পুনম,পর্বঃ৩৭,৩৮

পুনম,পর্বঃ৩৭,৩৮
আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩৭

সুমন সেই সকাল থেকে রেজিস্ট্রি অফিসে বসে আছে।মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ বের হলো।চরম হতাশ সুমন।দলিল পত্রের ঝামেলা যে এতটা বিরক্তিকর তা সুমন জানতো না।কখনো দাগ মিলে তো খতিয়ান মিলে না। খতিয়ান মিলে তো রেকর্ড জনিত সমস্যা! এত এত সমস্য। অথচ সমাধান নেই! সুমন চেয়ার থেকে উঠে সামনের টেবিলে বসা মুহুরীকে জিজ্ঞেস করে,
“ভাই আর কতক্ষন? ”
মুহুরী সুমনের থেকেও চরম বিরক্তি নিয়ে বলে, ” আরে মিয়া ত্যক্ত কইরেন না তো।চুপচাপ বসেন।নাম আসলেই ডাক দিবো।”

সুমন আবার বসে পড়ে।হাতের ফাইলে আঙুল দিয়ে গটগট শব্দ করে! রাশেদ ভাই বলেছে এই নথিটা পেলে কাজ অনেকটা আগাবে। তাই এই বিরতিহীন অপেক্ষা!
যদি তাড়াতাড়ি কিছুর ব্যবস্থা হতো তবে পুনমের জন্য কিছু হলেও করতে পারতো।এই শূন্য হাতে কি করে সামনে দাঁড়াবে?পুনমের জন্য তার খুবই কষ্ট হয়!

*********

লাবণ্য মাথা নিচু করে অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। তারুণ অনেক চেষ্টার পরও কান্না থামাতে পারলো না।তাই এখন সামনে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে। মেয়েটা একটুও সাজেনি।চুলগুলো এলোমেলো করে বেণী করা।গোলাপি একটা উলের চাদর শরীরে পেঁচানো।শ্যামলা মুখটা যেন কান্নার কারণে আরো মায়াবতচী লাগছে!কে বলে শুধু ফর্সা মানেই সুন্দর? সুন্দরের উপমা কি তারা জানেই না।এই যে তার সামনে দাঁড়ানো শ্যামবতীর কাছে সকল ফর্সা সুন্দরী হার মানবে!

” লাবণ্য এখন যদি কান্না না থামাস আমি কিন্তু চলে যাবো।”…..বিরক্তি নিয়ে বলে তারুণ।

লাবণ্য তারপরও কেঁদে যাচ্ছে। তাই তারুণ উল্টো হাঁটা ধরে।লাবণ্য তখন চোখ মুছে দৌড়ে গিয়ে তারুণের সামনে দাঁড়ায়। লাবণ্য ভেজা কন্ঠে বলে, ” চারপাশে এত কষ্ট কেন তারুণ?আমার দমবন্ধ লাগে!”

“সব ঠিক হয়ে যাবে লাবণ্য! ধৈর্য্য ধর।সব সামলে উঠবি দেখিস।সব ঝড়ই একসময় থেমে যায়!”

” কি করে সামলে উঠবো?আমার বাসার আনাচে কানাচে শুধু কষ্ট।এখন তুইও চলে যাচ্ছিস।কি করে সামলাবো আমি বলতো?”……কাঁদোস্বরে বলে লাবণ্য!

“চোখের আড়াল হচ্ছি লাবণ্য।তোর মনের আড়াল তো হচ্ছি না।আমি সবসময় তোর পাশে আছি।”….. বলে তারুণ লাবণ্যের হাত জড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে।

************

পাবনী থম মেরে বসে আছে হসপিটালের করিডোরে। পুনম ডাক্তারের সাথে কথা বলছে তার কেবিনে।পাবনীর গলা বারবার শুকিয়ে আসছে।মায়ের অবস্থা শোচনীয়! সকাল থেকে একবারও পস্রাব হচ্ছে না।পেট ফুলে আছে।হসপিটালে কতগুলো বিল হয়েছে।সেই বিল দুই শতাংশ শোধ না করলে পরবর্তী চিকিৎসা তারা শুরু করতে পারছে না।মা ব্যথায় ছটফট করছে।এ দৃশ্য চোখে দেখার মত নয়। পুনম বের হলো দশ মিনিট পর। চুপচাপ বসলো পাবনীর পাশে।
সেজ আপাকে অনবরত ঘামতে দেখে পুনম বললো, ” কি হলো আপা এত ঘামছিস কেন?”

” পুনম রে মায়ের কি হবে বলতো? আমার ভীষণ অস্থির লাগছে।মা কি বিনে চিকিৎসায় মরে যাবে?”……অস্থির কন্ঠে বলে পাবনী।

“কি সব কথা বলছো সেজ আপা। এত চিন্তা করো না।ডক্টর গেছে। আবার চিকিৎসা শুরু হয়েছে।”

“টাকা কোথায় পেলি পুনম?….ব্যগ্রস্বরে জানতে চায় পাবনী।

” সেজ আপা কিছু গহনা ছিল মনে আছে ।সেগুলো বিক্রি করে দিলাম।মা যদি না থাকে তবে তা দিয়ে কি হবে? আগামী একসপ্তাহর জন্য আর কোন চিন্তা নেই।”….বলে পুনম সেজ আপার হাত শক্ত করে ধরে।

“আমি এতটা অর্কমা কেন হলাম বলতো পুনম?তুই একা কতকিছু করছিস অথচ আমি তোকে একটু সাহায্যও করতে পারছিনা।এই পরিবার টা কি একা তোর? আমরা শুধু তোর কাঁধে বোঝা হয়ে রইলাম”

পুনম সেজ আপাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে।তারপর বলে, “আপা তোর ভালোবাসার ক্ষমতা অপরিসীম! সবাই ভালোবেসে আগলে রাখতে পারে না আপা।তুই পারছিস।আপা তুই আমার মানসিক শক্তি। তাই এতটা দূর্বল হোস না যে আমায় ভেঙে পড়তে হয়!”

পুনম সেজ আপাকে রেখে উঠে পড়ে।একটা টিউশনি করিয়ে রাশেদ ভাইয়ের কাছে যাবে পুনম।সামনে প্রতিটা পদক্ষেপ ওকে ভেবেচিন্তে রাখতে হবে।পুনম হারতে শিখেনি।ও হার মানলে বাকি ছয়টি মানুষও হেরে যাবে!

**********

তানভীর আর তারুণ বসে আছে তারিনের বসার ঘরে।তারুণ অনেকটা অবাক চোখে নিজের বোনকে দেখছে।আসার পর থেকেই দেখছে বুবু কাঁদছে আবার কতক্ষন হাসছে।হাসি আর কান্না দুটোই একসাথে। কোনটাই সামলাতে পারছে না।তারুণকে দেখার পরই জড়িয়ে ধরে দুগালে কপালে চুমু দিয়েছে। তারুণের মনে হলো এতদিন সে ভুল করছে।বুবু নামক মানুষটার থেকে দূরে থেকে।তানভীর বলে উঠলো, “বুবু ভাত খাবো।কি রেঁধেছো?”

তারিন চটপট করে চোখের জল মুছলো।তারপর বললো, “দেখ কি কান্ড। তোর পছন্দের বেগুন দিয়ে শুটকি রেঁধেছি। কিন্তু তারুণ তো খাবে না।কি করি?মুরগী রেধেছি খাবি ভাই?”
তারিনকে খুবই দুঃখী মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে। ভাইদের কি দিয়ে খাওয়াবে তাই নিয়ে চিন্তিত সে।

“নিয়ে আসো বুবু।আজ তুমি আমাদের দুই ভাইকে খাইয়ে দিবে ছোটবেলার মত।”

তারিন হন্তদন্ত হয়ে কিচেনে গেলো। খাবার মেখে তারুণ আর তানভীর কে খাইয়ে দিলো।খাওয়ানোর সময় তারিন একপশলা কাঁদলো।শেষমেষ তারুণ বলে উঠলো, “বুবু তুমি খুব ছিঁচকাদুনে!”
তারিন হেসে দিয়ে হাত ধুয়ে দুই ভাইয়ের ঠোঁট মুছিয়ে দিলো পরম যত্নে । তারুণের মনে হলো,বুবুর আদর কেমন যেন মা মা আদর।

********
হায়দার হোসেন একশো পার্সেন্ট নিশ্চিত এই খেলায় জিত তার হবে।টাকার কাছে সবকিছু নস্যি! সে চেয়েছিল পুনমের পরিবারকে আর্থিক ভাবে দূর্বল করতে সাথে প্লাস পয়েন্ট হিসেবে পুনমের মায়ের রোগ তাকে আরো আশাবাদী করলো।এবার তানভীর পুনমের জন্য হলেও তার কথা মানবে।সে নিশ্চিত মনে তার এসিস্ট্যান্টকে ফোন করে বললো, “ওদিকের খবর কি বলো?”

এসিস্ট্যান্টের কাছে সকল আপডেট নিয়ে সন্তুষ্ট মনে সে ওয়াইনের গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়ালো।

************

পুনম একটা কালো বোরখা পড়েছে।নাক মুখ সকল কিছু সুন্দর করে আটকানো। তার পরিচিত মানুষও পুনমকে চিনতে পারবে কিনা সন্দেহ।পুনম কিছুটা নুয়ে নুয়ে হাঁটছে।মুরুব্বি কিসেমের বোরখার কারণে তাকে পুরো দমে মুরুব্বি মনে হচ্ছে ।চোখে একটা চশমা পড়া।পুনম একটা রিকশা নিয়ে তাতে উঠে বসলো।গন্তব্য তার জানা।শুধু গন্তব্য পর্যন্ত পৌছানো বাকি। পুনম কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছে তাকে একটা লোক ফলো করে তাই এই ব্যবস্থা। সেই লোকটির সামনে দিয়েই পুনম চলে গেলো কিন্তু লোকটি জানতেও পারলো না।

***********

রুমা নিজেকে খুঁটে খুঁটে আয়নায় দেখছে।কি কারণে তাকে হারুন ত্যাগ করলো সে জানতেই পারলো না।একটা সংসার টিকিয়ে রাখতে কি শুধু সৌন্দর্য থাকতে হয়?এই যে এতটা বছর সে মানুষটার সাথে থাকলো একটুও কি মায়া হয় না?রুমা দু হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ওঠে। এত কষ্ট কেন?কিসের শাস্তি সে ভোগ করছে? আর তার মেয়ে দুটো তারাই বা কিসের শাস্তি পাচ্ছে?

***********
তারুণ আর তানভীর বসে আছে তারিনদের বাসার ছাদে। আর একসপ্তাহ পর তারুণ চলে যাবে লন্ডন। আজ তানভীর আবদার করলো তারুণকে নিয়ে কিছু সময় কাটাবে।তাই এই বসা।দু ভাই রেলিংয়ে বসে পা ঝুলিয়ে রেখেছে।দুজনেই চেয়ে আছে আকাশ পানে। বাতাস এসে তানভীর আর তারুণের চুল এলোমেলো করে দিয়ে যায়। তানভীর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভাই একটা গল্প শুনবি?”

তারুণ ভাইয়ের দিকে তাকালো। ভাইকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে।চোখমুখ শক্ত অথচ চোখের কোণে বিষন্নতা! ভাইকে দেখে তারুণের অবচেতন মন কেন যেন গল্পটি শুনার ইচ্ছা হলো না।কেন যেন মনে হলো, গল্পটি কোন সাধারণ গল্প নয়!গল্পটি শুনলে এমন কিছু জানা হবে যা না জানাই ভালো।তবু মুখে বললো, “বলো ভাই।”

তানভীর বলতে শুরু করলো মৃদুস্বরে। তানভীরকে দেখে মনে হচ্ছে তার কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।

চলবে,

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩৮

তারুণ ফুটপাতের রাস্তা ধরে এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছে। পুরোপুরি বিধ্বস্ত তারুণ ভিতর থেকে।কন্ঠনালী পুড়ছে, চোখ জ্বলছে অথচ কষ্ট গুলো জল হয়ে নামছে না।কোঁকড়া চুলগুলো সোডিয়ামের আলোতে চিক চিক করছে।সবসময়ের সুখী ছেলেটার আজ ভীষণ দুঃখ! এ দুঃখ কি আজকের?নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে। না দুঃখ আজকের নয়।সারাজনম দুঃখবিলাস করতে হবে ওকে।কানের কাছে এখনো ঝা ঝা করে ভাইয়ের গল্পটি বাজছে।একি শুধুই গল্প? এ তো ঠাকুমার ঝুলির রুপকথার গল্পকেও হার মানায়!বড় কুৎসিত রপকথা! ভাইয়ের প্রতিটি কথা ওর মস্তিষ্কে বার বার আঘাত করছে……..

“””শোন ভাই,এক কুঁড়ে ঘরে জন্ম নিয়েছিল ফুটফুটে দুটি মেয়ে।বড় কন্যাটি চাঁদের ন্যায় সুন্দর। আর ছোট কন্যা ছিল মায়াবতী রুপসী।যা বড় কন্যাকেও হার মানিয়েছিল।ছোট কন্যাকে জন্ম দিতে গিয়ে মা মারা গেলো।তখন বড় কন্যার বয়স মাত্র সাত।গরিব বাবা তাদের দুই কন্যাকে নিয়ে পড়লো বিপাকে।তখন বড় কন্যাকে নিয়ে গেলো তার চাচা।আর ছোট কন্যা রয়ে গেলো বাবার কাছে।মেয়েদের এত রুপই কাল হলো!দুই মেয়ে বড় হতে লাগলো দুই স্থানে।
ভিনঅঞ্চলের এক রাজার ঘরে ছিল দুই রাজপুত্র। বড় রাজপুত্র সামন্য তোতলা ছিল কিন্তু তার অন্যান্য গুণ ছিল নজরকারা!সকল পৌরষালী গুণের অধিকারী ছিল সে।আর ছোট রাজপুত্র ছিল বড় দুষ্ট আর অবাধ্য। নিজের মর্জিতে সে নিজেই রাজা!সকল বদগুণ ছিল তার বৈশিষ্ট্য! রাজা পড়লো মহাবিপাকে ছোট রাজপুত্রকে নিয়ে। ছোট রাজপুত্র মদ, জুয়া,মেয়েবাজি করে টাকা উড়াতে লাগলো।তখন রাজা ঘোষণা দিল যদি ছোট রাজপুত্র ভালো না হয় তবে তার সবকিছু বড়ছেলেকে দিয়ে যাবে।
একদিন সেই বদ রাজপুত্রের নজরে এলো গরিব ঘরের বড় কন্যাটিকে।তাকে তার চাই চাই।মরিয়া হয়ে বাবাকে বললো যদি সেই কন্যাকে তার জন্য এনে দেয় তবে সে ভালো হয়ে যাবে। রাজা সেই কন্যাকে ছোট ছেলের সাথে বিবাহ দিয়ে দিলেন।তখন সেই বড় কন্যাটির বয়স কেবল ষোল।ছোট রাজপুত্র সেই কন্যাকে পেয়ে সব বাজে কাজ ছেড়ে দিলো। মন দিয়ে সংসার শুরু করলো।যা ছিল তার ভান মাত্র।তাদের ঘরে প্রথমে মেয়ে হলো তার তিন বছর পর ছেলে হলো।রাজা বেশ খুশি হলেন।বড় রাজপুত্রকে বিয়ে দিতে চাইলে সে রাজি হলো না।সে একাকী জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নিল।
গরিব বাবাটি যখন মারা গেলো তখন ছোট কন্যাটির বয়স মাত্র সতেরো।ফুটন্ত একটা গোলাপ যেন।চাচা তাকেও তার কাছে নিয়ে এলো।আর বদ রাজপুত্রের নজরে এলো ছোট কন্যাটি।নারীদেহের আমোক টানে সে ভুলে গেলো তার স্ত্রী আছে,আছে দুটি সন্তান। সে মরিয়া হয়ে ছোট কন্যাকে পেতে চাইলো কিন্তু পারলো না।ছোট কন্যাটি ছিল ভীষণ জেদি।তাকে কোন লোভই টলাতে পারলো না। বড় কন্যাটি জানতেও পারলো না তার স্বামী তার বোনের প্রতি ভীষণ ভাবে আসক্ত। অনেক চেষ্টার পরও যখন ছোট কন্যাকে বাগে আনতে পারলো না তখন ছোট রাজপুত্র ভয়ংকর একটা কাজ করে বসলো।তার বন্ধুদের নিয়ে তুলে নিয়ে গেলো সেই ছোট কন্যাটিকে।এরপর টানা চারমাস তাদের জিম্মায় রাখলো মেয়েটিকে।প্রথমে সেই বদ রাজপুত্র পড়ে তার বন্ধুরা তাকে পালা করে ধর্ষন করলো।বিভৎস ভাবে মেয়েটিকে কষ্ট দিলো।মেয়েটি প্রতি ক্ষণে তার মৃত্যু কামনা করছিল এ অবস্থা থেকে দূর হতে কিন্তু মৃত্যুও যেন সহায় হলো না। বড় কন্যাটি তখন বোনকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। সাহায্যকারী হয়ে বদ রাজপুত্র সেই মেয়েটিকে খুঁজে নিজ স্ত্রীর কাছে নিয়ে এলেন অথচ কেউ জানলোও না সে সাহায্যকারী নয় বরং বিনষ্টকারী!আর ছোট কন্যা চিনতেও পারলো না।কেননা বদ রাজপুত্র সবসময় নিজের মুখ ঢেকে রাখতো। ছোট বোনের এমন পরিস্থতি দেখে বড় কন্যার মরিমরি অবস্থা।তারউপরে জানা গেলো ছোট কন্যা সন্তানসম্ভবা। আর সন্তানটি ততদিনে বেশ বড় হয়েছে যাকে নষ্ট করা যাবে না।তখন বড় রাজপুত্র বিয়ে করে নিলো সেই অসহায় ছোট কন্যাটিকে।রাজা তাতে অখুশি হলেন না বরং বড় ছেলের মহানুভবতায় আশ্চর্য হলেন।বড় রাজপুত্রের নিষ্কাম ভালোবাসায় ছোট কন্যা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলো।তাদের কোল জুড়ে এলো এক ছোট্ট ছেলে শিশু।যে শিশুটি মায়ের চেয়ে হাজার গুন সুন্দর!বড় ভাইয়ের এত সুখ বদ রাজপুত্র সহ্য করতে পারলো না।সে হিংসে জ্বলে যাচ্ছিল। তার কিছুদিন পরই আকস্মিক দূর্ঘটনায় বড় রাজপুত্র মারা গেলো।আর পুনরায় আবার ছোট কন্যা শোকে বিহ্বল হয়ে গেলো। নিজেকে চরম পাপী মনে করতো সে।নিজেকে নিজে দুষতো।মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো ছোট কন্যা।একদিন নিজেই নিজের গলায় ওড়না পেচিয়ে মৃত্যুকে আপন করে নিলো। আর ত্রাণকর্তা হিসেবে বদ রাজপুত্র বাবার চোখে ভালো হওয়ার জন্য নিজেই শিশুটির দায়িত্ব নিলো।রাজা বেজায় খুশি হলেন ছোট ছেলের আচরণে। আর বড় কন্যাও খুশি হলেন স্বামীর এহেন সিদ্ধান্তে।খুব সাধারণ ভাবেই বেড়ে উঠতে লাগলো তিনটি সন্তান।যখন ছোট শিশুটির বয়স তিন বছর তখন রাজা জানতে পারলেন তার ছোট ছেলের সকল দুষকর্ম।সে ভিতরে ভিতরে মর্মে মরে গেলেন।তার বড় ছেলের মৃত্যু কোন স্বাভাবিক নয়!ঐ মেয়েটির ধর্ষনকারী তার সন্তান! এতকিছু যেনে সে বাকহারা হয়ে গেলেন।ছেলেকে পুলিশে দিতে পারলেন না একমাত্র কোন শক্ত প্রমাণের অভাবে।তাই রাজা প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তার সকল সম্পত্তি, স্থাবর দান করে দিয়ে গেলেন সেই ছোট শিশুটিকে।সেই শিশুটি যখন একুশ বছরের প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ হবে তখন সে তার সম্পত্তি দখল নিবে আর তার আগে ছেলেটির কিছু হলে সকল কিছু ট্রাস্টে দান হয়ে যাবে। এই সিদ্ধান্তের পরই রাজা মারা গেলেন।আর বদ রাজপুত্র মিথ্যে ভালোবাসার দেয়ালে বড় করতে লাগলো ছোট কন্যাটির সন্তানটিকে।যেমন পালন করা হয় সোনার ডিম পাড়া হাঁস!একসময় বড় কন্যাও বুঝতে পারলেন তার শশুড়ের মৃত্যুর পর তার স্বামী বদলে যাচ্ছে। সে কিছুই বলতে পারলেন না।তাকে থামিয়ে দেয়া হলো।সে মুখ খুললেই জেনে যাবে তার বোনের ছেলে তার মা একজন ধর্ষিতা!সে সেই ধর্ষণের ফসল।যা ছোট ছেলেটা সইতে পারবে না।তাই বড় কন্যা সব মুখ বুজে সইতে লাগলেন।একে একে সব সত্য বড় কন্যাটি জানতে পারলেও সে কিছুই করতে পারলো না।সে শুধু অপেক্ষায় থাকলো তার দুই ছেলের বড় হওয়ার! “”””””

তারুণ এসব কথা ভেবে পুনরায় বিষাক্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে।যেন এটি কোন গল্প নয় হেমলকের সূরা পান! তারুন ভাইয়ের মুখ থেকে সব শুনে একমুহূর্তেই বুঝে ফেললো।সে কোন একজনের স্পার্মের ফল।তার মাকে ধর্ষন করেছে যে তাকে সে এতদিন পিতা বলে জেনেছে।কি বিশ্রী অনুভূতি!
তারুণ ভেবে পেলো না কোন মায়ের জন্য সে বেশি কষ্ট পাবে যে বিশ্রী কষ্ট পেয়ে ধর্ষন হয়ে তাকে জন্ম দিয়েছে নাকি যে সারাটা জনম তাকে বুকে আগলে তার জন্য সকল কিছু মুখ বুজে সহ্য করেছে সেই মায়ের জন্য!

***************

এক সপ্তাহ পর তারুণ অনেকটা সকলের অগোচরেই লন্ডন চলে গেলো।যেদিন সে চলে গেলো সেদিন এয়ার্পোটে শুধুমাত্র পুনম এসেছিল তাকে বিদায় জানাতে।পুনমকে কল করে তারুণই আসতে বলেছিল।পুনম প্রথমে আসতে না চাইলেও তারুণ অনেকটা অনুরোধ করেই তাকে এনেছিলো।পুনম তারুণকে বিদায় দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলো,তানভীর আসেনি একমাত্র ভাইকে বিদায় দিতে।তার কিছুটা খারাপ লাগলো কিন্তু প্রকাশ করলো না।আর পুনম অনেকটা অবাকও হয়েছিলো কেন তাকেই বিদায় মুহুর্তে আসতে বলা হলো। পুনম খেয়াল করে দেখেছিল তারুণ অনেকটা কষ্ট চেপে রাখছে।যা তারুণ চেয়েও লুকাতে পারেনি।
তারুণ বিদায় মুহুর্তে পুনমকে বলেছিল, “”” আপনাকে নয়াপু বলেই ডাকলাম।কেননা আপনি লাবণ্যর নয়াপুু।আর আমার ভাইয়ের খুব কাছের মানুষ! আমি অবশ্য আগে জানতাম না।এখন আপনাকে দেখে চিনলাম।নয়াপু আমার হয়তো এ দেশে আর ফেরা হবে না তাই আমার ভাইয়ের প্রাণ ভ্রমরাকে দেখে বিদায় নিতে চাচ্ছিলাম। আপনি হয়তো অবাক হচ্ছেন, কেন ভাই আসলো না?আসলে ভাই জানে আজ আমি চলে যাবো আর এও জানে এই দেশে আমার আর ফিরা হবে না।তাই ভাই এই বিদায় সহ্য করতে পারবে না তাছাড়া তাকে দেখলে আমারও কষ্ট হতো।এই দেশের আকাশে বাতাসে ভীষণ কষ্ট নয়াপু!ভীষণ কষ্ট! ছোট ভাই হিসেবে আবদার রইলো,আমার ভাইয়ের হাত কখনো ছেড়ে দিবেন না!সে আপনাকে ছাড়া শূন্য! “”””

পুনম তখন অবাক হয়ে তারুণের কথা শুনলো।ছলছল চোখে তারুণের আবদার দেখে পুনমের কান্না পেলো। পুনম বলে উঠলো, “” তারুণ সকল প্রস্থান সুখের হয় না।তোমার ভাই তোমাকে ভীষন ভালোবাসে! ”

তারুণ হেসে বললো, “ইশ! আজ ভাইকে হিংসে হচ্ছে। সে আপনার মত একজন মানুষ পেলো বলে।”

পুনম তারুণের কোঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল, ” ইশ!আমারো যে মি.তানভীরকে হিংসে হচ্ছে, সে তোমার মত ভাই পেলো বলে।আমি কেন পেলাম না বলতো?”

তারুণ সেদিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিল, “” নয়াপু লাবণ্যকে না বলেই চলে যাচ্ছি। তাকে বলবেন,সে আমার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দ্বিতীয় নারী! আমি তাকে ভীষণ মিস করবো!”

” আর প্রথম?”

“আমার মা!”…. বলে তারুণ ঠোঁট চেপে কান্না আটকালো আর হনহন করে চলে গেলো এয়ার্পোর্টের ভিতরে।

এক অভিমানী ছেলে অনেক অভিযোগ নিয়ে এ দেশ থেকে চলে গেলো।যার আপন বলতে কেউ নেই আবার অনেকে আছে।শায়লা হক জানতেও পারলেন না তার ছোট ছেলে কতটা কষ্ট নিয়ে চলে গেলো।সে যখন জানতে পারলো তখন আকাশ বাতাস কাপিয়ে গগনবিহারী সুরে কান্না করতে লাগলো আর বারবার বলতে লাগলো, ” আমায় ক্ষমা করিস নায়লা।তোর ছেলেকে আমি আগলে রাখতে পারলাম না!সে যে ভীষণ কষ্ট পেয়ে চলে গেলো।মায়ের বুক এ যন্ত্রণা কেমন করে সইবে? আমি কি তবে তোর ছেলের মা হতে পারিনি?”

*************
হায়দার হোসেনের মোবাইলে টুক করে একটা মেসেজ টোন বেজে উঠলো।হায়দার হোসেন মেসেজটি বজ্রহত দৃষ্টিতে পড়লেন।””””আপনাকে কি বলে সম্বোধন করি বলুন তো?এতকাল যে বাবা বলে সম্বোধন করতাম তাকি আদৌও এখন সম্ভব? ঐ কুৎসিত গল্পটা না জানলেই ভালো হতো। তাই না বাবা? তুমি আমার বাবা মায়ের হত্যাকারী জানার পরও তোমায় প্রবল ঘৃণা করতে পারলাম না।ঐ যে আমি জানতাম,আমার বাবা ওয়াল্ডের সেরা বাবা। আসলেই তুমি সেরা! আমার বিশ্বাস করতে ভীষন কষ্ট হয়েছিলো বিশ্বাস করো বাবা!ভাইকে খুন করতে মন চাইছিলো।মনে হয়েছিল ভাই তোমার নামে বানোয়াট কথা বলছে।আসলে সব সত্য! পৃথিবীর সব থেকে কুৎসিত সত্য! এই যে এত এত ভালোবাসলে সবটা ইনভেস্ট ছিলো বাবা?কেমনে পারলে বলতো? বাবা চলে যাচ্ছি আমি! তুমি যা চেয়েছিলে আমার একুশ বছর জন্মদিনে তুমি তা পেয়ে যাবে!আফসোস সে জন্মদিনে আমি তোমার পাশে থাকবোনা আর না জড়িয়ে ধরে বলবো, বাবা ইউ আর দা বেষ্ট বাবা!ভালো থেকো বাবা ঐ সম্পদের পাহাড়ে!”””

এই প্রথম হায়দার হোসেন তারুণের মেসেজটি পড়ে বুকের কোণে সুক্ষ্ম এক ব্যথা অনুভব করলেন!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here