পুনম,পর্বঃ৩২,৩৩
আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩২
জামিলা হসপিটালের করিডোরে বসে আছে।তার চোখে মুখে আনন্দের ফোয়ারা।হাতে প্রেগন্যান্সির কাগজ।যাতে দেখা যাচ্ছে রেজাল্ট পজিটিভ!
এই সংবাদটার জন্য এতদিন মুখিয়ে ছিল জামিলা।হারুনকে পুরোপুরি তার আয়ত্তে আনা এখন এক চুটকির ব্যপার!হারুন তাকে বিয়ে করতে রাজি হলেও তার দুই মেয়েকে ছাড়তে রাজি নয়।সতীনের সন্তান কেউই কাম্য করে না।এখন জামিলার এই অনাগত সন্তানই পারবে হারুনকে শুধু একমাত্র তার বানাতে! উফফ!একবার ঐদিকের ঝামেলা শেষ হলে এরপর বিন্দাস জীবন।শাড়ি চুড়ি,স্বর্ণ অলংকার বাড়ি গাড়ি কোন কিছুরই আর অভাব হবেনা জামিলার। কাঙ্খিত সুখের লোভে জামিলার চোখ দুটি চক চক করে ওঠে! হসপিটাল থেকে বের হয়ে দুই প্লেট মোল্লার দোকানের বিরানি খেয়ে বাসার উদ্দেশ্য হাঁটে।আজ হারুন আসছে ঢাকা…নিজেকে আজ ঘসে মেজে এমন ভাবে সাজাবে যে হারুন যেন তার পুরোপুরি মধ্যে ডুবে যায়!
************
শায়লা হক আজ অনেক দিন পর পুরানো ড্রয়ারটা খুলেছে।ড্রয়ারটা খোলার সাথে সাথে শায়লার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসে।চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা মুখ।কি সুন্দর! কি পবিত্র মুখখানি! নায়লা…!আমার নায়লা!
নায়লার ব্যবহৃত জিনিসপত্রের উপর হাত বুলাতে থাকে,তারপরই ডুকরে কেঁদে ওঠে শায়লা।বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
‘কেমন আছিস খুকি?’ ‘আমাকে তুই ক্ষমা করেছিস তো?’
নায়লা, হায়দার হোসেন, তানভীর, তারুণ, ভাইয়া,বাবা একে একে সবার মুখ চোখের সামনে ভাসতে শুরু করে।শায়লা চুল খামচে বসে পড়ে।মনে করতে চায়না সেসব দিন।কি বিভৎস! কি যন্ত্রাণাদায়ক! শরীরে কাঁপন ধরে।কপালের পাশ থেকে চিকন ঘামের রেখা নামে। জ্ঞান হারাবার আগে মৃদুস্বরে বলে,’আমি তোমাকে ঘৃণা করি হায়দার হোসেন!ভীষণ ঘৃণা করি!’
********
আজ শুক্রবার। ছুটির দিন।পুনম কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।পড়তে বসা দরকার!কিন্তু কেন যেন মনটা সায় দিচ্ছে না।বিকেলে মিতুর জন্মদিন। যাবে কি যাবে না?এ নিয়ে দ্বিধা কাজ করছে।মি.তানভীরের উপর রাগ করে একবার ভাবছে যাবে না আবার রাশেদ ভাই সুমনের জন্য এত খাটাখাটনি করছে।তার মেয়ের জন্মদিনে না গেলে কেমন দেখায়।কাজটা অকৃতজ্ঞের মত হয় যায়! আচ্ছা সেখানে গেলে যদি মি.তানভীরের সাথে দেখা হয়ে যায়, তখন? দেখা হলে হবে।নিজেকে নিজে বলে পুনম।সেদিনের সেই রাতের ঘটনার পর আর তানভীর তার সামনে আসেনি। কেন?নিজেই ক্ষ্যাপা ষাড়ের মত বিহেভ করবে আবার নিজেই রাগ করে দূরে থাকবে।আজব! এসব ভাবতে ভাবতেই পুনমের মুখ লালচে হয়ে ওঠে। অসভ্যটা সেদিন কিরকম করে চুমু খাচ্ছিলো! ছি! পুনমের আশ্চর্য লাগছে।সেদিন রাগ করে থাপ্পড় মারলেও আজ কেন যেন রাগ লাগছে না।বরং সেই উত্তপ্ত পৌরষালী স্পর্শের কথা মনে হলে লজ্জা লাগছে।’ছি!পুনম তোর কত অধপতন হয়েছে দেখ’ নিজেকে নিজেই শাসিয়ে ওঠে।
*********
লাবণ্য এক কাপ চা এনে পুনমের সামনে রাখে।পুনম অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
‘ মেকাপরাণী লাবণ্য আজ আমার জন্য চা এনেছে।এতটা পরিববর্তন কেন? ‘
” কোন কারণ নেই।সেজপা অসুস্থ তাই ভাবলাম…. ”
” আচ্ছা।গুড ভেরি গুড!”
” নয়াপু আমার ভীষণ মন খারাপ।”
পুনম চায়ের কাপটা সরিয়ে লাবণ্যকে নিজের কাছে টেনে বসায়।ছোট বোনের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখের ইশারায় সায় দায়।লাবণ্য মিনমিন করে বলে,
” আমার পড়তে ভালো লাগে না নয়াপু।আমি আর পড়তে চাই না।যে সব রেজাল্ট করি তাতে তোমাদের মান থাকে না।”
“লাবণ্য পড়াশোনাটা কেবল ভালো মার্কসের জন্য নয়।পড়াশোনাটা নিজের জন্য। নিজের আত্মতৃপ্তি, আত্মসম্মানের জন্য! তাই কে কি ভাবলো?ডাজ নট মেটার! ভাবছি তোকে মেকাপ এন্ড বিউটির জন্য একটা কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেবো।পাশাপাশি টুকটাক পড়াশোনা।ব্যস হয়ে গেলো।কোন চাপ নিস না।সবাই ভালো হয় না সবকিছুতে।”
লাবণ্য খুব খুশি হয়।তার নয়াপু তাকে কতটা বুঝে। চোখে জল এসে যায় লাবণ্যের।পুনমের বুকে মাথা গুজে দেয়।পুনম মৃদু হেসে লাবণ্যের চুলে বিলি কাটে।
“নয়াপু,আমি যে সোসাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ভিডিও আপলোড করি। সেজেগুজে নাচি…তুমি তো তা নিয়ে কখনো বকলে না।বাসার সবাই কিন্তু বারণ করেছে শুধু তুমি বাদে।”
“কেন বকা দেবো।তুই কি এখনো ছোট আছিস।নিজের ভালো নিজের বুঝতে হবে লাবু।খাবার না খেলে যেমন আমরা দূর্বল হয়ে পড়ি তেমন অতিরিক্ত খেলে বদহজম হয়।তেমনি সব কিছুরই ভালো ও খারাপ দিক আছে। তোর ভালো তোকেই বুঝতে হবে।তাছাড়া আমি বিশ্বাস করি লাবণ্য কখনো এমন কাজ করবে না যাতে আমরা কষ্ট পাই।”
“তুমি এত ভালো কেন নয়াপু।”
“কোন মানুষই শতভাগ ভালো বা খারাপ হয় না, লাবণ্য। তোর কাছে তোর নয়াপু ভালো হলেও কারো না কারো কাছে আমি খারাপ,খুব খারাপ!”
********
সুমন চোখ মেলে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করে।সমস্ত শরীর বিষের মত ব্যথা!চোখের পাতা ভারী!মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে।
চারদিকে তাকিয়ে বুঝলো,পুরুষ ওয়ার্ড এটা।চারপাশে অসুস্থ মানুষের আহাজরি।হসপিটালে আসার আগে নিজের রোগটা বড় মনে হলেও,হসপিটালে এলে বুঝা যায় কত মানুষ কত রোগে আক্রান্ত!
পাবনীর জ্বর শোনার পর থেকেই সুমনের ভীষণ অস্থির লাগছিলো।মেয়েটার মুখটা একটু দেখার জন্য বুকের মধ্যটায় চিন চিন ব্যথা করছিলো।তাই এদিকের কাজ কিছুটা গুছিয়ে রাতে রওনা হয়েছিলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাস থেকে নামতেই কোথা থেকে চার পাঁচটা ছেলেরা এসে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করলো।যতক্ষণ পর্যন্ত না সুমন জ্ঞান হারালো ততক্ষণ পর্যন্ত মারলো।অজান্তেই নিঃশ্বাস ছাড়ে সুমন।কি কারণে তাকে মারলো? এই প্রশ্নটাই তাড়া করছে। এই ঘটনার পিছনে কি আদৌ বড় ভাইজানের হাত আছে?
একটু নড়তেই বুঝতে পারে শরীরের গিটে গিটে ব্যথা!সুমনের হুট করে খুব মন খারাপ হয়।অসুস্থতার সময় আপনজনের সান্নিধ্য সবাই আশা করে।সুমন এই শহরের অলিগলিতে হারিয়ে গেলেও কেউ খোঁজ নিবেনা!তার কি আদৌ কেউ আছে?
পাবনী মেয়েটা তার কতটা আপন?নিজের মনকে শুধায় সুমন কিন্তু কোন উত্তর পায়না।
সুমন নিজেই স্বগোতক্তি করে,”আই মিস ইউ মা!আই মিস ইউ ভেরি মাচ!”
********
মিষ্টি রঙের একটা হাফসিল্ক শাড়ি, ম্যাচিঙ ব্লাউজ,চোখে হালকা কাজল আর ন্যুড কালারের লিপস্টিক। ব্যস! এতটুকু সাজেই পুনমকে চোখ ধাঁধানো সুন্দর লাগছে।আর বরাবরের মত দুই ভ্রুর মাঝখানের কালো তিলটা যেন সৌন্দর্যের মাত্রা দিগুণ করে ফুটিয়ে তুলেছে।
পুনম চোখঘুরিয়ে আশেপাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।কিন্তু নবাবপুত্রের দেখা না পেয়ে স্বস্তির চেয়ে বরং অস্থির লাগে!
পুনম নিজেকে নিজে সমানে বকে যাচ্ছে।মিতুর জন্মদিনে আসলে যে ওকে এতটা লজ্জায় পড়তে হবে জানলে আসতোই না।উফফ!কি যন্ত্রণা! তারিন বুবু তার সকল গেস্টের কাছে পুনমকে নিজের ভাইয়ের বউ বলে পরিচিত করে দিয়েছে।কি অস্বস্তি কর ব্যপার।আর কোন সম্বোধন ছিল না,ডাইরেক্ট বউ।তাও ঐ কচ্ছপটার?যার কোন খবরই নেই!
আর রাশেদ ভাই তো দেখেই বলে ফেলেছে,
“আরে শালাবউ যে,মাশাল্লাহ কি দারুণ লাগছে।আজ আমার সত্যিই শালাবাবুকে হিংসে হচ্ছে। ইশ!কি ভুল করে ফেললাম!”
পুনম তখন পারেনা তো নিজেকে কোন গর্তের ভিতর লুকিয়ে ফেলে।রাশেদ ভাইও যে এভাবে বলবে তা পুনম তা কল্পনাও করেনি।
সোফার এক কোণে পুনম অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে আছে।বার বার কপাল ঘাড় ঘেমে যাচ্ছে। কি বিশ্রী একটা অবস্থা!
পাশ থেকে এক মহিলা বলে উঠলো,”ভাবি এত সুন্দর ভাইয়ের বউ কোথা থেকে যোগার করলেন?
পুনম মনে মনে বলে,”ওরে বেক্কল মহিলা, তা জেনে আপনার কি?”
শুনতে পেলো তারিন বলছে,”তানভীরেরই পছন্দ ভাবি।”
কখন কেক কাটবে কে জানে?বাসায় ফিরতে হবে।হুট করে দরজার দিকে চোখ যেতেই পুনম দেখতে পেলো মি.তানভীরকে।নীল একটা গেঞ্জির উপর সাদা একটা শার্ট পড়েছে।শার্টের বোতামগুলো খুলে রেখছে।কালো জিন্স।ব্যাকব্রাশ করা চুল,ঘর্মাক্ত মুখ,খোঁচা খোঁচা দাড়ি….সবকিছু মিলিয়ে মি.তানভীরকে মারাত্মক লাগছে!পুরো আড়াই মাস পর দেখলো মানুষটাকে!বুকের ভিতর অজান্তেই ধক করে উঠলো!কারণ কি কে জানে?
দেখে তো মনে হচ্ছে খুব ভালোই ছিলো।হুহ!যা খুশি থাকুক গে……..পুনম চোখ ফিরিয়ে নেয়।ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে দেখার মত কিছুই নেই!
তানভীর রুমে প্রবেশ করতেই মিতু ঝাপিয়ে মামার কোলে উঠলো। তানভীর অসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে ভাগ্নিকে।গালে ভাঁজ পড়া হাসি নিয়ে কথা বলছে মামা ভাগ্নি।পুনমকে দেখে তানভীরের চোখে প্রথমে মুগ্ধতা পরে ক্রোধ দেখা দেয়!নিজেকে সামলে বলে,
“” বুবু কেক ফেক যা কাঁটার তাড়াতাড়ি কাটো।আমার খুদা পেয়েছে ভীষণ!”
সাথে সাথেই তারিন চঞ্চল ফরিংয়ের মত উড়ে উড়ে সবকিছুর ব্যবস্থা করছে।ঝটপটের সহিত কেক কাঁটা হয়ে গেলো।পুনম খেয়াল করে দেখলো মি.তানভীর একবারো তার দিকে তাকাচ্ছে না।উল্টো আরো চোখে চোখ পড়লে কটমটিয়ে তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিচ্ছে !আশ্চর্য!
পুনম বিদায় নিয়ে চলে আসতে চাইলো, পারলো না।মিতু মেয়েটা “মামি এখন যাবে না।মামি এটা,মামি ওটা… করে কান ঝালাপালা করে দিয়েছে পুনমের।পুনম শুধু আল্লাহ আল্লাহ করছে….এখান থেকে রেহাই পাওয়ার!
পুরোটা অনুষ্ঠানে তানভীর এমন ভাব করলো যেন পুনমকে সে চিনেই না।পুনমও আর মাথা ঘামালো না। মি.তানভীরের মোহ কেটে গেলেই বরং ভালো! ” যা না পাওয়ার তা চাওয়ার সাধ করা মস্ত বড় বোকামী ” আর পুনম বোকা কোন কালেই ছিল না!
তারিন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে তার ভাইটা গাপুসগুপুস করে বিরিয়ানি খেয়ে যাচ্ছে। তার কোনদিকেই নজর নেই,যেন কতদিনের অনাহারি! আর পুনমও কেমন সরে সরে থাকছে।ব্যপারটা কি? রাজু খাওয়া শেষ করে সবে কোকের বোতলে মুখ লাগিয়েছে তখনই তারিন কনুই দিয়ে রাজুর পেটে গুতো দিয়ে বলে, “” ব্যপার কি রাজু?এদের মধ্যে কি হয়েছে?”
ভরা পেটে গুতো খেয়ে রাজু মুখ বিকৃত করে বলে,”বুবু এরা দুজনেই আহাম্মক…. এদের কথা আমার কাছে বইলেন না….এরকম পানসে প্রেম আমার লাইফে আমি দেখিনি।”
তারিনের মেজাজ খিঁচড়ে যায়, কপাল কুঁচকে বলে,
“মানে কি?”
রাজু বিরক্তির সাথে বলে,
“বুবু এদের মধ্যে শাস্তি পর্ব চলছে…যাকে বলে ইউনিক প্রেম।এসব আপনি বুঝবেনা….বরং যা হয় তা শুধু দেখতে থাকেন!”
********
পুনমের মেজাজটা অসম্ভব খারাপ।একেতো মি.তানভীরের ঐ হামবড়া আচরণ একদম সহ্য হয়নি।নিজেকে কি মনে নবাবপুত্র? পুরোটা অনুষ্ঠানে পুনমকে ইগনোর করেছে। ইগনোর করেছে ভালো কথা কিন্তু একটু একটু পর চোখ গরম করে কেন দেখছিল?নবাবপুত্র কি ভেবেছে?যে সে ইগনোর করলেই এই পুনম তার পিছু পিছু ঘুরবে আর বলবে, “ওহে প্রনয়েশ্বর!আমাকে আপনি গ্রহণ করুন!” কখনো না! নেভার এভার!যে যেরকম থাকুক! হু কেয়ার?
আর মেজাজ খারাপের দ্বিতীয় কারণ হলো, লাবণ্য একটু আগে কল করে কান্নাকাটি করে যা বলেছে।তার সারমর্ম হলো….আজ শেষ বিকেলের দিকে সেজ আপাকে আবার যেন কারা দেখতে এসেছে।তাও বিনা নোটিশে! একেতো সেজ আপা অসুস্থ। তার উপর যখন তাদের সামনে গেছে তারা আপাকে রেখে লাবণ্যকে পছন্দ করেছে।আর মাও তাতে সায় দিয়েছে।কতবড় জঘন্য মানুষ….একজন দেখতে এসে আর একজনকে পছন্দ করে।যেন পন্য বাছাই!
আর লাবণ্য তাতে তেতে উঠতেই মা নাকি যা তা বলেছে সেজ আপাকে আর লাবণ্য কে।
পুনমের গলার কাছে এসে কষ্টরা দলা পাকায়…কিন্তু কান্না আসে না।তার চুপচাপ সেজ আপাকে কেউ কিছু বললে পুনমেন ভীষণ কষ্ট হয়!
রাতের বেলা বাজারের সকল কিছুরই দাম কম থাকে তাই পুনম কিছু তরকারি কিনেছিলো।তার মধ্যে লাবুর কলে পুনমের শান্ত মাথা বিগড়ে গেছে।বাজারের ব্যাগটা নিয়েই বাসায় ঢুকেই বসার রুমে সবাইকে বসা দেখতে পায়।অসুস্থতা কাটিয়ে উঠলেও সেজ আপা ভীষণ দূর্বল।সেই দূর্বল চোখে মুখে আজ ভীষণ হতাশা দেখতে পেলো পুনম! লাবু কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়েছে। পুনম বাজারের ব্যাগটা প্রচন্ড রাগে ফ্লোরে আঁছাড় মারে।
“সমস্যা কি মা?এসব কি শুরু করেছো?অসুস্থ সেজ আপাকে সাজিয়ে ঘুছিয়ে পুতুল বানিয়ে তাদের সামনে নিলে, তাদের পছন্দ হলো না তো পরের টাকে পুতুল বানালে।কেন? যে আমার এক বোনকে রিজেক্ট করে তার সাথে অন্য বোনের কথা ভাবো কি করে?”
মা এতক্ষণ থমথমে মুখে বসে থাকলেও এবার তেতে উঠেই জবাব দিলো,
” তো কি করবো?বল…পাঁচ পাঁচটা মেয়ের জ্বালা আর নিতে পারছি না।বড়টার সংসারে অশান্তি….. ঝুমা অসুস্থ… পাবনী এত বড় দামড়ি মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না….আর তুই…. তুইতো কারো কথাই কানে নিস না….এত বড় বেয়াদব।আর ছোটটা…. পড়াশোনায় তো শূন্য তাই ঘরে বসিয়ে অন্ন ধ্বংস না করে পরের বাড়ি যেয়ে ঘর করুক।
বলতে বলতে মা কেঁদে দেয়।পরক্ষনেই আবার বলে,
“তোর বাপের বয়স হইছে।আমি অসুস্থতায় ভুগি।তোদের কোন হিল্লে করে না গেলে কি করে শান্তি পাবো? ঘরে তিনটা মেয়ে অবিবাহিত এর যন্ত্রণা তুই কি বুঝবি?আমার ছেলেটা বেঁচে থাকলে এ দিন আমার দেখতে হতো না।”
পুনম সমান তেজের সাথে বলে,
“বিয়ে হলেই যদি গতি হয় তবে তোমার আর দুই মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করছো কেন? খবরদার বলে দিচ্ছি মা…আর কোন দিন তুমি আমার বোনদের খাবার খোঁটা দিবে না। আমি সারাদিন কাদের জন্য খাটি? ”
মা কাঁদোত স্বরেই বলে, ” এর থেকে দোয়া কর তোর মা যেন মরে যায়।এত চিন্তা আর নিতে পারি না। আমার ছেলেটা বেঁচে থাকলে এত চিন্তা আমার করা লাগতো না।”
বাবা পাশ থেকে বলে,”আহা সালেহা চুপ করো,মেয়েটা বাইরে থেকে আসছে!” নিয়াজ উদ্দিনকে আজ সত্যিই বিপন্ন দেখাচ্ছে। মেয়েদের চিন্তায় সেও কাহিল।
পুনম এবার একটু নরম হলো।মায়ের পায়ের কাছে বসে পুনম মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,
“মা তোমার ছেলে বেঁচে নেই তো কি হয়েছে? আমি আছি না।কোন চিন্তা করো না।এই দেখো টিকিট কেটে নিয়ে এসেছি।বাবাকে কাল কুমিল্লা পাঠাবো বড় দুলাভাই আসলে কি চায় তা জানার জন্য? আর তোমার মেজ মেয়ের কোলে দুদিন পর নাতি নাতনি আসবে।চিন্তা কিসের? আর সেজ আপাকে নিয়ে চিন্তা করছো? আর চিন্তা করো না।তার জন্য সুপাত্রের ব্যবস্থা হয়েছে। শুধু কটাদিন সময় দেও।
বাসার সবাই অবাক চোখে তাকায় এ কথা শুনে।আর মা অবিশ্বাসের স্বরে বলে,” পুনু তুই সত্যি বলছিস?কে সে?
পুনম হেসে বলে,”হুম মা।সে পুরাই রাজপুত্র। রাজ্য গুছিয়ে তারপর তোমার মেয়েকে নিতে আসবে।এতটুকু সময় সে চেয়েছে আমি না করি কি করে?আর সে কে? তা তখনই দেখো।কিন্তু এতটুকু জানি তোমার সেজ মেয়ের স্বামীভাগ্য ভীষণ ভালো!
আর আমায় নিয়ে চিন্তা করো না মা। ক্যারিয়ার না গুছিয়ে আমি বিয়ে করবো না।আর আমাদের লাবু তো এখনো ছোট।আর একটু বড় হোক তখন না হয় ওকেও বিদায় করবো।ঠিকাছে? এত টেনশন আর কখনো করো না মা।তোমাদের কিছু হলে আমি হেরে যাবো মা।”
হটাৎই সালেহা পুনমকে জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। এ কান্না কিসের? তা শুধু মা নামক মানুষগুলোই ভালো বুঝে!
চলবে,
#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩৩
ঝুমা এক হাতে পেট ধরে আর এক হাত কোমরে রেখে হাঁটছে।ডেলিভারির বেশিদিন বাকি নেই।হাতে গোনা বিশ পঁচিশ দিন।জামাল খাচ্ছে আর গোল গোল চোখে তাকিয়ে বউ কে দেখছে।বড় সর সাইজের লাড্ডু মনে হচ্ছে তার বউকে!গাল দুটো ফুলে টমেটো হয়েছে।পেটটা এতটা ফুলেছে যে জামালের সন্দেহ হচ্ছে পেটের ভিতরে দুইটা বাচ্চা আছে!ঝুমা বার বার ঘেমে যাচ্ছে। সকাল থেকে তিনটা মেকসি অলরেডি চেইঞ্জ করছে।এখন আবার ঘামছে! জামাল পানির গ্লাস ঝুমার মুখের সামনে ধরলো,যে হারে বউ ঘামছে আবার না পানি শূন্যতা দেখা দেয়।ঝুমা বিরক্ত নিয়া বলে, “বাবুর আব্বু সরো তো।আমি পানি খাবো না।এমনিতেই সারাদিনে পঞ্চাশ বার ওয়াশ রুমে যাওয়া লাগে।”
জামাল তারপরও জোর করে পানি ধরে রাখে ঝুমার মুখের সামনে।সেইসময় মরিচা হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করে বলে, ” নিন মাইজা আফা ধরেন আফনার নেপতানি।হাছা কইরা কনতো আফা নেপতানির মধ্যে আমনে কি পাইছেন?”
ঝুমার মরিচার কথার দিকে মন নেই।সে ঝটপট নেফতানির প্যাকেট খুলে ঘ্রাণ শুঁকে। জামাল অসহায় চোখে কতক্ষণ বউর দিকে তাকিয়ে থেকে কারখানার উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়!ঝুমার ইদানীং দুটো সমস্যা দেখা দিছে সারাদিন হাতের মুঠোয় নেফতানির দানা রাখবে।আর একটু পর পর ঘ্রাণ শুঁকবে। আর একটু পর পর সরিষার তৈল খাবে।কারো বারণই শোনেনা।জামালের চিন্তা হয় তার বাচ্চাটা না আবার নেফতানি গন্ধ নিয়া পৃথিবীতে আসে!
**********
পাবনী কাঁদছে।ফিঁচফিচ করে কাঁদছে।ওড়না দিয়ে একটু একটু পর পর চোখের জল মুছতেছে।নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে,চোখদুটোয় বর্ষার অশ্রুনীর।পাবনী আধা ঘন্টা ধরে কেঁদে চলছে….থামার কোন লক্ষন নেই।সুমন মুগ্ধ হয়ে দেখছে।এই গত আধা ঘন্টা সুমন পাবনীর কান্না নির্বাক হয়ে দেখেছে।তার ভালো লাগতাছে। তার জন্য কেউ কাঁদছে।এই বিষয়টা সুমনের কাছে আনন্দের, সুখের!পাবনী সুমনের জন্য কাঁদছে মানে সুমনের জন্য পাবনীর মায়া বা টান আছে। মেয়েরা হলো মায়াবতী! আর মায়াবতীরা তাদের মায়া কখনো লুকাতে পারেনা!
সুমন ঠিক করেছে আরো দশমিনিট পাবনীর কান্না দেখবে তারপর থামতে বলবে।প্রিয়মানুষের কান্নার মধ্যেও যে আলাদা প্রশান্তি আছে তা সুমন জানতো না।
ঠিক দশমিনিট পর সুমন বলে,
” পাবনী তুমি কাঁদছো কেন?”
এই কথা শুনে পাবনী আবার কেঁদে দেয়। পাবনীর নিজের কাছেও অবাক লাগছে।সে এতটা ইমোশনাল না।কিন্তু কেন জানি সুমন ভাইকে এভাবে অসুস্থ দেখে ভালো লাগছে না।মানুষটা এমনিতেই হ্যাংলা পাতলা তারউপর কারা যেনো মেরে হাতে পায়ে, মুখে চোখের কাছে জখম করেছে।যেখানে সেখানে ব্যান্ডেজ!এই মানুষটাকে এভাবে দেখে বুকের ভিতর কেমন সুক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে।
” বললে না কাঁদছো কেন?”
” এমনিতেই!”…নাকটেনে বললো পাবনী।
” শুধু শুধু কাঁদে বোকারা। তুমি কি বোকা?”
” হুম।আপনার জন্য খাবার এনেছি।সকালে কি খেয়েছেন?”…..চোখের জল মুছে বলে পাবনী।
” কলা খেয়েছি শুধু।এসব কেন করতে গেলে?”
পাবনী টিফিন কেরিয়ার খুলে খাবার সাজাতে সাজাতে বলে, ” আপনি কি উঠতে পারবেন সুমন ভাই? হাত ধোয়ার পানি দিচ্ছি। খেয়ে নিন।”
” আমার হাতে ব্যথা পাবনী!”….চোখ মুখ কুঁচকে বলে সুমন।
“আপনার তো বাম হাতে জখম।”
সুমন কিছু না বলে চুপ হয়ে পাবনীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।পাবনী খুব সন্তপর্ণে নিঃশ্বাস ফেলে।হাত ধুয়ে ভাত মেখে খাওয়াতে শুরু করে। ছোট ছোট লহমা তুলে খাবার তুলে দিচ্ছে পাবনী সুমনের মুখে।সুমনের আনন্দে চোখে জল এসে যায়।এই পৃথিবীতে এই মেয়েটিই ওর আপন!সুমন তা জেনে গেছে।সুমনের চোখে জল দেখে পাবনী আশ্চর্য হয়ে বলে,
” একি সুমন ভাই আপনি কাঁদছেন কেন? কোথাও ব্যথা করছে?ডাক্তার ডাকি?
চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে বলে সুমন,
” ডাক্তাররা কিসব দুই নম্বরি ঔষধ দেয় পাবনী।খালি চোখে জল এসে যায়!”
” পুনম ঠিকই বলে সুমন ভাই,আপনি মিথ্যে বলতে জানেন না।”…..বলে পাবনী নিজের ওড়না দিয়ে সুমনের চোখের জল আলতো হাতে মুছিয়ে দেয়।কিন্তু আবারো সুমনের চোখে জলে ভরে ওঠে। ছেলেদের কাঁদতে নেই,এ কথা ভুল!চরম ভুল!ছেলেরাও কাঁদে তা হোক গোচরে বা অগোচরে!
***********
নিয়াজ উদ্দিন বসে আছে তার বড় মেয়ের ঘরে।নিয়াজ উদ্দিন নিজের ভুল সংশোধন করে। না এটা তার বড় মেয়ের ঘর নয়।এই ঘর তার বড় মেয়ের স্বামীর ঘর।তার বড় মেয়ের ঘর হলে মেয়েটা আজ অনিশ্চয়তা ভুগতো না।আর না তাকে এতো অপমানিত হতে হতো। নিয়াজ উদ্দিনের বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়,মেয়ের বাবা মা হওয়া অন্যায়।এই অন্যায়ের শাস্তি প্রতিটা কন্যা সন্তানের পিতা মাতা জীবদ্দশায় পেয়ে থাকেন!
কিছুক্ষণ আগে তিনি বড় জামাইয়ের পা ধরা খালি বাকি রাখেন নি।এতটা অনুরোধ করেছেন।নাতনি দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে বলেছিলেন। কিন্তু হারুন তাকে চরম অপমানিত করে বলেছে, ” আপনার বড় মেয়ে হচ্ছে চরম লোভী। আপনার মেয়ের কথা বলছি কেন?আপনার পুরো পরিবারই তো লোভী। না হলে আমার ভাইয়ের পিছনে আপনার খোঁড়া মেয়েকে লেলিয়ে দেন? শুনুন বাবা, ঠান্ডা মাথায় বলছি।রুমাকে নিয়ে আমার সংসার করা সম্ভব না।তার উপর থেকে আমার রুচি চলে গেছে।তাই অযথা এসব বলে আমার সময় নষ্ট করবেন না।আসছেন থাকুন।কাজের লোকদের বলি ভালো মন্দ রান্না করতে খেয়ে বিদায় হোন। আর রুমা যদি যেতে চায় তবে তাকে নিয়ে যান।”
নিয়াজ উদ্দিন উঠে পড়েন। রুমা এসে সামনে দাঁড়ায়। মেয়েটাকে দেখে নিয়াজ চমকে যান।যে মেয়েটা সবসময় ভালো পোশাক গয়না পড়ে মাথা উচু করে কথা বলতো।আজ সে মেয়েটা এরকম জীর্ণ শীর্ণ হয়ে মাথা নুইয়ে রেখেছে।তার রুমা ছোট বেলা থেকে অহংকারী, স্বার্থপর।সবসময় নিজের ভালো আগে দেখেছে।এর জন্য তিনি সবসময় বকা ঝকা করতেন তাই বলে মেয়েটার সংসার ভেঙে যাক তা তো তিনি চাননি।
রুমা ছলছল চোখে বলে, ” বাবা আমি যাবো না।এই সংসারটা তো আমার।তবে তোমার জামাই এমন কেন করছে?বল না বাবা?”
নিয়াজ কি বলবেন ভেবে পেলো না।তার বুকে ব্যথা করছে।কপাল ঘামছে।তবুও নিজেকে স্থীর রেখে বলেন,
” মা এই সিদ্ধান্ত তোমার।এই ছেলে এই সংসার তুমি বেছে নিয়েছিলে তখনও আমি বাঁধা দেয়নি।আজ যদি ছেড়ে দাও তবু বাঁধা দিব না।আমি তোমাদের সবসময় সমার্থন করেছি।তাই বলবো যাই করো আমি তোমার পাশে আছি!”
রুমা বাবার কথায় হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। কি করবে রুমা? তিলে তিলে গড়া সাজানো সংসার তার!আজ অনাহুত কারো আগমণে তা ভেঙে যাবে? নিয়াজ উদ্দিন ব্যর্থ পায়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে আসেন।তার মনে হচ্ছে,এই সমাজে মেয়ে হয়ে জন্মানো পাপ,আর সবচেয়ে বড় পাপ হচ্ছে মেয়ের বাবা মা হওয়া!
*********
তারুণ কপাল কুঁচকে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। মোবাইলে একটা ভিডিও চলতাছে।একটা মেয়ে পাহাড়ি সাজে শাড়ি পড়ে, খোঁপায় একগাদা ফুল,চোখে মোটা করে কাজল,ঠোঁটে গাড়ো লাল রঙ, হাতে রেশমি চুড়ি দিয়ে পাহাড়ি গানে নৃত্য করতাছে।মেয়েটাকে অনিন্দ্য সুন্দর লাগছে।চোখে মুখে চঞ্চলতা, ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি নিয়ে নৃত্য করছে।
বিহুরে লগন মধুরে লগন
আকাশে বাতাসে লাগিল রে…..
তারুণের এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো, সে কোন শ্যামবতী নয় মায়াবতীকে দেখছে।মেয়েটির ভিডিওতে হাজার হাজার লাইক কমেন্ট পড়েছে একদিনের মধ্যে ।সবার এক মন্তব্য, এত স্নিগ্ধ একটা মেয়ের নৃত্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো।
কিন্তু তারুণের চোখ জুড়ালো না বরং ক্রোধ লাগলো।বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, “লাবণ্য তোকে জঘন্য লাগছে,পাহাড়ি ভুতের মত জঘন্য! ”
***********
রাজুর বরফ ব্যাগ ধরে রেখেছে তানভীররে মাথায়।তানভীর নাক মুখ রাগে লাল হয়ে আছে।রাজুর হতাশ অবস্থা! তার স্যার সকালে গেলো শাহবাগ কি একটা কাজে আর আসলো রাগে জর্জড়িত হয়ে। কি কারণ জিজ্ঞেস করতেও ভয় লাগছে রাজুর।
তানভীর সোফায় শরীর এলিয়ে বসেছে।চোখে ভাসছে একটা দৃশ্য। পুনম সাকিবের কাঁধে হাত রেখে তার বাইকে বসে কোথাও যাওয়ার দৃশ্য। শরীর মন দুটোই পুড়ছে তানভীরের!পুনম নামের মেয়েটিকে অসহ্য লাগছে। তানভীর চোখ বন্ধ করে।হাতের মুঠ শক্ত করে চেপে ধরে কুশন!বিড়বিড় করে বলে, “আই উইল কিল ইউ পুনমি!আই উইল কিল ইউ! ”
**********
কিছুদিন পর,
সময় চলে সময়ের গতিতে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষ চলতে পারে না। সময়কে টেক্কা দিবার কি কোন যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে?
পুনম ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে।তার টিউশনীতে যেতে হবে। অথচ মুষল ধারে বৃষ্টি নামছে।এই বৃষ্টি শীতের আগমনী বার্তা হয়ে এসেছে!ঢাকা শহরে একটু বৃষ্টি মানে হাটু সমান পানি। বৈশাখী ঝড়ের মত বাতাস হচ্ছে একটু পরপর!পুনম একবার ভাবলো টিউশনিতে যাবে না।তারপর আবার মন পাল্টে ফেলেছে।মানুষের মন আকাশের মতন!ক্ষণে ক্ষণে বদলায়! মাথার উপরে ছাতা থাকা সত্বেও বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শাড়ি ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। প্রকৃতির এই বৈরীতা মন্দ লাগছে না পুনমের!
একটু পরই একটা সিএনজি এসে থামে পুনমের সামনে।সিএনজি থেকে মি.তানভীরকে বের হতে দেখে পুনম অবাক হয়।মি.তানভীরকে অন্যরকম লাগছে।সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে সাথে কালো একটা চাদর গলায় ঝুলানো। বৃষ্টির পানি মি.তানভীরকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। আশ্চর্য! এই বর্ষায় কেউ ছাতা ছাড়া বের হয়? এ লোক তো জ্বর বাঁধাবে।
তানভীর দ্রুত পায়ে পুনমের দিকে হেঁটে আসছে।বৃষ্টি তানভীরের সুঠাম দেহ ভিজিয়ে দিচ্ছে। মাথার চুল বেয়ে বৃষ্টির পানি এসো তানভীরের পুরষ্ট ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছে! পুনম অজান্তেই কয়েকবার ঢোঁক খায়!এই প্রথম পুনমের মনে হচ্ছে, “মি.তানভীর একজন আকর্ষনীয় পুরুষ! ” নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জিত হয় পুনম।ছি! কি নোংরা চিন্তা!
তানভীর এসে পুনমের ছাতার ভিতর দাঁড়িয়ে পড়ে সামনাসামনি ভাবে।এতটুকু ছাতা আবার মানুষ দুজন!দুজনেই ভিজে যাচ্ছে। পুনম যে হাতে ছাতা ধরে আছে সে হাতের উপর হাত রাখে তানভীর। বৃষ্টিতে ভিজা শীতল হাত।পুনমের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাঁপন ধরিয়ে দেয়।পুনম কয়েকবার চোখের পলক ফেলে।স্বপ্ন নয়তো?পুনমের চাহনি দেখে বুঝতে পারে তানভীর, পুনম পুরো শকে আছে।তাই তানভীর হেসে দেয়। গালো ভাজ পড়া রমনীমোহন হাসি!পুনম মনে মনে দোয়ায় ইউনূস পড়ে।এই মানুষটা হুটহাট এসে পুনমকে এলোমেলো করে দেয়।সেদিন অনুষ্ঠানে অচেনার ভান ধরে আজ আবার এতটা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কেন? কি মতলব আল্লাহ জানে?
তানভীর পুনমের পুরো শরীরে চোখ বুলায়।তানভীরের দৃষ্টিতে আজ শান্ত ক্ষীপ্রতা!পুনমের লতানো দেহে সবুজ শাড়ি যেন বৃষ্টিতে ভেজা নির্মল প্রকৃতি! কপালের সামনে ছড়িয়ে পড়া চুল গুলো বাতাসে উড়ছে।দুই ভ্রুর মধ্যখানের কালো তিলটার উপর বৃষ্টির ফোঁটা!উফফ! কি অসহ্য সুন্দর! ঠোঁট গুলো তিরতির করে কাঁপছে পুনমের! তানভীর মুগ্ধ চোখে সেই কাঁপন দেখছে।পুনমকে দেখে তানভীরের হৃদয়টা ভাঙছে।এই নিষ্ঠুর মেয়েটিকেই কেন ও ভালোবাসতে গেলো?
তানভীরের এলোমেলো দৃষ্টি পুনমকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। তাই কাপাকাপা স্বরে বলে,” মি.তানভীর আপনার আবার জ্বর হয়নি তো?”
তানভীর ভারী স্বরে বলে, ” ছুঁয়ে দেখো! ”
পুনম মনে মনে অসংখ্য বার আল্লাহকে ডেকে ফেলেছে।এই ছেলে পাগল।আর আজ কেন যেন পুনমের নিজেকেও অচেনা লাগছে।কড়া করে কথা বলতে চাইছে কিন্তু কন্ঠনালীতে এসে আটকে যাচ্ছে!
তানভীর ছাতাটা নিজের হাতে নিয়ে আর এক হাতে পুনমের হাত ধরে।পাঁচ আঙুলের ভিতর লক করে নিজের আঙুল।তানভীরের স্পর্শে পুনম আবার কেঁপে ওঠে।
পুনম হাত ছাড়াতে নিলে আরো শক্ত করে চেপে ধরে তানভীর! পুনম রাগে কিড়মিড়িয়ে বলে, “হচ্ছে কি এসব? হাত ছাড়ুন বলছি।”
তানভীর পুনমের চোখের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
” পুনমি তুমি ভয় পাচ্ছো?
” কখনো না।”…দাঁতে দাঁত চেপে বলে পুনম।
” রাগের অভিনয় হচ্ছে না ঠিক মত পুনমি।”…. বলে আবার সেই ভাঁজ পড়া হাসি দেয় তানভীর।
পুনম নিজেকে শান্ত করে।আসলেই পুনম কেন যেন চেয়েও রাগতে পারছে না।অথচ ওর এখন ভয়ংকর রাগার কথা।রাস্তায় বসে তানভীরের এসব কর্মকান্ডের জন্য দু একটা কঠিন কথা বলা উচিত কচ্ছপটাকে।কিন্তু পারছে না।পুনমের নিজের স্বত্বা নিজের সাথে বেইমানি করছে!
তানভীরের গমগমে স্বরে পুনমের ধ্যান ভাঙে।তানভীর বলেছে, ” চলো!”
পুনম তানভীরের হাতের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
” আমি কোথাও যাবো না মি.তানভীর। কোথাও না!”
” তুমি যাবে পুনমি।তুমি যাবে। আমি কথা দিচ্ছি আজকের পর আর তোমায় বিরক্ত করবো না কিন্তু আজকে তুমি যাবে।”
” আমি বাধ্য নই।আর কিসের এত দাবী আপনার আমার উপর? যখন যা মন চাইবেন তাই করতে আমি বাধ্য নই।”
“তুমি বাধ্য পুনম। তুমি বাধ্য! তোমার ভিতর যে পুনমি বাস করে সে বাধ্য আমার কথা শুনতে।আর সেখানে তোমার জোর চলে না।কেবল আমিই তার অধিকারী!”
” আর দাবীর কথা বলছো?…….বলে তানভীর ছাতাটা কাঁধের উপর রেখে দুহাতে পুনমের মুখটি তালুবন্দি করে।দুজেনর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে যায়।তানভীরের ভেজা নিঃশ্বাস আঁচড়ে পড়ে পুনমের সারা মুখে।বৃষ্টির ধ্বনি আর তানভীরের কন্ঠ মিলেমিশে একাকার হয়!তানভীর ঘোরলাগা কন্ঠে বলতে শুরু করে, ” আমি তোমাকে ভালোবাসি পুনমি!হ্যা আমি তোমাকে ভালোবাসি! আজ এই বৃষ্টি সন্ধ্যাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি তোমাকেই ভালোবাসি!
আমার ভালোবাসার দাবী তোমার উপর!তাই এত জোর!সব উপেক্ষা করা যায় কিন্তু ভালোবাসার দাবী উপেক্ষা করা যায় না, পুনমি! ”
পুনমের মনে হলো কাছেপিঠে কোথাও বজ্রপাত হয়েছে।এমন ভাবে চমকেছে।এতদিন আড়েঠাড়ে বললেও আজ তো নবাবপুত্র সরাসরি তার ভালোবাসার কথা বলছে।কি করবে পুনম?এই পাগল প্রেমিককে কি করে পত্যাখ্যান করবে? এত করুণ করে কেন ভালোবাসি বলছে? মায়া হচ্ছে তো পুনমের!
পুনমের এসব ভাবনার ভিতরেই তানভীর পুনমকে নিয়ে সিএনজিতে ওঠে।তানভীর দৃষ্টি রাস্তার দিকে রেখে পুনমের হাত ধরে বসে আছে।আর পুনম সেই তখন থেকে তানভীরকেই দেখছে।কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কি হচ্ছে? কিছুই ভাবতে পারছে না পুনম।বাহিরে বৃষ্টির তান্ডব বাড়ছে আর সাথে বাড়ছে পুনমের ভিতর অস্থিরতা! এত বৃষ্টিতো আগে কখনো হয়নি?তবে আজ কেন? বৃষ্টির জোরে সব কিছু অস্পষ্ট! পুনম চোখ বন্ধ করে।যা হবার হোক।
একঘন্টা চলার পর গাড়িটা থামে।তানভীরের হাত ধরা অবস্থাতেই পুনম নামে।যে ভাবে এই ছেলে হাত ধরেছে তাতে মনে হচ্ছে পুনম কোথাও পালিয়ে যাবে।
পুনম পুরোপুরি ভিজে গেছে।ভেজা শাড়িতে শরীরের সকল ভাঁজ স্পষ্ট! তানভীর নিজের চাদরটা খুলে পুনমের শরীরে পেচিয়ে দেয়।
দু পা চলতেই পুনম কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।এ কোথায় নিয়ে এসেছে তাকে তানভীর? পুনম প্রশ্নচোখে তাকালেও তানভীর তার গুরুত্ব দেয় না। পুনমের সামনের সবকিছু ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে ।মাথা ঘুরাচ্ছে! এই ছেলে পাগল! নতুবা কি এখানে নিয়ে আসে?পুনমের পালাতে হবে।কিন্তু তানভীর কি তাকে পালাতে দিবে?আশেপাশে কেউ নেই!কেন আসলো? সেই প্রশ্ন পুনমকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। তানভীর হাস্যজ্জোল মুখে বলে, “চলো পুনমি।”
পুনম স্বপ্ন দেখছে না তো?কোন ভয়ংকর স্বপ্ন!
পুনম বড় বড় চোখে সামনের সাইনবোর্ড পড়ে।সেখানে স্পষ্ট লেখা….”কাজী অফিস”।
চলবে,