ভাবী_যখন_বউ পর্ব_১৪

ভাবী_যখন_বউ
পর্ব_১৪
Syed_Redwan

রিহান ভাইয়ার কথা শুনে আমি কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বারান্দা হতে নিজের রুমের দিকে আসতে লাগলাম। অনেক হিসাব মিলানোর চেষ্টা করছি আমি এখন। আমাকে যে মিলাতেই হবে, তাও আবার অতি শীঘ্রই। কিছুটা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় রুমে প্রবেশ করতেই দেখি রাইফা জেগে আছে, খাটের উপর বসে আছে মাটিতে পা দিয়ে। আমার দিকে মুখ করে আছে। চোখগুলো একেবারেই লাল টকটকে মনে হচ্ছে ওর।

আমার জানামতে কিছু কিছু মানুষ যখন রেগে যায় তখনও তার চোখ লাল হয়, আবার যখন অতিরিক্ত কান্না করে তখনও তার চোখ লাল হয়ে যায়। তার সাথে গভীর ঘুম ভেঙে গেলেও নাকি চোখ লাল হয়ে থাকে। এই কথাগুলো কার কার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য জানি না, তবে আমার ক্ষেত্রে শতভাগই বটে! রাইফা তো কাঁদছে না আমি সিউর। সুতরাং হয় ও ঘুম থেকে জেগে উঠেছে দেখে নয়তো ও কোন বিষয়ে প্রচন্ড ক্রুদ্ধ দেখেই ওর চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।

আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। ও আমার দিকে তাকালো। ওকে দেখে আমি কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
“কী হয়েছে? চোখ দুটো লাল লাগছে কেন তোমার? এত রাতে জেগেই বা আছো কেন?”
ও উত্তর না দিয়ে একমনে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি এবার সাহস করে ওর একটা হাত আমার হাতে নিয়ে বললাম,
“কী হয়েছে তোমার, বলো?”

এবার ও মাথাটা একবার ঝাঁকি দিয়ে যেন একটা ঘোর থেকে বের হয়ে আসলো। ও এবার খেয়াল করলো যে আমি ওর হাত ধরে ওকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছি। ও বলল,
“কী….কী হয়েছে?! কিছু লাগবে তোমার?”
“আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করলাম এইমাত্র।”
“কী প্রশ্ন?”

ওর আচরণটা এখন একেবারেই অস্বাভাবিক মনে হলো আমার কাছে। ঘুম থেকে জেগে উঠলে অনেক সময় এমনটা হয়। আমি ওর আরেকটু কাছে চেপে গিয়ে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
“তুমি ঠিক আছো তো? কী হয়েছে তোমার? আমি এতক্ষণ ধরে তোমার সাথে কথা বলছি তুমি কিছু খেয়ালই করলে না?”
“আসলে হয়েছে কি, আমি খেয়াল করিনি, স্যরি।”
“কী হয়েছে তোমার, বলো তো? তোমার ব্যবহার আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কোন সমস্যা?”

আমি সন্দেহের চোখে ওর দিকে তাকালাম। আমার মনে হচ্ছে যেন ও কোনকিছু আমার থেকে লুকচ্ছে। আমি ভুলও হতে পারি। আমার এমন তাকানোতে রাইফা প্রথমত কিছুটা হকচকিয়ে গেল। পরমুহূর্তেই মুখে একটা হাসি টেনে এনে আমার ডান হাত উঁচিয়ে একটা চুমু খেয়ে বলল,
“কিছু না। আসলে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি তো, তাই একটু লাল হয়ে আছে আমার চোখগুলো। চিন্তা করো না, কেমন?”
বলেই আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একপ্রকারের দৌঁড়ে ওয়াসরুমে ঢুকে গেল ও।

ওর এমন আচরণ আমার কাছে যথেষ্ট সন্দেহজনক মনে না হলেও কিছুটা সন্দেহ রয়েই গিয়েছে। আজ সারাদিন তো ওর আচরণ ঠিকই ছিল। হঠাৎ এত রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে এমন করল কেন ও? কিছু হয়েছে কি ওর? মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখলেও এমন রিয়াকশন দিয়ে থাকে বিধায় এটা নিয়ে আমি আর তেমন মাথা ঘামালাম না। তাছাড়া এই মেয়েটা একটু অন্য রকমেরই। অন্তত আমি এই দেড় মাসেরও বেশি সময় ওর সাথে সংসার করে আমি এতটুকু তো বুঝতেই পেরেছি যে ও সাধারণ কোন মেয়ে নয়। ওর আচরণ হঠাৎ করেই অন্য রকম হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। এটা ঠিক কী কারণে সেটা আমার অজানা। হতে পারে ওর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই এমন। তবে এতকিছুর মধ্যেও ও আমার পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় সদস্যই বটে। হোক না ওর ব্যবহার একটু অন্য রকমের, আমার কোন সমস্যাই নেই। তাছাড়া ভিন্নধর্মী অধিকাংশ বিষয়ই আমার ভালো লাগে। আর সেটা যদি হয় জীবনসঙ্গিনীর মধ্যে, যার মাঝে আছে আমার পরিবারের প্রতি কর্তব্যবোধ আর আমার প্রতি অঢেল ভালোবাসা, তাহলে তো আর কথাই নেই।
এমনিতেও এখন আমি যা শুনলাম সেটা নিজের ভেতর হজম করতেই আমার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

কিছুক্ষণ আগে রিহান ভাইয়া আমাকে বলেছেন যে
সিমি দেশে ফিরে এসেছে কিছুদিন হলো মাত্র। আগেই এটা জানা আছে যে সিমি বিবাহিত, ভাইয়া আর রাইফা বিয়ের অভিনয় শুরু করার প্রায় ২ সপ্তাহ আগেই সিমির বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের সাথে সাথেই ও তার দুর্ভাগা স্বামীকে নিয়ে চলে যায় বিদেশে হানিমুন করতে। হ্যাঁ, এই সিমি নামের মেয়েটা আমার ভাইয়াকে অনেক জ্বালিয়েছিল অতীতে। স্নিগ্ধা ভাবীকে যেন ভাইয়া বিয়ে না করে, এজন্য কিন্তু একপ্রকারের ফোর্সও করেছিল সে ভাইয়াকে। কিন্তু দিনশেষে তো সে ব্যর্থই হলো। ভাইয়াকে সে বিয়ে করতে পারল না; সিমি নিজের বাবার চাপে ভাইয়াকে নিস্তার দিয়ে আরেকজনের গলায় ঝুলে পড়লো এবং বিদেশে উড়াল দিল। এরপর ভাইয়া আর রাইফার বিয়ের অভিনয় শুরু এবং অতঃপর ভাইয়া স্নিগ্ধা ভাবীকে বিয়ে করে তাদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে আপাতদৃষ্টিতে ঘটনার ধারাটা সমাপ্ত হয়। এখানে সিমি কি একেবারেই নির্দোষ নয়? ও তো নিজের স্বামীকে বিয়ে করে বিদেশে চলে গিয়ে রেহাই দিয়েই দিয়েছে ভাইয়াকে; সে নিজেই বিয়ে করেছে ভাইয়ার আগে। মানে ভাইয়াকে পাবার রাস্তা সে আগে নিজেই বন্ধ করে দিয়েছিল নিজে বিয়ে করে। তাহলে সে কেন ভাইয়ার পিছনে লাগবে? সে কেন ভাইয়াকে খুন করতে চাইবে। ভাইয়া তো তার কোন ক্ষতি করেনি, উল্টো সে আরেকজনকে বিয়ে করে সুখী হয়ে বিদেশে উড়াল দিয়েছে। সুতরাং সিমি মেয়েটার ভাইয়ার খুনী হবার সম্ভাবনা একেবারেই থাকা উচিত নয়।

যেমনটা উর্ধ্বে বর্ণিত, তেমনটা কিন্তু হতে পারতো। কিন্তু আফসোস, সত্যটা এমন একেবারেই নয়। রিহান ভাইয়া সিমির আগমনী বার্তাসহ আরো এক অবিশ্বাস্য এবং নির্মম সম্ভাবনাময় একটা কথা বলেন। সিমি নাকি ভাইয়ার খুনী! এটা শোনার পরই আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। এটা কীভাবে সম্ভব!? ও তো নিজের জীবনে এগিয়ে গিয়েছে বিয়ে করে, তাহলে ভাইয়ার ক্ষতি করার কারণ কী। এমনটা যদি হতো যে ভাইয়া ওর জীবনের কোন ক্ষতি করেছে কিংবা ভাইয়া বিয়ে করে ফেলেছে কিন্তু ও করেনি, তবে আলাদা কথা ছিল। কিন্তু এমনটা তো হয়নি, তবে? কীসের জন্য ভাইয়ার ক্ষতি করতে চাইবে সিমি? কীসের জন্য?

চিন্তায় যখন বিভোর আমি, ঠিক তখনই রাইফা বাথরুম থেকে বের হয়ে বিছানায় এসে বসলো ও বলা শুরু করল,
“তদন্তের অগ্রগতি কেমন তোমার?”
“এক মাস যাবত তো ক্লু খুঁজেই বেড়াচ্ছি, কিন্তু কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না।”
“আরেকটু মন দিয়ে কাজ করো। আমার বিশ্বাস, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভাইয়া আর স্নিগ্ধার আসল খুনীকে আমরা পেয়ে যাব।”
“এতটা নিশ্চিত কীভাবে হতে পারছো তুমি?”
“সেটা তুমি বুঝবে না, বুঝলে?”
“ভাইয়া আর ভাবীর খুনের বিষয় এটা। কোথায় তুমি আমাকে সাহায্য করবে তা না, উল্টো চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসে আছো। তোমার মাথায় কি সমস্যা নাকি হ্যাঁ?”
“ওহ হ্যালো, তুমিই সর্বপ্রথম আমাকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলে, বুঝলে। তাছাড়া আমি নিজের জায়গা থেকে সবকিছুই ঠিকঠাকমতো করে যাচ্ছি। তুমি নিজের অংশটুকু করে যাও, তাহলেই আমরা অতি শীঘ্রই কেইসটার সুরাহা করতে পারবো।”
“আমার এই ব্যাপারে কাজ করার সাথে তোমার কাজের কী সম্পর্ক যে বললে ‘আমরা পারব’?”
“😏! এতকিছু এখন বুঝাতে পারবো না জানু। এখন ঘুমাও। আগামীকাল থেকে অনেক কাজ করতে হবে তোমাকে। গুড নাইট অ্যাগেইন!”
বলেই আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো।

সাধে কি আর বলি যে এই মেয়েটাকে আমি বুঝতেই পারি না? আমাকে অনেক ভালোবাসবে, কাছাকাছি থাকবে, রাতে জড়িয়ে না ধরলে ওর ঘুম হবে না কিন্তু শেষে গিয়ে ঠিকই আমার থেকে নিজের এই বিষয়টা আড়াল করে রাখবে। যদিও আমি নিজেও ওকে আমার কাজ সম্পর্কে কিছুই বলি না, তবুও, ও তো বলতে পারে। কিন্তু না! ও নিজেও আমাকে কিছুই বলবে না। এতো ইগো মেয়েটার রে বাবা! তবে ও যেভাবেই তদন্ত করুক না কেন, আমি নিশ্চিত যে ও নিজেও আমার সমপর্যায়েই আছে; আসল খুনীর সন্ধান ও নিজেও পায়নি। নাহলে অন্তত যাই হোক, ও হাত গুটিয়ে এভাবে বসে থেকে আমার সাথে খুনসুটি করতো না।

সিমির ব্যাপারে আমার খোঁজ লাগাতে হবে। ও কোথায় থাকে না থাকে, এই ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। এছাড়া রিহান ভাইয়া গতরাতে আমাকে বলেছিল যে সিমিকে সে এখন সন্দেহ করছে। আমি ঠিক জানি না যে রিহান ভাইয়া সিমিকে মাসখানেক আগে বলেছিল যে সন্দেহ করে না, তাহলে এখন সে-ই রিহান ভাইয়া সিমিকে সন্দেহ করছে। কিন্তু কেন? আমি এই ব্যাপারে তাকে আবারও জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় যে সিমি ছাড়া আর কারো উপর সন্দেহ করা যাচ্ছে না। সুতরাং, এমনি হাত গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে বরং সিমির ব্যাপারে তদন্তই করে দেখি, কিছু অপ্রত্যাশিত বের হয় কিনা।

কিন্তু মূল সমস্যাই হচ্ছে এখন এই জায়গায়; রিহান ভাইয়া শহরের বাইরে গিয়েছেন একসপ্তাহের জন্য তার অফিসিয়াল কাজে। এর আগে তিনি কোনভাবেই সহযোগিতা করতে পারবেন না। তিনি ততদিন আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। তিনি আমার থেকে জবান নিয়েছেন যেন আমি আমার ভাই, তার তথাকথিত বেস্টফ্রেন্ডের হত্যার পেছনের মূল ব্যক্তিকে নিজের হাতেই জঘন্যতম শাস্তি দেই। আমিও তাকে কথা দিয়েছি। এবার সর্বশেষ খুনীর সর্বশেষ শাস্তি আইন নয়, আমি নিজেই দিব। এটাই আমার সিদ্ধান্ত।

তদন্ত করার মতো মানুষ যখন পেয়েই গিয়েছি, তখন আর শুধু শুধু সময় অপচয় করার কোন মানে হয় না। এরকম মানুষ আমি নইও বটে। আমি রিহান ভাইয়ার কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলাম সিমির বাবা বাড়ি, অর্থাৎ ভাইয়া যেই ব্যাংকে কাজ করতো, সেখানকার ম্যানেজারের বাসা কোথায়। সিমির তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে, সুতরাং ওর নিজের শ্বশুরবাড়িতে থাকার কথা। কিন্তু আমি ওর শ্বশুরবাড়ি তো চিনি না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ওর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জেনে নিব ওর স্বামীর বাসা কোথায়।

আমি নিজেই ছদ্মবেশ ধরে যাই ম্যানেজারের বাসার আশেপাশের এলাকায়। ছদ্মবেশ না নিলেও হতো, তবুও নিলাম আরকি। কথায় আছে না ‘সাবধানের মার নেই’? যদি কোনক্রমে সিমি বা আমাদের গোপন কোন শত্রু আমাকে চিনে ফেলে, এই ভয়ে সতর্কতা অবলম্বন করলাম আমি ছদ্মবেশ নিয়ে। সিমির যে প্রায় দু’মাস আগে বিয়ে হয়েছিল, এই ব্যবহার নিশ্চিত হলাম। প্রতিবেশীদের বেশিরভাগেরই সিমির সাথে যোগাযোগ নেই ওর বিয়ের পর থেকেই।

আমি নানা ছলে-কৌশলে এবং বুদ্ধি খাটিয়ে সিমির একটা ছবি জোগাড় করে নিলাম। প্রথমতঃ কেউ দিতেই চাচ্ছিল না, অনেক কষ্ট করে ভুলভাল বুঝিয়ে কোনমতে ওর ছবি পাই আমি। সিমিকে ছবিতে দেখেই আমি নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝে নিলাম যে ওর চরিত্র কীরকম হতে পারে; এতদিন ধরে তার মানে ওর চরিত্র সম্পর্কে যা কিছু শুনেছি, সবকিছুই সত্য বলে বিশ্বাস করেই নিলাম।

একটু ভালোমতো সিমির বাবার আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষদের কাছ থেকে কৌশলে খোঁজ নিয়ে জেনে নিলাম ওর বর্তমান ঠিকানা। তবে সাথে এটাও জানতে পারলাম যে ওর স্বামীর সাথে ওর বনিবনা হচ্ছে না ভালোমতো। তাই তো দুই মাসের জায়গায় একমাসের মধ্যেই চলে এসেছে ওরা দেশে।

এখানেই আমার খটকা লাগছে। রিহান ভাইয়া যেভাবে বলল, আমি তো বিশ্বাসই করে নিয়েছিলাম যে সবেমাত্রই কিছুদিন আগে ও দেশে ফিরেছে। কিন্তু এখানে এসে যে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন কথা শুনছি, ব্যাপারটা কী? ওর এতগুলো প্রতিবেশী কোনভাবেই একসাথে মিথ্যা কথা কিংবা ভুল তথ্য দিবে না আমাকে।

আমি আমার সাথে জুনায়েদকেও কাজে শামিল করলাম। ও ছাড়া আর কেউ-ই নেই আমার তেমন বিশ্বস্ত। কিছুদিন ধরে খোঁজ নিলাম। প্রায় এক সপ্তাহ কেটেই গেল। আমি আর জুনায়েদ মোটামুটি বেশ ভালোই তথ্য জোগাড় করতে পেরেছি। কিন্তু কয়েক জায়গায় এমন কিছু জিনিসও বের হয়ে আসছে যেটা আমি কোনদিনও স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। কীভাবে এটা হলো। আমার অতি বিশ্বস্ত মানুষও কীভাবে পারলো ধোঁকা দিতে? মানুষের এমন কাজ দেখে যদি আমার মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায়, তবে সেটা কি অনেক দোষের হবে? আমার তো মনে হয় না।

তারপরও আমি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হইনি এখনো তেমনভাবে। শক্ত প্রমাণ ছাড়া আমি কিচ্ছু করবো না। এখন শুধু অপেক্ষা রিহান ভাইয়ার ফিরে আসার। আশা করছি যে খুব শীঘ্রই এই রহস্যের সুরাহা করতে যাচ্ছি আমি।

ছয়দিনে বেশ অনেকটাই আমি জেনে গিয়েছি সিমির চরিত্র সম্পর্কে। আমি এটাও জানতে পেরেছি যে ওর স্বামী ওর ভয়ংকর কালো, নোংরা অতীত এবং দুশ্চরিত্র সম্পর্কে জেনে গিয়েছে। এ নিয়ে নাকি তাদের মধ্যে ঝগড়াও হয়েছে। তাই দু’দিন আগে সিমিকে ওর স্বামী আফজাল সাহেব ওর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বিষয়টা কিন্তু অবশ্যই কৌতূহলোদ্দীপক কোন সন্দেহ নেই। এত ঘটনার মাঝে এই ঘটনাটা রহস্যের জটকে জটিল না করলেও অনেকটাই ঝাঁঝালো করে দিয়েছে। এটা আমার ভাইয়ের খুনের তদন্ত হলেও আমি নিজেকে যথাযথ স্বাভাবিক রেখে বিষয়টা কৌতুহলের সাথে সমাধান করার চেষ্টা করছি। ভয় এবং অতি উত্তেজিত না হয়ে বরং কিছুটা কৌতূহল রেখে কোন তদন্তের কাজ করলে অধিক ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

অবাক করার বিষয় এই যে আমি সিমির সাথে একেবারের জন্যও কথা বলিনি তবুও ওর কন্ঠবর চিনি। কিছুদিন আগে একটা অপরিচিত মেসেঞ্জার আইডি থেকে আমার কাছে একটা অডিও রেকর্ড এসেছিল সেখানে বলা যে এটা সিমির গলার আওয়াজ। সেখানে সিমি কল রিসিভ করে শুধু ‘হ্যালো’ বলেই যাচ্ছিল কিন্তু অপরপ্রান্তের মামুষটি চুপ ছিল। শেষে রেগে সিমি কল কেটে দেয়।

শুধু এটাই নয়। ওই আইডি থেকে সিমির মোবাইল নম্বরও আমার কাছে এসেছে। যেই আইডি থেকে এগুলো এসেছে আমার কাছে, সেই আইডিটার নাম ‘তোমার একমাত্র গন্তব্য’। আমি ওটাতে অনেকগুলো ম্যাসেজ দিলেও কোন রিপ্লাই আসে না, শুধু সিন করেই রেখে দেয়। শেষে যখন বিরক্ত হয়ে লিখলাম ‘ধুর! আপনাকে আমি আর কোন টেক্সটই করবো না।’,
তখন ওই আইডি থেকে শুধুমাত্র একটা হার্টের ইমোজি(💗) আসলো। আর কোন লেনদেন হয়নি সেটা থেকে। আমিও আর এই আইডি নিয়ে তেমন মাথা না ঘামিয়ে বরং সিমি এবং আরেকজন সন্দেহভাজনের দিকেই মনোনিবেশ করলাম।

আগামীকাল রিহান ভাইয়া আসছে শহরে ফিরে তার বাইরের কাজ শেষে। আজ রাতটা খুবই অস্থির অবস্থায় কাটবে আমার বুঝতেই পারছি। আগামী দু’দিনের মধ্যেই আসল খুনী আমার হাতে এসে পড়বে কোন সন্দেহই নেই। জুনায়েদকে বলে রেখেছি সিমির উপর নজর রাখার জন্য। ওর বাসা থেকেও সিমির বাবার বাড়ি কাছে এবং যেহেতু সিমি ওর হাসবেন্ডের সাথে ঝগড়া করে আপাতত তার গুণবান পিতার বাসায়ই অবস্থান করছে, তাই কাজটা জুনায়েদের জন্য সহজও বটে। এছাড়া ওর কিছু পরিচিত ছোটভাইও আছে যারা এই কাজে সহায়তা করছে ভালোই।

রাতে ঘুমানোর আগে আমার হাতে ভাইয়ার ফোনটা রাইফা দিয়ে বলল,
“এই ফোন ভালোমতো চেক করে দেখো। কিছু পেলেও পেতে পারো।”
“মানে?” অবাক হয়ে গেলাম আমি এটা খেয়ালে আসতেই।
“তেমন কিছুই না। ফোনটা একটু ঘেঁটে দেখো এটাই বলছি। সবকিছু দেখলেও এটা ঠিকই বাদ দিয়েছ তুমি🙂। তারপর ঘুমিয়ে পড়ো।”

আসলেই তো। ভাইয়ার ফোন চেক করার কথা তো আমি বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম। এটাতে তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ নজির থাকতে পারে। এটা আমি কীভাবে বাদ দিলাম? অতিরিক্ত টেনশনে এত দরকারি একটা বিষয়ই আমার মাথা এড়িয়ে কীভাবে গেল? তার সাথে এটাও একটা প্রশ্ন যে রাইফাই বা কীভাবে জানলো যে আমি ভাইয়ার ফোন ঘেঁটে দেখিনি? আমি জিজ্ঞেস করলাম ওকে,
“তুমি কীভাবে জানলে যে আমি ভাইয়ার ফোন চেক করতে ভুলে গিয়েছিলাম?”
“আমি জানি। কীভাবে জানি, সেটার কৈফিয়ত আপাতত না দেই বাবু, কেমন? এটা জানার জন্য তোমার গোটা জীবন এখনো কিন্তু পরে আছে, বুঝলে। আগে তাড়াতাড়ি আসল খুনীকে সপ্রমাণে ধরে শাস্তি দেও, তারপর আমি সব বলব তোমাকে। আমি ঘুমালাম, আগামীকাল অনেক কাজ আছে আমার। গুড নাইট জানু।”

ওর সাথে কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। আমি অগত্যা ভাইয়ার ফোনের গ্যালারি চেক করলাম। তেমন কিছুই নেই, শুধুমাত্র স্নিগ্ধা ভাবীর একার কিছু ছবি, দেখেই বোঝা যায় লুকিয়ে ছবিগুলো তুলেছে ভাইয়া। আর আছে তাদের বিয়ের সময়কার ছবি। আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। তবুও আমি চোখের পানি মুছে নিজেকে সংযত করলাম। এখন স্মৃতিকাতর হওয়ার সময় নয়। তার মেসেঞ্জার চেক করেও কিছু পাইনি। তাহলে কি ফোনে পাওয়ার মতো তেমন কিছুই নেই?

হঠাৎ মনে পড়লো যে ভাইয়া তার ফোনে কল রেকর্ডার অন করে রাখতো। আমি সর্বশেষ কল রেকর্ডার চেক করে দেখি ভাইয়া একটা মেয়ের সাথে কথা বলেছিল। আরে! এটা তো সিমির গলার আওয়াজ! নম্বর মিলিয়ে দেখি যে এটা সিমির নম্বর! তাদের কথোপকথন ছিল এরকম:-
ভাইয়ার ফোনে রিং হচ্ছে। ভাইয়া ফোনটা রিসিভ করল।
ভাইয়া: তোমার অসুবিধা কী বলবে একবার? বারবার কল দিয়ে কেন ডিস্টার্ব করছো আমাকে?
সিমি: আমি কল করবো না তো কে তোমাকে কল করবে জানেমন? তুমি যে আমার একমাত্র ভালোবাসা। তোমাকেই তো আমি কল করব।
ভাইয়া: প্লিজ সিমি, পাগলামি বন্ধ করো এবার। ভুলে যেও না যে তুমি বিবাহিত। আগে যা কিছু করেছ আমি কিন্তু সবকিছুই ভুলে গিয়েছি। প্লিজ এবার এসব বন্ধ করে নিজেও শান্তিতে বাঁচো, আমাকেও শান্তিতে বাঁচতে দাও। আমি স্নিগ্ধাকে বিয়ে করছি আগামীকাল।
সিমি: একদম না! আমি কোন সতীন সহ্য করবো না। তোমার শরীরের যত চাহিদা আছে আমি একাই পূরণ করার জন্য যথেষ্ট। আমাকে শুধু একবার কাছে পেয়ে দেখো, দুনিয়ার অন্য কোন মেয়ের দিকেই আর তাকাতে ইচ্ছা করবে না তোমার।
ভাইয়া: আমি তোমার হাসবেন্ডকে এসব বলে দিব।
সিমি: হা হা হা হা হা! ওই ফালতু জিনিসটার সাথে আমার সংসার করার এমনিতেও কোন ইচ্ছা নাই। শুধু আব্বু ওকে বিয়ে করার জন্য জোর করেছিল তাই বিয়ে করেছি। ও আমাকে একটুও সুখ দিতে পারে না, ব্যাটা অকর্মণ্য একটা। এই শালার সাথে আমি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে ফেলতে একপায়ে খাঁড়া। তুমি শুধু একবার বললেই এই অকর্মণ্যটাকে লাত্থি মেরে বিদায় করে তোমাকে আপন করে নিব আমি। আমার মন, মনের চেয়েও বেশি আমার শরীর যে তোমাকে একেবারে চিরকালের মতো আপন করে পাবার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছে না! খুব শীঘ্রই একেবারেই এসে পড়ো না আমার কাছে, চিরদিনের মতো আমার দেহের জ্বালা মিটাবার দায়িত্ব নাও না গো। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমাকে আমি নিজের করেই নিব ডার্লিং।
ভাইয়া: (প্রচন্ড ঘৃণায়) ছিঃ! এসব বলতে তোর একবারের জন্যও লজ্জা করলো না? Enough! আমি আর সহ্য করবো না তোর এইসব। তুই একটা নষ্টা মেয়ে, বুঝলি। আর কোনদিন আমাকে ফোন দিস না। পারলে আর কারো জীবন নষ্ট করার আগেই মরে যা, অন্তত এতে একটা ক্ষতিকর পদার্থ কমে যাবে এই পৃথিবী থেকে।
সিমি: শেষবারের মতো বলছি, আমাকে বিয়ে করবি না কি বলো।
ভাইয়া: তোকে বিয়ে করার চেয়ে একটা পতিতাকেও বিয়ে করা হাজার গুণ ভালো। তারা অন্তত বাধ্য হয়ে টাকার জন্য খারাপ কাজটা করে। কিন্তু তুই কি, নিজের শরীরের চাহিদার জন্য নিজেকে ড্রেইনের চেয়েও নোংরা করেছিস। এতই যখন তোর চাহিদা, নিজের গুণধর বাপকে বলে আগে বিয়ে করতে পারলি না? ধরে নিলাম বিয়ের আগে যা কিছু করেছিস, সবকিছুই মাফ। কিন্তু তুই তো বিয়ের পরও শুধরালি না। নাহ! তোর মতো মেয়ে কোনদিনও শুধরাবে না। আর যা-ই কর না কেন, আমার আর স্নিগ্ধার জীবন থেকে চিরতরে চলে যা, এতেই তোর মঙ্গল। নষ্টা কোথাকার!
সিমি: আমার কথা শুনলি না তো তুই? আমি তোকে নিজের সবটা দিয়েই খুশি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুই ওই স্নিগ্ধার বাচ্চার জন্য আমাকে গ্রহণ করলি না, আমাকে অপমান করলি, তাই না? ঠিক আছে। তোর আর স্নিগ্ধার এজন্য যে…..
সিমি কথা শেষ করার আগেই ভাইয়া বিরক্ত হয়ে কল কেটে দেয়।

শিট! শেষের দিকের কথায় ভাইয়া আর স্নিগ্ধা ভাবীকে খুন করার হুমকি দিয়েছিল সিমি আমি নিশ্চিত। ভাইয়া যদি আরেকটু ধৈর্য্য ধরে ওর কথাগুলো শুনতো, তাহলে হয়তো ভাইয়া আর ভাবীর এভাবে খুন হতে হতো না।

সিমি যে খুনী এটা আমি নিশ্চিত। কিন্তু তৃতীয় আরেকজন ব্যক্তি আছে যেও খুনী। কিন্তু কে সে। আমার চোখ গেল রাইফার ঘুমন্ত মুখটার দিকে। এই মেয়েটা আমাকে কত ভালোবাসে! যদি ও-ই খুনী বের হয়, তবে আমি পারব কি ওকেও শাস্তি দিতে?!

পরদিন সকালবেলা। আজ রিহান ভাইয়া শহরে ফিরে আসছে। ফোনটা রিং হচ্ছে। আমি হাতে নিতেই দেখি জুনায়েদের কল। রিসিভ করার সাথে সাথেই একটা মর্মান্তিক খবর পাই আমি। ছুটে চলে যাই ঘটনাস্থলে।

আমি বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছি সিমির মৃত স্বামী আফজাল সাহেবের ফ্ল্যাটের সামনে। বিষপানে তার মৃত্যু হয়েছে। মুখ থেকে সাদা ফেনা বেড়িয়ে আছে। কিন্তু কীভাবে এটা হয়েছে, সেটা এখনো অজ্ঞাত। ইতিমধ্যে পুলিশ এসে পড়েছে ঘটনাস্থলে। কেউ কিছুই বলতে পারছে না। সিমি তার বাপের বাড়িতে এখন। ভদ্রলোক একাই বাসায় ছিলেন। কীভাবে তিনি বিষপানে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেটাই এখনও রহস্য। আমি জুনায়েদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সে হ্যাঁসূচক ভাব প্রদর্শন করে।

রিহান ভাইয়া আর আমি একটা পার্কে বসে আছি। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি সিমি সম্পর্কে কিছু কথা বললেন আর সাথে এটাও বললেন যে কেন তিনি হুট করেই সিমিকে সন্দেহ করেছেন ভাইয়ার খুনের পিছনে। রিহান ভাইয়ার কথা শুনে আমি দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেললাম।

পরদিন দুপুরের একটু পরে, শহর থেকে একটু দূরে একটা নির্জন ও পরিত্যক্ত গোডাউনের মতো জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে জুনায়েদ। বাইরে বিশ্বস্ত কয়েকজনকে পাহারা দেওয়ার জন্য রেখেছি। আমাদের সামনে বসে আছে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় ভাইয়া আর ভাবীর দু’জন খুনী। তাদের কোন ক্ষমা নেই। আমি নিজ হাতেই তাদের শেষ করতে যাচ্ছি এখন, তাও আবার অসহনীয় কষ্ট দিয়ে।

ঠিক এমন সময়ই একজন বাইরের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here