেষে (পর্ব-১৭)
হালিমা রহমান
মৃত্যু, কর্মফল —এ দুটো অনিবার্য বিষয়।মানুষ এ দুটোকে কখনোই এড়াতে পারে না।বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণকেও সহজে এড়ানো যায় না।বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।একে অনেকটা অনিবার্য বিষয়ও বলা যায়।এই আকর্ষণকেই কখনো মোহ,কখনো মায়া আবার কখনো ভালোবাসার মতো শ্বাশত অনুভূতি নামে আখ্যায়িত করা হয়।
তুষারের অবস্থা নাজেহাল।ইদানীং কি যেন হয়েছে তার।ব্যবসায়ের কাজ দেখতে ইচ্ছা করে না,ঘুমাতে ইচ্ছা করে না,ঘরের বাইরে বের হতে ইচ্ছা করে না।সারাক্ষণ শুধু ঘরে থাকতেই ভালো লাগে।তার সুন্দর, সাজানো সংসারটাকে দু-চোখ ভরে দেখতে ইচ্ছা করে।কি সুন্দর সবকিছু!মেয়ে ভালো আছে,সে ভালো আছে,অর্ধাঙ্গিনী ভালো আছে।একটা ছোট্ট সংসারের সবকিছু গোছানো।এ বাড়িতে যখন নতুন এসেছিল,তখন ঘরগুলোতে দমবন্ধ অবস্থা ছিল।এখানে আসবাব,সেখানে আসবাব—সবকিছু এলোমেলো। রুবিনা বেগম চলে যাওয়ার পর, এক শুক্রবারে মহুয়া এসব টেনে টেনে বের করলো।এরকম দমবন্ধ অবস্থায় আর কিছুতেই না।তুষারকে নিয়ে সব ঘরের আসবাব গুছিয়েছে।খাট থেকে শুরু করে সোফা,ফ্রিজ সব।পাঁচ রুমের একটা ফ্ল্যাট গোছানো চাট্টিখানি কথা!ক্লান্তিতে,বিরক্তিতে তুষারের প্রাণ ওষ্ঠাগত। কিন্তু ঘর পুরোপুরি গোছানোর পর তুষার অবাক হয়ে পুরোটা দেখেছে।এই ছোট ফ্ল্যাটটা এতো সুন্দর!এই ঘরটাই বহু বছর আগ থেকে মহুয়ার পছন্দ।মহুয়া কি কখনো কল্পনা করেছিল, এই ঘরেই তার ভাগ্য বেঁধে যাবে?
মহুয়ার প্রতি অন্যরকম এক আকর্ষণ অনুভব করে তুষার।এই মেয়ের সব কিছুতে সে মুগ্ধ হয়।কখনো কথায়,কখনো বুদ্ধিতে,কখনো এলো চুলে,কখনো হাসিতে আবার কখনো শাড়ির ভাঁজে।তবে,তুষারের সবচেয়ে বেশি পছন্দ মহুয়ার পরিপক্বতা। মেয়েটা অতি মাত্রায় পরিপক্ব।সে যেন একটা পরিণত ফুল।কোনো কিছুতে ভণিতা নেই,ন্যাকামি নেই।তার সবকিছুই সহজ, সুন্দর,স্বাভাবিক।এই তো সেদিনের কথা।অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছিল তুষার। নাস্তা করে কিছুক্ষণ মেয়ের সাথে দুষ্টুমি করে,মহুয়ার সাথে বকবক করে আবারো বিছানায় শুয়ে পড়লো।তার ইচ্ছা, সে এখন ল্যাপটপে দোকানের সিসি টিভির ফুটেজ দেখবে।আজ আর দোকানে যাবে না।আজকাল খুব কাজচোর হয়েছে সে।বাড়ি থেকে বেরই হয় না।তুষার আয়েশ করে কোলের উপর ল্যাপটপ রেখে ফুটেজ দেখছিল।এভাবে বসে দেখতে ইচ্ছা করছে না।যদি হালকা কোনো খাবার অথবা টকটকে লাল শুকনো মরিচ দিয়ে কাঁচা আমের ভর্তা খাওয়া যেত, তবে দারুন হতো।মহুয়াকে গলা বাড়িয়ে ডাক দেওয়ার আগেই সে এসে হাজির।ঘর্মাক্ত শরীরে কচু পাতা রঙের একটা শাড়ি জড়ানো।তুষারের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে।মেয়েটাকে শাড়িতে খুব মানায়।
—” মহুয়া ঘরে আম থাকলে একটু ভর্তা বানিয়ে দেও না,প্লিজ।বেশি করে শুকনো মরিচ দিয়ো।আর তোমার কাজ থাকলে, আমাকে বটি আর আম দিয়ে যাও। আমি কেটে দেই।তুমি একটু মেখে দাও শুধু।”
তুষারের অনুরোধ পালন করলো না মহুয়া।বরং,কপাল কুঁচকে তুষারের সামনে বসলো।ল্যাপটপ বন্ধ করে বললঃ”আপনি এখনো বাসায় কেন?”
—” তো কোথায় থাকব আমি?”
—” আপনার ব্যবসা-বাণিজ্য নেই? সবকিছু কি ডোবানোর ইচ্ছা আছে?ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ ভাবতে হবে না?”
—” আরে,টেনশন করো না।এতোজন কর্মচারী থাকতে আবার আমার যাওয়া লাগে?তাছাড়া,আমি ঘরে বসেই দেখছি।তাহলে আর যাওয়ার কি দরকার।”
—” আরেকজনের উপর ভর দিয়ে যদি ব্যবসা হতো,তাহলে আর পৃথিবীতে চাকরিজীবী খুঁজে পাওয়া যেত না।এরকম ঘরে বসে থাকলে ব্যবসায়ে লাল বাতি জ্বলতে সময় লাগবে না।উঠুন,দোকানে যাবেন।উঠুন।আরে আশ্চর্য! শুয়ে পড়ছেন কেন?মিত্তির বাবা,উঠুন।”
তুষার বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে।চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো একেবারে।
—” আমি নতুন ব্যবসায়ী না। আমি যখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে, তখন বাবা মারা গেছে।সেই তখন থেকে ব্যবসায়ের হাল ধরেছি।একটা দোকানের জায়গায় দুটো হয়েছে,ফ্ল্যাট হয়েছে।তুমি কি আমাকে যে সে ভাবছো নাকি?”
—” আপনি অনেক বড় কারবারি তা বুঝলাম।কিন্তু এখন কিছুতেই বাড়ি থাকতে পারবেন না।পুরুষ মানুষ ঘরের কোনে বসে থাকে?সারাদিন শুধু ঘর।এই আপনার বিরক্ত লাগে না?”
তুষার মাথা নাড়তে নাড়তে খাট থেকে নেমে পড়ে।মুখে দুষ্টুমির আভাস ফুটিয়ে তুলে বলেঃ” ঘরে নতুন বউ থাকলে কার যেতে ইচ্ছে করে?আমার একটামাত্র সুন্দরী বউ।যদি একা ঘরে ভয় পায়?”
—” ধান্দাবাজি বন্ধ করুন।সন্ধ্যা সাতটার আগে যেন বাড়ি ফিরতে না দেখি,খবরদার।”
মহুয়ার এসব অধিকারবোধ, কর্তৃত্ব খুব ভালো লাগে তুষারের।আবার মহুয়া যখন যত্ন করে তুষারের পছন্দের খাবার রান্না করে, তখনও ভালো লাগে।মনে হয় যেন,খাবার নয়।মহুয়ার ভালোবাসা খাচ্ছে সে।শুধু একটা জিনিস অপছন্দ।মহুয়াকে কখনো লজ্জা পেতে দেখেনি।নতুন বউয়েরা কোথায় স্বামীকে দেখলে লজ্জা পাবে, মুখ লুকাবে;তা না।এই মেয়ে কথায় কথায় উত্তর দেয়।এ যেন একটা পাথরের মূর্তি।একে ভাঙা গেলেও নিজের মতো করে তৈরি করে নেওয়া যাবে না।তবুও,নিজের মনে বসন্ত হাওয়ার খোঁজ পায় তুষার।সময়টা কি প্রনয়ের?অবশ্যই প্রণয়ের।নাহয় এই একত্রিশ বছর বয়সে এসে হঠাৎ মহুয়ার প্রতি এতো আকৃষ্ট হয়ে পড়বে কেন সে??
তুষারের মতিগতি খুব ভালো করেই বুঝতে পারে মহুয়া।তার উপর কারো চোখ আটকে থাকবে,চোখে একরাশ মুগ্ধতা থাকবে,ভীষণভাবে কেউ নির্ভর হয়ে পরবে—আর সে বুঝতে পারবে না?এটা কি সম্ভব?তুষারকে দেখে মহুয়ার হাসি পায় মাঝে মাঝে।বিয়ের মাস দেড়েকের মাঝেই কেউ এতোটা দুর্বল হয়ে পরতে পারে, তা তুষারকে না দেখলে বুঝতো না।মহুয়া হেঁটে গেলেও মনে হয় তুষার ব্যাথা পায়।মহুয়ার মাইগ্রেনের ঔষধ আর কয়টা আছে,কোন শাড়িটা পুরোনো হয়ে গেছে,কোন মাছ পছন্দ,বাইরের কোন খাবারটা মহুয়া দুই চোখে দেখতে পারে না, কোন ফুল পছন্দ, কখন মহুয়াকে কেমন দেখা যায়,নাকের উপর ঘাম জমলে ভালো লাগে নাকি মন্দ,মহুয়া কখন ভ্রু কুঁচকে তাকায়, কপালের তিলটাকে কখন সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়,কিভাবে হাসলে ঠোঁটের আধ ইঞ্চি নিচে একটু ভাঁজ পড়ে —এসব খবর তুষারের চাইতে আর কে বেশি রাখে? তুষার যেন মহুয়ার পায়ের আওয়াজও চিনে।মহুয়া আর মৃত্তিকাকে একসাথে দেখে কি সুন্দর করে হাসে সে! তুষারের গেজ দাঁতটা খুব পছন্দ মহুয়ার।যখন সে হাসে,তখন এর একাংশ একদম ঠোঁটের উপরে চলে আসে।আগের থেকে স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে এখন।তাই একটু বেশিই সুন্দর দেখা যায়। তুষারের প্রতি মহুয়া নিজেও খুব আকৃষ্ট। মানুষটা ভালো,ভদ্র।একজন ভালো অভিভাবকের সাথে,একজন ভালো বন্ধুও বটে।মহুয়াকে ভরসা করে,সম্মান করে,ভালোবাসে।মহুয়া নিজেও সাবলম্বী।জীবনে সুখী হওয়ার জন্য আর কি লাগে?আশপাশটা খুব রঙিন লাগে মহুয়ার।আজকাল মুখোমুখি ফ্ল্যাটের দিকে নজরও যায় না।কেন যাবে?ওটা ছলনা ছিল,এটা সত্যি।ওটা অশান্তি ছিল,এটা শান্তি।আবরার স্বপ্ন ভেঙেছে, তুষার গড়ার চেষ্টা করছে।তাহলে,অতীতের দিকে নজর পড়ার প্রশ্নই আসে না।প্রাক্তনে দেখে এখন মহুয়া প্রাণখুলে হাসতে পারে।এখন আর আবরারের সামনে বিব্রত হতে হয় না।আবরারকে অকারণে গালি দিতে ইচ্ছে হয় না।আবরারকে ক্ষমা করে দিয়েছে মহুয়া। এই পৃথিবীতে সবাই সুখী থাকতে চায়।আবরার যদি অনন্যাকে নিয়ে সুখী হয়, তবে হোক।ওর প্রতি রাগ পুষে রেখে মহুয়ারই বা কি লাভ হবে?তার চেয়ে সব ভুলে,তুষারের সাথে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলেই হয়।মহুয়া এখন খুব সুখী।
—” আম্মাম্মাম্মা….”
মৃত্তিকার ডাক শুনে মৃদু হাসে মহুয়া।এই মেয়েটা তাদের পূর্ণতা। একসপ্তাহ ধরে সে মাকে এভাবেই ডাকে।মৃত্তিকা মা ডাকতে জানতো না।মহুয়া মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাকে শিখিয়েছে।এখন সারাক্ষণ মায়ের নাম জপ করে মৃত্তিকা।মহুয়া টেনে কোলে নেয় মৃত্তিকাকে।দু-গালে চুমু দেয়।তারপর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বারান্দায় চলে যায়।বিকেলের দিকে এদিকটায় কেউ থাকে না।তাই মহুয়ার কোনো বাধা নেই।নিজের এতো সুন্দর পরিস্থিতি দেখে মাঝে মাঝে সে নিজেই অবাক হয়।দ্বিতীয়বার একসমুদ্র সুখ পাবে বলেই হয়তো প্রথমবার কাঁদতে হয়েছে।সত্যিই সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা বুঝা মুশকিল।ভাগ্যে তিনি সুখই রেখেছেন।শুধু মাঝখানে একটা দুঃস্বপ্নকে এনে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছেন।
***
রাতের খাবার গরম করছিলো মহুয়া।আজ তুষারের ফিরতে দেরি হয়েছে।সে হাত-মুখ ধুয়ে মেয়ের সাথে খেলছে।
মহুয়ার দেরি দেখে তুষার কিছুক্ষণ পরেই রান্নাঘরে এলো।হেলান দিয়ে দাঁড়ালো দেয়ালের সাথে।মহুয়া একনজর তাকালেও পাত্তা দিল না।সে জানে তুষার কিছুক্ষণ নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে থাকবে,তারপর কিছুক্ষণ বকবক করে বিরক্ত করবে।এগুলো তার প্রতিদিনের রুটিন।
—” মহুয়া,কালকে বিকালে আমরা এক জায়গায় যাব।তুমি তৈরি থাকবে, ঠিকাছে?”
—” কোথায় যাব?”
—” অনেক জায়গায়।এখন বলতে পারব না।”
—” না বললে নাই।”
তুষার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে বউকে দেখে।শুকনো কাঠাল বিচির উপরের সাদা আস্তরন ফেলে দিলে যেরকম রঙ হয়,ঠিক সেই রঙের একটা সুতি শাড়ি গায়ে।আঁচলের দিকটা সাদা।মহুয়াকে এই মুহূর্তে তার কাছে একটা কাঠাল বিচির মতো লাগছে।অর্ধেক ছিলে রাখা একটা কাঁঠাল বিচি।শুকনো কাঁঠাল বিচি দিয়ে শুটকির তরকারি খুব পছন্দ তুষারের।মহুয়াকেও তো কাঁঠাল বিচির মতোই দেখা যাচ্ছে।ওকে যদি শুটকি দিয়ে রেঁধে খেয়ে ফেলা যেত,তবে তাই করতো তুষার।এমন উদ্ভট একটা কথা মনে আসার পরমুহূর্তে, নিজেই হেসে ফেললো তুষার।তার হাসির শব্দ কানে আসায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় মহুয়া।
—” কি সমস্যা?”
—” তোমাকে শুটকি দিয়ে রেঁধে খাব।ঘরে শুটকি আছে?”
আর দাঁড়ায় না তুষার। রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।মহুয়াও খুব বেশি একটা গুরুত্ব দেয় না তুষারের কথায়।তুষার মাঝে মাঝে অসংলগ্ন কথা বলে।এই স্বভাবের সাথে খুব পরিচিত মহুয়া।
মহুয়া প্রায় ঘুমিয়েই গিয়েছিল।এমন সময় কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে তাকে ডেকে তুলে তুষার।
—” এই মহুয়া,মহুয়া।উঠো।”
—” আপনার সমস্যা আসলে কোথায়, মিত্তির বাবা।আজকে আবার কি?আমার ঘুমের সাথে খুবই শত্রুতা করেন আপনি।”
মহুয়াকে একটানে উঠে বসায় তুষার।তারপর বেশ আবদারের সুরে বলেঃ”চলো বারান্দায় যেয়ে বসি।আমার ঘুম আসছে না।”
—” একা যান।অসহ্য বিরক্তিকর একটা লোক।মাঝরাতে শয়তানে ধরে আপনারে?”
মহুয়া আবারো শুয়ে পড়তে চেয়েছিল।কিন্তু তাকে সে সুযোগ দিলো না তুষার।টেনে হিঁচড়ে বারান্দায় নিয়ে গেল।মহুয়ার হাতে একটা ছুরি থাকলে সে নিশ্চিত তা তুষারের গলায় ধরতো।ফাইজলামির একটা সীমা-পরিসীমা থাকা উচিত।
নিজে বারান্দার ফ্লোরে বসে মহুয়াকেও টেনে পাশে বসালো তুষার।এভাবে বসাটা বেশ কষ্টকর। তাই দু-তিনটে চেয়ার কিনবে।তাহলে আরামে বসা যাবে।মহুয়ার মাথা নিজের কাঁধে চেপে ধরে।
এলোমেলো চুলগুলোতে সযত্নে হাত বুলাতে বুলাতে বলেঃ”আত্মসমর্পণের জন্য ডাকলাম তোমায়।রাগ করো না, প্লিজ।”
—” এভাবে গরমের মধ্যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বসে থাকে।মাঝে মাঝে রাতের বেলা কি হয় আপনার?”
—” বউয়ের কাছে আবদার করতে ইচ্ছা হয়।আচ্ছা,এবার মনোযোগ দিয়ে শোনো।আত্মসমর্পণের মন্ত্র বলি তোমায়।”
—” কিছু শুনবো না আমি।ঘুম পেয়েছে,ঘুমাব।”
—” আরে,শুনেই যাও।না শুনলে পরে আফসোস করতে হবে।”
বিরক্তিতে শরীর ছেড়ে দেয় মহুয়া।
—“ঠিক আছে,বলুন।”
—” ভালোবাসি, মহুয়া।একদম মহুয়ার পালার সেই নদের চাঁদের মতো ভালোবাসি।”
মুখে হাসি ফুটে মহুয়ার।জানা কথাটাই তুষারের মুখ থেকে শুনতে কি ভালো লাগলো!মহুয়াকে আর কেউ কখনো এরকমভাবে বলেছে?উঁহু, কেউ বলেনি।
—” মহুয়া? ”
—” হুম।”
—” কেমন লাগলো?”
—“ভালো। কিন্তু নদের চাঁদের সাথে তুলনা করলেন কেন নিজেকে?নদের চাঁদ যুগে যুগে আসে?”
—” তুমি মহুয়া তাই।নদের চাঁদরা যুগে যুগেই আসে।কেবল ভিন্নরূপে।এবার তুমি উত্তর দাও?”
—” কিসের?”
—” ভালোবাসো?”
মহুয়া অন্ধকারেই মুচকি হাসে।তুষারের কাধেঁর ভিতর নিজের মাথাটাকে আরেকটু গুজে দেয়।
—” বুঝতে পারেন না?”
—” উঁহু। ”
—” আত্মসমর্পণের মন্ত্র না জানলে আপনার উপর আমার এতো অধিকারবোধ,কর্তৃত্ব কোথা থেকে আসে?সাহিত্যের ছাত্রকে সবকিছু ভেঙে বুঝাতে হয় কেন?”
মহুয়ার প্রশ্নের উত্তর দেয় না তুষার।বরং,মুচকি হেসে মহুয়াকে আরো একটু জড়িয়ে ধরে।আজ সে বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।আচ্ছা এই যে তুষারের হৃৎপিণ্ডে খুশিরা দামামা বাজাচ্ছে,তা কি মহুয়া অনুভব করতে পারছে?বুঝতে পারছে,তার হৃদয়ের জয়ধ্বনী?
***
ঘড়ির কাটায় প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে।তুষার মৃত্তিকাকে কোলে নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।বউ-মেয়েকে নিয়ে আজ একটু ঘুরতে যাবে।অনেককিছু কেনাকাটা করতে হবে আজ।কিন্তু প্রায় পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরেও কোনো রিকশা পেল না।বিরক্তিতে শরীর অবশ হয়ে আসছে তুষারের।অন্যান্য দিন রিকশার অভাব থাকে না।অথচ, আজকেই পৃথিবীতে আকাল পড়েছে সবকিছুর।অসহ্য!
আরো মিনিট দশেক পর একটা রিকশা এসে থামলো তুষারের সামনে।আরোহীর আসনে আবরার ছিল।সে হয়তো ব্যাংক থেকে এসেছে।তুষারকে দেখে আবরার এগিয়ে গেল।
—” কি ব্যাপার, তুষার ভাই?মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যে?”
—” একটু ঘুরতে যাব। কিন্তু রিকশাই পাচ্ছি না।”
—” এটা নিয়ে যান।দূরে কোথাও যাবেন নাকি?”
—” হ্যাঁ, একটু দূরেই যাব।বউয়ের পাখি আর গাছের শখ।ওগুলো কিনতে যাব।তাছাড়া, মেয়ের কিছু খেলনাও লাগবে।অনেকদিন পর বের হলাম।তাই অনেকটাই ঘুরে আসব।”
আবরারের মনে হলো, তুষার মায়ের কাছে মাসির গল্প করছে।মহুয়ার শখগুলো তো সব পরিচিত তার।তাহলে,এতো ফলাও করে বলার কি আছে?লোকটা বোধহয় জানে না ওদের সম্পর্কের কথা।তাই এতো সহজে আবরারের সাথে মিশতে পারে।
আবরারের চিন্তা কাটলো মহুয়াকে দেখে।সে হয়তো এতোক্ষণ গেটের ভিতরে ছিল।খয়েরী রঙের শাড়ি পরা মাঝারি গড়নের মেয়েটাকে আজ নতুন লাগছে আবরারের চোখে। মেয়েটার মুখে যেন সুখ ও হাসি লেপ্টে আছে।তবে কি তার সব স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেছে?
মহুয়াকে রিকশায় বসতে সাহায্য করলো তুষার।তারপর নিজেও উঠে বসলো মেয়েকে নিয়ে।আবরারের চোখের সামনে দিয়েই চলে গেল রিকশাটা।তবুও আবরার সেদিকেই চেয়ে রইলো। তার মানসপটে ভেসে উঠলো তিনজনের সেই সুখী মুখ।অসুখী মানুষদের চোখে সুখী মানুষরা সহজেই ধরা পড়ে।আবরার অসুখী।তাই তুষার-মহুয়ার সুখছবিও ধরা পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না।আবরার ঈর্ষাপরায়ণ নয়।তাই মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে।কিন্তু আজ আর হচ্ছে না।মনের একাংশ যেন বারবার ঘোষণা করছে—” তুমিও এমন সুখী হতে পারতে।এরকম তিনজনের একটা ছোট্ট পরিবার তোমারও থাকতে পারতো।মহুয়ার পাশের মানুষটা আজ তুমিও হতে পারতে।”
আবরার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির গেটের দিকে পা বাড়ায়।মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত।একদিন যাকে মোহ বলে অপমান করেছিল, আজ সেই মানুষটার কাছেই আবার ছুটে যেতে ইচ্ছা করছে।অনন্যা আগের মতো নেই।আগে তো শুধু বিয়ে নিয়ে উদাসীন ছিল।এখন সংসার নিয়েও উদাসীন।আবরারের জন্য একটু সময় তার ঝুলিতে নেই।সে ভীষণ ব্যস্ত।আর আবরার ভীষণ একা।অনন্যাকে দেখলে তার একটা কথাই মাথায় আসে।অনন্যা বোধহয় মুক্ত খাচার পাখি।এরা কখনোই নীড় বাধে না।।।
চলবে…..