পুনম,পর্বঃ৩৬
আয়েশা_সিদ্দিকা
তানভীর ফিরলো টানা পঁচিশ দিন পর।ততদিনে পুনম যুদ্ধসম বাস্তবতার সাথে লড়ে ক্লান্ত!রাজুর মুখ থেকে সব শুনে তানভীর পাগলপ্রায়। কেন তাকে জানানো হলো না এ নিয়ে কতক্ষণ চিল্লাপাল্লা করলো।তারপর ছুটলো পুনমের সন্ধানে।তানভীর কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না।সি এনজিতে বসে কতক্ষণ নিজের চুল খামছে ধরলো,ঠোঁট চেপে কান্না আটকালো।সে জানে না সামনে কি আছে?তবে এতটুকু জানে সে যা ভাবছে যদি তাই হয় তবে সে পুনমকে হারাবে!যা তানভীরের জন্য মৃত্যু স্বরুপ!
ইষ্টি মিষ্টি লুকিয়ে ফোন করে তার মাকে। লাবণ্য ফোন রিসিভ করে বড় আপার কাছে নিয়ে যায়।রুমে গিয়ে দেখে বড় আপা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছে।একমুহূর্তের জন্য তাকে মৃত মনে করলেও ভুল হবে না।অসার হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। চোখ দুটো নিষ্প্রাণ!ইদানীং বড় আপা খুব কম কাঁদে।চুপচাপ বসে থাকে,আর পাগলের মত প্রলাপ বকে। লাবণ্যর কান্না পেলো কিন্তু কাঁদলো না। মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো, ” বড় আপা ইষ্টি কল দিয়েছে।”
বড় আপার চোখের মণিতে চঞ্চলতা দেখা দিলো।ছো মেরে ফোন হাতে নিলো।বড় আপাকে এই মুহূর্তে এরকম দেখে লাবন্যের মনে হলো, ” একজন নারী সবার কাছে খারাপ হলেও সন্তানের কাছে সে সেরা মা হয়েই থাকে,মায়ের তুলনা একমাত্র মা হয়!”
“আমার ইষ্টি-মিষ্টি কেমন আছো তোমরা?” বলে বড় আপা হুহু করে কেঁদে দিল।
” মা তুমি ফিরবেনা?যদি নাই ফিরো তবে আমাদের কেন নিয়ে গেলে না?আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে মা!”….চিকন কাঁদো স্বরে বলে ওঠে ইষ্টি মিষ্টি।
মেয়েদের কান্না শুনে রুমা বিহ্বলিত হয়।পরক্ষনেই আবার আহাজারি করে কেঁদে ওঠে। ঘরের দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খায় একজন মায়ের করুণ আহাজারি!
মুক্ত আগের থেকে আরো নাদুসনুদুস হয়েছে। তার বয়স মাত্র বিশ দিন কিন্তু বুঝায় দুমাসের।লাবণ্যের পড়ালেখা লাটে উঠেছে, সারাদিন মুক্তকে কোলে কোলে রাখে।কত কথা বলে মুক্তর সাথে তার ইয়াত্তা নেই।ভবিষ্যতে এই ছেলে যে খালামণির মত বাচাল হবে তা হলফ করে বলা যায়।ঝুমার সারাদিন কাটে জামালের ফিরার অপেক্ষায়। শুধুমাত্র বাচ্চার খুদা লাগলেই বাচ্চাকে কোলে নেয় সে।নতুবা গুম হয়ে বসে থাকে নাহলে গুনগুন করে কাঁদে।ঝুমা জানে তার স্বামী কখনো কাউকে খুন করতে পারেনা। ঝুমা দুদিন আগে জামালের সাথে দেখা করতে থানায় গিয়েছিল। জামাল তার হাত ধরে শুধু কেঁদেছে।বাচ্চাকে দেখাতে চাইলে বললো, “ঝুমা আমার মুক্তকে আমি সেদিনই দেখবো যেদিন আমি মুক্ত হতে পারবো!” ঝুমার ভীষণ কষ্ট হয়!এ কেমন ঝড় এলো তাদের পরিবারে।বড় আপার এত সুন্দর সাজানো সংসার ভেঙে গেলো এক ডাইনীর আগমণে আর তার স্বামী বিনাদোষে কিসের শাস্তি ভোগ করছে?
***********
নিয়াজ উদ্দিন বারান্দায় নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।ঘোলা চোখে চশমার দেয়াল!আগের থেকে শুকিয়ে গেছে নিয়াজ উদ্দিন। সারাদিন চুপচাপ বসে থাকে। চাকরি হারানোর শোক সামলাতে পারলেও প্রিয় স্ত্রীর অসুস্থতা তাকে আরো দূর্বল করে দিয়েছে।তারউপর মেয়েগুলোর জীবনে শান্তি নেই।এ কেমন জীবন?নিয়াজ উদ্দিন বারান্দা থেকে নিজের বিছানায় এসে বসেন।রুমের চারপাশে নজর বুলান।সারা রুমে সালেহার হাতের ছোঁয়া!কতটা জীবন্ত!অথচ মানুষটার জীবন নিয়ে সংশয়!সালেহা আজ দশদিন হলো হসপিটালে ভর্তি।নিয়াজ উদ্দিন বিড়বিড় করে বলে,
” ইয়া আল্লাহ! চিরকাল সৎ থাকার এই পারিশ্রমিক দিলে তুমি?”
পুনম হসপিটালে যাবে।একটু আগেই সে বিকালের শিফটের কাজ করে আরো দুটো টিউশনি করিয়ে এসেছে।সেজ আপা তিনদিন ধরে হসপিটালে মায়ের কাছে থাকে।আজ তাকে পাঠিয়ে পুনম থাকবে।এখন রাত নয়টা।সারাদিন ছোটাছুটির পর শরীরে না কুলালেও কিছু করার নেই।পুনম একেবারে তৈরি হয়ে একটা প্লেটে খাবার নিয়ে বাবার রুমে আসে।বাবাকে বিছানায় হাত বুলাতে দেখে পুনম প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ে! ধীরপায়ে এসে বাবার কাছে বসে পুনম!তারপর ভাত মাখতে মাখতে বলে,
” বাবা সারাদিনে তো কিছুই খাওনি।এখন খাবে আর আমি তোমাকে খায়িয়ে মায়ের কাছে যাবো।”
নিয়াজ উদ্দিন পুনমের দিকে তাকায়। মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গেছে।তার ফর্সা মেয়েটা সারাদিনের ছোটাছুটিতে ফ্যাকাসে রঙের দেখাচ্ছে। নিজেকে ব্যর্থ পিতা মনে হয়।নিজ সন্তানের কষ্ট লাঘব করতে পারলো না উল্টো আরো বোঝা চাপিয়ে দিলেন।
” হা করো তো বাবা।এরকম করে তাকিয়ে আছো কেন?”
“মারে খুদা লাগেনা কেন বলতো?”
“বাবা ছোট বাচ্চাদের মত করছো তুমি।হা করো।”
নিয়াজ উদ্দিন হা করে।পুনম খুব যত্ন করে ভাত মাখিয়ে বাবার মুখে তুলে দেয়।পুনমের চোখ ভিজে আসতে চাইলেও তা খুব গোপনে সংবরণ করে।চারিপাশে এত কষ্ট কেন?
“বাবা মায়ের কাছে যাও না কেন?মার যখনই ঘুম ভাঙে তখনই জিজ্ঞেস করে, তোরা বাবা আসেনি?তোর বাবা আমায় একটুও ভালোবাসে না!”
“তোর মা ঠিক বলে পুনম। তোর মা ঠিক বলে।ওই বোকা মহিলাকে আমি একটুও ভালোবাসি না।সারাজীবন ওই বোকা মহিলা আমার সংসারের পিছনে খেটে গেলো আজ তার চিকিৎসার জন্য আমি কিছুই করতে পারতেছিনা!শূন্য আমি তোর মার সামনে কি করে দাঁড়াই বলতো?”
“বাবা খাওয়া শেষে চট করে পাঞ্জাবি পড়ে নেও।আজ দু বাপ বেটি মার কাছে যাবো।মায়ের ঘুম ভেঙেই তোমায় দেখতে পেলো। মা তখন আর রাগ করে থাকতে পারবে না।কি বলো?”
“আমায় তুই ক্ষমা করে দিস মা।ক্ষমা করে দিস।বাপ হয়ে তোদের একটু সুখের মুখ দেখাতে পারলাম না।এ বড় লজ্জার!”…. বলে নিয়াজ উদ্দিন হু হু করে কাঁদতে শুরু করেন।
পুনম ভেজা কন্ঠে বলে, ” ছি!বাবা ভাতের পাতে কাঁদতে নেই, জানো না?”
*************
রাত এগারোটা। হসপিটাল চত্তরটা নিরব।একটু আগেই মায়ের ঘুম ভেঙেছে,বাবার সাথে এখন গুটুর গুটুর করে কথা বলছে মা।বাবাকে দেখে অসুস্থতা ভুলে গেছে।মায়ের শরীর থেকে ঔষধের গন্ধ আসে! পুনমের ভালো লাগে না।মা মা গন্ধটাকে খুব মিস করে। পুনম কেবিনের দরজা ভেজিয়ে বেড়িয়ে আসে।মাথাটা ব্যথা করছে।একটু চা খেতে পারলে শান্তি পাওয়া যেতো।খালি বারান্দার এককোণের চেয়ারে বসে পুনম।মাথায় হাজারো চিন্তা!বাবা কিছু একাকালিন টাকা পেতো তাও আটকে আছে চাকরি হারানোর চক্করে।মেজ দুলাভাইকে কি করে ছাড়াবে আল্লাহ জানে?রাশেদ ভাইয়ের সাথে কথা বলেছে পুনম। রাশেদ ভাই বলেছে ক্রিমিনাল লয়ার ধরতে হবে।তার জন্য অনেক টাকার দরকার।টাকা থাকলে সত্য মিথ্যা সব করানো যায়।পুলিশকে টাকা খাওয়াতে হবে।নানান ঝক্কি। বড় দুলাভাইকে ফোন করেছিল পুনম।একটা মিমাংসায় আসতে চেয়েছিল কিন্তু ফোন ধরলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। আর সে কতগুলো বিশ্রী গালি দিলো পুনমের পরিচয় জানার পর।পুনম অবশ্য পাল্টা কিছু গরম গরম কথা বলেদিয়েছে।কিন্তু তাতে কি?বড় দুলাভাইতো জীবনেও বড় আপাকে আর গ্রহণ করবে না।
তার উপর মায়ের চিকিৎসার খরচ।দিনকে দিন মা দূর্বল হয়ে পড়ছে।ইমার্জেন্সি অপারেশন করা দরকার! পুনম চোখে সরষে ফুল দেখে।পুনমের মোবাইল বেজে ওঠে, বল্টু কল করেছে।মায়ের জন্য রক্তের ব্যবস্থা হয়েছে তাই জানালো।পুনম ফের চিন্তায় মগ্ন হয়।তানভীরের বাবাকে খুন করতে মনে চায়!
*********
পুনম মাথা এলিয়ে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে।মাথাটা সামন্য কাত হয়ে আছে তার জন্য ঠোঁট দুটো একটু হা করে আছে।তানভীর নিরবে এসে পুনমের পাশে বসে।পুনমকে এভাবে ঘুমাতে দেখে প্রচন্ড খারাপ লাগে তানভীরের।ঘুমন্ত পুনমকে নিরবে পর্যবেক্ষণ করে তানভীর। এত মায়া কেন এই মুখে কে জানে?মেয়েটা ঘুমালেই নাক ঘামে!কি আজব?তানভীর একটু ঝুঁকে পুনমের ক্লান্ত মুখের ললাটে একটা গভীর চুম্বন আঁকে। এক চুম্বনে শুষে নিতে চায় তার পুনমির সকল কষ্ট!
এত ঠান্ডায় পুনমকে শুধু সালওয়ার কামিজে দেখে তানভীরের মেজাজ খারাপ হয়।নিজের শরীর থেকে জ্যাকেটটা খুলে পুনমের শরীরের উপর চাপিয়ে দেয়।গরম পোশাকের আলিঙ্গনে ঘুমন্ত পুনম জ্যাকেটটা ভালো মত আকড়ে ধরে গুটিশুটি মেরে শুতে নিলেই পড়ে যেতে নেয়।মুহুর্তেই তানভীর দুহাতে আগলে নিজের বুকের মাঝখানে নিয়ে আসে পুনমকে। শক্ত করে ধরে রাখে বুকের মাঝে।পুনম যেন পাকাপোক্ত একটা স্থান পেয়ে আরো গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।আর তানভীর, তার পুনমিকে বুকে পেয়ে যেন চরম শান্তি পায়।পুনমের মাথার চুলে খুব সন্তোপর্ণে ফের চুমু দেয় তানভীর। এই মেয়েটাকে হারিয়ে ও বাঁচবে কি করে? তার উত্তর খুঁজে!কোন জবাব না পেয়ে হতাশ হয়!
মাঝরাতে পুনমের ঘুমটা হালকা হয়।নিজেকে কারো শক্ত আলিঙ্গনে দেখে হকচকিয়ে যায়।হুড়মুড় করে উঠে বসে।ঘুম ঘুম চোখে চেয়ে দেখে তানভীর বসে আছে। তানভীরকে দেখে নিজেকে ধাতস্থ করে। কোন উচ্চবাচ্য না করে চুপ করে উঠে কেবিনের দরজা ঠেলে মাকে দেখে আসে।মা ঘুমাচ্ছে আর বাবা মায়ের হাত ধরে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে গেছে।দরজাটা পুনরায় ভেজিয়ে দিয়ে তানভীরের পাশে এসে বসে।তানভীর পুনমের এই শান্ত রুপ দেখে ভয় পায়।তানভীর নিজেকে সামলে পুনমকে বলে, “চা খাবে পুনম?”
পুনম শান্তস্বরে বলে, “খাওয়া যায়।”
পুনমের শরীরে তখনও তানভীরের জ্যাকেট।পুনম ফিরিয়ে দিতে নিলে তানভীর বাধ সাধে।পুনমও আর জোর করে না।দুজনে পাশাপাশি হেঁটে হসপিটাল থেকে বের হয়।হসপিটালের সামনে সবসময়ই কিছু দোকান খোলা থাকে।তার একটা দোকানে গিয়ে দুজনে বসে।তানভীর দোকানিকে চায়ের কথা বলে পুনমের পাশে বসে পড়ে।পুনম চুপচাপ রাতের শহর দেখায় মগ্ন হয়।কি নিরব চারপাশ!অথচ দিনের বেলা কত কোলাহল! চা এলে দুজনেই চুপচাপ চায়ে ঠোঁট ছোঁয়ায়! চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তানভীর পুনমকে আড়চোখে দেখে।মেয়েটা এরকম মুখটা শক্ত করে রেখেছে কেন?
চা শেষে দুজনে আবার হাঁটতে শুরু করে।হসপিটালের সামনে একটা বসনি আছে।সেখানে বসে দুজনে।তানভীর খুব সাহস সঞ্চয় করে পুনমের একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।পুনম বাঁধা দেয় না।তানভীর ভারী স্বরে বলে, “পুনমি এতটা চুপচাপ হয়ে রয়েছো কেন?”
পুনম গভীর চাউনিতে তাকায় সরাসরি তানভীরের চোখের দিকে।সে চাহনি দেখে তানভীরের নিজেকে খুব অপরাধী লাগে।তানভীর তার দৃষ্টি নত করে।পুনম পরিষ্কার অথচ কাঁটা কাঁটা স্বরে বলতে শুরু করে,
“মি.তানভীর আপনি খুবই ভালো মানুষ। এতটা ভালো আমি কখনো কাউকে দেখিনি।জানেন তো ছোটবেলা থেকেই আমি একটু অন্যরকম।সবাই যখন নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত আমি তখন আমার পরিবারের একটু সুখ খুঁজতে ব্যস্ত।অসংখ্য প্রেমের প্রপোজাল পেয়েছি আমি।একবার তো আমাদের কলেজের এক বড় ভাই আমার পিছনে আঠার মত লেগে পড়লো।দেখতে শুনতে কিন্তু আপনার থেকেও ভালো ছিল।পথে ঘাটে ক্লাসে সব খানে সে আমার জন্য উপস্থিত থাকতো যেকোন মূল্যে সে আমাকে রাজি করাবে।একদিন কলেজ ফাংশনে আমার সাথে একটু বেশিই জোড়াজুড়ি করলো।ডেস্পারেট হয়ে গিয়েছিলো আরকি।আমাকে জড়িয়ে ধরতে আসলে আমি কি করলাম জানেন?আমার পাজামার পকেটে থাকা ছোট নাইফ দিয়ে তাকে আঘাত করলাম।রক্তাক্ত হলো সে।আমি এরকমই। আজ পর্যন্ত যেই আমার সাথে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে এসেছে তাকে আমি কোন না কোন ভাবে আঘাত করেছি।একমাত্র আপনি বাদে।মি.তানভীর আপনি আমায় হোটেল রুমে জোর করে চুমু খেলেন আমি শুধু আপনাকে থাপ্পড় মারলাম অথচ তা কিন্তু আমার স্বভাব বিরুদ্ধ!আমার উচিত ছিল আপনাকে খুব বাজে ভাবে আঘাত করা। কিন্তু আমি পারলাম না, কেন জানেন?আপনি খুব আলগোছে আমার মনে জায়গা করে নিয়েছেন।কতটা অজান্তে তা আমি নিজেও জানি না।আপনি চেয়েছিলেন আমার ভিতরে আপনার বিচরণ থাকুক ।আপনি পেরেছেন!আপনি জয়ী হয়েছেন।আপনি আমাকে জিতলেন অথচ আমি হেরে গেলাম!খুব নিঃস্ব ভাবে হেরে গেলাম! আপনি এক পা এক পা করে আমার দিকে ধাবিত হলেন।আমিও শত চেষ্টা করে পিছাতে পারলাম না।অথচ আপনি কিন্তু জানতেন আপনার বাবা কতটা জঘন্য মানুষ! তারপরও আপনি আপনার বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে আমায় চুজ করলেন আর আমাকে হারিয়ে দিলেন।আপনার বাবা আমায় অসংখ্য বার টাকা অফার করলো তারপরও তাতে জয়ী না হয়ে আমার কতটা ক্ষতি করলো।ইদানীং তো সে অনেকের মাধ্যমে আমায় হুমকি দিচ্ছে। কখনো লাবণ্যকে ক্ষতি করার হুমকি,কখনো বাবাকে মেরে ফেলার হুমকি।আপনি আমায় জয়ী করতে গিয়ে আমাকে কঠিন বিপদের মুখে ঢেলে দিলেন।আমার স্থানে অন্য কোন মানুষ থাকলে এতদিনে আপনার বাবার লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতো।আমি পারলাম না।ঐ যে কারো সামনে মাথা নত করতে পারি না।কিন্তু কতদিন এরকম থাকতে পারবো জানি না।আচ্ছা মি.তানভীর আপনি আমার পথে পা বাড়িয়েছেন আমি তো আপনার পথে যায়নি তবে আমার পথে এত কাঁটা কেন বিছালো বলতে পারেন? আমি আপনাকে কখনো ঘৃণা করতে পারবো না কিন্তু আপনাকে কখনো গ্রহণও করতে পারবো না মি.তানভীর। যদি বলেন এতকিছুতে আপনার দোষ কোথায় তবে আমি বলবো আমার বাবার কি দোষ ছিল আর দুলাভাইয়ের তারই বা কি দোষ? আমার পরিবার আমার দায়িত্ব! ভালোবাসা আর দায়িত্বের মধ্যে আমি দায়িত্ব বেছে নিলাম মি.তানভীর। ‘ভালোবাসা এড়ানো সম্ভব,কিন্তু দায়িত্ব এড়ানো অসম্ভব! ‘ এই রাতশেষে আমি চাইবো আর কোনদিন আপনি আর আমি মুখোমুখি না হই!আমার সামনের পথটা অনেক কঠিন মি.তানভীর আপনি তা আরো কন্টকপূর্ণ করবেন না।আমার পরিবারকে নিয়ে আমায় বাঁচতে দিন।আপনাকে গ্রহণ করা মানে আমার পরিবারকে শেষ করে দেয়া।আর এতটা সাহসী আমি নই,একদমই নই!”
তানভীর নিরবে পুনমের কথা শুনলো।তানভীর হাতের মুঠোয় রাখা পুনমের হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বললো,
“পুনমি ভালোবাসা কি দায়িত্ব নয়?”
পুনম এর জবাবে নিরুত্তর রইলো।তানভীর ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।তানভীর এই ভয়টাই পাচ্ছিল।বাবার উপর প্রচন্ড রাগ হলো।
খানিক পড়ে পুনম উঠতে নিলে তানভীর পুনমের হাতের উল্টো পিঠে আলতো ভাবে চুমু দিলো।তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে পুনমের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “ভালো থেকো আমার পুনমি!”
পুনম উল্টো ঘুরে নিরবে হাঁটা শুরু করলো।তানভীর চেয়ে চেয়ে দেখলো তার পুনমি ধীরপায়ে হেঁটে যাচ্ছে। রাতের স্নিগ্ধ আলোতে একটা মেয়ে তার ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে দায়িত্বের বেড়াজালে আবরিত হয়ে চলে যাচ্ছে। প্রেমিক পুরুষটার জ্যাকেটে যে মেয়েটা আলঙ্কারিত সে মেয়েটা প্রেমকে পদদলিত করে চলে যাচ্ছে!পুনম চোখের আড়াল হতেই তানভীর উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরলো।তানভীর কি কখনো জানবে উল্টো পথে হাঁটতে থাকা মেয়েটা নিরবে কাঁদছিলো?
***********
একটু পরই সকাল হবে।ঠিক সেই সময় তানভীর এসে উপস্থিত হলো হায়দার মেনশনে।কয়েকমাস পরে এ বাসায় সে পা রাখলো।দপদপ করে সিড়ি বেয়ে সোজা চলে গেলো বাবার রুমে।হায়দার হোসন ঘুমিয়ে ছিলেন।তানভীর গিয়ে বাবার পায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়লো।বাবার পা জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো।হায়দার হোসেন তানভীরের কান্না শুনে হকচকিয়ে ঘুম থেকে উঠলেন।ছেলেকে পা জরিয়ে কাঁদতে দেখে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে তানভীর? কাঁদছো কেন?”
“আপনি আমার পুনমিকে এতটা কষ্ট দিয়েন না।আমি আজ স্বীকার করলাম আপনি চাইলে সব পারেন।আপনি পুনমিকে আপনার চক্রান্ত থেকে রেহাই দেন। প্লিজ!আমি পায়ে পড়ছি আপনার!আমার পুনমি মরে যাবে!স্রেফ মরে যাবে!প্লিজ!”
হায়দার হোসন শান্ত স্বরে বললো, “তুমি চাও তো পুনম ভালো থাকুক?”
” হ্যা “….তানভীর ব্যগ্র কন্ঠে বলে।
” তবে তাই হোক।তোমার বিয়ের আয়োজন করি।আমার কোটিপতি বন্ধুর মেয়েকে তুমি বিয়ে করে নাও।তবে সব ঝামেলা চুকে গেলো।”
তানভীর বাবার কথা শুনে বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে রইলো!তানভীরের মনে হলো তার সামনে তার বাবা নয় কোন নর্দমার কীট বসে আছে!
চলবে,