যাত্রাশেষে (পর্ব-৯)
হালিমা রহমান
বিশাল আকাশ থেকে সূর্য বিদায় নিচ্ছে।আকাশটা পুরো লাল-কমলা রঙে রাঙা হয়ে উঠেছে।ঢাকা শহরে সচরাচর সূর্যাস্ত দেখা যায় না।অবশ্য সময় নিয়ে কেউ দেখেও না।ব্যস্ত মানুষের জীবনে এতো সময় কোথায়?মহুয়ার দিনই ভালো লাগে।দিনের বেলা নানা কাজে ব্যস্ত থাকা যায়।তাই অতীতগুলো সহসা হানা দেয় না।কিন্তু রাত যত গভীর হয়,মহুয়ার অস্থিরতা ততোই বাড়ে।তাদের ছোট্ট ঘরের দূর্বল দেয়ালগুলোও যেন ফিসফিসিয়ে ঘোষণা দেয়—“মহুয়া তুই সত্যিই একা।”
পার্কের অশ্বত্থ গাছের নিচে রাখা বেঞ্চে বসে আছে মহুয়া।তুষার নেই তার পাশে।কোথায় যেন গেছে।সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে দেখে পার্ক ক্রমশ খালি হচ্ছে।কপোত-কপোতীরা বেড়িয়ে যাচ্ছে একে একে।মহুয়া বেঞ্চের গায়ে হেলান দিয়ে বসলো।হাত ঘড়িতে নজর বুলিয়ে নিলো একবার।সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।বাসায় ফিরতে হবে।তুষার না আসা অবধি উঠতে পারবে না মহুয়া।তাই অলস নজরে বয়স্ক অশ্বত্থ গাছের বিস্তৃত ডালের দিকে চেয়ে রইলো।ডালে দুটো ছোট ছোট পাখি দেখা যাচ্ছে।মহুয়ার পাখি সংগ্রহের খুব শখ।কিন্তু,সে দু-তিনটা পাখি ছাড়া খুব বেশি পাখি চিনে না।শুধু নাম জানে।এই দুটোও যে কি পাখি তা মহুয়া বুঝতে পারছে না।
—” মহুয়া, পানি খেয়ে নিন।আপনার গলা নিশ্চয়ই শুকিয়ে গেছে।”
তুষারের কথায় মহুয়া পাখি দেখায় বিরতি দিল।তুষারের হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে,বোতলের মুখ খুলতে খুলতে বললঃ” পানি আনতে গিয়েছিলেন আপনি?”
—” হুম।”
মহুয়া ঢকঢক করে প্রায় অর্ধেক বোতল পানি খেয়ে ফেললো। সেই বিকাল থেকে একটানা কথা বলছে।গলাটা সত্যিই খুব শুকিয়ে গেছে।মহুয়া পানি খাওয়া শেষ করে বললঃ” পানির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”
—” ধন্যবাদ দেওয়া লাগবে না।আজ যেই গরম পরেছে।আমারই ভুল হয়েছে। আজকে আপনাকে এখানে না ডাকলেই ভালো হতো।”
মহুয়ার নজর ঘুরে ফিরে বারবার অশ্বত্থ গাছের ডালে চলে যাচ্ছে।হলদে রঙা পাখি দুটো কি সুন্দর!মহুয়া আঙুলের ইশারা দিয়ে তুষারকে প্রশ্ন করলোঃ” ওই দুটো কি পাখি?”
—” খুব সম্ভবত বেনে-বৌ পাখি।”
—” আপনি নিশ্চিত?”
—” অনেকটাই।আগে আমাদের গ্রামে অনেক দেখা যেত।মহুয়া,চলুন একটু হাঁটি।একটানা বসে থেকে আমার হাঁড়-মাংস লেগে গেছে একদম।আর বসতে পারব না।”
—” চলুন।”
মহুয়া উঠে আগে হাত-পা ঝারা দিলো।বসে থাকতে থাকতে কোমড় ব্যাথা হয়ে গেছে একদম।কিছুক্ষণ হাত-পা নড়াচড়া করার পর তুষারের সাথে পা বাড়ালো সামনে।আজকে গরম পড়েছে খুব।ঘামে তুষারের শার্ট ভিজে গেছে।মহুয়া তুষারের থেকে একপা পিছিয়ে আছে।তুষার একটু থেমে পিছু ফিরে বললঃ” মহুয়া, এরপর কি হয়েছিলো? বললেন না তো।”
—” এরপর আর কি।সেই ঝড়-বৃষ্টির সন্ধ্যায়, আমি আমার প্রাক্তনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।তখন বাইরে ছিল প্রবল বৃষ্টি,আমার শরীরে ছিল তীব্র অসুস্থতা আর মনের অবস্থা ছিল আরো নাজুক।বুঝতেই পারছেন কি বিচ্ছিরি অবস্থা ছিল আমার।”
—” তখনই বেরিয়ে আসার কি দরকার ছিল?আপনি সেই রাতটুকু তো সেখানেই থাকতে পারতেন।”
তুষারের কথায় খুব অবাক হলো মহুয়া।কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বললঃ”আপনি কি পাগল, তুষার সাহেব?আমি এতোকিছুর পরেও ওই হারামজাদার সাথে থাকতাম! ওইদিন যদি আর এক মুহূর্তের জন্য আমি সেখানে থাকতাম, তবে নিশ্চিত কুকুরটাকে খুন করে ফেলতাম।”
মহুয়ার কন্ঠে রাগ ও ঘৃণা একসাথে ঝরে পড়ে।তুষার বুঝতে পারে, মহুয়া এখনো আবরারকে ক্ষমা করতে পারেনি।অবশ্য, এইরকম অপরাধ ক্ষমা করাও যায় না।রাগের মাথায় বিয়ে করে ফেলেছে–এটা কোনো কথা?বিয়ে কি কোনো ছেলেখেলা? আবরারের উপর তুষারের খুব রাগ হচ্ছে।মেয়েটার কত স্বপ্ন ছিল।একটা মেয়ের স্বপ্ন ভাঙার অধিকার আবরারকে কে দিল?
—” তুষার সাহেব,কি ভাবছেন?”
মহুয়ার কথায় ভাবনার সুতা ছিড়ে যায় তুষারের।হাত দুটো বুকের উপর ভাঁজ করে হাঁটতে হাঁটতে বলেঃ”কিছুই ভাবছি না।”
—” আজকে অনেক সময় নষ্ট করলাম আপনার।আসলে, আমি শর্ট-কার্টে কথা শেষ করতে পারি না।”
—” কে বলল আপনি সময় নষ্ট করেছেন?এখানে তো আমিই আপনাকে ডেকেছি।আচ্ছা,মহুয়া আপনি যখন এতো অসুস্থতার ভিতরেও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তখন আবরার আপনাকে থামায়নি?”
—” উঁহু। ”
ভীষণ অবাক হয়ে যায় তুষার।আবরার কি মানুষ নাকি অমানুষ?যার শরীরে মানুষের রক্ত আছে, সে কিভাবে একটা মেয়েকে দুর্যোগের রাতে একা বেড়োতে দেয়?তুষার কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বলেঃ”আপনাকে একবারের জন্যও নিষেধ করেনি!আপনাকে সেই রাতে একা আসতে দেওয়া উচিত হয়নি।যদি পথে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতো?”
তুষারের কথায় মলিন হাসে মহুয়া।অবিচল চোখে সামনে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলেঃ” আমাদের সম্পর্কে আমি ছিলাম অনেকটা অ্যাপেনডিক্সের মতো।আমাদের শরীরে যেমন এটার কোনো গুরুত্ব থাকে তেমনি আমারো কোনো গুরুত্ব ছিল না।সবাই মিলে আমাকে জুরে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু আবরারের সবটা জুরে আমি ছিলাম না।শুনলেন না, সে আমাকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিল।আমি নাকি তার মোহ ছিলাম।বিয়ের নয় মাসের মাথায় এসে আমি জানতে পারি, আমি একজন মানুষের মায়া নয় মোহ।হাহ!এটাকে কি বলা যেতে পারে তুষার সাহেব?দূর্ভাগ্য? ”
উত্তর নেই তুষারের কাছে।সে নিজেও তো একটা প্রতারণার শিকার।হয়তো মহুয়ার মতো তুষারের চোখ ভরা এতো স্বপ্ন ছিল না।কিন্তু,মহিমা ও মৃত্তিকাকে নিয়ে একটা সুন্দর পরিবার গড়ার ইচ্ছে তো ছিল।মহিমা যে কেন এরকম প্রতারণা করলো!মাঝে মাঝেই তুষারের মনে একটা প্রশ্ন জাগে।আচ্ছা,মহিমা কি তাদের কথা মনে করে?তার একটা মেয়ে আছে,মেয়েটা ছোট, নিজের কাজ নিজে করতে পারে না,মা ছাড়া মেয়েটা অসহায়–এসব কথা কি মহিমার মনে পড়ে?তুষার-মৃত্তিকা এদের জন্য কি কখনোই মহিমার মন খারাপ হয় না?দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুষার।যদি তাদের কথা মহিমা চিন্তা করতো তবে কখনোই এমন কাজ করতে পারতো না।প্রতারকরা কেন বেঁচে থাকে পৃথিবীতে? তারা কিভাবে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেয়,চলাফেরা করে?তাদের কি কখনো কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা হয় না?খারাপ কাজের জন্য দম বন্ধ হয়ে আসে না?
—” তুষার সাহেব,সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।আমাকে বাড়ি যেতে হবে।চলুন,বেড়িয়ে যাই।”
মহুয়ার কথায় তুষার তার দিকে তাকায়।মহুয়া তার পাশাপাশি হাঁটছে।দুজনের মাঝে অবশ্য দূরত্ব আছে।তুষারের হাঁটতে খারাপ লাগছে না।শেষ বিকালের নরম আলোয় মেয়েটার সঙ্গ বেশ উপভোগ করছে সে।অনেকদিন পর আজ তুষার কারো সাথে এতো কথা বলল।আজকাল কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।তাছাড়া,সারাদিন কাজ শেষ করে রাতে মৃত্তিকাকে সময় দিতে হয়।মেয়ের খাবার রান্না করতে হয়,তার সাথে খেলতে হয়,মৃত্তিকার অব্যক্ত সব কথা বুঝে নিতে হয়,কথা শিখাতে হয়।কারো সাথে দু-দন্ড কথা বলার সময় কোথায়?
—” তুষার সাহেব,কি ভাবছেন?”
—” না, কিছু না।”
—” আমার সম্পর্কে আর কিছু জানার আছে আপনার?”
—” হ্যাঁ, আরেকটা কথা।আপনাদের সম্পর্কে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত কার ছিল?”
—” দুজনেরই।আমি চলে আসার পর ওই বাড়ির সাথে আর কোনো সম্পর্ক ছিল না।কারো সাথে কোনো কথা-বার্তাও হয়নি।এভাবে তিনমাস চলেছে।এরপর বিয়ের প্রায় এক বছরের মাথায় বিচ্ছেদ।আবরারের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছে উকিলের চেম্বারে,ডিবোর্সের সময়।”
—” কোনো কথা হয়নি আপনাদের মাঝে?”
—” নাহ।সেও চেষ্টা করেনি, আমিও বলিনি।কথা কেন বলবে?গলার কাটা নেমে গেলে কি কেউ আর কাটার কথা মনে রাখে?”
—” আচ্ছা,একটা কথা বলুন।আবরার অনন্যাকে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, তাই তো?”
—” হুম।”
—” তাহলে,আপনার সাথে কেন সম্পর্কে জড়ালো?মানলাম বিয়েটা নাহয় রাগের মাথায় করে ফেলেছে।কিন্তু, আপনার কথা মতো সে বিয়ের এক-দেড় মাস পর থেকেই খুব স্বাভাবিক ছিল।যে তার প্রেমিকাকে খুব ভালোবাসে, সে কেন আরেক মেয়ের সাথে এতোটা স্বাভাবিক থাকবে?বিষয়টা কেমন গোলমেলে না?
মহুয়া হাসে।তুষার কি বোকা?এটা বুঝার জন্য প্রশ্ন করতে হয়?এমনিই তো বুঝে ফেলা যায়।
—” তুষার সাহেব,আপনি স্যার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘এজ ইউ লাইক ইট ‘ নাটকটা পড়েছেন?”
মহুয়ার তাল ছাড়া কথায় খুব অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না তুষার।মাথা নেড়ে বললঃ”না।ইংরেজি সাহিত্যে খুব বেশি বিচরণ নেই আমার।”
—” আমি পড়েছি।অবশ্য নাটকের অনুবাদটা পড়েছি আরকি।সেখানে একটা সংলাপ ছিল।সংলাপটা অনেকটা এরকম-চোরদেরকে রূপার চাইতে রূপ বেশি প্রলুব্ধ করে।আবরারের সাথেও হয়তো এমনটাই হয়েছিল।আমাদের সবারই কিন্তু
বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ থাকে।দুটো নারী-পুরুষ একসাথে একঘরে থাকবে অথচ তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক তৈরি হবে না,এটা শুধু নাটক-সিনেমাতেই সম্ভব।বিয়ের পর অনন্যা খুব বেপরোয়া আচরণ করতো আবরারের সাথে।আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল।বুঝতেই পারছেন, অনন্যার কাছে তখন স্বস্তি পেত না আবরার।যেখানে শান্তি থাকে না সেখানে ভালোবাসা ফিকে হয়ে যায়।অন্যদিকে,আমি তো তাকে এতোটা যন্ত্রণা দিতাম না।বরং, বিয়ের পর থেকেই তার সাথে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করে এসেছি। তাই হয়তো আমার দিকেই ঝুকে পড়েছিল।”
—” মহুয়া,কারো প্রতি অভিযোগ নেই আপনার?”
—” কার প্রতি অভিযোগ করব, বলুন তো?আমার বাবা আমার ব্যাপারে খুব সচেতন।আমার জন্য একজোড়া জুতো কিনার আগেও বাবা তিন-চারটা দোকান ঘুরে।যেই দোকানে সবচেয়ে ভালো জুতো পায় সেটাই কিনে নিয়ে আসে।অথচ,বিয়ের আগে আবরারের সম্পর্কে শুধু এলাকাতেই খোঁজ-খবর নিয়েছে।অফিসে যেয়ে কোনো খবর নেয়নি।অফিসের প্রায় সবাই অনন্যা-আবরারের সম্পর্কের কথা জানতো।অফিসে যেয়ে খোঁজ -খবর নেওয়া কি উচিৎ ছিল না?এক্ষেত্রে, দোষ তো অনেকটা আমাদেরও ছিল।তারপর আবার আমার প্রাক্তন শ্বাশুড়ির কথাই চিন্তা করুন।তিনি কিন্তু ছেলের সম্পর্কের কথা জানতেন।তবুও, তিনি আমাকে ছেলের বউ করে নিয়ে গেলেন।দোষ তো তাকেও দেওয়া যায়।”
তুষার কপাল কুঁচকে ফেললো।তারমানে আবরারের মা সব জানতো!
—” তিনি যদি সবই জানতেন,তবে অনন্যাকে কেন বউ করে আনলেন না?অনন্যাকে তার পছন্দ ছিল না?”
—” না।অনন্যার চলাফেরা অনেকটাই উগ্র।তাই আমার প্রাক্তন শ্বাশুড়ি তাকে পছন্দ করতেন না।আমার বিয়ের আগে যখন তিনি দেখলেন আবরার ও অনন্যার মাঝে ঝামেলা হচ্ছে,তখনই ঝোপ বুঝে কোপ মারেন।আমাকে বউ করে নিয়ে যান।তিনি ভেবেছিলেন বিয়ের পর হয়তো আবরার বদলে যাবে।”
—” আপনি কি করে জানলেন এসব?”
—” আফিয়া আপা একদিন ফোনে এসব বলেছিল আমায়।তাহলে এখন বলুন, আমি কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব?সবাই তো একটু-আকটু দোষী।তার চেয়ে ভাগ্যের দোহাই দেওয়াই ভালো।এসব আমার ভাগ্যেই ছিল।নাহয়,আমার সাথেই কেন এতো এমন হলো?”
চারদিকে আলো-আধারের লুকোচুরি খেলা চলছে।এখনই হয়তো ঝুপ করে একমুঠো সন্ধ্যা নেমে আসবে।তুষারের পাশ দিয়ে একটা বাদামওয়ালা হেঁটে চলে গেল।তাকে থামিয়ে বেশ খানিকটা বাদাম কিনে নিলো তুষার।মহুয়া একটা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইলো।তুষার ফিরে এসে মহুয়ার মুখোমুখি দাঁড়ায়।
—“মহুয়া,নিন বাদাম খান।”
তুষারের প্রস্তাব হাসিমুখে নাকচ করে দেয় মহুয়া।
—” আপনি খান।আমি খাব না।”
—” না করবেন না প্লিজ।নিন।”
—“বিব্রত হবেন না তুষার সাহেব।বাদামের খোসা ফেলে খেতে ইচ্ছে করছে না এখন।আমি আবার এসব বিষয়ে খুবই অলস।”
মুচকি হাসে তুষার।হাতের মুঠোয় বাদাম নিয়ে খোসা ফেলতে ফেলতে বলেঃ”ওহ,এই কথা।আগে বলবেন না।আমি ছিলে দিচ্ছি আপনি খান।এতে সমস্যা নেই তো?”
মাথা নাড়ায় মহুয়া।তুষার মহুয়ার হাতে বাদাম তুলে দিয়ে কুন্ঠিত গলায় প্রশ্ন করেঃ”আপনি বোধহয় আমার থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট,তাই না?”
—” আমার সাতাশ চলছে।আপনার?”
—” একত্রিশ।তাহলে আপনাকে তুমি করে বলি?আমি কাউকে খুব বেশিক্ষণ আপনি করে বলতে পারি না।”
মহুয়া হেসে ফেলে।অনুমতি দিয়ে বলেঃ” ঠিক আছে, বলবেন।এ আর এমন কি কথা।”
—” মহুয়া,তুমি আমাকেও বিশ্বাস করতে পারছ না।বিয়েটা তুমি স্বেচ্ছায় করছো না।পরিবারের চাপে করছো, তাই না?”
মহুয়া অবাক হয়ে তাকায় তুষারের দিকে।তুষারের কথা সম্পূর্ণ ঠিক।কিন্তু মহুয়া তো এমন কোনো আচরণ করেনি, যাতে করে তুষার বুঝতে পারবে।তুষার মহুয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। তাই তুষারের মুখের দিকে তাকাতে বেগ পেতে হয় না।মানুষটা নিচের দিকে তাকিয়ে হাসছে।এই প্রথম মহুয়া ভালোভাবে তুষারকে দেখলো।ইনিও যথেষ্ট সুপুরুষ।আগে হয়তো আরো বলিষ্ঠ ছিল।এখন স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে তা চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।তুষারের একটা গেজ দাঁত আছে।হাসলে সেটা দেখা যায়।
—” কি হলো বললে না যে?”
—” ঠিক ধরেছেন।কোনো পুরুষকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।আপনাকেও আমার ভালো লাগে।অনেকটা স্বার্থপরের মতো লাগে।”
তুষার সরাসরি মহুয়ার চোখের দিকে তাকায়।শান্ত গলায় প্রশ্ন করেঃ” কেন?”
—” মনে আছে,প্রথম দিনের কথা?আপনি সেদিন আমাকে বলেছিলেন, আপনি মৃত্তিকার জন্য আমাকে বিয়ে করছেন।এর মানে কী দাঁড়ায়?আপনার জীবনে আমার প্রয়োজন নেই।আপনার মেয়ের প্রয়োজনেই আপনি বিয়ে করছেন।এই কথার মাধ্যমে কিন্তু পরোক্ষভাবে আপনি মৃত্তিকাকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিলেন।আপনি নিজেই চিন্তা করুন, আপনার এই কথার পরেও কি মৃত্তিকার প্রতি আমার ভালো ব্যবহার আসবে?ওকে দেখলেই আমার হিংসা হবে।মনে হবে, ওর জন্যই আমার অধিকার খর্ব হচ্ছে।আপনার ওই কথার পর থেকেই আপনাকে স্বার্থপর মনে হয়।যে নিজের দিকটা ষোলো আনা দেখছে।কিন্তু,আমার দিক এক আনাও দেখছে না।”
তুষার মহুয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।তারপর হুট করেই প্রশ্ন করলোঃ”হিজাব বেধে টিপ কেন পরো? ”
অবাক হয়ে যায় মহুয়া। সে কি বললো আর তুষার কি বলল! মহুয়া বিস্মিত গলায় বলেঃ” মানে!”
—” মানে হচ্ছে, তুমি হিজাব পরেছো আবার কপালে টিপও দিয়েছ।বিষয়টা কি ঠিক হলো?”
—” এটা টিপ না তিল।ছোট থেকেই টিপের মতো একটা তিল আছে আমার।”–ভোতা মুখে উত্তর দেয় মহুয়া।
—” ওহ।তুমি কিন্তু আবার কিছু মনে করো না।আচ্ছা, আসল কথায় আসি।আমাকে তোমার স্বার্থপর লাগে, তাই তো?”
—” হুম।”
—” তুমি যদি আমাকে স্বার্থপর বলতে পারো,তবে আমিও কিন্তু তোমাকে স্বার্থপর বলতে পারি।”
—” কিভাবে!”— মহুয়ার গলায় বিস্ময় ঝরে পড়ে।
তা দেখে মুচকি হাসে তুষার।
—” তুমি শুধু নিজের দুর্ঘটনার কথাই মনে রাখছো মহুয়া।তোমার শুধু নয় মাসের সংসার ছিল।এর মাঝে আবার বিয়ের প্রথম দেড় মাস তোমার ও আবরারের মাঝে ভালো সম্পর্ক ছিল না।অথচ,আমার সংসার ছিল তিন বছরের।স্বাভাবিক জীবনে কিন্তু আমরাও সুখী ছিলাম।তবুও আমাকে ছেড়ে, আমার মেয়েটাকে ছেড়ে মহিমা চলে গেল।মহিমা যেদিন চলে গেছে, সেদিন রাত পর্যন্তও আমি জানতাম না সে আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।আরেকজনের মুখে আমার স্ত্রীর দ্বিতীয় সম্পর্কের কথা শুনতে হয়।বুঝতে পারছো,তখন আমার কেমন লেগেছে?তুমি তো তাও আবরারকে জিজ্ঞেস করতে পেরেছিলে,কেন সে তোমায় ঠকিয়েছে।কিন্তু,আমার ভাগ্যে তাও জোটেনি।আমিও কিন্তু তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি না।আমার কাছে এই মুহূর্তে আমার মেয়েই সব।আমি আমার মেয়ের জন্য কাউকে বিশ্বাস করি না।আচ্ছা তুমিই বলো, আমার জায়গায় থাকলে তুমি কি করতে?তুমিও তো কারো মেয়ে।তোমার বাবা যেমন তোমাকে নিয়ে সচেতন তেমনি আমিও কিন্তু আমার মেয়েকে নিয়ে সচেতন।আমার মেয়ে তার আপন মায়ের কাছেই নিরাপদ ছিল না।তাহলে, আমি কিভাবে মৃত্তিকার বিষয়ে অন্য কাউকে বিশ্বাস করি বলো তো।এটা কি সম্ভব?”
ঠিকই তো। এভাবে তো মহুয়া কখনো ভেবে দেখেনি।তারা তো এক ঘাটেরই মাঝি।তবুও মহুয়া বললঃ” তাহলে, আমাকে কেন বিয়ে করছেন?আমাকেও তো বিশ্বাস করতে পারছেন না।”
—” এখন পারছি না,কিন্তু ভবিষ্যতে যে পারব না এটা কে বলল? আমি চাই আমার মেয়ের একটা মা থাকুক।মৃত্তিকাকে আদর করার,শাসন করার,বুকে জড়িয়ে নেওয়ার একটা মানুষ থাকুক।হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না।দ্বিতীয় মা সবসময় খারাপ হয় না।আমার মৃত্তিকাকে নিজের অংশ ভাবতে পারবে না মহুয়া?তোমার তো একটা টুকুনের শখ ছিল।মৃত্তিকাকে দিয়ে নিজের শখ মেটাতে পারবে না?”
মহুয়া কিছুক্ষণ তুষারের দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর মাথা নেড়ে বলেঃ” পারব।”
হাসি ফুটে তুষারের মুখে।বিয়ের আগে এরকম একটা বোঝাপড়ার দরকার ছিল।সে হাঁটা শুরু করে বলেঃ”তোমার সাথে মৃত্তিকার পরিচয় করিয়ে দেব একদিন।বিয়ের আগে আরেকদিন দেখা করব। সময় হবে তোমার?”
—” হুম হবে।আপনি আমাকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখবেন।”
—” ঠিকাছে।”
পার্ক থেকে বেড়িয়ে মহুয়াকে রিকশায় তুলে দেয় তুষার।মাগরিবের আজান দিয়েছে।মহুয়াকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেও পার্কের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে তুষার।তার মনটা আজ খুব ভালো।মনে হচ্ছে, আল্লাহ এবার তার ভাগ্যে ভালো কিছুই রেখেছে।তুষার গুলিস্তানের বাসের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলেই বেঁচে যায় সে।বিয়েটা হয়ে গেলে একাকিত্ব কমবে।সারাদিন সবার মাঝে থাকলেও, দিনশেষে তুষার ভয়াবহ একা।।
চলবে…
বি.দ্রঃ(ভুল -ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)