যাত্রাশেষে (পর্ব-২,৩)

যাত্রাশেষে (পর্ব-২,৩)
হালিমা রহমান

ঘড়ির কাঁটায় এখন বিকাল পাঁচটা।তুষার বসে আছে আজিমপুরের একটি বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে।ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে এখন রেস্টুরেন্ট। একদম ব্যাঙের ছাতার মতো।তুষার চোখ ঘুরিয়ে একবার পুরোটা দেখলো।বেশ সুন্দর করেই সাজিয়েছে পুরোটা।সবখানে আধুনিকতার ছোঁয়া।তুষার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে একবার ঘড়ির দিকে তাকালো।অনেক কাজ-কর্ম ফেলে সে এখানে এসেছে।এখানে আসার উদ্দেশ্য মহুয়ার সাথে দেখা করা।মহুয়ার সাথে বোধহয় বিয়েটা এবার হয়েই যাবে।
তুষারের খালা, রুবিনা বেগম মহুয়ার খোঁজ পেয়েছেন তুষারের বন্ধু শফিকের মাধ্যমে। শফিক বন্ধু মহলে ঘটক হিসেবে পরিচিত।কতো বন্ধুর বিয়ে যে ও ঠিক করেছে তা হাতে গোনা মুশকিল।প্রায় সপ্তাহ খানেক আগের এক শুক্রবারে, সারাদিনের কাজ শেষ করে,মৃত্তিকাকে ঘুমে রেখে, তুষার বেরিয়েছিল বন্ধুর সাথে দেখা করতে।একসময় প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ হতো শফিকের সাথে।কিন্তু, এখন আর হয় না।যে যার জীবন, ঘর-সংসার, ছেলে-মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত।তাই সচরাচর এখন আর দেখা করা হয় না।ব্যস্ত জীবনকে পাশে রেখে তুষার আজিমপুরে গিয়েছিল শফিকের সাথে দেখা করতে।শফিক আজিমপুরের বাসিন্দা।এখানেই একটা স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক।বহুদিন পর প্রাণের বন্ধুকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে শফিক।তুষারটা কেমন শুকিয়ে গেছে! চোয়াল ভেঙে চেহারাটা একটুখানি হয়ে গেছে।চোখের নিচেও বোধহয় এক আঙুল কালি পরেছে।শফিকের ভিতরটা হু হু করে উঠে, বন্ধুর এই দশা দেখে।তুষারকে দেখে কে বলবে একসময় সে বন্ধু মহলের সবচেয়ে সুন্দর যুবক ছিল!ভার্সিটির বহু মেয়ের ঘুম হারাম করেছে নিজের সৌন্দর্য দিয়ে!মনে মনে মহিমার উপর আকাশসম রাগ জমে শফিকের।ওর মতো ছলনাময়ী আর কোনো পুরুষের ভাগ্যে না থাকুক।
—” কিরে, শফিক ছাড় আমাকে।এতোক্ষণ কে মানুষকে জড়িয়ে ধরে রাখে?”
তুষারের কথায় ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায়।সে আরো একবার জোরে জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দেয় তুষারকে।তুষারের পিঠের হাড়গোড় বোধহয় ভেঙেই গেছে।সে শফিকের পেটে একটা ঘুসি মেরে বলেঃ” শালা, গন্ডারের স্বাস্থ্য বানাইছিস।আমার পিঠটা ভেঙেই গেছে।”
শফিক মুচকি হেসে বলেঃ”তোরে আপাদমস্তক ভাঙার জন্য গন্ডারের স্বাস্থ্য লাগে না।যেই অবস্থা করেছিস নিজের! একটা কঙ্কালের চাইতেও খারাপ দেখা যায়।নিজের যত্ন-টত্ন নিস না নাকি?”
—” আরে ধুর,নিজের দিকে তাকানোর সময় আছে এখন?দোকানের কাজ,মৃত্তির খেয়াল সবকিছুর দেখাশোনার বাইরে সময় কই আর।”
—” শোন এইসব আমারে বুঝাইস না,বুঝছোছ? ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।তুই তো মনে হয় বউয়ের শোকেই দেবদাস হওয়ার পায়তারা করছিস।মানে,এটা কোনো কথা ভাই?একটা প্রতারকের জন্য কে নিজের এই হাল করে! শালা,তুই পুরুষ জাতির কলঙ্ক।তোকে এই মুহূর্তে আমাদের জাতি থেকে বহিষ্কার করা উচিৎ। ”
শফিকের কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ে।তাই কথা ঘুরিয়ে ফেলে তুষার।ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাতে ল্যাম্পপোস্টের হলদে-সাদা আলোয় বহু কথা হয় দুজনের মাঝে।কখনো বাড়ির কথা,কখনো পুরোনো বন্ধুদের কথা আবার কখনো দেশের কথা।কথার এক ফাঁকেই শফিক তুষারকে প্রশ্ন করেঃ” বিয়ে-সাদি করবি না আর?মৃত্তির কিন্তু এখন একটা মায়ের দরকার।”
—” কেন? আমি কি কম নাকি? তাছাড়া, খালামনি ওর খুব খেয়াল রাখে।ওর কোনো কষ্টই হয় না।”
—” তুই আর কতটুকু খেয়াল রাখিস?তাছাড়া, দাদির আদর দাদির মতো আর মায়ের আদর মায়ের মতো।দুটো কি এক নাকি?”
—” আমার দ্বিতীয় স্ত্রীই কি ওর মা হয়ে উঠবে?যাকে নিজের মায়ই ফেলে গেছে,তাকে আর কে আপন করে নিবে?”
—” এইসব নিম্ন শ্রেণির কথা- বার্তা বন্ধ কর।সব সৎমা খারাপ হয় না। এমনও তো হতে পারে মৃত্তির দ্বিতীয় মা তাকে সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখবে।”
—” কি জানি।কিন্তু,এবার বোধহয় বিয়ে একটা করতেই হবে।খালা-খালু হজ্বে যাবে এবার।আমি একা মিত্তিকে দেখে রাখতে পারব না।”
খুবই খুশি হয় শফিক।উৎফুল্ল স্বরে জিজ্ঞাসা করেঃ” মেয়ে কি দেখেছিস নাকি?আমার কাছে খুব ভালো একটা মেয়ের খবর আছে।”
—” না,মেয়ে এখনো দেখা হয়নি।খালামনি দেখেছি খুঁজছে।”
—” তাহলে,খালামনির নাম্বার দে।আমি তার সাথে কথা বলি।”
তুষার নাম্বার দিতে দিতে বলেঃ”মেয়ে যাতে ডিভোর্সি হয়।অবিবাহিত মেয়েদের আমি বিয়ে করব না।”
খুবই অবাক হয় শফিক।অবাক কন্ঠে বলেঃ” একটা ষাট বছর বয়সী বুড়োও দ্বিতীয় বিয়ে করার সময় অবিবাহিত মেয়ে খুঁজে। তুই এমন দল ছাড়া,গোত্র ছাড়া হতে যাবি কেন?”
—” আমার বউ নয়,মেয়ের মা দরকার।দুটো ভাঙা জিনিস একসাথে জোড়া লাগতে পারে।কিন্তু একটা ভাঙা জিনিস আর একটা ভালো জিনিস কখনোই একসাথে জোড়া লাগতে পারে না।বুঝেছিস?”
—” উঁহু, কিছুই বুঝলাম না।আচ্ছা,বাদ দে।এখন মেয়ের কথা শোন।মেয়ের নাম মহুয়া।সে আমার সহকর্মী।আমাদের স্কুলের আইসিটির জনপ্রিয় শিক্ষক।ভাইরে ভাই,কি যে মেধাবী! আমাদের স্কুলের কলেজ সেকশন হচ্ছে।ওইটা হলে,এই মেয়ে নিশ্চিত কলেজের লেকচারার হতে পারবে এক চুটকিতে।”
—” এতো কিছু বাদ দে।তুই বল,সে ডিভোর্সি নাকি?”
—” হুম।এক বছর হয়েছে ডিভোর্স হয়েছে।আমি বুঝি না কোন শালা এই নম্র-ভদ্র মেয়েটারে ছারছে।ওই শালা নিশ্চিত একটা বলদ।”
তুষার বুঝলো শফিক মহুয়ার বিশাল ভক্ত।তাই সে কিছু বলল না।
—” বুঝলি তুষার,মেয়েটা এতো ভালো।আমার এতো ভালো লাগে।তোর ভাবি যদি না থাকতো, তবে আমিই ওকে বিয়ে করার চেষ্টা করতাম।”
তুষার মুচকি হেসে শফিকের পিছনে লাথি দেয়।মুখে বলেঃ” এই কারণেই ভাবি তোকে দু-বেলা জুতোপেটা করে।তোর মতো মানুষের জন্য এটাই ঠিক আছে।কত্ত বড় বদমায়েশ হলে,মানুষ ঘরে বউ রেখে বাইরের মেয়েদের দিকে তাকায়!”
বিয়ের জন্য তুষারকে আর কিছুই করতে হয়নি।রুবিনা বেগম ও শফিক মিলেই সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে।রুবিনা বেগম প্রথমে গাইগুই করেছিলেন,মহুয়া ডিভোর্সি বলে।কিন্তু,পরে যখন জানলেন তুষার ডিভোর্সি ছাড়া বিয়ে করবে না ; তখন আর কিছুই বলেননি।ছেলের জীবন,সিদ্ধান্তও সেই নেক।রুবিনা বেগম বাড়ি যেয়ে দেখে এসেছেন মহুয়াকে।পছন্দ হয়েছে তার।তুষারকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।কিন্তু,তুষার যায়নি।বাড়ি বয়ে মেয়ে দেখতে তুষারের ভালো লাগে না।তবে,তুষার শফিকের সাথে একদিন গিয়েছিল স্কুলে। সেখানে, একবারের জন্য চোখে পড়েছে মহুয়াকে।দেখতে খারাপ না।আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতোই।দুই বাড়ির কারোরই আপত্তি নেই বিয়েতে।তুষারেরও আপত্তি নেই।তাই বিয়ের আগে একবার মহুয়ার সাথে দেখা করতে চেয়েছে তুষার।মহুয়ার সাথে কিছু কথা খোলামেলা আলোচনা করতে চায় সে।মহুয়াও সায় দিয়েছে।তাই আজ বিকাল পাঁচটায় আজিমপুরের বিলাসবহুল এই রেস্টুরেন্টে বসে আছে তুষার।পাঁচটা বেজে গেছে অনেক আগেই।তুষার বিরক্ত নিয়ে বসে আছে।আশ্চর্য!এই মেয়ের কি কোনো সময়জ্ঞান নেই?সে কি জানে, তুষার কতো কাজ-কর্ম ফেলে এখানে এসেছে?সামনাসামনি দেখা হওয়ার আগেই, মহুয়ার প্রতি বিতৃষ্ণায় ভরে গেল তুষারের মন।

***

ঘড়ির কাঁটা যখন সাড়ে পাঁচটার ঘরে এসেছে, তখন রেস্টুরেন্টে টুকটুক করে ঢুকলো মহুয়া।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরটায় চোখ বুলালো।কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখে ফেললো তুষারকে।তুষারকে সে চিনে।ছবি দেখেছে এর আগে।মহুয়া ধীরপায়ে তুষারের দিকে এগিয়ে গেল।এককোনে একটা টেবিলে বসে আছে।কপাল কুঁচকে ফোন টিপছে।মহুয়া টেবিলের সামনে পৌঁছে গলায় কাশি তুলে বললঃ” আসসালামু আলাইকুম, আপনিই কি তুষার সাহেব?”
মহুয়াকে দেখে উঠে দাঁড়ালো তুষার।মুখে বললঃ” জ্বি।বসুন,প্লিজ।”
মুচকি হেসে বসলো মহুয়া।তুষার বসতে বসতে বললোঃ” আমি ভেবেছিলাম, আপনি আসবেন না।আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেই চলে যেতাম আমি।”
—” আমি অনেক আগেই আসতাম।কিন্তু,বাসায় একটু ঝামেলা হওয়ায় দেরি হয়ে গেছে।আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ”
—” ঠিক আছে,সমস্যা নেই।নিন অর্ডার করুন।”
মেনু কার্ড এগিয়ে দিলেও খুব বেশি একটা অর্ডার করলো না মহুয়া।কেবল এককাপ কফির ফরমায়েশ দিলো।তুষারও এক কাপ কফির বেশি আর কিছু অর্ডার দিলো না।এখানে তারা আজ খেতে আসেনি।খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছে।
তুষার ভিতরে ভিতরে কথা সাজিয়ে বললঃ”আপনি বোধহয় আমার সম্পর্কে সবকিছুই জানেন।তবুও আমি নিজের মুখেই বলছি।আমি তুষার আহমেদ।গুলিস্তানের সুন্দরবন মার্কেটে একটা ও পাতাল মার্কেটে একটা দোকান আছে আমার।দুটোই মোবাইলের। আমার একটা একবছর বয়সী মেয়ে আছে।মৃত্তিকা তার নাম।আপনি বোধহয় দেখেছেন ওকে।”
—” জ্বি, দেখেছি।সেদিন আপনার খালামনির সাথে সে এসেছিল আমাদের বাসায়।আপনার মেয়েটা খুব ফুটফুটে।”
—” হুম।ওর জন্যই এখন আবার বিয়ে করতে হচ্ছে আমাকে।আমি আমার প্রথম স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতাম।”
—” স্বাভাবিক।আপনার স্ত্রী কেন পালিয়ে গিয়েছিলো? ”
খুবই বিশ্রি একটা প্রশ্ন।তুষার বিরসমুখে বললঃ”সে নতুনত্বের খোঁজ পেয়েছিলো।ব্যক্তিগতভাবে, আমাদের দুজনের মাঝে কোনো সমস্যা ছিলো না।তবে,আমি সেই কয়েকটা মাস মহিমাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারিনি।”
—” কেন?”
—” মৃত্তি হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই আমার মা মারা গিয়েছিলো।দোকানগুলোর অবস্থাও তখন ভালো ছিল না।মৃত্তি হওয়ার কারণে মহিমার পিছনেও অনেক টাকা খরচ হয়েছিল।হাতে তখন বেশ টানাটানি।এসব নিয়েই মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত ছিলাম আমি।তাই খুব একটা সময় দিতে পারিনি ওকে।”
—” আচ্ছা,আপনি কি পরে খবর পেয়েছিলেন কার সাথে মহিমা পালিয়ে গিয়েছিল?”
—” হুম। আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ বিলের কাগজ বিলি করতো একটা লোক।তার সাথেই। ”
—“ওহ,আচ্ছা।”
কফি এসে পড়েছে।দুজনেই উদাস মুখে একটা চুমুক দিলো কফি কাপে।তুষার এক চুমুক কফি খেয়ে বললঃ”আমি আসলে এখন মেয়েটার জন্যই বিয়ে করছি।আমার এখন বউয়ের দরকার নেই।আমার মেয়েটার একটা মা দরকার।আপনি কি আমার মেয়ের মা হবেন, প্লিজ?”
নিঃসংকোচ আবেদন।মহুয়া মুচকি হেসে বললঃ ” আপনার কথাগুলো বেশ স্বার্থপরের মতো শুনাচ্ছে।মিত্তির জন্য বিয়ে করছেন,কিন্তু আমি যদি ওর মা না হয়ে উঠতে পারি?”
—” দেখুন ভবিষ্যতকে কল্পনা করা যায়।আমি কেন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খারাপ কল্পনা করব? আমি আশা করেই নিচ্ছি আপনি আমার মেয়ের খুব ভালো মা হবেন।”
—” আরেকটা প্রশ্ন,আপনার যেই বয়স; এই বয়সে একটা অবিবাহিত মেয়েকেই বিয়ে করতে পারেন।মানে,এই বয়সে আমাদের দেশের অনেক ছেলেই প্রথম বিয়ে করে।তো আপনি কেন আমার মতো একটা ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করছেন?”
—” আমি তিন বছর সংসার করেছি মহিমার সাথে।সংসারের অলিগলি সব আমার চেনা।আমাদের দেশের মেয়েরা সংসার চিনে কোন বয়স থেকে, জানেন?যখন তারা পুতুল খেলে তখন থেকে।তখন থেকেই তারা স্বামী- সংসারের স্বপ্ন দেখে।দেখেন না, আমাদের মেয়েরা ছোটবয়সে কিন্তু বল খেলে না।তারা দুটো পুতুলের বিয়ে দিয়ে সংসার সংসার খেলে।আমি যদি একটা অবিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করি, তবে সে প্রথমেই আমার বউ হতে চাইবে।আমার বাচ্চার মা না।তাই, আমি একজন ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছি।”
মহুয়া বুঝলো লোকটা বেশ বাস্তববাদী।তাই কফি শেষ করে বললঃ” আপনার মনে প্রশ্ন জাগে না, আমার কেন ডিভোর্স হয়েছে? এমনও তো হতে পারে, আমার দোষেই আমার আগের সংসার ভেঙেছে। ”
—” আপনি যদি নতুনত্বের খোঁজে সংসার ছাড়তেন তবে নিশ্চয়ই এতোদিন বিয়ে না করে থাকতেন না।দু কারণে আমাদের সংসার ভাঙে।নতুনত্বের খোঁজ পেলে অথবা অত্যাচারের কারণে। তাছাড়া,আমি খালামনির কাছে শুনেছি, তৃতীয় ব্যক্তির জন্যই আপনার সংসার ভেঙেছে। ”
—” তৃতীয় ব্যক্তির জন্য কখোনো আমাদের বন্ধন ছিন্ন হয় না।বন্ধন ছিন্ন হয়, আমাদের নিজেদের মানুষদের জন্যই।আপনি কি শুনবেন আমার এলোমেলো সংসারের পুরোপুরি ভেঙে যাওয়ার গল্প?”
খুব অসহায় দেখালো মহুয়ার চোখ।সহসা না করতে পারলো না তুষার।সবারই কিছু না কিছু গল্প থাকে
আজ নাহয় শোনাই যাক মহুয়ার পুরোনো সেইসব কথা।এক পুরোনো সংসারের কিছু ঘটনার নগ্ন উত্থান।

চলবে…

( বি.দ্রঃভুল- ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)

# যাত্রাশেষে(পর্ব-৩)
# হালিমা রহমান

দুবছর আগের এক শীতের সকাল।ঘরের দরজা- জানালা বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে মহুয়া।একেবারে কম্বল মুড়ি দিয়ে, কোলবালিশ জড়িয়ে, বিছানার মাঝে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে।এখন বোধহয় সকাল নয়টা বাজে।এতোবেলা পর্যন্ত মহুয়ার এই সুখনিদ্রা পছন্দ হচ্ছে না মহুয়ার মা,সাবিনা বেগমের।তিনি তিনবার মহুয়ার বন্ধ দরজায় জোরে জোরে আঘাত করেছেন,গলা উঁচিয়ে বকাবকি করেছেন, নিজের মোবাইল দিয়ে মহুয়ার মোবাইলে কল করেছেন।তবুও, মহুয়ার ঘুম ভাঙার কোনো নাম – গন্ধ নেই।আশ্চর্য! মেয়ে কি মরে-টরে গেল নাকি?সাবিনা বেগমের এইসব কাজে চরম বিরক্ত মহুয়ার বাবা,আফজাল হোসেন।একটা মাত্র আদরের মেয়ে তার।সারা সপ্তাহ মেয়েটা বাইরে কাজ করে। অন্যান্য দিনতো সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠতে হয়।সপ্তাহে একটা দিনই একটু ঘুমানোর ফুরসত পায়।ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক।তিনি চেয়ারে বসে বিরক্ত চোখে সাবিনার দিকে চেয়ে আছেন।এই মূর্খ মহিলার কাজ- কর্মের কোনো দিকপাল নেই।সাবিনা বেগম আরো একবার মহুয়ার দরজায় আঘাত করলেন।গলা উঁচিয়ে বাংলা ভাষায় কয়েকবার গালাগালিও করলেন।তবুও যখন দেখলেন মেয়ের উঠার কোনো লক্ষণ নেই,তখন রেগেমেগে তেড়ে আসলেন মহুয়ার বাবা আফজাল সাহেবের দিকে।
—” আপনার জন্য,শুধুমাত্র আপনার জন্য আজকে আমার মেয়ের এই অবস্থা।মেয়েরে লাই দিয়ে দিয়ে এক্কেবারে মাথায় তুইলা ফেলসেন।আমি ওরে ছোটবেলা থেকে একা মানুষ করি নাই?কই তখন তো ওর এতো সাহস ছিল না।মেয়ের কত্ত পাখা গজাইছে,আমার কথা কানে নেয় না!আজকে শুধু উঠুক, ওরে যে কি করব আমি।আপনি যদি শুধু মেয়েরে সাপোর্ট করছেন,খবর আছে আপনার।”
—” সাবিনা,একটু আস্তে কথা বলো।আজকে শুক্রবার,সব বাসায় মানুষ এখনো ঘুমায়।মেয়েটা তো একটু শুক্রবারেই ঘুমায়।অন্যান্য দিন সেই সকালে উঠে রাত বারোটায় ঘুমাতে যায়।সেগুলো কি তোমার চোখে পড়ে না?আমার মেয়ের মতো কোন মেয়েটা সারাদিন এতো কাজ করে?তুমি ওর মা,কোথায় একটু মায়ের মতো আচরণ করবা,ভালোবাসবা তা না।মেয়েটা বাড়িতে থাকলেই খিটমিট শুরু করো।একদম সৎমাদের মতো।”
সাবিনা বেগম রাগে দিশেহারা হয়ে গেলেন।স্বামীর দিকে আবারো তেড়ে এসে বললেনঃ” হ্যাঁ, আমি সৎমাই।ওরে কি আমি পেটে ধরসি নাকি? আমার তো মেয়ের প্রতি আদর নাই।মেয়েটা উঠবে এগোরাটায়,সকালের নাস্তা খাবে বারোটায়,এরপর দুপুরের খাবারই আর খাবে না।এটাই আদর,তাই না?থাকেন আপনারা বাপ-মেয়ে।কিছু বলব না আর।আমি তো আপনাদের শত্রু।মেয়েরে সবকিছুতে লাই দিতে হবে।এই স্বভাব নিয়ে যদি পরের বাড়িতে যায় না,এক দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে আরেক দরজা দিয়ে বের করে দিবে।আমি তো…….” আফজাল সাহেব আর কানে নিলেন না সাবিনা বেগমের কথা।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।এই মহিলার কথা শোনা মানেই স্বেচ্ছায় কানের উপর অত্যাচার করা।সব কিছুতে এতো বাড়াবাড়ি ভালো না।তাছাড়া,মেয়েরা তো একটু বাবার বাড়িতেই আরাম করবে তাই না?শ্বশুর বাড়িতে কি আর আরাম করতে পারবে?মেয়েটা একটু চলুক না নিজের মতো।কি সমস্যা হয় এতে?
আফজাল সাহেব ধীরপায়ে যেয়ে মেয়ের দরজার সামনে দাঁড়ালেন।যতটা ধীরে ধীরে মেয়ের দরজার সামনে গিয়েছিলেন, তার চাইতেও ধীরে দরজায় আঘাত করলেন।নরম গলায় ডাক দিলেন মেয়েকে।
—” মহু মা, মা।উঠো মা।নাস্তা করবা না? উঠো।মহুয়া,মহুয়া।”
খট করে খুলে গেল মহুয়ার দরজা।সকাল সকাল বাবাকে দেখে মনটাই ভালো হয়ে গেল মহুয়ার।এতোক্ষণ সে জেগেই ছিল।সাবিনা বেগম যেইহারে চিল্লাচিল্লি করেছেন,এতে কারো সাধ্য নেই ঘুমানোর।আফজাল সাহেব মেয়ের ঘরে ঢুকে বিছানায় আয়েস করে বসলেন।দূর্বল হাঁড়ের পাগুলোকে ঢুকিয়ে দিলেন মেয়ের নরম উষ্ণ কম্বলে।এতোক্ষন চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে থাকার কারণে পায়ে ব্যাথা হয়ে গেছে।মহুয়া এসে আবারো বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।আফজাল সাহেব মৃদু হেসে বিলি কেটে দিলেন মেয়ের মাথায়।
—” মা এমন করে কেন বাবা?”
—” তোকে বেশি ভালোবাসে তাই।”
—” এটা কেমন ভালোবাসা?ভালোবাসায় শান্তি থাকতে হয়।শান্তি না থাকলে কি আর তাকে আর ভালোবাসা বলে?”
—“হুম, অবশ্যই বলে।তোর কাছে যেটা অশান্তি,তোর মায়ের কাছে তা সচেতনতা।তুই যে ছুটির দিনে দুপুরে ভাত খাস না, এটা তোর মাকে বড্ড পোড়ায়।বুঝলি? সে তোর স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন।ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন।”
—” এক বেলা না খেলে কি এমন হয়? মানুষ কি মরে যায়?একটা জিনিসকে কেন্দ্র মা সেই সকাল থেকে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়।হাহ।”
—” শোন তোর মা একটু এমনই।সে সবকিছু নিয়ে বেশি বেশি ভাবে বুঝলি।তোকে একটা ঘটনা বলি।তোর ছোটবেলায় একবার খুব জ্বর হয়েছিল।একদম গা কাঁপানো জ্বর।তুই বোধহয় তখন তিন- চার বছরের বাচ্চা মেয়ে।আমি দেশে নেই।তোর মায়ের চিন্তা তখন দেখে কে!তখন তো আর এতো সহজে যোগাযোগ করা যেত না।তোর মা নাকি তোকে নিয়ে তখন খুব দৌড়াদৌড়ি করেছে।একা মানুষ হয়েও এই ডাক্তার থেকে ঐ ডাক্তারের কাছে দৌড়ে গেছে।যে যা বলেছে তাই করেছে।কখনো ঔষধ, কখনো ভেষজ লতা- পাতা খাইয়েছে তোকে।অথচ,তোর জ্বর ছিল মাত্র তিনদিন।তাও আবার সাংঘাতিক কিছু না।সিজোনাল জ্বর।তোর মা সবসময়ই একটু পাগলাটে।বুঝলি?”
—” বুঝলাম।এখন তুমি যে এখানে বসে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াচ্ছ,মা দেখলে কি করবে বল তো?”
—” আমাদের গর্দান নেবে।যা যা তাড়াতাড়ি উঠ।তুই নিজেও তোর মায়ের সাথে বেশি করিস। কি হয় একটু তাড়াতাড়ি উঠলে?”
মহুয়া উঠে বসেছিলো। বাবার কথা শুনে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললঃ” বাবা,একটা দিনই তো মাত্র।নিজের মায়ই যদি এই সুযোগ না দেয়,তবে কে দিবে আর?”
আফজাল সাহেব মৃদু হেসে উঠতে উঠতে বললেনঃ”আমার মাকে সবাই ভালোবাসবে,সুযোগ দেবে।আমার মহুয়া মায়ের জন্য আমি একটা নদের চাঁদ খুঁজে আনব।পড়েছিস না মহুয়ার পালা?নদের চাঁদকে তো চিনিস।কি ভালোই না বাসতো মহুয়াকে।নিজের জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে দিল।”
মহুয়া বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে গলা বাড়িয়ে বললঃ” নদের চাঁদরা যুগে যুগে আসে না বাবা।তারা শুধুমাত্র একবারই আসে।আর তাছাড়া, বাস্তবে কি আর নদের চাঁদ হয় নাকি?এরা সাহিত্যেই হয়।”
আলফাজ সাহেব কিছু বললেন না আর।তিনি নিজেও জানেন নদের চাঁদরা বাস্তবে হয় না।এরা সাহিত্যেই সুন্দর।তবুও বাবা-মায়ের মন।সব বাবা-মায়ই চায় ছেলে-মেয়ের জন্য রাজকন্যা বা রাজপুত্র ।তেমনি,আফজাল সাহেবও ব্যতিক্রম নয়।তিনিও মেয়ের জন্য একটা রাজপুত্রই চান।যে তার মেয়েকে তার মতোই আগলে রাখবে।মেয়েটা যে তার বড় আদরের।

মহুয়া আফজাল সাহেব ও সাবিনা বেগমের একমাত্র মেয়ে।আঁধার ঘরের একমাত্র বাতি।আফজাল সাহেবের জীবনভর মালয়েশিয়া ছিলেন।সেই যে বিয়ের একমাস পর গিয়েছিলেন সেখানে,এসেছিলেন পুরো সাত বছর পর।দেশে আসার সুযোগ ছিল না এমন নয়।অনেকবার সুযোগ পেয়েছিলেন।কিন্তু,আসেননি।মালয়েশিয়ায় একটা গ্লাস কোম্পানিতে চাকরি করতেন।বিদেশিরা সেখানে চাকরি করতো বটে,কিন্তু সুযোগ খুব কম ছিল।সারামাসে গাধার মতো খেটে নামমাত্র বেতন পেতেন।এছাড়া,অস্থায়ী চাকরি।দেশে আসলে চাকরি থাকবে কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই।তাই, দেশে আসেননি আফজাল সাহেব।সাতবছর পর দেশে এসেছিলেন মাত্র তিনমাসের জন্য।এরপর আবার পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশে।মহুয়ার জন্মের সময় দেশে ছিলেন না তিনি।যোগাযোগ ব্যবস্থা এতোটা উন্নত ছিল না।তাই, মহুয়ার মুখ দেখা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার। সাবিনা বেগম কয়েকমাস পর পর একটা চিঠির ভাঁজে মহুয়ার একটা ছবি পাঠাতেন।সস্তা স্টুডিওতে তোলা ছবি।তাই দু-চোখ ভরে দেখতেন আফজাল সাহেব।কখনো মুখে হাসি নিয়ে দেখতেন আবার কখনো চোখে জল নিয়ে দেখতেন।কলিজার টুকরাকে দু-হাতে ধরতে না পারার ব্যর্থতা তাকে কুড়ে কুড়ে মারতো। মহুয়ার বয়স যখন পনেরো বছর,তখন দেশে এসেছেন আফজাল সাহেব।দেশে এসে রোগে পড়লেন।দীর্ঘ প্রবাস জীবনে যেই টাকা জমিয়েছিলেন,তার অর্ধেকটাই খরচ হয়ে গেল নিজের পিছনে।বাকি অর্ধেক ভাইয়ের চালের ব্যবসায়ে খাটালেন।মাস শেষে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আসে ঘরে।এই তার আয়।আফজাল সাহেব তার মেয়েকে সবকিছুতেই সমর্থন করেন।সাবিনা বেগমের ভাষায় তিনি লাই দিয়ে মাথায় তুলছেন মেয়েকে।আফজাল সাহেব কানে নেন না তার কথা।পনেরো বছর তিনি মেয়ের থেকে দূরে ছিলেন।তাই তার আচরণ ভিন্ন হবেই।তিনি মেয়েকে বেশি বেশি ভালোবাসবেন এটাই স্বাভাবিক। সাবিনাটা কেন যে বুঝে না!!

বিকাল বেলা একটু বাইরে বের হলো মহুয়া।সারা সপ্তাহে কাজে কাজে থাকতে হয় বলে এখন আর ঘরেই থাকতে ইচ্ছে হয় না।মহুয়া মাথায় ওরনা টেনে গায়ে চাদর জড়িয়ে নিল।এবার বোধহয় খুব ঠান্ডা পড়বে ঢাকায়।পৌষ মাস সবে শুরু হলো।অথচ,এখনই কতো ঠান্ডা!মহুয়া ভালোমতো চাদর জড়িয়ে রাস্তার কোণঘেষে হাঁটা শুরু করলো।আজিমপুর কবরস্থান এখান থেকে কাছেই।তবে, সেদিকে গেল না মহুয়া।কাছেই একটা চটপটির দোকান আছে।সেখানেই যাবে।তবে, দু- পা এগিয়েই থেমে গেল মহুয়া।একজন ভদ্রমহিলা পা ছড়িয়ে বসে আছে।ইচ্ছে করে নয়,হয়তো হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছেন।আশেপাশে মানুষ খুব বেশি নেই।তাই,মহুয়া দৌড়ে গেল সেদিকে।উদ্বিগ্ন গলায় বললঃ”আপনি পরে গেলেন কি করে?খুব ব্যাথা পেয়েছেন?”
ভদ্রমহিলা মলিন হেসে বললঃ” আর বলো না, মা।বোরকার সাথে পা জড়িয়ে পরে গেলাম।হাঁটুতে লেগেছে খুব।তাই উঠতে পারছি না।”
মহুয়া একটু নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো।
—” আপনি আমার হাত ধরে উঠুন।আস্তে আস্তে চেষ্টা করুন।”
ভদ্রমহিলা বহু কষ্টে, বহু চেষ্টায় মহুয়ার হাত ধরে উঠলো।তাকে উঠাতে একটু কষ্টই হলো মহুয়ার।মহুয়ার স্বাস্থ্যের তুলনায় বেশ ভারী তিনি।ভদ্রমহিলা মিনিট কয়েকের মধ্যে দাঁড়ালেন বটে,কিন্তু পা ফেলতে পারলেন না সহজে। পায়ের গোড়ালিতে লেগেছে খুব।মহুয়া তা দেখে চিন্তিত স্বরে বললঃ”আপনার বাসা কোথায়?
—“নয়া পল্টন।”
—” এই অবস্থায় কি আপনি একা বাসায় যেতে পারবেন?”
—“মনে হচ্ছে পারব না।পা ফেলতে পারছি না আমি।”
—“এখন কী করবেন তবে?কাউকে ফোন দিতে হবে তো।
—“আমার ছেলেকে কল করতে হবে।ও এখন অফিসে আছে।আসতে হয়তো দেরি হবে।ততোক্ষণ অপেক্ষা করব এখানে।”
মহুয়া আশেপাশে নজর বুলিয়ে বললঃ”এখানে অপেক্ষা করবেন?আপনি তো ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছেন না।আপনি চাইলে আমার সাথে আমার বাসায় আসতে পারেন।সামনেই আমার বাসা।সেখানে নাহয় একটু বসলেন।যাবেন?”
বেশ চিন্তিত দেখালো ভদ্রমহিলাকে।উভয় সংকটে পড়েছেন তিনি।অচেনা একটা মেয়ের বাসায় যেতেও ইচ্ছে করছে না আবার রাস্তার মাঝেও বসে বসে অপেক্ষা করা সম্ভব না।মহুয়া তার মুখ দেখে চিন্তার কারণ বুঝলো।তাই আশ্বস্তের সুরে বললঃ”আপনার সমস্যা না হলে আসতে পারেন।এই গলির সামনেই আমার বাসা।বাড়িতে আমার বাবা- মা আছেন।”
আর বেশি ভাবলেন না ভদ্রমহিলা।পা বাড়ালেন মহুয়ার সাথে।মহুয়া বেশ যত্ন করে তাকে বাড়িতে নিয়ে গেল।মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।সাবিনা বেগম বেশ আলাপী।অচেনা একজনের সাথে ভাব জমাতে তার বেশি সময় লাগে না।তেমনি,এই ভদ্রমহিলার সাথেও রাজ্যের আলাপ জুরে দিলেন তিনি।কথা – বার্তার একপর্যায়ে ভদ্রমহিলা বললেনঃ” আপনার মেয়েটা ভীষণ লক্ষ্মী।ওর না বুঝি মহুয়া?”
—” হ্যাঁ, আপা।”
—“কি করছে ও? পড়াশোনা? ”
—” নাহ।এম.এস.সি পরীক্ষা দিলো সবে।রেজাল্ট এখনো বের হয়নি।তাই, অবসর সময় কাটাতে কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে কাজ করছে।কম্পিউটার শেখায় সেখানে।”
—“ওহ।ওকে দেখলে কিন্তু বুঝা যায় না ওর পড়াশোনা শেষ।মহুয়া চাইলেই তো একটা স্কুলে চাকরি করতে পারে।ট্রেনিং সেন্টার থেকে ওটা বেশি ভালো না?”
—” কম্পিউটারের প্রতি ঝোক বেশি ওর।নিজেও কিসের যেন কোর্স করেছে কয়েকবছর আগে।এখন ছেলেমেয়েদের শেখায়।আমিও কিছু বলি না।নিজের ইচ্ছে মতো করুক।”
প্রায় ঘন্টাখানেক ছিলেন ভদ্রমহিলা।মাগরিবের আগে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে তার ছেলে আসে।শক্ত-সমর্থ বলিষ্ঠ এক যুবক।বেশ অস্থির দেখায় তাকে।সাবিনা বেগম ছেলেটার অস্থিরতায় মুগ্ধ হন।মাকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসে ছেলেটা।এমন লক্ষ্মী ছেলে আজকাল দেখাই যায় না।যাওয়ার আগে ভদ্রমহিলা ডাক দেন মহুয়াকে।মহুয়া নিজের ঘরে বসে ছিল।সে বেড়িয়ে আসলে ভদ্র মহিলা বলেনঃ” এই যে মা,এটা আমার ছেলে আবরার।তোমাকে ধন্যবাদ দিলেও কম হবে।তুমি না থাকলে আজ বেশ কষ্ট পোহাতে হতো আমাকে।”
মহুয়া বিনিময়ে মুচকি হাসে।আবরার নামের ছেলেটিও বারকয়েক ধন্যবাদ দেয় মহুয়াকে।যাওয়ার আগে বারবার প্রচার করে যায় মহুয়ার কাছে সে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।কারণ, মহুয়া আজ যেই উপকার করলো ; তার ঋণ শোধ করা মুশকিল।

***

তুষার টেবিলের উপর দু-হাত রেখে বললঃ” তারপর?”
মহুয়া একবার হাত ঘড়ির দিকে নজর বুলালো।
—” সন্ধ্যা হয়ে গেছে তুষার সাহেব। আজ এতুটুকুই।আমাকে বাড়িতে ফিরতে হবে।বাকিটুকু অন্য আরেকদিন বলব।”
আশ্চর্য! মাঝ পথে মানুষ কথা থামিয়ে দেয়?তুষার কপাল কুঁচকে বললঃ”আপনি যদি এতুটুকুই বলবেন,তবে এতো আগ থেকে শুরু করার কি দরকার ছিল।আপনার বিয়ের পরের ঘটনাগুলো বললেই হতো।”
—” উঁহু।ওভাবে অতটুকু বললে আমার ভালো লাগতো না।আপনিও শুনে মজা পেতেন না।আমার জীবনে দূর্ভাগ্যের আগমনটুকু বললাম আপনাকে।এর চাইতে বেশি আর বর্ণনা করতে ইচ্ছে করছে না।”
—” দূর্ভাগ্য! তার মানে,আপনার প্রাক্তন স্বামীর নাম আবরার ছিল।”
—” হুম।সেই শীতের বিকালে তার মাকে সাহায্য করার মাধ্যমেই তার সাথে দেখা।তখন মানুষের মতোই দেখা গেছে।কিন্তু,বিশ্বাস করুন পরে দেখলাম সে মানুষ নয়।হারামজাদা একটা কুকুর।”
—” থাক গালি দিয়েন না।”
—” এটা তো কোনো গালিই নয়।আপনি সামনে আছেন বলে আমি চুপ করে আছি।নাহয় এর কথা মনে পড়লেও আমি গালি দেই।একদম বাছা বাছা জঘন্য কিছু গালি।আমি নিশ্চিত ও যদি এসব নিজ কানে শুনতো, তবে ওর কানদুটোই পচে যেত।আচ্ছা,অনেক দেরি হয়ে গেল।আজকে উঠছি আমি।ভালো থাকবেন।”
মহুয়া উঠে গেলেও তুষার উঠলো না।চুপচাপ একদিকে চেয়ে বসে রইলো।ও মহুয়াকে বুঝতে পারেনি।মেয়েটা কে আসলে কি বলা যায়।সহজ-সরল নাকি সাংঘাতিক??

চলবে…

বি.দ্রঃ( ভুল -ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here